বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১০ অপরাহ্ন

ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনকর্ম

-আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*


ভূমিকা
শরী‘আতের উৎসগ্রন্থ হিসাবে পবিত্র কুরআনের পরই হাদীছের স্থান। হিজরী তৃতীয় শতকে ‘ইলমে হাদীছ’ পূর্বাপেক্ষাও অধিক সমৃদ্ধি লাভ করে। মুসলিম জাহানের প্রায় সব বড় শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র হাদীছের ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদান চলতে থাকে। মক্কা-মদীনা, কূফা-বছরা, সিরিয়া, বাগদাদ, দামেশক প্রভৃতি শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ হয়ে উঠে। হিজরী তৃতীয় শতকে যে সকল হাদীছবেত্তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে হাদীছশাস্ত্র উৎকর্ষতা লাভ করে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন তাদের অন্যতম। তাঁর দারসের মাজলিসে লক্ষাধিক জ্ঞান পিপাসু ছাত্রের সমাগম ঘটত। এই সময়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেন জগদ্বিখ্যাত হাদীছ গ্রন্থ ‘জামি‘উছ ছহীহ’। মূলত এই গ্রন্থ সংকলনের মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীসমূহ বিশুদ্ধ ও নির্ভেজালভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। এই গ্রন্থকে পবিত্র কুরআনের পর সর্বাপেক্ষা মর্যাদা দেয়া হয়। আমরা বক্ষমান গবেষণায় ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনকর্ম নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী নিবন্ধ তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ!

নাম ও বংশ পরিচয়
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আসল নাম- মুহাম্মাদ। উপনাম- আবু ‘আব্দিল্লাহ। উপাধি- আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ। বংশধারা- মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবা। নিসবাত- আল-জু‘ফী আল-ইয়ামানী আল-বুখারী।[১] তাঁর পিতা ইসমাঈল ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ। তিনি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন। তিনি অত্যন্ত নির্মল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আহমাদ ইবনু আবূ হাফছ বলেন, আমি ইসমাঈলের মৃত্যুর সময় তাঁর নিকট উপস্থিত হলে, তিনি বলেন, ‘আমার সমুদয় সম্পদে আমার জানামতে একটি দিরহামও সন্দেহজনক নেই’।[২] তাঁর দাদা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে প্রপিতা বারদিযবাহ ছিলেন একজন অগ্নিউপাসক। পারস্য বিজয়ের সময় তিনি মুসলিমদের হাতে বন্দী হন এবং ইমাম বুখারীর দাদা মুগীরা বুখারার তৎকালীন গভর্ণর ইয়ামান আল-জু‘ফীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার দিকে সম্বন্ধ করে তাকে জু‘ফী বলে সম্বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-কেও তার দাদার দিকে সম্বোধন করে জু‘ফী বলা হয়।[৩] বুখারা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম এক শহর। খ্রিষ্টাব্দ ৮ম শতকে কুতায়বা বিন মুসলিম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর হাতে এই শহর বিজিত হয়। ১২২৯ সালে চেঙ্গিস খান এই শহরটি ধূলায় মিশিয়ে দেয়। এটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত শহর ছিল। বর্তমানে এটি স্বাধীন উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি শহর।[৪]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আব্বাসীয় খলীফা আল-আমীন-এর শাসনামলে ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল শুক্রবারের দিন জুমু‘আর ছালাতের পর জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম বুখারীর জন্ম তারিখ বিষয়ে ইমাম ইবনু আদী (রাহিমাহুল্লাহ) হাসান বিন হুসাইন থেকে বর্ণনা করেন,

.ولد محمَّد بن إسماعيل البخاريُّ رحمه الله يوم الجمعة بعد صلاة الجمعة لثلاث عشرة خلت من شوال سنة أربع وتسعين ومئة

‘মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল শুক্রবারের দিন জুমু‘আর ছালাতের পর জন্মগ্রহণ করেন’।[৫] ইবনু আবি হাতিম আল-ওয়াররাক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমাকে আবু আমর মুস্তানীর ইবনু আতীক্ব বলেছেন, আমি ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কখন জন্মগ্রহণ করেছেন? তিনি তার পিতার লিখিত একটি পত্র বের করলেন, যাতে লেখা ছিল, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার দিন জুম‘আর ছালাতের পর জন্ম গ্রহণ করে’।[৬] ইমাম বুখারীর এই জন্ম তারিখের উপর সকলের ঐকমত্য রয়েছে মর্মে ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যায় মন্তব্য করেছেন।[৭]

শৈশবকাল ও জ্ঞানার্জন
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর শৈশবকালেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এ সম্পর্কে ইবনু ফযল আল-বালখী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

ذهبَتْ عينَا مُحَمَّدِ بنِ إِسْمَاعِيْلَ فِيْ صِغَرِهِ فَرَأَتْ وَالِدتُهُ فِي الْمَنَامِ إِبْرَاهِيْمَ الخَلِيْلَ عَلَيْهِ السَّلّام فَقَالَ لَهَا يَا هَذِهِ قَدْ رَدَّ اللهُ عَلَى ابْنِكِ بصرَهُ لكَثْرَةِ بُكَائِكِ أَوْ كَثْرَةِ دُعَائِكِ

‘মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শৈশবকালে তার দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল। একদিন তার মাতা স্বপ্নে দেখলেন যে, নবী ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তাকে বলছেন, ‘ওহে! মহান আল্লাহ তোমার অত্যধিক ক্রন্দনের বা দু‘আর কারণে তোমার সন্তানের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন’।[৮]
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আহমাদ ইবনু ইউসুফ আস-সুলামী বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারীকে (রাহিমাহুল্লাহ) মালেক ইবনু ইসমাঈল-এর মজলিসে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখেছি। আমি তাকে বললাম, কেন তুমি কাঁদছো? তিনি বললেন, আমার দ্বারা লেখা ও স্মরণ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ অন্ধ হয়ে গেছি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈলকে সুস্থ করে দেন, যেমনটা তোমরা এখন দেখছো’।[৯]
শৈশবেই তিনি পিতাহারা হন। এরপরে তিনি স্বীয় পূণ্যবতী মায়ের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন এবং শিক্ষাজীবনের হাতেখড়িও মায়ের হাতেই হয়। ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

وَمَاتَ أَبُوهُ وَهُوَ صَغِيرٌ فَنَشَأَ فِي حِجْرِ أُمِّهِ فَأَلْهَمَهُ اللَّهُ حِفْظَ الْحَدِيثِ وَهُوَ فِي الْمَكْتَبِ، وَقَرَأَ الْكُتُبَ الْمَشْهُورَةَ وَهُوَ ابْنُ سِتَّ عَشْرَةَ سَنَةً حَتَّى قِيلَ إِنَّهُ كَانَ يَحْفَظُ وَهُوَ صَبِيٌّ سَبْعِينَ أَلْفَ حَدِيثٍ سَرْدًا

‘ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শৈশবকালেই তাঁর পিতা মারা যান। অতঃপর তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি লালিত পালিত হন। তিনি মকতবে পড়াকালীন আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরে হাদীছ মুখস্থের ইচ্ছা জাগ্রত করেন। তিনি দশ বছরের বালক থাকাবস্থায় প্রসিদ্ধ হাদীছের গ্রন্থগুলো পড়া শেষ করেন। এমনকি বলা হয়ে থাকে, তিনি সাত বছরের বালক থাকাবস্থায় ধারাবাহিকভাবে সাত হাজার হাদীছ মুখস্থ করেন’।[১০]

ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর স্মরণ শক্তির প্রখরতা
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রখর স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। এক্ষেত্রে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শৈশবের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ একটি ঘটনা উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। ঘটনাটি ‘তারিখে দিমাশক’ গ্রন্থের মধ্যে ইবনুল আসাকির নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন, ‘ইবনু আবি হাতিম আল-ওয়াররাক আন-নাহবী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বললাম, আপনার হাদীছ সংগ্রহের সূচনা কেমন ছিল? তিনি বললেন, ‘আমি মক্তবে থাকাবস্থায় আমার অন্তরে হাদীছ মুখস্থ করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আমি (ওয়াররাক্ব) তাকে বললাম, তখন আপনার বয়স কত ছিল? জবাবে তিনি বললেন, দশ বছর বা তার চেয়েও কম’ অতঃপর দশ বছর বয়সের পর দাখিলী ও অন্যান্য ওস্তাযদের কাছে হাদীছ শিক্ষার্জনের জন্য গমনাগমন শুরু করি। একদিন শায়খ দাখিলী (রাহিমাহুল্লাহ) জনগণের সামনে পড়াতে গিয়ে বললেন, সুফিয়ান আবু-যুবায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন, আর তিনি বর্ণনা করেছেন ইবরাহীম থেকে। তখন আমি তাকে বললাম, হে উমুকের পিতা! নিশ্চয় আবুয-যুবায়ের ইবরাহীম থেকে হাদীছ বর্ণনা করেননি। তখন তিনি আমাকে ধমক দিলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি মূল পাণ্ডুলিপি দেখুন, যদি তা আপনার নিকটে থেকে থাকে? তিনি ঘরে প্রবেশ করে আবার বের হয়ে আসলেন এবং আমাকে বললেন, সনদটা কেমন হবে? আমি বললাম, যুবায়ের ইবনু আদী ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি আমার নিকট থেকে কলম নিলেন এবং নিজের বইয়ে সংশোধন করলেন আর বললেন, তুমি ঠিক বলেছ। এরপর ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কিছু ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন আপনি কত বছর বয়সের বালক ছিলেন? জবাবে ইমাম বুখারী বললেন, ১১ বছরের বালক’।[১১]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘যখন আমি ১৬ বছরে উপনীত হই, তখন আমি ইবনুল মুবারক ও ওকী‘ (রাহিমাহুমাল্লাহ)-এর বই মুখস্থ করে ফেলি। আর আমি এদের মতবাদ সম্পর্কেও সম্যক অবগত হই’।[১২] ইমাম যাহাবী আরো বর্ণনা করেন,

قَالَ مُحَمَّدُ بنُ سَلاَمٍ كُلَّمَا دَخَلَ عليَّ هَذَا الصَّبِيُّ تحيَّرْتُ وَألبسَ عليَّ أَمر الحَدِيْثِ وَغَيْرِهِ وَلاَ أَزَالُ خَائِفاً مَا لَمْ يَخْرُجْ

‘মুহাম্মাদ ইবনু সালাম আল-বায়কান্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখনই এই ছেলে আমার নিকট আসে, তখনই আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আমার কাছে হাদীছ ও অন্যান্য বিষয় উল্টা-পাল্টা হয়ে যায়। আর সে বের না হওয়া পর্যন্ত আমি ভয় পেতে থাকি’।[১৩]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর স্মৃতিশক্তির প্রখারতার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নের ঘটনায় :
মুহাম্মাদ ইবনু আবি হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি সুলাইম ইবনু মুজাহিদকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনু সালাম আল-বায়কান্দীর নিকট ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি যদি কিছু পূর্বে আসতে, তাহলে একজন ছোট বালককে পেতে, যে সত্তর হাজার হাদীছ মুখস্থ করেছে। আমি তখন তার অনুসন্ধানে বের হয়ে তাকে পেয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, তুমিই কি সেই ছেলে, যে বলে, আমি সত্তর হাজার হাদীছ মুখস্থ করেছি। সে বলল, হ্যাঁ, বরং তার চেয়েও বেশী। আর আমি যেসব ছাহাবী ও তাবেঈ থেকে তোমাকে হাদীছ বর্ণনা করব, তাদের অধিকাংশের জন্ম, মৃত্যু ও বাসস্থান সম্পর্কে আমি জানি’।[১৪]
মুহাম্মাদ বিন আযহার আস-সিজিস্তানী বলেন, ‘আমরা সুলায়মান ইবনু হারবের দারসে ছিলাম এবং ইমাম বুখারীও আমাদের সাথে ছিলেন। ইমাম বুখারী শুধু শ্রবণ করতেন, কিন্তু কিছুই লিখতেন না। কোন একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করা হল, কেন সে লিখছে না? সে জবাবে বলল, তিনি বোখারায় ফিরে গিয়ে তার মুখস্থ থেকে লিখবেন’।[১৫]
ইমাম বুখারীর (রাহিমাহুল্লাহ) স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, তিনি দারসে বসে উস্তাদগণের হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন না। শ্রবণ মাত্রই তার মুখস্থ হয়ে যেত। এই বিষয়ে তার সহপাঠী হাশিদ বিন ইসমাঈল বলেন, ‘হাশিদ ইবনু ইসমাঈল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘বাল্যাবস্থায় ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আমাদের সাথে বাছরার শায়খদের কাছে গমন করতো। কিন্তু সে হাদীছ লিখতো না। এভাবে অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমরা এ বিষয়ে তাঁকে বলতাম, তুমি আমাদের সাথে দারসে আস অথচ হাদীছ লিখে রাখনা, তাহলে কি করতে আমাদের সাথে আস? অতঃপর এভাবে ১৬ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সে আমাদের বলল, তোমরা বিষয়টি নিয়ে খুব বেশী বাড়াবাড়ি করছো, খুব বেশি সমালোচনা করছো। তোমরা যা লিখেছ, তা বের কর! আমরা ১৫ হাজারের বেশী হাদীছ তার উদ্দেশ্যে বের করলাম। তখন সকল হাদীছ সে আমাদের মুখস্থ শুনাল, এমনকি আমরা তার মুখস্থ থেকে আমাদের লেখার ভুল-ত্রুটিগুলো ঠিক করতে লাগলাম’ অতঃপর সে বলল, তোমরা কি মনে করছো আমি এখানে বৃথা এসে সময় নষ্ট করছি? আমরা বুঝতে পারলাম, ইলমে হাদীছে তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।[১৬]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর প্রখর স্মৃতিশক্তির আরো প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনু আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণিত নিম্নের ঘটনায়।
আবূ আহমাদ ইবনু আদী স্বীয় ‘আসামী’ গন্থে বলেন, আমি একাধিক শাইখকে বর্ণনা করতে শুনেছি, তারা বলেছেন, ‘ইমাম বুখারী যখন বাগদাদে গমন করলেন, তখন বাগদাদের মুহাদ্দিছগণ একত্রিত হয়ে ১০০টি ছহীহ হাদীছ নির্বাচন করে তার সনদ ও মতন ওলট-পালট করে দিলেন। এক হাদীছের সনদ আরেক হাদীছের মূল টেক্সটের সাথে যুক্ত করলেন। আর এক হাদীছের মূল টেক্সটকে অন্য হাদীছের সনদের সাথে যুক্ত করলেন। অতঃপর তারা দশজন মুহাদ্দিছ ঠিক করে তাদের প্রত্যেককে দশটি করে হাদীছ ভাগ করে দিলেন। ইমাম বুখারীর জন্য হাদীছের মজলিস স্থাপন করা হল। তিনি যখন উপস্থিত হলেন, তখন প্রথমে একজন মুহাদ্দিছ ১০টি হাদীছ নিয়ে ইমাম বুখারীর (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সামনে একটি একটি করে সবগুলো হাদীছ পাঠ করলেন। প্রতিটি হাদীছ পাঠ শেষে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, لاأعرفه ‘এ ধরনের কোন হাদীছ আমার জানা নেই’। এমনিভাবে ১০ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ১০০টি হাদীছ তাঁর সামনে পাঠ করলেন। সকল হাদীছের ক্ষেত্রে তিনি বার বার একই কথা বললেন। সকলের হাদীছ শুনানো শেষ হওয়ার পর ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রথমজনকে ডাকলেন। তিনি যেভাবে হাদীছ শুনিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে তাকে শুনালেন এবং সেই হাদীছের সঠিক রূপটিও শুনালেন। এভাবে প্রত্যেককে তার হাদীছের ভুল সংশোধন করে দিলেন। অতঃপর বাগদাদবাসী ইমাম বুখারীর জ্ঞান ও সম্মানের স্বীকৃতি দিল’।[১৭]
মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি ‘কিতাবুত তারীখ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যখন আমি আঠারো বছর বয়সে উপনীত হলাম, তখন ছাহাবী ও তাবেঈগণের ফযীলত এবং তাদের ফৎওয়ার উপর লিখতে শুরু করলাম। আর আমি চাঁদনী রাতে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবরের পাশে ‘তারীখ’ গ্রন্থটি লিখেছি’।[১৮] নিম্নের ঘটনায় এই ‘কিতাবুত তারীখ’ গ্রন্থের গুরুত্ব ফুটে উঠে।
ইবনু আবি হাতিম আল-ওয়াররাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈলকে বলতে শুনেছি, ‘ইমাম ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ আমার লিখিত গ্রন্থটি নিলেন এবং মুগ্ধ হয়ে গ্রন্থটি সাথে করে নিয়ে আমীর ইবনু ত্বাহিরের নিকটে গেলেন এবং বললেন, ‘হে আমীর! আমি কি আপনাকে যাদু দেখাব? তখন আমীর আব্দুল্লাহ ইবনু ত্বাহির ইমাম বুখারীর লিখিত ‘তারীখ’ দেখে মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, আমি তার লেখা উপলব্ধি করতে সক্ষম নই’।[১৯]

হাদীছ সংগ্রহের জন্য দেশ ভ্রমণ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) ১৬ বছর বয়সে তার মা ও ভাইয়ের সাথে হজ্জ সফরে বের হন। হজ্জ সম্পন্ন করে তার মা ও ভাই দেশে ফিরে চলে আসেন এবং তিনি মক্কায় থেকে ওলামায়ে কেরামের নিকট থেকে ইলম হাছিল করা শুরু করেন। মক্কা থেকে মদীনায় আসেন। সেখানেও ইলম হাছিল করেন। এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

فَلَمَّا طَعَنْتُ فِي سِتَّ عَشْرَةَ سَنَةً كُنْتُ قَدْ حفظتُ كتبَ ابْنِ المُبَارَكِ وَوَكِيْعٍ وَعرفتُ كَلاَمَ هَؤُلاَءِ، ثُمَّ خرجْتُ مَعَ أُمِّيْ وَأَخِيْ أَحْمَدَ إِلَى مَكَّةَ فَلَمَّا حَجَجْتُ رَجَعَ أَخِيْ بِهَا! وَتخلَّفْتُ فِيْ طَلَبِ الحَدِيْثِ

‘আমার বয়স যখন ষোলতে পরে, তখন আমি ইবনুল মুবারাক, ওয়াকিঈ (রাহিমাহুমাল্লাহ)-এর (হাদীছের) সকল গ্রন্থ হিফয করা ও তাদের বক্তব্য অবগত হওয়া শেষ করি। অতঃপর আমার মা, ভাই আহমাদ এবং আমি এক সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। যখন আমরা হজ্জ সম্পন্ন করলাম, তখন আমার মাকে নিয়ে আমার ভাই ফিরে আসলেন। আর আমি ইলম হাছিলের উদ্দেশ্যে মক্কাতে থেকে গেলাম’।[২০]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বিভিন্ন শহরের সফর সম্পর্কে আরো বলেন,

لَقِيْتُ أَكْثَرَ مِنْ أَلفِ رَجُلٍ أَهْلِ الحِجَازِ وَالعِرَاقِ وَالشَّامِ وَمِصْرَ لَقِيتُهُم كَرَّاتٍ أَهْلِ الشَّامِ وَمِصْرَ وَالجَزِيْرَةِ مرَّتينِ وَأَهْلِ البَصْرَةِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ وَبَالحِجَازِ سِتَّة أَعْوَامٍ وَلَا أُحْصِيْ كم دَخَلْتُ الكُوْفَةَ وَبَغْدَادَ

‘আমি মক্কা, মদীনা, ইরাক্ব, সিরিয়া ও মিশরের এক হাজারেরও বেশী শায়খের সাথে বহুবার সাক্ষাৎ করেছি। আমি সিরিয়া, মিশর ও আল-জাযীরার শায়খগণের সাথে ২ বার এবং বাছরার শায়খগণের সাথে ৪ বার মুলাকাত করেছি। মক্কা-মদীনায় ছয় বছর অবস্থান করেছি। আর আমি কত বার যে কূফা ও বাগদাদে প্রবেশ করেছি, তার হিসাবই রাখি না’।[২১] আল্লামা খতীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইলমে হাদীছের সন্ধানে সকল শহরের প্রত্যেক মুহাদ্দিসের নিকট তিনি গমন করেন। তিনি হাদীছ লিখার জন্য খুরাসান, জিবাল, ইরাকের সকল শহর, হিজায, শাম ও মিসরে গমন করেন’।[২২]

[ইনশাআল্লাহ চলবে]

*এম.এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র

[১] মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ আবু যাহ্উ, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছুন (রিয়ায : ইদারাতুল বুহূছিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইনশা ওয়াদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪/১৯৮৪), পৃ. ৩৫৩।
[২] ইবনু তাক্বীউদ্দীন আস-সুবকী, তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যাহ, ২য় খণ্ড (২য় সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), পৃ. ২১৩।
[৩] ইবনু আসাকির, তারিখে মাদীনাতুত দিমাশক, ৫২ তম খণ্ড (বৈরূত দারুল ফিকর, ১৯৯৫), পৃ. ৫৩।
[৪] উইকিপিডিয়া দ্র. ।
[৫] ইবনু আদী আল-জুরজানী, আসামী মান রাওয়া আনহুম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী (বৈরুত : দারুল বাশাইর আল-ইসলামিয়্যাহ, ১৯৯৪), পৃ. ৪৯।
[৬] ইবনু আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৫২ তম খণ্ড, পৃ. ৫৫।
[৭] ইমাম আল-আজুলুনী আদ-দিমাশক্বী, আল-ফাওয়ায়েদুদ দারারী (সিরিয়া : দারুন নাওয়াদির, ১ম প্রকাশ, ২০১০), পৃ. ৩৭।
[৮] ইবুন আসাকির, তারীখে দিমাশক, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৫৬; ইমাম যাহাবী, সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড (আর-রিসালাহ প্রকাশনী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৫), পৃ. ৩৯৩।
[৯] ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাগলীকুত তা‘লীক্ব ‘আলা ছহীহিল বুখারী, ৫ম খণ্ড (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৫ হি.), পৃ. ৩৮৮ ।
[১০] ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১১তম খণ্ড (দারুল ফিকর, ১৯৮৬), পৃ. ২৫।
[১১] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৩৯৩; ইবনু আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৫৭; খতীব বাগদাদী, তারিখে বাগদাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৪।
[১২] খতীব বাগদাদী, তারিখে বাগদাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৫।
[১৩] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২ তম খণ্ড, পৃ. ৪১৭; ত্ববাকাতুশ শাফিঈয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২২।
[১৪] ইবনু আব্দিল মালিক আল-কাসতাল্লানী, ইরশাদুস সারী, ১ম খণ্ড, (মিসর : মাতবা‘আতুল কুবরা আল-আমীরিয়্যাহ, ৭ম সংস্করণ, ১৩২৩ হি.), পৃ. ৩৪।
[১৫] ইবনু হাজার ‘আসকালানী, হাদইউস সারী লি মুকাদ্দামাতি ফাৎহিল বারী, ১ম খণ্ড (দিমাশক্ব : রিসালাতুল ‘আলামিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ: ২০১৩) পৃ. ৪৭৮।
[১৬] আল্লামা খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ২য় খণ্ড ( বৈরূত : দারুল গারব আল-ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ২০০১), পৃ. ৩৩৪; ইবনু আসাকির, তারিখে দিমাশক্ব, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৬১; ইমাম যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ২য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবুল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃ. ১০৪; তারীখুল ইসলাম ১৯তম খণ্ড, পৃ. ২৪৪।
[১৭] আসামী মান রাওয়া আনহুম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী, পৃ. ৫২; তারীখে বাগদাদ ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪০; ইবনু আসকীর, তারিখে দিমাশক, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৬৬; আল্লামা মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ফী আসমাঈর রিজাল, ২৪তম খণ্ড (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮০), পৃ. ৪৫৩।
[১৮] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৩৯৩; তাহযীবুল কামাল, ২৪তম খণ্ড, পৃ. ৪৩৯; তারীখে বাগদাদ ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২২।
[১৯] খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৬।
[২০] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২ তম খণ্ড, পৃ. ৩৯৩; তারীখে দিমাশক্ব, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৫৭।
[২১] তারীখে দিমাশক্ব, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৫৮; সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪০৭, তাগলীকুত তা‘লীক্ব, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮।
[২২] ইবনু আসাকির, তারীখে দিমাশক্ব, ৫২তম খণ্ড, পৃ. ৫৮; সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪০৭, তাগলীকুত তা‘লীক্ব, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮।





প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
সৈয়দ নাযীর হুসাইন দেহলভী - প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (২য় কিস্তি ) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ