জাতীয় ঐক্য: ভিত্তি হোক ইসলাম
দেশে জাতীয় ঐক্যের কর্মযজ্ঞ চলছে। উদ্দেশ্য রাষ্ট্র সংস্কার ও ফ্যাসিস্টমুক্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন। জনগণের পক্ষ থেকে একটি উন্নত, সুসংহত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাষ্ট্র বিনির্মাণের আওয়াজ উঠেছে। এজন্য জনগণ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ডান-বাম ও ধর্মীয় দল সহ সাধারণ নাগরিকের মাঝে এ ব্যাপারে সদিচ্ছার কোন কমতি নেই। রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এরূপ ঐক্য ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। যা সহবস্থানপূর্ণ ও কল্যাণমূলক জাতিগঠনের অন্যতম হাতিয়ার।
২৪-এর গণঅভুত্থান ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটা রক্তস্নাত ঐক্যের ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু পতিত স্বৈরাচারের ফাঁদ ও ষড়যন্ত্র জাতীয় ঐক্যের পথে পাহাড়সম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচন, ভারতের দাদাগিরি, স্বৈরচারী পলাতক ফ্যাসিস্ট লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। শত শত যুবকের লাশ, হাজার হাজার ভাই-বোনের গগণবিদারী আর্তচিৎকার, আহত, অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে অর্জিত দেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব চরম হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। একদিকে ঐক্যের মঞ্চে বসে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন পক্ষান্তরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ, বক্তৃতা, বিবৃতি এবং মাঠে-ময়দানে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করছেন। আধিপত্য বিস্তারে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। হত্যা, রক্তাক্ত, সংঘর্ষ, গুম ও খুনের ঘটনায় অনেকেই জড়িত হয়ে পড়ছেন। ধর্মীয় দলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য দুই গ্রুপ ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। জালসা-মাহফিলের অতিথি হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, অফিস-আদালত নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়েও গোণ্ডামির শেষ নেই। হরহামেশা ঘটেই চলেছে। দৃশ্যত ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিই চরম আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে তথাকথিত বিদেশী ও বন্ধুপ্রতীম (!) রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রও দেশকে অকার্যকর করার উপক্রম করেছে। কেননা, তাদের স্পাই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাছির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তদুপরি দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত ও লালিত স্বপ্ন দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর কেউ ফ্যাসিজমের বিষফোঁড়ায় আক্রান্ত হতে চায় না। সকলেই সুবিচার, বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও সামাজিক নিরাপত্তার বাংলাদেশ চায়। সবাই মিলে মাতৃভূমিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে নিতে চায়।
ঐক্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম অন্তরায় হলো ধর্মহীন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মতবাদ। যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদ। যা জাতিকে ফ্যাসিষ্ট ও স্বৈরচার উপহার দিয়েছে। মানুষেরা গড়ে উঠেছে অনৈক্য, দলাদলি, বিভেদের অনুসারী ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে। অথচ যেকোন জাতিকে স্থবির, হীনবল, ব্যর্থ, অকার্যকর ও অস্থিতিশীল করার জন্য উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোই যথেষ্ট। এছাড়া পাশ্চাত্য সভ্যতার বিষবৃক্ষ গণতন্ত্রের নামে সমাজের মানুষকে সরকারী দল ও বিরোধী দলে বিভক্ত করেছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে আর বাকি দলগুলো মিছিল, মিটিং, হরতাল, অবরোধসহ নানা কর্মসূচী দিয়ে তাদের বিরোধিতা করবে। প্রয়োজনে ককটেল, বিস্ফোরণ, গুলি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, গুম, খুন, অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, লুটপাঠ ইত্যাদি পর্যন্ত করতে পারবে। এটা নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার ও ডিমোক্রেটিক্যাল ট্রাডিশন! যে অধিকার মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়, যে ট্রাডিশন সমাজ ব্যবস্থাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে, ধিক! ঐ অধিকার বা ট্রাডিশনের প্রত। সুতরাং দলীয় সরকার দিয়ে কখনো নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সুশাসন ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র আশা করা যায় না, বরং জাতি ঐক্যবদ্ধও হয় না।
অথচ দেড় হাজার পূর্বে তমসাচ্ছন্ন, বর্বর, উৎশৃঙ্খল ও অনৈক্যপূর্ণ জাহিলী সমাজে মুহাম্মাদ (ﷺ) কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। দা‘ওয়াহ ও তাবলীগ এবং তারবিয়া ও তাযকিয়ার মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করে পৃথিবীতে দৃষ্টান্তহীন এক আলোকজ্জ্বল সমাজকাঠামো উপহার দিয়েছিলেন। ‘আক্বীদা-বিশ্বাস ও খুলূছিয়াতপূর্ণ কাজের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ও আত্মোৎসর্গিত নিবেদিতপ্রাণ একদল ঐক্যবদ্ধ কর্মী গঠন করেছিলেন। আল্লাহদ্রোহী শক্তির মূলোৎপাটন করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে এক ভারসাম্যপূর্ণ ও বৈষম্যহীন অর্থব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। নারীদেরকে সম্মানজনক মর্যাদা প্রদান করেন ও দাসপ্রথার বিলোপ সাধন করেন। তিনি অন্যায়-অবিচার ও মিথ্যার বিপরীতে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এককথায় যাবতীয় শিরক-কুফর ও নিফাকী চরিত্র, সূদ-ঘুষ, দুর্নীতি, পাপাচার, হত্যা-লুণ্ঠন, যেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, মদ্যপান, মারামারি-কাটাকাটি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আত্মোগৌরব, আত্ম অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত-তোহমত, অনৈক্য ইত্যাদি সহ মানব সমাজের জন্য খারাপ ও ক্ষতিকর সকল কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন একটি নিরাপদ ও কল্যাণকর সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি জাহিলিয়াতকে উচ্ছেদসাধন করে পৃথিবীতে এক সোনালী ইতিহাসের সূচনা করেন।
অতঃপর তাঁর তিরোধানের পর সুপথপ্রাপ্ত খলীফাগণও উক্ত উৎসদ্বয়ের আলোকে তাদের খিলাফতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। ভ্রান্তমতের বিরুদ্ধে তাঁরা যেমন ছিলেন আপোসহীন, তেমনি আল-কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ গঠনেও ছিলেন দৃঢ়চেতা। তাঁরা ইসলামের বাস্তব নমুনা যথাযথভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে একটি বৃহত্তর সমাজের মডেল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা বিশ্ব ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জুকে (দ্বীনকে) সুদৃঢ়রূপে ধারণ কর ও পরম্পর বিভক্ত হয়ে যেয়ো না’ (আলে-ইমরান: ১০৩)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, পারস্পরিক হৃদ্যতা বজায় রেখে চল, হক্বের উপর ঐক্যবদ্ধ থাক এবং আল্লাহর আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ কর (তাফসীরে তাবারী, ৫/৬৪৩)। এছাড়া নবী করীম (ﷺ) ও ছাহাবীদের মানহাজ ছেড়ে ভিন্ন মতাদর্শ তৈরি করে মুসলিম মিল্লাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না (ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৯৩, সনদ হাসান)। কেননা বিভক্তির মাধ্যমে বন্ধন ছিন্ন হয়, একতা নষ্ট হয়, কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় (আলে ‘ইমরান: ১০৫; তিরমিযী, হা/২৬৪১, সনদ হাসান)। স্মতর্ব্য যে, একতা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দান করে। যুগের পর যুগ চালু থাকা যুদ্ধবিদ্ধস্ত মদীনাবাসীকে পবিত্র অহির আলোকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাকে ‘মদীনা সনদ’ বলা হয়। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট বার্তা পাঠান এই বলে যে, ‘ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন’। অনুরূপ হিরাক্লিয়াস এ বার্তা পেয়ে বলেছিলেন, ‘হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর বায়‘আত গ্রহণ কর’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭)। রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তিকালের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতেও মুসলিমদের ঐক্য ছিল অনড়, খলীফগণও (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) ঐক্যের ব্যাপারে ছিলেন আপোসহীন। যে ঐক্যের মানদণ্ড ছিল তাওহীদের প্রতি পূর্ণাঙ্গরূােপ আত্মসমর্পণ করা (আয-যারিয়াত: ৫৬; ছহীহ বুখারী, হা/১৩৮৫; আহমাদ, হা/১৬০৬৬) এবং মুক্তিপ্রাপ্ত জামা‘আতকে আঁকড়ে ধরা (ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৯৩, সনদ হাসান)। মহান আল্লাহ ইসলামের ভিত্তিতে দেশের জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!