নাস্তিকতার অভিশাপ
নাস্তিক্যবাদকে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Atheos বা ‘ঈশ্বরহীন’ বলা হত। এটা অধার্মিক ও অপরাধী হিসাবেও প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকেই এর দ্বারা বুঝানো হয় যে, ঈশ্বরকে অস্বীকার করা, ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। দেব-দেবীকে যারা অসম্মান করত মূলত তাদের উদ্দেশ্যেই এটা প্রয়োগ করা হত। ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে নাস্তিকতাবাদ (Atheism) প্রচলিত হয়েছে ১৫৬৬ সালে। এখন এটি একটি দর্শনে রূপ নিয়েছে। অষ্টাদশ শতকে এসে কিছু মানুষ সরাসরি নিজেদেরকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। বর্তমানে এদের হার ২.৩%। এদের মূল উদ্দেশ্য হল, ধর্ম, স্রষ্টা ও পরকালকে অবিশ্বাস করা, ব্যঙ্গ করা, কটুক্তি করা, অসম্মান করা। সাধারণ মানুষ ও সমাজ জীবনে এর কুপ্রভাব ফেলতে তারা সর্বাগ্রে মনস্তাত্তিক বিষক্রিয়া প্রয়োগ করে। তারা বিভিন্ন কুযুক্তি, অজুহাত ও তথ্য দিয়ে ঈমানদার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। আগে এই কুচিন্তা ও কুধারণাকে অপরাধ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু ১৯৯১ সালে আমেরিকায় যখন ‘এথিয়েস্ট অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল’ (Atheist Alliance International) অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক নাস্তিক জোট’ গঠিত হয়, তখন থেকে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা বলে দেখা হয়। আন্তর্জাতিক মহল এখন আর এটাকে অপরাধ হিসাবে দেখছে না। এই সুযোগে অল্প সংখ্যক মানুষ পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে ধোঁকা দিচ্ছে। আধুনিক নাস্তিকদের মূল সমস্যা হল, ইসলাম। অন্য হাজার হাজার ধর্ম ও দেব-দেবী নিয়ে কুধারণা থাকলেও সেগুলো নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই, কোন সমস্যাও নেই। সমস্যা শুধু ইসলাম, মাদরাসা, মসজিদ আর ধর্মীয় ব্যক্তিকে নিয়ে।
তাদের মুক্ত চিন্তা, বাকস্বাধীনতা হল, আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে কটুক্তি করা, ইসলাম সম্পর্কে উলঙ্গ মন্তব্য করা এবং কুরআন-হাদীছের মর্যাদা নষ্ট করা। তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ধ্বংস করেছে যে, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতির লেশমাত্র রাখেনি। তারা যৌন অপসংস্কৃতির প্রলেপ দিয়ে দ্বীনি সংস্কৃতিকে বিনাস করে দিয়েছে। সেজন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গন নাস্তিকতার অভিশাপে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়েছে। নাস্তিকরা ভদ্র সেজে সব জায়গা থেকে ইসলামের চিহ্নগুলো মুছে ফেলছে। শিক্ষা কারিকুলামে উদ্ভট ধর্ম ও বিজাতীয় মতবাদের ঠাঁই হলেও সেখানে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের ঠাঁই হয়নি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে নাস্তিক্যবাদ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ফলে বাপের ঘাম ঝরানো অর্থে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যরিস্টার, প্রফেসর, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, সচিব, বিচারপতি, প্রশাসনিক ক্যাডার ও কর্মকর্তা হলেও তাদের আসল পরিচয় নেশাখোর, ঘুষখোর, সূদখোর, ধর্ষক, সন্ত্রাসী, খুনী, লম্পট, দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাফি, অর্থ পাচারকারী ইত্যাদি। ডিগ্রীধারী অধিকাংশই এই ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মূল কারণ হল, তারা ইসলামের শিক্ষা পায়নি, ধর্মীয় পরিবেশ তাদেরকে স্পর্শ করেনি। তাই তারা বড় ডিগ্রীধারী হয়েছে, কিন্তু মানুষ হতে পারেনি। যদিও তারা কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ স্যেকুলার, কেউ গণতন্ত্রের পূজারী, কেউ প্রগতির বশংবদ, কেউ ত্বাগূতের সেবক বলে পরিচয় দেয়। আসলে সবাই খাঁটি নাস্তিক। এভাবে নাস্তিক্যবাদের হিংস্র থাবায় রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ক্ষেত্র মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেছে। বস্তুবাদী শিক্ষার অপবিত্র ছোঁয়ায় সর্বোচ্চ জ্ঞানকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের মাঝেও মানুষের গুণাবলী খুঁজে পাওয়া যায় না। আর যারা ক্ষমতার ফেরিওয়ালা এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার তাদের কথা মুখে উচ্চারণ করাই পাপ। পুলিশ জনগণের বন্ধু, সেবাই পুলিশের ধর্ম এমন সুন্দর শ্লোগান সাইন বোর্ডে লেখা থাকলেও প্রশাসনের লোকের মাঝে এর কোন প্রভাব নেই। মূলত তারা দেশ থেকে ইসলামের নাম-নিশানা তুলে দিতে চায়, অশ্লীল নর্দমায় পরিণত করতে চায়। নারী স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের নামে মহিলাদেরকে উলঙ্গ করতে চায়, দেশে পশুত্বের রাজত্ব কায়েম করতে চায়।
নাস্তিকরা চরম স্বার্থপর, ধূর্ত ও কৌশলবাজ। কারণ নাস্তিকতার পিল খাওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতার জন্য, স্বার্থের জন্য শেষ বেলায় ইসলামকেই ব্যবহার করে, ধর্মের মুখোশ পরে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়। অথচ তাদের মূল পূজি হল, মূর্খতা আর কল্পনা। এদের অনেকেই সুশীল সমাজের তকমা ধারণ করে, কেউ ধারণ করে বুদ্ধিজীবীর লকব। শয়তানী চিন্তা আর কুবুদ্ধি বিক্রি করেই তারা জীবিকা উপার্জন করে। এটাই তাদের আসল পেশা। এরা সর্বদা ইসলামের বদনাম করে। এরা অফিস-আদালত, প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান কোথাও নীতিবান মানুষকে ঠাঁই দিতে চায় না। আর আলেম ব্যক্তি এবং দাড়ি-টুপিওয়ালা হলে তো নানাভাবে অপমান-অপদস্ত করে ছাড়ে। শরী‘আতের চোখে এরা কাফের (সূরা আন-নিসা : ৬৫; আত-তওবা : ৬৫-৬৬; মুহাম্মাদ : ৯)। ইসলামে এদের কোন অংশ নেই।
সমস্যা হল, নাস্তিকরা দলীলও মানে না, যুক্তিও মানে না। তারা যদি আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করত, তাহলে এ সমস্ত কুধারণা পোষণ করতে পারত না। আল্লাহ বলেন, ‘তাদেরকে কি কোন কিছু ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, নাকি তারাই স্রষ্টা?’ (সূরা আত-তূর : ৩৫)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন’ (সূরা আয-যুমার: ৬২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যেই রয়েছে নিদর্শন, তোমরা কি তা লক্ষ্য করছ না?’ (সূরা আয-যারিয়াত : ২১)। মানুষ যদি তার নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে অর্থাৎ হাত-পা, চোখ, কান, নাসিকা, মুখ, মস্তিষ্ক, দেহের সুন্দর অবয়ব সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তবে অবশ্যই সে বুঝতে পারবে যে, এমন একজন প্রতিপালক আছেন যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, বিজ্ঞ, সর্বজ্ঞ এবং অমুখাপেক্ষী (তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮০৯)। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে, জাহাজসমূহের চলাচলে- যা মানুষের লাভজনক এবং সম্ভার নিয়ে সমুদ্রে চলাচল করে, আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাতে, প্রত্যেক জীবজন্তুর বিস্তার করেন তাতে, বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় সত্য জ্ঞানবান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৪)। বুঝা যাচ্ছে যে, এ জগতের এমন একজন স্রষ্টা আছেন যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরিচালনা করছেন। এই নিদর্শনগুলো আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির এবং ক্ষমতার উজ্জ্বল প্রমাণ (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৪১৯)।
অতএব প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব হল, নাস্তিকদের ব্যাপারে সতর্কতা থাকা। পরিবার ও সমাজকে এদের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। সেই সাথে পরিবারে যথাযথভাবে ইসলামের চর্চা করা। বিভিন্ন অঙ্গনে যারা তাক্বওয়াশীল প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন, তাদের উচিত সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে এই চক্রের হাত থেকে রক্ষা করুন-আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়