প্রতারণার পরিণাম
প্রতারণা এখন শিল্পের রূপ ধারণ করেছে। এর মাধ্যমেই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। ঘুষ, ক্রোনিজম, নেপোটিজম, স্লিইজ এবং অন্য যেকোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে এর রূপ দেয়া হচ্ছে। ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বকধার্মিকের আড়ালে এই প্রতারণার প্রতিযোগিতা চলছে। ঘরে-বাইরে, কাছের-দূরের মানুষ দ্বারা সমাজ ও জাতি আজ প্রতারিত হচ্ছে। ফলে সমাজব্যবস্থা ধসে পড়ছে। পুরো দেশ আজ প্রতারক ও ঠকবাজদের দখলে পরিণত হয়েছে। কেউ প্রতারক, কেউ প্রতারকদের সম্রাট। দেশটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতারণায়। ভোটার বিহীন সিলেকশন এবং নৈশ ভোটের নির্বাচন পুরো জাতিকে ঐতিহাসিক প্রতারণা উপহার দিয়েছে। নেতাদের মিথ্যাচারে দেশটা অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে প্রতারক ও দুর্নীতিবাজ বলেই বিশ্বাস করে।
যেহেতু প্রতারণার মাধ্যমেই এর সূত্রপাত, তাই এদের দ্বারা দেশের ক্ষতি ছাড়া উপকার আশা করা যাবে না। কারণ জনসাধারণ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করলে, তাদের পেটে খাবার না থাকলেও নেতাদের সম্পদ বেড়েছে দুই হাজার তিন হাজার গুণ বেশি। রাজনৈতিক এই অভিশাপই জনগণ বহন করতে পারছে না। কেউ ব্যবসায়ী সেজে, কেউ বড় বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে, কেউ স্কুল, মাদরাসা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে দুর্নীতির মডেল তৈরি করেছে। খাদ্যে-পণ্যে ভেজাল, ব্যবসায়ে ফাঁকি, এমএলএম প্রতারণা, বিশ্বাস ঘাতকতা, সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে ড্রাইভার পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে দেশজুড়ে চলছে নিষ্ঠুর প্রতারণা। দুদক সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বত্রই আছে অশুভ শক্তি। অথচ তারা জানে না যে, এই প্রতারণার ফল দুনিয়াতেই ভোগ করতে হবে। আর পরকালে তো অবশিষ্ট আছেই।
মূলত তারা নিজেরাই ভয়াবহ অভিশাপ ও গযব দ্রুত ডেকে আনছে। প্রতারণা ও মিষ্টি ধোঁকা সাময়িক তৃপ্তি দিতে পারলেও তা স্থায়ী হয় না। কারণ যুল্ম, অন্যায়, অপরাধ ও পাপের ধ্বংসাত্মক শাস্তি একদিন ভোগ করতেই হবে। এটা অনিবার্য, অবধারিত। এই প্রভাব পড়তে পারে মর্যাদা ও সম্মানের উপর, যা মুহূর্তের মধ্যে নস্যাৎ করে দিবে। তখন সর্বত্র গ্লানি আর অপমান বহন করতে হবে। মিথ্যা প্রতারণার প্রভাব পড়তে পারে স্বাস্থ্যের উপর, যাতে ক্যান্সার বা অন্য কোন মরণব্যাধিতে হার্ড, কিডনি, লিভার বিকল হয়ে যেতে পারে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হয়ে যেতে পারে। অথবা এমন রোগে আক্রান্ত হবে, পৃথিবীতে যার চিকিৎসা নেই। এছাড়া সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে, প্রতিবন্ধি হতে পারে। সম্পদ ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দুর্নীতি ও প্রতারণার অর্থে সন্তান বেড়ে উঠলে সন্ত্রাসী, নেশাখোর হবে, ধর্ষক হবে, লম্পট হবে, খুনি হবে, যা নিজের জন্য বোঝা হবে। ক্ষমতা, দাপট, নেতৃত্ব সবই মুহূর্তের মধ্যে বিনাস হয়ে যাবে। কিছু করার থাকবে না। এগুলো আল্লাহর গযবের কারণ। যা পূর্বে ঘটেছে, এখনো ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে ইনশাআল্লাহ।
মানুষ যখন ন্যায়ের পথ ছেড়ে অন্যায়ের পথে ধাবিত হয়, তখন আল্লাহ তাকে সংকীর্ণ জীবনে বন্দী করে ফেলেন (সূরা ত্ব-হা : ১২৪)। আল্লাহ তাকে শঙ্কা ও খাদ্যসংকটে নিমজ্জিত করেন (সূরা আন-নাহল : ১১২)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি তোমার অপকর্ম তোমাকে তাৎক্ষণিক গ্রাস না করে, তাহলে তুমি প্রতারিত হয়ো না, কারণ ৪০ বছর পর হলেও তোমাকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে’। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অপকর্ম অন্তরকে বিকল করে দেয় এবং চিরদিনের জন্য লাঞ্ছনার গর্তে নিক্ষেপ করে। এদের জন্য পরকালে আরো ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে’। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা হতে দূরে থাক’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা মিথ্যা পরিহার করবে। কারণ মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। কোন ব্যক্তি মিথ্যাচারের পথে ধাবিত হলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭)।
এ ধরণের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন। যেকোন কাজে প্রতারণা ও ধোঁকার পথ অবলম্বন করা ইসলামে ভয়ারহ অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামী (ইবনু হিব্বান, হা/৫৬৭, সনদ ছহীহ)। অন্য হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১০১)। তাছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জিত সকল সম্পদ অবৈধ এবং হারাম। মহান আল্লাহ তা ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন (সূরা আন-নিসা : ২৯)। প্রতারণা ও হারাম উপার্জন দিয়ে উদরপূর্তি ব্যক্তির ঠিকানা জাহান্নাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু যারা কুফুরি করে, তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু জানোয়ারের মত উদরপূর্তি করে; জাহান্নামই তাদের নিবাস’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১২)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘হারাম খাদ্য দিয়ে গড়া দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫৯৬১, সনদ ছহীহ)। আল্লাহ তা‘আলা এমন ব্যক্তির দু‘আও কবুল করবেন না (ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৫)। তাছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত সম্পদ কাঁধের উপর নিয়ে বহন করে ক্বিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে (সূরা আলে ইমরান ১৬১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩১)। এদের একমাত্র পরিণাম জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল এবং তার মৃত্যু হল এ হালতে যে, সে ছিল খিয়ানতকারী, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫১)। অতএব বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে যদি শান্তিময় ও সুখময় করতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে ধোঁকা প্রতারণার অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই ভয়াবহ মহামারি সম্পর্কে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। নতুন প্রজন্ম তরুণ ছাত্রদেরকে এর মর্মান্তিক আগ্রাসন থেকে নিরাপদে রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা যাবতীয় ধোঁকা ও প্রতারণা করা থেকে দেশ ও জাতিকে হেফাযত করুন-আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়