বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ অপরাহ্ন
 اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ

ইসলামের দৃষ্টিতে ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য

পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম হল ছবি, মূর্তি বা ভাস্কর্যপূজা। মূর্তি বা ভাস্কর্যের মূল উৎস হল ছবি। ছবি অঙ্কনের মাধ্যমেই মূর্তি বা ভাস্কর্যপূজার সূচনা হয়েছে। আর তা সংঘটিত হয়েছে সরাসরি অভিশপ্ত ইবলীস শয়তানের পরামর্শে। এ জন্য ছবির বিরুদ্ধে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। ছবি অঙ্কনকারীকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে (ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/২১০৯)। অঙ্কিত ছবির মধ্যে আত্মা দিতে বাধ্য করা হবে, কিন্তু সে আত্মা দিতে পারবে না (ছহীহ বুখারী, হা/২২২৫)। অবশেষে জীবনে যত ছবি তুলেছে সমস্ত ছবির মধ্যে আল্লাহ জীবন দিয়ে দিবেন। তখন সেগুলো একই সঙ্গে মেশিনের মত অনন্তকাল তাকে জাহান্নামে শাস্তি দিতে থাকবে (ছহীহ মুসলিম, হা/২১১০)। সেজন্য মানুষসহ যেকোন প্রাণীর ছবি তুলা, তাকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা নিবেদন করা, মহব্বত করা শরী‘আতে হারাম।

মূলত মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপনের গোড়াপত্তন হয় নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে। আদম ও নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর মধ্যবর্তী সময়ে ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়াঊক্ব ও নাসর নামক পাঁচজন ব্যক্তি খুবই নেককার ও সৎকর্মশীল বান্দা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর তাদের ভক্তদেরকে ইবলীস শয়তান কুমন্ত্রণা দেয় যে, এসব নেককার ব্যক্তিদের মূর্তি বা ভাস্কর্য সামনে রাখলে আল্লাহ্র ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তাই তাদের বসার স্থানগুলোতে মূর্তি তৈরি কর এবং তাদের নামে নামকরণ কর। অনুসারীরা তাই করল। কিন্তু তখন সেই মূর্তিগুলোর পূজা-অর্চনা করা হত না। ঐ প্রজন্মের তিরোধানের পর পরবর্তীরা সেই মূর্তি বা ভাস্কর্যের প্রকৃত ইতিহাস ভুলে গেল। আর তখনই শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তারা ঐ মূর্তিগুলোকেই উপাস্য হিসাবে পূজা করা শুরু করল এবং মূর্তি বা ভাস্কর্যপূজার মাধ্যমে শিরকের সূচনা হল (তাফসীরে ইবনু কাছীর, সূরা নূহ : ২৩-২৪; ছহীহ বুখারী, হা/৪৯২০)।

তাছাড়া পৃথিবীতে যেখানে মূর্তি-ভাস্কর্য, দেব-দেবী, কবর-মাযার পূজা হয় সেখানেই নগ্ন নারী জিন শয়তান রয়েছে (সূরা নিসা : ১১৭; আহমাদ, হা/২১২৬৯, সনদ হাসান; আল-আহাদীছুল মুখতারাহ, হা/১১৫৭)। মূলত শয়তানই এই সমস্ত নির্বোধদের পূজা গ্রহণ করে (ছহীহ বুখারী, হা/৩২৭৩)। তাই মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিমা, কবর, মাযার, খানকা, খাম্বা, পীর-ফকীর, ওলী-দরবেশ, ত্বাগূতের পূজা করা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করা শিরকে আকবার বা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত, যার পরিণাম ইসলাম থেকে বহিষ্কার আর তওবা বিহীন মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম (ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২)। কারণ এগুলো আল্লাহ্র তাওহীদ ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। এ জন্য শিরক সবচেয়ে বড় পাপ (সূরা লুক্বমান : ১৩; ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫৪)।  

উক্ত কারণেই ছবি-মূর্তি-ভাস্কর্য ও ত্বাগূতের বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, এগুলো সব শয়তানের কাজ (সূরা মায়েদাহ : ৯০)। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) মূর্তি ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন সেটা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তুলে ধরেছেন (সূরা আম্বিয়া : ৫৭-৫৮)। কা‘বা চত্বরে প্রতিষ্ঠিত ৩৬০টি মূর্তি মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতের লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন (ছহীহ বুখারী, হা/২৪৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৮১)। তিনি বলে দিলেন যে, আমাকে আল্লাহ মূর্তি ভাঙ্গার জন্য এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠিয়েছেন, যেন আল্লাহ্র সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা হয় (ছহীহ মুসলিম, হা/৮৩২)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেছিলেন, ‘হে আলী! কোন ছবি-মূর্তি না ভেঙ্গে রাখবে না এবং কোন উঁচু কবরকে সমান না করে ছাড়বে না’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৯৬৯)। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে খালেদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উযযা নামক নগ্ন নারী জিন শয়তানকে হত্যা করেছিলেন এবং তার আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, যে শয়তান মূর্তিপূজার জন্য কাফের-মুশরিকদেরকে উৎসাহিত করত (নাসাঈ কুবরা, হা/১১৫৪৭; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৯০২, সনদ ছহীহ)। এছাড়া কোন ঘরে ছবি-মূর্তি থাকলে না ভাঙ্গা পর্যন্ত রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে প্রবেশ করতেন না (ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫২)। যুগে যুগে সমস্ত নবী-রাসূল এগুলো পূজা করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন (তিরমিযী, হা/২১৮০)।   

উল্লেখ্য যে, কিছু গণ্ডমূর্খ এবং আলেম নামের কলঙ্ক ভাস্কর্যপূজা বৈধ করার জন্য মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয় বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীছের অপব্যাখ্যা করছে। এমনকি কা‘বা ঘরকে পর্যন্ত মূর্তির সাথে তুলনা করে ভাস্কর্য বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কোন কোন নাস্তিক নির্বোধ কা‘বা ঘরের কালো পাথরকে নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করছে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা‘বা গৃহের দেয়ালে অঙ্কিত ইবরাহীম ও মারইয়াম (আলাইহিমাস সালাম)-এর ছবিটিকে অক্ষত রেখে দিয়েছিলেন, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) পুতুলের মূর্তি নিয়ে খেলতেন ইত্যাদি সব বানোয়াট কথা ও অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে ভাস্কর্যকে বৈধতা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে (মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ শামী, সুবুলুল হুদা, ৫/২৩৮)। অথচ ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্যের ব্যাপারে শরী‘আতের বিধানগত কোনই পার্থক্য নেই। কারণ ছবি হল, কোন প্রাণীর প্রতিমূর্তি, প্রতিকৃতি, চিত্র, আলেখ্য। মূর্তি হল, কোন প্রাণীর দেহ, আকৃতি, প্রতিমা ইত্যাদি; যা মাটি, পাথর, কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি। আর কোনো প্রাণীর ছবি বা মূর্তির আকৃতি প্রস্তরাদিতে খোদাই করে নির্মিত অবয়ব হল ভাস্কর্য। তাই যেকোন প্রাণীর ছবি, মূর্তি, ভাস্কর্য, ম্যুরাল, প্রতিমা, প্রতিকৃতি ইত্যাদি অঙ্কন, সংরক্ষণ, প্রতিস্থাপন, বাঁধাইকরণ, তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন, শিখা অনির্বাণ ও শিখা চিরন্তন, অগ্নিপূজা, বৃক্ষপূজা সবই বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত, যা ভেঙ্গে ফেলা ও প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক (সূরা হজ্জ : ৩০)।

কা‘বা গৃহ কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য নয়। বরং তা মহান আল্লাহ্র ঘর; যা মুসলিম জাতির ইবাদতের জন্য নির্মিত (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১২৭; ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৫) এবং তা সারা পৃথিবীর মানুষদের জন্য হেদায়াত ও বরকতময়’ (আলে ‘ইমরান : ৯৬)। হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথর কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য নয়, বরং এটি জান্নাতী পাথর। বান্দার পাপ মোচনের ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ তাকে জান্নাত থেকে নাযিল করেছেন (তিরমিযী, হা/৮৭৭)। এটার কেউ পূজা করে না, যেমন কা‘বা ঘরের কেউ পূজা করে না। আল্লাহর ইবাদতের জন্য কা‘বাকে ক্বিবলা হিসাবে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়। যেমন মুসলিমরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সিজদা করে মহান আল্লাহকে। তার অর্থ মাটির পূজা করা নয়। কারণ মাটি বা পাথরের কোন ক্ষমতা নেই। যেমন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কালো পাথরকে চুম্বন করার সময় বলতেন (ছহীহ বুখারী, হা/১৫৯৭)। তাই শরী‘আত সম্পর্কে না জেনে এ সমস্ত বিষয়ে মাতলামি করা ঈমান হারানোর নামান্তর।

উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন করা ও তার পূজা করা ইবলীস শয়তানের কুমন্ত্রণার অংশ। মানুষ সঠিক বিষয় না জানার কারণে ব্যক্তি বিশেষের নামে স্থাপন করে থাকে। অথচ এতে কোন কল্যাণ নেই, বরং পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই পরকালীন জীবনকে সুখময় করার জন্য ছাদাক্বাহ হিসাবে মুসলিম ব্যক্তির নামে মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা, দ্বীনি দাওয়াতের মারকায প্রতিষ্ঠা করা, গৃহহীন বাস্তুহারা মানুষের কল্যাণে আবাসস্থল নির্মাণ করা খুবই যরূরী (আবূ দাঊদ, হা/২৮৮৩, সনদ হাসান)। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত বর্জন করার এবং নির্ভেজাল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক্ব দান করুন। সেই সাথে বাংলাদেশকে শিরক-বিদ‘আতমুক্ত তাওহীদ-সুন্নাতের দেশ হিসাবে কবুল করে নিন-আমীন!!

 رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ




সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র: বাস্তবতা ও পরামর্শ - সম্পাদকীয়
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, না-কি পঙ্গুত্ব? - সম্পাদকীয়
প্রচলিত কুসংস্কার : মুসলিমদের জন্য মরণব্যাধি ক্যান্সার - সম্পাদকীয়
ইলিয়াসী তাবলীগ নিষিদ্ধের নেপথ্যে - সম্পাদকীয়
প্রচলিত রাজনীতি ও মানবতার করুণ পরিণতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ত্বাগূতী রাজনীতি অভিশাপ ও করুণ পরিণতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ : অমার্জনীয় ধৃষ্টতার আস্ফালন - সম্পাদকীয়
তাওহীদ সম্পর্কে জানা আবশ্যক কেন? - সম্পাদকীয়
মানহাজের বিরোধিতা ও তার পরিণাম - সম্পাদকীয়
কুরআনে কারীমের মর্যাদা - সম্পাদকীয়
উত্তম চরিত্রের দুর্ভিক্ষ ও পরিত্রাণের উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
অবরুদ্ধ কাশ্মীর : বিশ্ব মোড়লরা নীরব - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ