শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র: বাস্তবতা ও পরামর্শ


বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের শিকার। অপরিমিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূরাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি ও আয়তনগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মানচিত্রে এর অবস্থানগত মর্যাদা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অপার সম্ভাবনাময় এ রাষ্ট্রটি পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী হওয়ার পরেও যায়নবাদী ইহুদী-খ্রিস্টান গোষ্ঠী ও কট্টর বর্ণবাদী ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চেতনা থেকে মুক্ত নয়। ছলে-বলে-কৌশলে সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশটাকে লুটেপুটে খেয়েছে, সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। বস্তুবাদী ও ভোগবাদী চেতনার উন্মেষ সাধন করে মানুষকে করেছে পরকালবিমুখ। করেছে দুনিয়াসর্বস্ব জড়পদার্থ। শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত আগ্রাসনে মানুষের নৈতিক চেতনাকে যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি মানুষ অদৃশ্যভাবে সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে যা মহামারী রূপ ধারণ করেছে।

দুর্বল দেশকে একনায়কতান্ত্রিক উপায়ে দখল করাই সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য। প্রাচীনকালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দখলিকৃত দেশের জনগণের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখের ব্যাপারে কম-বেশি যত্নবান ছিল। কিন্তু আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জনগণের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ বা জীবন-মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করে না। সংশ্লিষ্ট দেশকে লুণ্টন করা, গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে টুকরা টুকরা করা এবং ভূমিদাসে পরিণত করে অবাধে ভূখণ্ড ব্যবহার করার অধিকার লাভ করাই তাদের মৌলিক লক্ষ্য। বিগত প্রায় দেড় যুগ যাবৎ বাংলাদেশে তার বাস্তবতা সুস্পষ্টরূপে লক্ষ্যনীয়।

যায়নবাদী ইসরাঈল হলো আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির গডফাদার আর বরকন্দাজরা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী ও কট্টর বর্ণবাদী ভারত। তাদের চেতনা এক ও অভিন্ন। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে গোটা দুনিয়াতে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী সভ্যতা ছড়িয়ে দেয়া তাদের অন্যতম কর্মসূচী। যাতে দেশে দেশে নীতি-নৈতিকতাহীন পাশ্চাত্যের চাটুকার জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। যারা তাদের মূল অস্ত্র হিসাবে পরিগণিত হবে। এক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, গণতন্ত্রকামী, জাতীয়তাবাদী দল ও গোষ্ঠী, নৈরাজ্যবাদী কম্যুনিস্ট, কাদিয়ানী ও বাহাই সম্প্রদায়, ইসকন, বিদেশী মদদপুষ্ট পীর-ফকীর-কবর ও মাযার পূজারী ব্যক্তিবর্গ, নাস্তিক ও পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবী, দুর্নীতিপরায়ণ ও লোভী রাজনৈতিক-সামরিক কর্মকর্তা-আমলা ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিবর্গ, দাগী আসামী ও পলাতক সন্ত্রাসী, সাম্রাজ্যবাদী দেশ কর্তৃক পরিচালিত বহুজাতিক কোম্পানী ও এনজিও কর্মকর্তা, জাতিগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘ-বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মচারীবৃন্দকে তারা টার্গেট করে থাকে। অতঃপর তাদেরকে দিয়েই তারা বিভিন্ন দল ও জোট গঠন করে।

যারা ব্যাপক জনসংযোগ করে রাজনৈতিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় এবং সরকার গঠন করে। যাদেরকে ‘তাবেদার’ বা ‘পুতুল’ সরকার বলা হয়। এ সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে নিজেদের ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থকে রাষ্ট্র ও জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। জনগণের মৌলিক, মানবিক ও নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করা। সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর নিপীড়ন করা। পক্ষান্তরে চোর-ডাকাত, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী অসৎ লোকদেরকে পুরস্কৃত করা। যা স্বৈরাচারীদেরও বৈশিষ্ট্য। আর এসবই প্রভু রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়ন ছাড়া কিছুই নয়।

অতঃপর জনরোষ, গণ প্রতিরোধ ও গণযুদ্ধ শুরু হলে ঐ পুতুল সরকারই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে অসংখ্য দেশবিরোধী গোলামী চুক্তি করে। সাম্রাজ্যবাদের পদতলে বিসর্জন দেয় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তাই তারা দেশের অভ্যন্তরে চরিত্রহীন, লম্পট, নারী ও নেশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মেরুদণ্ডহীন লোকদেরকে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে। সুযোগ বুঝে তাদেরকে অর্থ-বিত্ত ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। সংখ্যালঘুদেরকে উসকে দেয়। শীর্ষস্থানীয় দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দকে আটক করে বিচারের নামে প্রহসন করে। আলেমসমাজকে হয়রানী, গ্রেফতার করে অকথ্য নির্যাতন করে। বিরোধীপক্ষকে গুপ্তহত্যা, গুম-খুন, হামলা-মামলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করে গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও পারিবারিকীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশকে পঙ্গু করার ব্যবস্থা করে।

ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য প্রতিবাদকারীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে। লুটপাট, অর্থপাচার, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে। আইন, শাসন ও বিচার বিভাগকে সাম্রাজ্যবাদের সন্তুষ্টচিত্তে পরিচালনা করে। ইনসাফ ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় দেশপ্রেমিক সুনাগরিকেরা। এভাবে একসময় দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। শুরু হয় সর্বাত্মক মরণপণ প্রতিরোধ সংগ্রাম। ফলে ক্ষত-বিক্ষত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল স্তর। অতঃপর গৃহযুদ্ধ বন্ধের অজুহাতে সংশ্লিষ্ট দেশে বহুজাতিক বাহিনী কিংবা জাতিসংঘ বাহিনী প্রেরণ করে। যাদের কাজ হলো তাবেদার সরকারকে রক্ষা করা এবং নির্বিঘ্নে লুটপাট করা। ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। দখলিকৃত দেশটির সম্পদ ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান সাম্রাজ্যবাদীদের মূল টার্গেট। সুতরাং কতজন জনগণ আহত বা নিহত হলো কিংবা পঙ্গু বা উদ্বাস্তু হলো তা দেখার তারা প্রয়োজনবোধ করে না। এসবই সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির আগ্রাসী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

পরিশেষে বলতে চাই, সাম্রাজ্যবাদের অন্ধকার নিগড় থেকে দ্বিতীয়বারের মত স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ যেন আর কখনো সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ঘুর্ণিপাকে পতিত না হয়। সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট কোন স্বৈরাচার যেন দেশকে ভাগাড়ে পরিণত করতে না পারে। জনগণের রক্তচোষা হায়েনায় পরিণত না হয়; তার জন্য কঠোরভাবে প্রতিরোধ বলই গড়ে তোলা যরূরী। সুতরাং এখনই সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা উপলব্ধিপূর্বক ঘাপটি মেরে থাকা তাদের দোসরদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে এবং তাদের সকল পথ স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। সৎ, সাহসী, অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও তাক্বওয়াবান সুনাগরিক দ্বারা একটি সর্বদলীয় প্লাটফরম গঠন করতে হবে। যারা জনগণের মাঝে শান্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের রূপরেখা চিহ্নিতকরণ ও তা মূলোৎপাটনের সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তজ্জন্য একটি মযবুত টীম গঠন করতে হবে। আর যেন কোন পুতুল সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে এবং এ দেশকে অন্য কোন দেশের সেবাদাসে পরিণত করতে না পারে তার সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঠিক থাকলে নাগরিক হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব ঠিক থাকবে এবং দেশের উত্তোরত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি হবে। পক্ষান্তরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যদি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নেয়, তাহলে এদেশে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এবং দেশ ধ্বংসস্তূপের এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের ন্যায় আমাদের লাশও শেয়াল-কুকুরের খাদ্যে পরিণত হবে। দাফন-কাফন করানোর লোক পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে আমাদের এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করুন এবং জনগণকে বাস্তবতা উপলব্ধি পূর্বক ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন !!





প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়
অবরুদ্ধ কাশ্মীর : বিশ্ব মোড়লরা নীরব - সম্পাদকীয়
রামাযান : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যে কিছু কথা - সম্পাদকীয়
খ্রিষ্টান মিশনারী : হুমকির মুখে ইসলাম ও বাংলাদেশ - সম্পাদকীয়
সালাফী মানহাজ : পরিচিতি ও অনুসরণের আবশ্যকতা - সম্পাদকীয়
শৃঙ্খলাপূর্ণ উন্নত সমাজ কাঠামো কাম্য - সম্পাদকীয়
ধর্ষণ, খুন, গুম, নারী নির্যাতন : মধ্যযুগীয় বর্বরতার নব-সংস্করণ - সম্পাদকীয়
প্রতারণার পরিণাম - সম্পাদকীয়
ইসলামী শিক্ষা : উন্নত জাতি গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম - সম্পাদকীয়
বাবরি মসজিদের রায় : ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায় - সম্পাদকীয়
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ : অমার্জনীয় ধৃষ্টতার আস্ফালন - সম্পাদকীয়
তরুণদের মানহাজ বিভ্রান্তি ও তার কুফল - সম্পাদকীয়
অসুস্থ রাজনীতি ও তার কুপ্রভাব - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ