সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

اَلْحَمْدُ لِلّٰہِ وَحْدَهُ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

অবরুদ্ধ কাশ্মীর : বিশ্ব মোড়লরা নীরব


কাশ্মীর জ্বলছে, পুড়ছে, গুলির আঘাতে অসংখ্য তাজাপ্রাণ ঝরে যাচ্ছে। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা তীব্রতর হচ্ছে। অবরুদ্ধ রেখে একদিকে গুলি করে মারা হচ্ছে, অন্যদিকে অন্ন ও চিকিৎসাহীনভাবে অসহায় অবস্থায় রেখে নিঃশেষ করা হচ্ছে। এখন যেন কাশ্মীর এক মৃত উপত্যকা। সবুজ যমীনজুড়ে ছোপ ছোপ রক্ত, বাতাসে লাশের গন্ধ। মোবাইল ফোন, ল্যান্ডফোন, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা অবরুদ্ধ। হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালও বন্ধ। খাবার ফুরিয়ে গেছে, চিকিৎসার অভাবে প্রসূতি মায়েরা ছটফট করছেন। রাস্তায় রাস্তায় সেনা চৌকি আর কাঁটা তারের ব্যারিকেড। রাস্তায় যত না সাধারণ মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশী ভারতীয় সেনাবাহিনী। সামরিক আধা-সামরিক প্রায় সাত লক্ষ সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। ভারত গোটা কাশ্মীরকে কারাগার বানিয়ে রেখেছে। বরং অন্ধকূপের মত অবস্থা আরো ভয়াবহ।  বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ভূস্বর্গ খ্যাত এই অঞ্চলটিতে দেড় কোটি মানুষ নরকযন্ত্রণায় ভুগছে। এভাবে লক্ষাধিক মানুষকে গুলি করে মারা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে গুম করা হয়েছে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-শিশু। বাহাত্তর বছর যাবৎ এভাবেই চলছে। কখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ১৯৪৮ সালে লন্ডনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘টাইম পত্রিকা’ অভিযোগ করেছে, দুই লাখ ৩৭ হাজার মুসলিমকে পুরোপুরি শেষ করে দেয়া হয়েছে। 

ভারতবর্ষ ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। কথা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত হবে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র। কাশ্মীর শত শত বছর ধরেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৪১ সালের শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরে মুসলিম ছিল ৭৫.৯৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে জনবহুল কাশ্মীর উপত্যকায় এর হার ছিল ৯৫ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীর স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ বছরের পর বছর স্বাধীনতা সংগ্রাম করলেও আজও স্বাধীন হয়নি।

উল্লেখ্য, কাশ্মীরে ইসলাম শিকড় গাড়ে ১৩২০ সালে। তখন স্থানীয় এক রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর হন কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসকগণই কাশ্মীর শাসন করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মোগল সম্রাটরা, যাদের শাসনকাল ছিল ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত। অতঃপর ইংরেজ শক্তি সব হিসাব পাল্টে দেয়। ১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করা পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। যে মানদণ্ডে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়েছিল সে অনুযায়ী মুসলিম প্রধান কাশ্মীর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং বিদ্রোহী ও উপজাতীয় আক্রমণের অজুহাতে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিতর্কিত চুক্তিতে সই করেন। পরের দিন ২৭ অক্টোবর ঐ চুক্তি অনুমোদিত হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এই চুক্তি ছিল কাশ্মীরের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার সাথে সুস্পষ্ট প্রতারণা। এখান থেকেই ভারত পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের শুরু।

অতঃপর ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর ৩৭০ অনুচ্ছেদটি ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে এর সাথে ৩৫-এ ধারা যুক্ত করা হয়। এই ধারা দু’টি মিলে বিধান ছিল, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। অপরদিকে জম্মু ও কাশ্মীর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। কাশ্মিরিরা বসবাস করবে তাদের নিজেদের প্রণীত স্বতন্ত্র আইনের অধীনে। এর মাধ্যমে ভারতের অন্য অংশের নাগরিকদের জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা, স্থায়ীভাবে বসবাস ও সম্পদ নিষিদ্ধ করা হয়। সেই ধারা গত ৫ আগস্ট ২০১৯ প্রেসিডেন্টের জারি করা এক ডিক্রির মাধ্যমে বাতিল করার মাধ্যমে বিধি নিষেধ তুলে নেয়া হয়। এতে কাশ্মীর তাদের বিশেষ মর্যাদা হারায়। সেই সাথে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে কেন্দ্রশাসিত দু’টি অঞ্চলে ভাগ করার কথাও বলা হয় এই বিলে। একটি জম্মু ও কাশ্মীর আর অপরটি হবে লাদাখ। অথচ এ সমস্ত ধারা প্রণয়ন ও বিল উত্থাপনের নৈতিক কোন অধিকার ভারতের নেই। কারণ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের হাইকোর্ট বছর দুয়েক আগের এক রায়ে ভারতের দাবীকে অসার প্রমাণ করেছে। উক্ত রায়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীর কখনোই ভারতের অংশ ছিল না এবং এখনো ভারতের অংশ নয়। এই রায়ে আদালত বলেছেন, ভারতের সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীরকে সীমিত সার্বভৌম ভূখণ্ডের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ৬০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে এই রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে; যা সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। আদালত বলেছেন, সংবিধানের ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে কাশ্মীরকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।

কাশ্মীরের জনগণের অপরাধ হল তারা মুসলিম। তারা স্বাধীনতাকে ভালবাসে। তারা কোন শক্তির কাছে মাথা নত করতে রাযী নয়। তারা জীবন দিতে প্রস্তুত কিন্তু সম্মান খোয়াবে না। যুগের পর যুগ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে, কিন্তু কাশ্মীরের এক ইঞ্চি মাটি হাতছাড়া করবে না। তারা শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে না। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর সরকারী তত্ত্বাবধানে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। ভারতের গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার সেটাই করছে কাশ্মীরী জনগণের সাথে। যদি এমন সমস্যা কোন অমুসলিম দেশে হত, তাহলে জাতিসংঘে দফায় দফায় বৈঠক হত, তড়িৎ সিদ্ধান্ত হত, নেয়া হত কঠিন ব্যবস্থা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলে কাশ্মীরের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

আমরা মনে করি মুসলিম দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার মত পরাশক্তিগুলো যদি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবী মেনে নিতে ভারতকে বাধ্য করে, তাহলে কাশ্মীর স্বাধীন হওয়ার পথ উন্মুক্ত হতে পারে। এরপরও বিশ্ব মোড়লরা যদি নীরব ভূমিকা পালন করে তবুও আল্লাহ্র মদদে বিশেষ রহমতে কাশ্মীর একদিন স্বাধীন হবেই ইনশাআল্লাহ। কোন শক্তিই তাদেরকে দমাতে পারবে না। ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী উপমহাদেশে ১৯০ বছর যুলুম নির্যাতনের রাজত্ব করলেও অবশেষে পালাতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন লাঞ্ছিত হয়ে পালিয়েছে ১০ বছর পর। এখন আফগানিস্তান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে আমেরিকা। সে জন্য তারা তালেবান নেতাদের সাথে কাতারসহ বিভিন্ন জায়গায় বারবার শান্তি আলোচনায় বসছে। অর্থাৎ ১৮ বছরের মাথায় তারা পালানোর পথ খুঁজছে। অনুরূপ মুসলিম কাশ্মীরের নির্যাতিত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ একদিন আল্লাহ্র কাছে কবুল হবে, নারী-শিশুর কান্নার বদৌলতে একদিন আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। ভারত সেদিন পালানোর পথ খুঁজে পাবে না ইনশাআল্লাহ। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের দু‘আ কবুল কর, আসমানী সাহায্য নাযিল কর এবং কাশ্মীরকে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত কর-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ





ফেসবুক পেজ