সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:০৩ অপরাহ্ন

সার্বিক নিরাপত্তা আবশ্যক 


মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে চোখে পড়ে ছোট্ট লেখা Safety First বা নিরাপত্তাই প্রথম। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ মর্মে একটি দিবসও পালন করা হয়। সড়ককে নিরাপদ করার জন্য এই আন্দোলন। মনে হচ্ছে নিরাপত্তা শুধু রাস্তার জন্য দরকার, অন্যত্র এর কোন প্রয়োজন নেই। আর বাস্তবেও তাই মনে হয় যে, কোনকিছুরই নিরাপত্তা নেই। শুধু রাস্তার ধারে লেখাটুকুই বাকী আছে। আর জাতিসংঘ নামক বিশ্বপ্রতিবন্ধী সংস্থায় ‘নিরাপত্তা পরিষদ’ নামে একটি বিভাগ আছে বলে পত্রিকায় মাঝে মাঝে দেখা যায়, যার দ্বারা পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিপন্ন মানবগোষ্ঠীর কোন দেশে প্রকৃত কোন নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় না। নিরাপদ, নিরাপত্তা, শান্তি ইত্যাদি মুখরোচক শব্দগুলো বিশ্ব মোড়লদের মুখে তোতা পাখির বুলির মত সর্বদা উচ্চারিত হলেও বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই। প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষই নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন বিশ্ববিধ্বংসী মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমার মহড়ায় মত্ত, তখন নিরাপত্তার কথা কারো স্মরণ থাকার কথা নয়। অন্য দেশকে মুহূর্তের মধ্যে বিনাশ করে দিতে পারে এমন দূরপাল্লার অত্যাধুনিক অস্ত্রের আবিষ্কার ও যোগান নিয়েই তারা ব্যস্ত। তাই পৃথিবী নামক গ্রহটি এখন হুমকি, ত্রাস আর সর্বনাশা অস্ত্রের গুদামে পরিণত হয়েছে। ফলে কেউই নিরাপদ নয়।

দেশের নিরাপত্তা না থাকলে দেশ স্বাধীন করে লাভ কি? নিজের ভাষার নিরাপত্তা না থাকলে ভাষা আন্দোলনের ফলাফল কোনদিন কি আমরা উপলব্ধি করতে পারব? জীবনের নিরাপত্তা না থাকলে জন্ম নিয়ে লাভ কি? সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড বলা হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথাও আছে কি? উন্নয়নের মূল উৎস কৃষি ও শিল্পখাত। কিন্তু কৃষক-শ্রমিকরা কি কখনো নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে? ঘর থেকে বেরিয়ে পুনরায় নিরাপদে ঘরে ফিরে আসবে এমন নিশ্চয়তা ও বিশ্বাস কেউ এখন আর লালন করে না। কত মানুষ গুম হয়ে গেছে, তার কোন হিসাব নেই, হদিসও নেই, স্বজনদের অপেক্ষা ও কান্নারও শেষ নেই। এখন নিজের ঘরেও কেউ নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসী চক্র অস্ত্রের মহড়া দিয়ে মা-বাবার স্বপ্নের সুন্দরী মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অতঃপর গণধর্ষণ করে হত্যা করছে। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, পালাক্রমে ধর্ষণ করছে অতঃপর হত্যা করছে, আগুনে পুড়িয়ে ভস্মী করে দিচ্ছে। এমনকি মায়ের কোলেও একটি শিশু নিরাপদ নয়। মুহূর্তেই ছুঁ মেরে কিশোর গ্যাং নিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিপণ না পেয়ে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কত স্বপ্ন নিয়ে একটি সন্তান শিক্ষা অর্জনের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর লাশ হয়ে বাড়ী ফিরছে। নিমিষেই সমস্ত স্বপ্নের সমাধি রচিত হচ্ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণেই লম্পট চক্র এ সমস্ত লোমহর্ষক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। যেন দেশে সরকার নেই, প্রশাসন নেই, বিচার বিভাগ নেই, কোন দায়িত্বশীলও নেই। দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে বড় বড় দুর্নীতিবাজ রাক্ষস বসে আছে। তাদের মধ্যে নিষ্ঠা, সততা ও মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। সেজন্য কোন মানুষেরই জান, মাল, সম্মান, ইযযতের নিরাপত্তা নেই। 

বস্তুত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভর করে জনসমষ্টির ওপর। জনসমষ্টি রাষ্ট্রের নিয়ামক। রাষ্ট্রের রয়েছে আইন বিভাগ (Legislature), নির্বাহী বিভাগ (Executive) এবং বিচার বিভাগ (Judiciary)। এই শ্রেণী বিভাগ সবই মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়- ‘সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ’ (Greatest happiness to the highest number of people) নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। মানুষের জন্য সরকার। সরকারের জন্য মানুষ নয়। মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। অথচ এত নিরাপত্তা বাহিনী ও সংবিধিবদ্ধ আইন থাকার পরও মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এর মূল কারণ হল আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই।

আসুন এবার আমরা দেখি নিরাপত্তাকে ইসলাম কেমন গুরুত্ব দিয়েছে এবং তা কিভাবে কার্যকর করেছে। আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, যারা শিরকমুক্ত দৃঢ় ঈমান পোষণ করবে তাদের জন্য রয়েছে সার্বিক নিরাপত্তা (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)। অন্য আয়াতে তিনি অঙ্গীকার করেছেন যে, যারা ঈমান আনবে এবং আমলে ছালেহ করবে, তাদেরকে খেলাফত দিবেন এবং নিরাপত্তা দান করবেন (সূরা আন-নূর : ৫৫)। দেশের নিরাপত্তা এতটাই অপরিহার্য যে, ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর কাছে সর্বপ্রথম মক্কা নগরীর নিরাপত্তা চেয়েছেন। অতঃপর অন্যান্য বিষয়ের জন্য আবেদন করেছেন (সূরা ইবরাহীম : ৪১-৩৫)। অন্য আয়াতে এসেছে যে, তিনি সর্বপ্রথম দেশের নিরাপত্তা চেয়েছেন, তারপর রুযির আবেদন করেছেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১২৬)। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি মক্কা নগরীতে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে (সূরা আলে ইমরান : ৯৭; সূরা আল-আনকাবুত : ৬৮; সূরা কুরাইশ : ৫)। রাসূল (ছালাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা দিয়েছেন, প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে (ছহীহ বুখারী, হা/১০)।

ইসলাম মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেছে (ছহীহ বুখারী, হা/১৭৩৯)। কেউ এই বিধানের লংঘন করলে সাথে সাথে তার শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। এক্ষেত্রে কখনো স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি স্থান পায়নি (ছহীহ বুখারী, হা/৪৩০৪)। অন্যায়ভাবে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে বা শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে, তাহলে অপরাধীর জন্য রয়েছে ক্বিছাছ। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীকে হত্যা করা বা রক্তপণ গ্রহণ করা এবং ভিকটিমের শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, অপরাধীর ততটুকু প্রতিশোধ গ্রহণ করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৮; ছহীহ বুখারী, হা/২৭৬৪, ৪৬১১)। উক্ত আইনের শাসন কার্যকরের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া হয়নি। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন আরেকজনের দিকে অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত করাও হারাম (ছহীহ বুখারী, হা/৩১, ৬৮৭৫)। আর যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করে সে উম্মতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত নয় (ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৭৪)। এমনকি কোন মুসলিমকে ভীতি প্রদর্শন করাও নিষিদ্ধ (আবূ দাঊদ, হা/৫০০৪)। অন্যের প্রতি যুলম করলে, কষ্ট দিলে, সম্পদ আত্মসাৎ করলে, দুর্নীতি করলে, ব্যভিচার করলে ইসলাম শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আর উক্ত অহীর বিধান কার্যকর করার কারণেই জাহেলী যুগ স্বর্ণের যুগে পরিণত হয়েছিল। 

দেশের সরকারের উপর অপরিহার্য কর্তব্য হল, সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ যে দেশের নিরাপত্তা যত কঠোর সে দেশ তত উন্নত ও অগ্রসর। নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন কার্যকর করতে পারলে সবকিছুই নিরাপদ থাকবে ইনশাআল্লাহ। জানা আবশ্যক যে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা যদি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন না করেন, তাদের জন্যও রয়েছে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি। রাসূলুল্লাহ (ছালাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, শাসক তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩৮)। অন্য হাদীছে এসেছে, যে শাসক জনগণকে কল্যাণের সাথে তত্ত্বাবধান না করেন, তিনি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেন না’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫০)। কেউ যদি জনসাধারণের দায়িত্ব নিয়ে খিয়ানত করে মারা যায়, তাহলে তার জন্য জান্নাত হারাম’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫১)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর সার্বিক নিরাপত্তা নাযিল করুন এবং সরকারকে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!






ফেসবুক পেজ