শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন

 সামাজিক অনাচার: আশু প্রতিরোধ যরূরী 


মানুষ সামাজিক প্রাণী। সঙ্ঘবদ্ধভাবে সমাজে বসবাস করাই মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার মধ্যে রয়েছে কিছু নিয়ম, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য। রয়েছে কতিপয় দায়বদ্ধতা ও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য। যার অধিকাংশ দিক-নির্দেশনাই ইসলামে সুস্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে। অথচ ধর্মীয় এবং নৈতিকতার শিক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্য কালচার অনুসরণের ফলে সামাজিক অনাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষ হারিয়েছে মর্যাদা, সম্মান; এমনকি জীবনও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন বিমুখতার কারণে অশ্লীলতা, পাপাচার, মাদক, ব্যভিচার, অবৈধ মেলামেশা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব এবং ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের সহজলভ্যতার দরুন অশ্লীল সিনেমা, ভিডিও ক্লিপ খুব সহজেই যুবসমাজের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ব্যভিচার, ধর্ষণ, অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া ইত্যাদি মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এভাবে দুর্নীতি-দুরাচার, হারাম উপার্জন, সূদ-ঘুষ, পাচার এখন খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেড়ে চলেছে চাঁদাবাজি, প্রতারণা, গুম ও খুন। সরকারী সম্পদ মানে বেওয়ারিশ সম্পদ, যার কোন মালিকানা নেই। যে যার মত লুটেপুটে খাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স করছে, বিদেশে বিলাসবহুল অট্টালিকা গড়ে তুলছে। জনগণের সম্পদ চুরি করে পোষ্য গুণ্ডাবাহিনী ও স্বীয় সন্তানদেরকে লেলিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিজস্ব পরিমণ্ডলে একেকটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। যার যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে অসহায় মানবতা।

সরকারী চাকুরীজীবী, কালোবাজারী, হারামখোর শিল্পপতি, প্রতারক ব্যবসায়ীগণ অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। তাদেরই সন্তানরা দেশে মাদকের চোরাচালান ব্যবসা করছে, মাদকদ্রব্যের লালনক্ষেত্রে পরিণত করছে, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ খুন করছে, অসহায় মানুষকে শোষণ করছে, যুলম ও নির্যাতন করছে। অপচয়, বিলাসী জীবনযাত্রা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব তাদেরকে অমানুষে পরিণত করছে। নামী-দামী গাড়ি, অবৈধ নারী আর হারাম অর্থ হয়েছে তাদের খেল-তামাশার শ্রেষ্ঠতম সঙ্গী। পক্ষান্তরে দেশের নিম্নবিত্ত জনগণ অর্থের অভাবে না খেয়ে উপোষ থাকছে, চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। কুকুর আর জনগণ একই ডাস্টবিন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করছে। বাসস্থানের অভাবে হাড্ডিসার অবস্থায় রাস্তাঘাটে রাত্রিযাপন করছে। আর মধ্যবিত্তরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে, নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলছে। কেউবা পেটে পাথর বেধে দিনাতিপাত করছে। এসবই সামাজিক অনাচারের প্রত্যক্ষ কুফল ব্যতীত কিছুই নয়।

দণ্ডনীয় কার্য, নিয়মের লঙ্ঘন ও আইনের বিরুদ্ধাচরণের অনিষ্টতায় বর্তমানে জীবনযাত্রা অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। কোন ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা দৃষ্টিগোচর হয় না। বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, অন্যায়  ও অনিয়মের রাজত্ব সর্বত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে স্থানীয় প্রশাসন, শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়, সচিবালয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, মেট্রোপলিটন থেকে গ্রাম পুলিশ, ডিসি অফিস থেকে গ্রামের চায়ের দোকান, বিমান থেকে ভ্যান, বিমানবন্দর থেকে ভ্যান স্টান্ড সহ সকল স্থানে নিয়ম ও আইনের বিরুদ্ধে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটি স্থানে জবরদস্তী আইনের প্রচলন লক্ষ্যনীয়। মনে হচ্ছে উপনিবেশ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের এগুলোই নিত্য নৈমিত্তিক বাস্তব দৃশ্যপট। ব্যক্তিমাত্রই স্বার্থকেন্দ্রিকতার নর্দমায় ডুবন্ত। যেনতেন উপায়ে অর্থ উপার্জনের নেশায় আসক্ত। কোন স্তরেই সামান্য নীতি-নৈতিকতাও লক্ষ্য করা যায় না। খাদ্যদ্রব্য, শিশুখাদ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, শুকনা খাবার, ফল-ফলাদি সহ সকল ধরনের খাদ্য সামগ্রীতে কীটনাশক সহ নানা জাতের ঔষধ সংমিশ্রণ বর্তমানে সবচেয়ে বড় অনাচার। কেননা যা খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করে, যার উপর পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে, সেই খাবারগুলোও নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত না হয়। ফলে মানুষ নানাবিধ অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়ছে।

সমাজে কিশোর অপরাধ, কিশোর গ্যাং ইত্যাদি এখন ক্যান্সারের রূপ ধারণ করেছে। শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত কিশোর গ্যাংদের অপরাধকর্মে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তাদের মারামারি, হত্যা, খুন, প্রেম-ভালোবাসা, পরকীয়া, যেনা-ব্যভিচার, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা ইত্যাদিতে সমাজ অগ্নিগর্ভে পরিণত করেছে। মূলত নেশা, উগ্রতা, সম্পদের অহংকার, অবাধ ও উন্মুক্ত স্বাধীনতা, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, পিতা-মাতার স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও ধর্মীয় চর্চাহীনতা, সমাজে দ্বীনি কৃষ্টি-কালচারের অনুপস্থিতি, সামাজিক শাসনের অভাব ইত্যাদিই এগুলোর জন্য দায়ী। সর্বোপরি দ্বীনি শিক্ষার অপ্রতুলতার কারণে যত অনাচার বৃদ্ধির মূল কারণ।

উপরিউক্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এ কথা দ্বীধাহীনচিত্তে বলা যায় যে, সামাজিক অনাচারের লাগাম যদি এখনি টেনে ধরা না যায়, তাহলে আগামীর বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং প্রথমেই সামাজিক অনাচারের কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। ইসলাম এক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে। কেননা ইসলাম অনাচার সংঘটনের পূর্বেই তার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায়। এরপরও কেউ বিভিন্ন অপরাধ করলে ইসলাম সেক্ষেত্রে কোনরূপ দ্বিধা না করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। প্রথমতঃ নিবর্তনমূলক তথা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে তা বন্ধ করার প্রচেষ্টা করা (সূরা আলে ‘ইমরান: ১১০; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৯; মিশকাত, হা/৫১৩৭)। দ্বিতীয়তঃ উপদেশ ও সংশোধনমূলক: অনাচারী ব্যক্তিদেরকে ইসলামের আলোকে উপদেশ প্রদান (সূরা আন নাহল: ১২৫), তাদের অন্তরের পরিশুদ্ধিতা আনয়ন (সূরা আশ-শামস: ৭-১০), আল্লাহর পথে ব্যয়ে উৎসাহ (সূরা আত-তাওবা: ৩৪-৩৫), সৎকাজে উৎসাহ প্রদান (সূরা আন-নাহল: ১৯; সূরা আল-মায়িদাহ: ২), পরকালের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ (সূরা আল-আন‘আম: ৩২), হালাল উপার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৬৮), পরকালের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ (সূরা আল-আন‘আম: ৩২), মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা (সূরা আন-নিসা: ৫৮; ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, হা/২১৪৪), নৈতিক শিক্ষার সম্প্রসারণ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৫; সূরা আল-মুতাফফিফীন: ১-৩), জবাবদিহিতা (সূরা বানী ইসরাঈল: ১৪), উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান (মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৪৬৯), নিয়োগে স্বচ্ছতা (সূরা আল-কাসাস: ২৬) ইত্যাদি। তৃতীয়তঃ কতিপয় বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেমন: শরী‘আহ নির্দেশিত তা‘যীরী আইনের বাস্তব প্রয়োগ (সূরা আন-নিসা: ৩৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৫, সনদ ছহীহ), দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ, দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণ (সূরা আলে ‘ইমরান: ১০৪), অনাচারের কুফলের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার করা, গণসচেতনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (দারেমী, হা/২৩০২, সনদ ছহীহ) এবং সামাজিকভাবে বয়কটের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অনাচারমুক্ত করুন এবং দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিন- আমীন!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّیۡعُ الۡعَلِیۡمُ





প্রসঙ্গসমূহ »: সমাজ-সংস্কার সম্পাদকীয়
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় - সম্পাদকীয়
ঈদে মীলাদুন্নবী : শী‘আদের সৃষ্ট অভিশপ্ত অনুষ্ঠান - সম্পাদকীয়
ইসলাম ও মানবাধিকার - সম্পাদকীয়
তাওহীদ সম্পর্কে জানা আবশ্যক কেন? - সম্পাদকীয়
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরাজয় : - সম্পাদকীয়
পরকীয়ার পরিণাম - সম্পাদকীয়
মানুষের চরম সংকট! - সম্পাদকীয়
রামাযান : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যে কিছু কথা - সম্পাদকীয়
শৃঙ্খলাপূর্ণ উন্নত সমাজ কাঠামো কাম্য - সম্পাদকীয়
শী‘আদের ধ্বংসযজ্ঞ ও আমাদের করণীয় - সম্পাদকীয়
নারী পোশাকের স্বাধীনতা ও প্রগতিবাদীদের ভ্রান্তি বিলাস - সম্পাদকীয়
প্রচলিত কুসংস্কার : মুসলিমদের জন্য মরণব্যাধি ক্যান্সার - সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ