মানহাজের বিরোধিতা ও তার পরিণাম
মানহাজ ব্যাপক একটি পরিভাষা। এটা আক্বীদার চেয়েও অনেক ব্যাপক। আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক্ব, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানহাজ ভিত্তিক পরিচালিত হওয়া আবশ্যক (ড. ছালেহ ইবনু ফাওযান, আল-আজওয়াবাতুল মুফীদাহ ‘আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ, পৃ. ১২৩, প্রশ্ন নং-৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেক জাতির জন্য আমরা নির্দিষ্ট শরী‘আত এবং মানহাজ নির্ধারণ করেছি’। অর্থাৎ তিনি নির্দিষ্ট পথ ও কর্মপন্থা অবতীর্ণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সে অনুযায়ী চলার এবং উম্মতকে পরিচালনা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন (আল-মায়েদাহ : ৪৮; সূরা আল-হাশর : ৭)। আর সালাফে ছালেহীনের নীতির অনুসরণ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এটাকেই ‘মানহাজুস সালাফ’ বলে। সালাফদের কর্মপন্থা, বুঝ ও ব্যাখ্যাকে অবজ্ঞা করার কারণেই অধিকাংশ মুসলিম আজ গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। বিভিন্ন তরীক্বা, মাযহাব, মতবাদ, বিজাতীয় দর্শন ও ত্বাগূতী রাজনীতির অপবিত্র ফাঁদে আটকে পড়েছে।
‘মানহাজ’ অর্থ নীতি, পরিষ্কার, সরল-সোজা, প্রশস্ত ও আলোকিত পথ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪৩০, সনদ ছহীহ)। এক কথায় ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা জান্নাতের পথ। এই নীতি ও কর্মপন্থার অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর ফরয। আর ‘সালাফ’ অর্থ ‘অগ্রবর্তী বা গত হওয়া, উপদেশ, শিক্ষা, অগ্রগামী (সূরা আন-নিসা : ২২-২৩; আল-মায়েদাহ : ৯৫; আয-যুখরুফ : ৫৬; ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০)। সালাফ হলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের যুগের সৎ ব্যক্তিবর্গ (ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; সূরা আলে ‘ইমরান : ১১০)। তাই ‘মানহাজুস সালাফ’ অর্থ হল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে এযামের নীতি-আদর্শ, কর্মপন্থা ও মূলনীতি।
আর ‘সালাফী’ হলেন, যিনি সালাফদের মানহাজের নীতি ও কর্মপন্থার আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনা করেন। তাই যারা সালাফদের কর্মপন্থা ও ব্যাখ্যাকে ঈমানের সাথে গ্রহণ করবে, তারা মুক্তি পাবে। আর যারা প্রত্যাখ্যান করবে এবং বিরোধিতা করবে তারা ধ্বংস হবে, পথভ্রষ্ট হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তারা যদি তোমাদের ঈমান আনার মত ঈমান আনে, তবে তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা ভ্রষ্টতার মধ্যে থাকবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৭)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, সালাফদের পথ অনুসরণ না করলে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (সূরা আন-নিসা : ১১৫)। সেজন্য শরী‘আত বুঝার ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাখ্যা ও মূলনীতি অনুসরণ করা ফরয।
যারা সালাফী মানহাজের অনুসরণ না করে বিভক্তি, গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। তিনি বলেন, ‘হেদায়াত প্রকাশিত হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলবে, সে যেদিকে চলতে চায়, আমরা তাকে সেদিকেই প্রত্যাবর্তিত করব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (সূরা আন-নিসা : ১১৫)। এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানহাজকে আঁকড়ে ধরাকে ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি তাঁদের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে সে কুফরী করবে। ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাফদের তরীক্বা ছাড়া অন্য কোন তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং তাদের মানহাজের বিরোধী কোন মানহাজে পরিচালিত হবে, সেটা আল্লাহর সাথে কুফরী হিসাবে সাব্যস্ত হবে। কারণ সালাফদের রাস্তার বাইরে চলা এবং তাদের মানহাজের বিপরীত চলাই হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করা’ (তাফসীরে ত্বাবারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২০৪)।
বর্তমান ফেতনার যুগে মুসলিমরা অসংখ্য দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কুরআন-হাদীছ নিজের মত বুঝে পথভ্রষ্ট হচ্ছে এবং জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই সময় সালাফদের অনুসরণ করা ছাড়া মুক্তির কোন রাস্তা নেই। জান্নাতে যাওয়ার আশা থাকলে তাঁদের মানহাজকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, নিশ্চয় বানী ইসরাঈলরা ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফের্কায়। একটি দল ব্যতীত সবই জাহান্নামে যাবে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সেই জান্নাতী দল কোনটি? তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে নীতির উপর আছি, সেই নীতির উপর যারা থাকবে, তারাই জান্নাতী (তিরমিযী হা/২৬৪১, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৮)। ছাহাবী-তাবেঈদের নীতি ও ব্যাখ্যা কত গুরুত্বপূর্ণ তা উক্ত হাদীছে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাই যত উদ্ভট ব্যাখ্যা বা ইখতিলাফ প্রচলিত থাক, সবগুলোকে বর্জন করে সালাফদের ব্যাখ্যাকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং সমস্ত দল-উপদলকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যখন তোমরা বিভিন্ন মতপার্থক্য দেখতে পাবে, তখন আমার সুন্নাতকে এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তাকে শক্ত করে ধারণ করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তার উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে (আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, সনদ ছহীহ)। অন্য হাদীছে সমস্ত ভ্রান্ত দলকে প্রত্যাখ্যান করতে বলা হয়েছে (ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮৪)। যেমন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মানহাজ একটি সুপরিচিত অতি প্রাচীন কর্মপন্থা। আল্লাহ তা‘আলা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুমুল্লাহ)-কে সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকেই এই মানহাজ সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। নিশ্চয় এটি ছাহাবীদের কর্মপন্থা, তাঁরা এটা পেয়েছেন স্বয়ং তাঁদের নবী (ﷺ)-এর কাছ থেকে। যে ব্যক্তি এই মতাদর্শের বিরোধিতা করবে, সে আহলুস সুন্নাহর নিকট বিদ‘আতী হিসাবে পরিগণিত হবে’ (মিনহাজুস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০১)। ইমাম আবূ মুযাফফর ছাম‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সালাফে ছালিহীনের অনুসরণ করা। আর প্রত্যেক বিদ‘আতী তাদের অনুসরণকে পরিত্যাগ করে’ (আল-ইন্তিছার লি-আহলিল হাদীছ, পৃ. ৩১)।
অতএব অসংখ্য ফিতনা ও জাহান্নামের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য ‘সালাফী মানহাজ’ ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই। জান্নাতে যাওয়ার আশা থাকলে সালাফদের মানহাজকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। সেই সাথে যাবতীয় অপব্যাখ্যা, দল-উপদল সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে এবং যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ছাহাবীদের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তাদের সাথে চলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মানহাজ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত করুন-আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সম্পাদকীয়