আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
রচনাবলী
দাওয়াত, সমাজ সংস্কার ও জিহাদের কণ্টকাকীর্ণ ও বাধাসঙ্কুল কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকায় কলমী জিহাদে তিনি ততটা সময় ব্যয় করতে পারেননি। তারপরেও যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছিল অত্যন্ত সারগর্ভ ও সংস্কারধর্মী।[১] জীবনীকার আবুল হাসান ‘আলী নাদভী (রহ.) বলেন, ‘যদি তিনি দরস-তাদরীস ও গ্রন্থ রচনার সুযোগ পেতেন তাহলে সমকালীন অনেক আলেমের চেয়ে অগ্রগণ্য হতেন এবং অনেক বিষয়ে তাঁকে ইমাম বা মুজাদ্দিদের মর্যাদা প্রদান করা হত’।[২] তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী হল- ১. রাদ্দুশ শিরক (আরবী) ২. তাক্বভিয়াতুল ঈমান (উর্দূ), ৩. সালকে নূর, তাওহীদী কবিতা (উর্দূ ও ফারসী) ৩. এক রোযী (উর্দূ)। তাক্বভিয়াতুল ঈমান গ্রন্থ সম্পর্কে ফযলে হক খায়রাবাদী লিখিত সমালোচনার জবাব দিয়ে তিনি একদিনে এই পুস্তক রচনা করে এমন নামকরণ করেছেন। ৪. আবাক্বাত (আরবী), ৫. ছিরাতে মুস্তাক্বীম (প্রথমার্ধ-ফারসী) ৬. ঈযাহুল হাককিছ ছারীহ বিআহকামিল মাইয়িত ওয়ায যারীহ (ফারসী) ৭. উছূলুল ফিকহ (আরবী) ৮. মানছাবে ইমামত (ফারসী) ৯. তানভীরুল আইনাইন ফী ইছবাতি রাফ‘ইল ইয়াদায়েন (আরবী) ১০. মানতেক-এর উপরে একটি পুস্তিকা।[৩]
মনীষীদের মূল্যায়ন
১. শাহ ‘আব্দুল আযীয ‘মুহাদ্দিছ দেহলভী এক পত্রে মাওলানা আব্দুল হাই ও শাহ ইসমাঈলকে ‘তাজুল মুফাসসিরীন’ (মুফাসসিরদের মুকুট), ‘ফাখরুল মুহাদ্দিছীন’ (মুহাদ্দিছদের গর্ব) ও ‘সারআমাদে ওলামায়ে মুহাক্কিক্বীন’ (মুহাক্কিক্ব আলিমদের সর্দার) বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেছেন যে, তাঁদের দু’জনের কেউই তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ, মানতিক প্রভৃতি জ্ঞানে তাঁর চেয়ে কম নন। উভয়কেই তিনি ‘আলেমে রব্বানী’ বলে গণ্য করতেন।[৪]
২. ‘আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وكان كالوزير للإمام يحهز الجيوش ويقتحم فى المعارك العظيمة بنفسه حتى استشهد فى بالاكوت
‘তিনি সাইয়িদ আহমাদ শহীদের জন্য মন্ত্রীর মত ছিলেন। তিনি সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করতেন এবং নিজেই বড় বড় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। অবশেষে তিনি বালাকোটে শহীন হন’।[৫]
৩. ‘আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮ খ্রি.) বলেন,
‘India has hitherto produced only one Moulavi and that is Moulavi Mohammad Ismail’.
‘ভারতবর্ষ এ যাবৎ মাত্র একজন মৌলভীর জন্ম দিয়েছে, তিনি হলেন মৌলভী মুহাম্মাদ ইসমাঈল’।[৬]
৪. আবুল হাসান আলী নাদভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তিনি ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর খান্দানের পবিত্র বৃক্ষের একটি শাখা, শাহ সাহেবের খ্যাতনামা পৌত্র, শাহ ‘আব্দুল গণীর পরকালীন নাজাত ও মাগফিরাতের অছিলা-সন্তান, শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয, শাহ ‘আব্দুল কাদির ও শাহ রফিউদ্দীনের প্রিয়তম ভাতীজা ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শাগরেদ। শুধু তাই নয়, তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কওম ও যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন সে কওম ও সে দেশের গর্বের বস্তু হিসাবে গণ্য হন। তিনি ইসলামের সেইসব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান, দুঃসাহসী ও অসাধারণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত-শত শত বছরেও যাঁদের দু’একজন কদাচিৎ জন্মগ্রহণ করে থাকে’।[৭]
ধর্মীয় সংস্কারে তাঁর অবদান
ধর্মীয় সংস্কারে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অনুরূপ অবদান ছিল, যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) সমকালীন যুগে অবদান রেখেছিলেন। তিনি যেমন মুসলিমদেরকে বিনা দলীলে কোন মুজতাহিদ ইমামের তাক্বলীদ করার বিরুদ্ধে এবং ‘আক্বীদাহ ও ‘আমলের ক্ষেত্রে শুধু কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তেমনি শাহ ইসামঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সময়ে ভারতবর্ষে একই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন।[৮] এজন্যই তো সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণের পর তিনি দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ও শিরক-বিদ‘আতের প্রতিরোধ মিশনে সারা জীবনকে উৎসর্গ করেন।[৯] ভারতবর্ষে ধর্মীয় সংস্কারে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অবদানগুলো নিম্নরূপ:
১. ‘আক্বীদাহ-বিশ্বাসের সংশোধন করা এবং মুসলিম সমাজে প্রচলিত সকল ধরনের শিরককে প্রত্যাখ্যান করা।
২. সকল প্রকার বিদ‘আত ও নতুন সৃষ্টিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, যা প্রথম শতাব্দীতে ছিল না। যেমন তিনি বলেন, ‘আমাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল- তাওহীদকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়া এবং নবীগণের সরদার মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাতের পুনর্জীবন করা’।
৩. শরী‘আতের সকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা, জমাটবদ্ধ তাক্বলীদকে প্রত্যাখ্যান করা এবং তাক্বলীদ ব্যতীত ফক্বীহ মুহাদ্দিছগণের দলীলসহ শরী‘আতের বিধি-বিধান গ্রহণের পদ্ধতিকে সম্প্রসারণ করা।
৪. সৎ ‘আমল ও প্রশংসিত চরিত্রের দিকে দা‘ওয়াতের মাধ্যমে যাবতীয় অপসন্দনীয়, নিকৃষ্ট এবং অশ্লীলতা, যা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদকে প্রকাশ করে, তা থেকে সমাজকে সংস্কার করা।
৫. আল্লাহ তা‘আলার কালেমাকে সুউচ্চ করার জন্য জিহাদের সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করা, যা পূর্ববর্তী যুগ থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে।
৬. ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে করে প্রত্যেক বিভাগে শরী‘আতের বিধানাবলী জারি করা যায়’।[১০]
সংস্কার কার্যক্রমের উক্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়নের জন্য শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) কিছু মাধ্যম গ্রহণ করেছিলেন। যেমন, খুতবাহ, তাদরীস ও মুনাযারা।[১১] নিম্নে তার উক্ত কর্মসূচীগুলো উল্লেখ করা হল:
১. খুত্ববাহ বা বক্তব্য
মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য বক্তৃতা অন্যতম সেরা হাতিয়ার। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বক্তব্য দিয়েই তার চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘঠিয়েছিলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বক্তব্য প্রদানের এক সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বাগ্মী। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যাদুকরী মোহিনী শক্তি নিহিত ছিল। তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শুনে মুসলিমদের মনের দর্পণ স্বচ্ছ ও আলোকদীপ্ত হয়ে উঠত। শত্রুরাও লুকিয়ে তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করত এবং ভূয়সী প্রশংসা করত।[১২] বুধবার ও শুক্রবার দিল্লীর শাহী জামে মসজিদে তিনি ওয়ায-নছীহত করতেন। জুমু‘আর দিনে তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য মানুষের এত উপচেপড়া ভীড় হত, যেমন দুই ঈদের ছালাতে হয়ে থাকে। তিনি খুব সহজ-সরলভাবে তাঁর বক্তব্য জনগণের সামনে পেশ করতেন। আলেম ও সাধারণ মানুষ সবার মনেই তাঁর বক্তব্য সমানভাবে দাগ কাটত।[১৩] সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে জিহাদের সফরে সবসময় শাহ শায়খ আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ) এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বক্তব্য পেশ করতেন।[১৪]
দিল্লীর শাহী জামে মসজিদে পবিত্র রামাযান মাসের শেষ জুমু‘আর ছালাত সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু তখনো মুছল্লীরা স্ব স্ব স্থানেই বসেছিলেন। সেদিন সেখানে বড় বড় আলেম ও বক্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম কাতারে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বসে ছিলেন। সবাই তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তিনি সামনে উঠে গিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। তাওহীদ, শিরক, কবরপূজা, তাযিয়া মিছিল এবং গায়রুল্লাহর জন্য নযর-নিয়ায পেশ করা প্রভৃতি বিষয়ের অবতারণা করে এক সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করলেন। জুমু‘আর ছালাতের পর থেকে আছর ছালাতের সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত বক্তৃতা শ্রোতারা পিনপতন নীরবতার সাথে শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। ঐ সময় শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)ও সেখানে বসা ছিলেন। প্রথমবারের মত তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য শুনে সেদিন সবাই স্তম্ভিত হয়েছিল। বিদ‘আতীদের অন্তর্দহন বেড়ে গিয়েছিল।[১৫]
একবার তিনি দিল্লীর মাদরাসা রহীমিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় কিছু সুসজ্জিত যুবতীকে বিনা পর্দায় কোথাও যেতে দেখলেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারলেন যে, এরা পতিতা। তিনি বললেন, এরা আমাদের মুসলিম বোন। এদেরকে নছীহত না করলে আল্লাহ আমাকে পরকালে জিজ্ঞেস করবেন, ওদেরকে পাপাচারে লিপ্ত দেখে তুমি কেন নছীহত করনি। একথা বলে তিনি পতিতা পল্লীতে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন। বন্ধুরা তাঁকে সেখানে যেতে চরমভাবে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি সবার নিষেধকে উপেক্ষা করে রাতের বেলায় ফক্বীরের বেশে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়েন। একজন পতিতা এসে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি ফক্বীর। আমি তোমাদের গান শুনাব ও তামাশা দেখাব। সে তাঁকে ভিতরে নিয়ে যায়। তিনি জানতে পারেন যে, পতিতা সর্দারণী বালাখানায় আগত লোকদের সাথে নববর্ষ উদযাপন করছে ও তাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত আছে। তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। ছদ্মবেশে থাকলেও দিল্লীর এই মুকুটহীন সম্রাটকে সে চিনে ফেলে এবং স্বসম্মানে চেয়ারে বসতে দেয়। অন্য মহিলারা বিছানায় বসে পড়ে। তিনি পকেট থেকে ছোট্ট কুরআন শরীফ বের করে পড়তে শুরু করেন। এরপর দুনিয়াবী ভোগ-বিলাসের ক্ষণস্থায়িত্ব, কবরের আযাব, ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা, ব্যভিচারের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে এমন তেজোদীপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন যে, চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে যায়। তাদেরকে তওবার কথা বলে সান্ত¦না দিয়ে বিবাহের ফযীলত বর্ণনা করেন। তাঁর বক্তব্যের ফলে ২৯ জন যুবতী পতিতা বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং বয়ষ্ক পতিতারা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কথিত আছে যে, পরবর্তীতে ঐ পতিতালয়ের সর্দারণী কোহেস্তানে গাযীদের ঘোড়ার জন্য দানা পিষত।[১৬]
একবার বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ তাঁকে শাহী দরবারে তলব করেন। তিনি দরবারে গিয়ে বাদশাহর হাতে সোনার আংটি দেখে তাঁকে উপদেশের স্বরে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরুষদের জন্য সোনা ব্যবহার হারাম ঘোষণা করেছেন। তাঁর কথা শুনে বাদশাহ আংটি খুলে ফেলে মানতের জন্য পেশ করেন। কিন্তু শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) তার মূল্য মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার জন্য বলেন। এভাবে তাঁর ওয়ায-নছীহতে বহু লোক শিরক-বিদ‘আত ও হারাম বর্জন করে হেদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। জীবনীকার মিরযা হায়রাত দেহলভী লিখেছেন, ‘এমন কোনদিন অতিবাহিত হত না যেদিন তাঁর বক্তৃতা শুনে ৫/১০ জন হিন্দু মুসলিম হত না ও ডজন ডজন বিদ‘আতী তওবা করত না’।[১৭]
তাঁর বক্তব্যে এতই গভীরতা ছিল যে, আলিম ও সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁর বক্তব্য থেকে সমানভাবে উপকৃত হত। তাঁর ওয়াজ ও নছীহতের বরকতে সুন্নাহর সত্য ধ্বনি প্রত্যেক মানুষের কানে পৌঁছে যায়, শিরক-বিদ‘আতের বুনিয়াদ ধসে পড়ে, মানুষ সুন্নাতে নববী গ্রহণ ও বিদ‘আত পরিত্যাগের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়। তাঁর বক্তব্যে বহু সংখ্যক মানুষ হেদায়াত লাভ করে।[১৮]
২. তাদরীস তথা পাঠদান
কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদরীস বা পাঠদান কর্মসূচী অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই শাহ ইসমাঈল শহীদও (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের জন্য পাঠদান কর্মসূচীকে গ্রহণ করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্য থেকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যারা ‘ইলম, সচ্চরিত্র ও দা‘ওয়াত বিভিন্ন দেশে ও দেশের অধিবাসীদের নিকট উপস্থাপন করেছেন।[১৯] তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই দারস প্রদান করতেন। যেমন জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেও তিনি সকল মুজাহিদের আত্মোন্নয়ন ও ‘ইলমে হাদীছের প্রতি আগ্রহান্বিত করার জন্য প্রতিদিন আছরের পরে ‘মিশকাতুল মাছাবীহ’-এর দারস প্রদান করতেন।[২০] হজ্জের সফরে মক্কা মুকাররমায় গিয়েও তিনি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’র দারস দিতেন।[২১]
৩. মুনাযারা বা তর্ক-বিতর্ক
শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বাধ্য হয়ে অসংখ্যবার মুনাযারা করতে হয়েছে। একবার শী‘আ মতবাদের জনৈক বড় মুজতাহিদের সাথে শী‘আদের ‘তাক্বিয়াহ’ নীতির উপরে একটি মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। ‘নিফাক্ব ও তাক্বিয়্যাহ সমান। উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই’ কথাটি তিনি তাদেরকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন।[২২] ‘তাক্বভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থটি রচনার পর এর প্রভাবে দিল্লীর আলিমগণের সাথে প্রচলিত শিরক-বিদ‘আত যেমন কবরে চুম্বন করা ইত্যাদির ব্যাপারে একটি মুনাযারা হয়েছিল।[২৩] তিনি এই কর্মসূচীর মাধ্যমে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাহ আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে দিল্লীর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় তাওহীদ সম্প্রসারণে ও সমাজ সংস্কারে বেশ অবদান রাখেন।[২৪]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৭০।
[২]. সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃ. ৩৭৪।
[৩]. ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৭২-৮৪; নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৯১৫; ইসলামী বিশ্বকোষ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৫।
[৪]. আবুল হাসান আলী নদভী, সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (লাক্ষ্ণৌ : নামী প্রেস, মার্চ ১৯৩৯ খ্রি.), পৃ. ৩৬৫; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৫৮।
[৫]. নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৯১৪।
[৬]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃ. ২৫৮।
[৭]. সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃ. ৩৭৩।
[৮]. ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৭২-৮৪; নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৯১৫; ইসলামী বিশ্বকোষ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৫।
[৯]. মাসঊদ আলম আন-নাদভী, মাওলানা ‘উবাইদুল্লাহ সিন্ধী কে আফকার ওয়া খিয়ালাত বার এক নাযর (লাহোর : দারুদ দা‘ওয়াতিস সালাফিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৬ হি.), পৃ. ২০-২১।
[১০] ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৯৭-৯৮; তাযকিরায়ে শহীদ, পৃ. ১৬-৪২ ও ১৪২; আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত, পৃ. ২৬।
[১১] ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৯৯।
[১২] হায়াতে তাইয়েবা, পৃ. ৩৮।
[১৩]. ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ১০০।
[১৪]. আবুল হাসান আন-নদভী, সীরাতু সাইয়েদ আহমাদ শাহীদ, ১ম খণ্ড (লাক্ষ্মৌ : মাজলিসু তাহক্বীক্বাত ওয়া নাশরিয়াত ইসলাম, ৩য় সংস্করণ, ১৩২৭ হি.), পৃ. ৩০৮।
[১৫]. তারাজিমে ‘উলামাই হাদীছ হিন্দ (লায়ালপুর-পাকিস্তান : জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯১ হি./১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ৯৫-৯৬।
[১৬]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭-৯৮।
[১৭]. হায়াতে তাইয়িবা, পৃ. ১৪১।
[১৮]. হায়াতে তাইয়েবা, পৃ. ৩৮; জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১০০; ইসলামী বিশ্বকোষ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৩।
[১৯] জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১০১।
[২০] সীরাতু সাইয়েদ আহমাদ শাহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
[২১] মুহাম্মাদ আকরাম, মাউয কুটার (দিল্লী : তাজ কোম্পানী, ১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ২৩।
[২২] তাযকিরায়ে শহীদ, পৃ. ১২০।
[২৩] জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১০১।
[২৪] গোলাম রসূল মেহের, সারগুযাস্তে মুজাহিদীন (লাহোর : শায়খ গোলাম আলী, তা.বি.), পৃ. ১২৯।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মনীষীদের জীবনী