রবিবার, ১৫ Jun ২০২৫, ০৪:৫০ অপরাহ্ন

জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন : ইসলাম, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ


ইসলাম বিশ্বজয়ী ও সর্বজনীন জীবনাদর্শ। ইসলাম তার নিজস্ব শক্তিমত্তা ও অনুপম আদর্শের উপর ভিত্তি করে সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছিল। পার্থিব শক্তির সকল ক্ষেত্রে ইসলামের ভারসাম্য ছিল অতুলনীয়। তাই সামগ্রিক সফলতার জন্য কল্যাণকর পার্থিব সকল শক্তির সক্ষমতা অর্জন করা জরুরী। বিজ্ঞানের উৎকর্ষে প্রযুক্তি যখন এগিয়ে যাবে, তখন শক্তি, সামর্থ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে ইসলামেরও উৎকর্ষ সাধিত হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় মুসলিমদেরকেও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সক্ষমতা অর্জন করা আবশ্যক। তবে এক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

পার্থিব শক্তির সক্ষমতা এমনিতেই অর্জিত হবে না। এজন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত মূলনীতি, উদ্যম চেতনা, ঈমানী শক্তির দৃঢ়তা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার মোকাবেলায় জাগতিক শক্তির ভারসাম্যতা অর্জন করা প্রভৃতি। এজন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত।

ক. শিক্ষাগত সক্ষমতা অর্জন (Acquiring educational skills) : মুসলিমদের সামগ্রিক অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো- শিক্ষাগত সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়া। তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন অভিন্ন পদ্ধতিতে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে, যা আল-কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর উপর ভিত্তি করেই মুসলিম জাতি ইসলামের অভ্যুদয়ের পর কয়েক শতাব্দীতে তার জ্ঞানগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং বিশ্বকে সভ্যতা-সংস্কৃতির এক আদর্শিক সংস্করণ উপহার দিয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী সভ্য দুনিয়া ইসলামের জ্ঞানগত বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করেছে, তার কলম দিয়ে লিখেছে এবং তারই ভাষায় লেখালেখি করেছে, গ্রন্থ প্রণয়ন করেছে। এককথায় মুসলিমরাই দুনিয়াতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এজন্য কল্যাণকর যেকোন সমসাময়িক বিষয়ে ইসলামের প্রাধান্য থাকা অপরিহার্য।

খ. শিল্প-প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন (Acquisition of industrial-technical capabilities) : শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রধান প্রধান শাখায় মুসলিম ছাত্র ও শিক্ষকদেরকে নেতৃত্ব প্রদান করা জরুরী। বিশেষ করে প্রকৌশল, ফলিত বিজ্ঞান, মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি ও প্রজনন-প্রকৌশল, জীব-প্রকৌশল, চিকিৎসা, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। শত্রুর মোবাবেলা করার জন্য সকল প্রকার শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কাফিরদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করবে’ (সূরা আনফাল : ৬০)।

শায়খ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঐ সমস্ত বিষয়, যার দ্বারা তোমরা বৃদ্ধিবৃত্তিক, দৈহিক ও যাবতীয় অস্ত্রশক্তিসহ এরূপ অন্যান্য বিষয়ে শক্তি অর্জন করতে পারবে, যার মাধ্যমে বিরোধী শক্তির সাথে সংগ্রাম করতে পারবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাবতীয় ইন্ডাস্ট্রী, যাতে সব রকমের অস্ত্র ও প্রতিরক্ষার যন্ত্র, মেশিনগান, বন্দুক, জঙ্গী বিমান, জল ও স্থল পথের যুদ্ধ জাহাজ, দুর্গ, অপসারণযন্ত্র, পরিখা ও সংরক্ষণের যাবতীয় সরঞ্জাম তৈরি হবে। এছাড়া কূটনীতি ও রাজনীতিও এর অন্তর্ভুক্ত, যার দ্বারা মুসলিমরা অগ্রগতির শীর্ষে পৌঁছে যাবে এবং শত্রুদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারবে। তাছাড়া তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ, বীরত্ব প্রদর্শন এবং প্রতিরোধ কৌশলও এর অন্তর্ভুক্ত’ (তাইসীরে সা‘দী, পৃ. ৩২৪)।

গ. সামরিক শক্তির সক্ষমতা অর্জন (Acquiring military capabilites) : ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামরিক সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন। এজন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী একদল প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী আব্যশক। যারা প্রাচীন ও আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে হবেন অভিজ্ঞ এবং দৃঢ়চিত্ত মনোবলের অধিকারী। কেননা ইহুদী-খ্রিষ্টান ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে যখন ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে, তখন তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারে। তাইতো সম্মিলিত কাফির শক্তিকে পদানত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তাঁর ছাহাবীদেরকে সমর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন (ছহীহ মুসলিম, হা/১৯১৭)। একদা সা‘দ ইবনু ‘উবাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, যদি আপনি আমাদেরকে সওয়ারীসহ সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়ব। আর যদি ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্তও আমাদের সওয়ারীকে ছুটিয়ে যেতে আদেশ করেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তা করব। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদেরকে আহ্বান করলেন। তখন সকলেই রওয়ানা হলেন এবং বদর নামক স্থানে উপনীত হলেন’ (মুসলিম, হা/১৭৭৯)।

উল্লেখ্য, সামরিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সামরিক সংখ্যা মূখ্য বিষয় নয়। কেননা পূর্ণ ইখলাছ, প্রদীপ্ত ঈমান ও শাহাদতের তামান্না যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিদ্যমান থাকে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের সাহায্য আসবেই। যেমন বদর প্রান্তে কাফিরদের ১০০০ জন বিরাট স্বশস্ত্র বাহিনীর মোবাবিলায় মাত্র ৩১৩ জন মুসিলম সৈন্য বাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহ বিজয় দান করেন (সূরা আনফাল: ১২-১৩)।

বলা বাহুল্য, ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিসমূহ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা তাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্যই করেছে। তাই মুসলিমদের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী জ্ঞান আহরণের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। জীবনের প্রতিটি শাখায় পাশ্চাত্যের আগ্রাসন থেকে মুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। এমনকি নিজেদেরকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে। জীবন পরিচালনায় সকল জিনিস নিজেদেরকেই প্রস্তুত করতে হবে। যমীনের বুকে লুক্কায়িত খনিজ সম্পদ নিজেদেরকেই উত্তোলন ও তা যথাযথ ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নিজেদের সমুদ্রসীমায় নিজস্ব জাহাজ, নৌ-বহর, যুদ্ধজাহাজ, কামান, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। আমদানির চেয়ে রপ্তানী বেশী করতে হবে এবং পাশ্চাত্য থেকে সকল প্রকার ঋণগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

তাই অভিন্ন শিক্ষা কাঠামো তৈরি, শিল্প-প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামরিক প্রস্তুতির মাধ্যমেই একদিকে যেমন ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে, অন্যদিকে জাগতিক সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে। এটি অর্জন করা যেমন কঠিন, তেমনি পরিশ্রমলব্ধ বিষয়। সুতরাং এর জন্য প্রয়োজন সুশৃঙ্খল ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা-সাধনা, পরিপূর্ণ প্রস্তুতি, ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন, দৃঢ়চিত্ত অবিচলতা এবং কঠোর ও প্রাণান্তকর সাধনা। পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখুন, সর্বোপরি ইসলামকে সামগ্রিক ক্ষেত্রে বিজয় দান করুন- আমীন!




প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ