আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
(৪র্থ কিস্তি)
সংস্কারসমূহ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সমসাময়িক যুগের সার্বিক প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত নাযুক। মুসলিমরা শিরক-বিদ‘আতে ডুবে ছিল, আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, হিন্দুয়ানী প্রথা-বিশ্বাস বিস্তৃতি লাভ করেছিল, শী‘আদের রীতি-নীতিও সমাজে অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। মোটকথা তৎকালীন মুসলিমদের জীবনে শিরক-বিদ‘আত, অপচয় ও মূর্খতা একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল। সে সময় সুন্নাহ ও শরী‘আত বইয়ের পাতায় বন্দি ছিল। অসংখ্য হারাম বিষয়কে হালালে পরিণত করা হয়েছিল এবং অসংখ্য হালাল বিষয়কে হারামে পরিণত করা হয়েছিল। ইসলামের পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্নসমূহ উঠে যাচ্ছিল। ইসলামের বহু বিধান বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আল-কুরআন যেন একটি হেয়ালী গ্রন্থ ছিল, যা কেউ বুঝতে পারত না।[১] এমনকি ইসলামের অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক বিষয়াবলী এবং ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে গাফলতি দেখান হত। স¤্রাট আলমগীরের ১৯তম সিংহাসন আরোহণ (১০৮৭ হি.) উপলক্ষে অনুষ্ঠিত জলূসের ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক আলিম মীর সাইয়েদ ‘আব্দুল জলীল বলগ্রামীর পুত্র মীর সাইয়েদ মুহাম্মাদ আপন লিখেছেন যে, ‘২৭ শা‘বান তারিখে একজন ভিস্তিওয়ালা জামে মসজিদের সিঁড়ির উপর উঠে বাদশাহকে ‘সালামু আলাইকা’ বলে অভিবাদন জানাল। তখন (বাদশার পক্ষ থেকে উত্তর প্রদানের পরিবর্তে) নির্দেশ ঘোষিত হল, একে পুলিশের হাওয়ালা কর’।[২] উক্ত ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) জোরালোভাবে সংস্কার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। চেষ্টা করেন সকল প্রকার অসংগতি থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাযত করার। নিম্নে তার ধর্মীয় সংস্কারসমূহের চুম্বকাংশ উল্লেখ করা হল :
১. আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার প্রতি আহ্বান
চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী সংবিধান হল আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে এর বিধান গ্রহণ করা অপরিহার্য। সকল ক্ষেত্রে এতদুভয়ের সিদ্ধান্ত নিঃশর্তে মেনে নেয়া ও অকপটে গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলিমের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অথচ মুসলিমরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ বাপ-দাদার পথের অন্ধ অনুসরণ করছে এবং দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার মত একে মযবুত করে ধরে থাকছে। তাদের মধ্যে কেউ পূর্ববর্তী বুজুর্গ ব্যক্তিদের পথ ও পদ্ধতি থেকে দলীল গ্রহণ করছে। কেউ আবার আলিমদের নিজস্ব কথাকে সনদ হিসাবে পেশ করছে। যারা শুদ্ধভাষী ও অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, তাদের মধ্যে কেউ নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে প্রয়োগ করছে এবং সে অনুপাতে চলছে’। তিনি একটু পরেই এর সমাধান হিসাবে আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে নিঃশর্তভাবে আঁকড়ে ধরার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন,
وكان الأفضل الأعدل أن يرد الإنسان كل ذلك إلى الله ورسوله، فيصدر عما ثبت عنهما، ويتحاكم إليه، ويتخذه بيانًا شافيًا، وحكمًا قاطعا، فيقبل من قصص المشايخ والصالحين، ومن كلام العلماء والوعاظ والمذكرين، ما وافق الأصول والنصوص، وينبذ من الكلام والأحاديث ومن العادات والتقاليد ما خالفها
‘সবচেয়ে উত্তম ন্যায়পরায়ণতা হল, মানুষ তার প্রতিটি বিষয় মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর দিকে ন্যস্ত করবে। সেখান থেকে যা সাব্যস্ত রয়েছে, তা বর্ণনা করবে। ফায়ছালা একমাত্র তাঁর দিকেই ন্যস্ত করবে, তাকে স্বচ্ছ বর্ণনা ও অকাট্য বিধান হিসাবে গ্রহণ করবে। সৎ ব্যক্তি ও মাশায়েখ, আলেম, আলোচক ও উপদেশদাতাদের যে মাসআলা ও রীতিনীতি কুরআন ও হাদীছের মূলনীতির সাথে মিলে যাবে, তা মেনে নেবে এবং এ দু’য়ের পরিপন্থী বিষয়গুলো পরিত্যাগ করবে’।[৩]
শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা এবং এতদুভয়ের বিরোধী সকল কিছুকে পরিত্যাগ করার দিকে মানুষকে সর্বদা জোরালোভাবে আহ্বান করেছেন। তিনি তাঁর অনবদ্য রচনা ‘রাদ্দুশ শিরক’ গ্রন্থ ‘সুন্নাহ অনুসরণ করা এবং বিদ‘আতকে পরিত্যাগ করা’ মর্মে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এবং উক্ত অনুচ্ছেদের অধীনে আল-কুরআন ও হাদীছ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, বিদ‘আতী ফের্কা ও তাদের ইস্তিম্বাতকৃত সকল নতুন বিধান নিষিদ্ধ। অতঃপর তিনি বলেন, ‘সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, ছাহাবী ও তাবি‘ঈদের পথের অনুসরণ করা মুক্তির কারণ এবং তাদের বিরোধিতা করা ও সালাফদের বিরোধিতা করা ধ্বংসের কারণ’।[৪] তাইতো তিনি দুঃখভরা কণ্ঠে বলেন,
أن القوم قد نبذوا كلام الله وحديث رسوله وراءهم، وسمحوا لعقولهم القاصرة أن تتدخل فيما ليس لها مجال فيه، وتشبثوا بالأساطير والروايات الشائعة التي لا تستند إلى تاريخ ونقل صحيح، واحتجوا بتقاليد خرافية. وعادات جاهلية، ولو كانوا عولوا على كلام الله ورسوله وعنوا بتحقيقه، لعرفوا أنها نفس التأويلات، والحجج التي كان كفار العرب يتمسكون بها في عصر النبي صلى اللَّه عليه وسلم، ويحاجونه بها، ولم يقبلها الله منهم، بل كذبهم فيها
‘লোকেরা মহান আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছকে তাদের পশ্চাৎে ফেলে এসে তাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা এমনভাবে অনাধিকার চর্চা করছে, যার কোনই সুযোগ নেই। তারা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা কিচ্ছা-কাহিনী ও ভ্রান্ত বর্ণনাকে দলীল হিসাবে পেশ করছে। অথচ তা কোন বিশুদ্ধ ইতিহাস বা বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত নয়। তারা এক্ষেত্রে তাক্বলীদের মত কুসংস্কার ও জাহেলিয়াতের স্বভাব-চরিত্র দ্বারা দলীল গ্রহণ করে। কিন্তু যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কিতাবের উপর নির্ভর করত এবং এর হাক্বীক্বত বুঝার চেষ্টা করত, তাহলে অবশ্যই জানতে পারত যে, এ সকল কিছু মনগড়া ব্যাখ্যা। আরবের কাফেররাও রাসূল (ﷺ)-এর যুগে এ ধরনের প্রমাণই পেশ করত এবং তা আঁকড়ে ধরে থাকত, কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের পক্ষ থেকে এসব কথা গ্রহণ করেননি বরং তাদেরকে মিথ্যুক আখ্যা দিয়েছেন’।[৫]
তিনি তাক্বলীদের অসারতা প্রমাণ করে আরো শক্ত করে বলেন যে, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন হুকুমদাতা। তাঁর বিধান মেনে চলা ওয়াজিব, অন্যের বিধান নয়। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিধান মেনে নেয়া হল আল্লাহর বিধানকে মেনে নেয়া। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং বিধানদাতা নন। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশিত না হয়ে তিনি কোন কথা বলতেন না। এমতাবস্থায় তাহলে কিভাবে একজন মুজতাহিদ, ফক্বীহ, মৌলভী, মুফতী, কাযী, ছাত্র, গাউছ, কুতুব, অলী, শায়খ, শহীদ, শায়খের পুত্র, খাদিম, নিকটস্থ কেউ এবং মুরীদ কিভাবে সে এই অধিকার পায়? তবে শরী‘আতের কোন অজানা বিষয় আহলে ‘ইলমের নিকট জিজ্ঞেস করা যাবে কিন্তু তাকে শরী‘আতের বিধানদাতা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না’।[৬]
তিনি মানুষকে সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার উপর জোরালোভাবে আহ্বান করতেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হল- তাঁর সকল প্রকার আদেশ ও নিষেধের প্রতি দৃঢ়ভাবে আনুগত্য করা এবং তাঁর কোন কথা, আমল, অভ্যাস ও বিশ্বাসমূহের বিপরীত সকল বিষয়কে পরিত্যাগ করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘আল্লাহর রাসূল ও তাঁর বান্দা’ হিসাবে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ বর্ণনায় শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল গুণাবলীই প্রশংসিত। তিনি সত্যবাদী ও সকল পাপ থেকে নিষ্পাপ। তিনি রিসালাতের আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর প্রত্যেক আদেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত আদেশ। তাঁর সকল নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে আইন। তাই আমাদের উপর কর্তব্য হল- তাঁর সকল বিধানকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করা, তাঁর পথে পরিচালিত হওয়া এবং অন্যান্য সকল পথকে পরিত্যাগ করা। আর যিনি রাসূল নন তিনি মা‘ছূম বা নিষ্পাপও নন। (সুতরাং রাসূলকে বাদ দিয়ে যাকে আদর্শ গণ্য করা হয়) তিনি পাপ ও ভুল করে থাকেন। আর যখনই তিনি কোন পাপ ও ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত হবেন, তখনই তার পথ ও পদ্ধতি সঠিক হবে না। আর তাকে আনুগত্য করাও আমাদের জন্য বৈধ হবে না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এরই কেবল অনুসরণ করতে হবে, তার দেখানো পথে পরিচালিত হবে এবং তাঁরই নির্দেশিত পন্থায় ‘ইবাদত বন্দেগী করতে হবে’।[৭] এমনকি তিনি বলেছেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি দুনিয়াবী কিংবা পরকালীন কোন বিষয়ে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে ন্যায়বিচারক মনে না করে, তাঁর কোন বিধানের ব্যাপারে বিরক্তবোধ বা রাগ করে এবং তার উপর আস্থা রাখতে পারে না, তাহলে সে মুসলিম নয় বরং কাফির ও মুনাফিক’।[৮]
জীবনীকার মিরযা হায়রাত দেলভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আন্তরিক কামনা ছিল যে, মুসলিম যাবতীয় মাযহাবী গোঁড়ামি ভুলে নিরপেক্ষভাবে পূর্ণ উদ্দীপনায় আল-কুরআন ও হাদীছের হুকুম অনুযায়ী জীবন-যাপন করুক।... মুসলিম নিজেকে হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী না বলে বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে সম্বন্ধ করে নিজেকে ‘মুহাম্মাদী’ বলুক। প্রিয় শহীদের অন্যতম কৃতিত্ব এই যে, তিনি লক্ষ লক্ষ মুখ দিয়ে একথা গর্বের সাথে বলাতে পেরেছিলেন যে, ‘আমরা মুহাম্মাদী’।[৯]
এজন্য যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের মধ্যে ডুবে আছে, তার জন্য আল্লাহর কালাম ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর হাদীছ বেশি বেশি বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। অন্যদের চেয়ে এ ব্যাপারে তার বেশি আগ্রহ দেখানো যরূরী। যার গুনাহ ও নিজের উপর যুল্ম বৃদ্ধি পেয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হেদায়াতের শরণাপন্ন হওয়া বেশি যরূরী, যতক্ষণ না তার জীবনটা সংশোধন হয়ে যায় ও নফসকে মুক্ত করে দেয়। তাই নির্বিশেষে প্রত্যেক স্তরের মানুষের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কথা অনুসন্ধান করে তা বুঝা ও নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। আল-কুরআন ও হাদীছের মানদ-ে নিজের ঈমান ও ‘আক্বীদাহ পরিমাপ করা এবং তার হুকুম-আহকামের ছাঁচে ঢেলে ঈমান গঠন করা খুবই যরূরী।[১০]
২. তাওহীদের সম্প্রসারণ ও শিরকের প্রত্যাখ্যান
সমকালীন যুগে ধর্মীয় অবস্থা ছিল অবনতির শেষ পর্যায়ে। তাছাওউফের শিশুসুলভ ধ্যান-ধারণার মাত্রাতিরিক্ত চর্চা ইসলামের মৌলিক রুকন তাওহীদকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মসজিদসমূহ জনমানবহীন অবস্থায় পড়েছিল। মূর্খ ও নিরক্ষর জনসাধারণ এ থেকে দূরে থাকত। তারা তাবীয-তুমার বে-শরা দরবেশদের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছিল। তারা আল্লাহর ‘ইবাদত-বন্দেগী ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণ পীর-বুযুর্গদের মাজার যিয়ারতে নিমগ্ন থাকত এবং ঐ মৃত ব্যক্তিদেরই আল্লাহর বন্ধু, নিজেদের অভিভাবক ও সুপারিশকারী ধরে নিয়ে তাদেরই পূজা করত। ঐসব মূর্খ-জাহেল মনে করত যে, আল্লাহ এমন এক ঊর্ধ্বতন সত্তা, যাকে কোনরূপ মাধ্যম ব্যক্তিরেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তখন কুরআন মাজীদের নৈতিক শিক্ষাকে কেবল পেছনেই ফেলে রাখা হয়নি, বরং তা অমান্যও করা হত। আফিম ও মদের ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। সর্বত্রই ছিল ব্যভিচারের প্রাবল্য। ঘৃণ্যতম কর্মও খোলাখুলি করা হত’।[১১] একইভাবে উক্ত কথার স্বীকৃতি প্রদান করে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখুন! এ যুগে মানুষের মাঝে শিরক প্রসার লাভ করেছে এবং ক্রমেই তা বিস্তৃতি লাভ করছে। একনিষ্ঠ তাওহীদ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। অথচ অধিকাংশ মানুষ শিরকের অর্থ কী তা জানে না। তারা নিজেদের ঈমানের দাবী করে, কিন্তু অজ্ঞাতসারে শিরকের মধ্যে ডুবে আছে। তাই সবকিছুর আগে মানুষের জন্য শিরক ও তাওহীদের মর্মার্থ উপলব্ধি করা যরূরী, যাতে কুরআন ও হাদীছ থেকে তার ভাল-মন্দ পরিচয় লাভ করা যায়’।[১২] উক্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য তিনি নিম্নোক্ত উপায়ে সংস্কারের ঘোষণা দিলেন, যা সে যুগে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় ছিল। তিনি বলেন,
ليعلم أن للإيمان جزأين، لأول الإيمان بالله إلها وربا والثاني الإيمان بالرسول رسولا ونبيا. فالإيمان بالله إلها وربا يعني أن لا يشرك به أحد، والإيمان بالرسول رسولا ونبيا يعني أن لا يسلك طريق غيره، فيجب على كل أحد أن يتمسك بالتوحيد واتباع السنة بقوة وعزم، ويبتعد عن الشرك والبدعة كل الابتعاد، فإن الشرك والبدعة يؤثران في الإيمان، ويحدثان خللا فيه، أما سائر الذنوب والمعاصي فهي تؤثر في الأعمال، وتحدث خللا فيها
‘জেনে রেখ! ঈমানের দু’টি অংশ রয়েছে- প্রথমতঃ ইলাহ ও রব হিসাবে মহান আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস স্থাপন করা। দ্বিতীয়তঃ নবী ও রাসূল হিসাবে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। ইলাহ ও রব হিসাবে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হল- তাঁর সাথে কাউকে শরীক স্থাপন না করা। আর নবী ও রাসূল হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হল- তাঁকে ছেড়ে অন্যের পথে না চলা। তাই প্রত্যেকের উপর আবশ্যক হচ্ছে, দৃঢ় ও মযবুতভাবে তাওহীদ ও ইত্তিবায়ে সুন্নাহকে ধারণ করা। শিরক ও বিদ‘আত থেকে বহু দূরে অবস্থান করা। কেননা শিরক ও বিদ‘আত ঈমানের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও ত্রুটি সৃষ্টি করে। আর যাবতীয় পাপাচার ও অবাধ্যতা আমলের মধ্যে প্রভাব ফেলে এবং তার মধ্যে ঘাটতি তৈরি করে দেয়’।[১৩]
তাওহীদের প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদানের জন্য শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘রিসালাতুত তাওহীদ (তাকভীয়াতুল ঈমান)’ গ্রন্থে ‘তাওহীদপন্থী পাপী ব্যক্তি দ্রুত তওবাহকারী হয়, তাকে আল্লাহর রহমত ও করুণা পেয়ে বসে, যা কোন ‘ইবাদতগুজারী মুশরিকের ক্ষেত্রে ঘটে না’ মর্মে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত হাদীছে কুদসীটি উপস্থাপন করেছেন। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
يَقُوْلُ قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِيْ بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيْتَنِيْ لَا تُشْرِكُ بِيْ شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً
‘মহান আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! যদি তুমি দুনিয়া ভরা পাপ নিয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, আর আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক না কর, তাহলে দুনিয়া ভরা ক্ষমা নিয়ে আমি তোমার নিকট এগিয়ে আসব’।[১৪]
অতঃপর তিনি বলেন, ‘অতএব স্পষ্ট হল যে, পাপ তাওহীদের কাছে নগণ্য। তাওহীদের বরকত পাপীকে আবৃত করে তার সকল পাপ মিটিয়ে দেয়। যেভাবে পাপের যুল্ম সকল নেকীকে ঢেকে দেয়। সকল ‘ইবাদতকে ধ্বংস করে দেয়। তাছাড়া মানুষ যখন শিরক থেকে পাক-পবিত্র থাকবে এবং তার ‘আক্বীদাহ এমন হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মালিক নেই। আল্লাহর অবাধ্য বান্দাকে আশ্রয় দেয়ার কেউ নেই। তাঁর সামনে সবাই অসহায়। কেউ তাঁর নির্দেশ পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। তাঁর বিরুদ্ধে কারো সাহায্য কার্যকরী হতে পারে না এবং তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো জন্য সুপারিশও করতে পারে না। এ ‘আক্বীদাহ পোষণের পর তার দ্বারা যেসব পাপ সংঘটিত হবে, তা কেবল মানবসুলভ দুর্বলতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে। এ পাপের কারণে তার অন্তরে ভীতি সঞ্চার হবে’। একটু পরেই তিনি বলেন, ‘তাওহীদের বিশ্বাসে যে যত মযবূত হবে, তার পাপও ঐ কাজের ক্ষমতা রাখবে যা অন্যদের ইবাদতও রাখতে পারে না। তাই পাপাচারী তাওহীদে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি, শিরকী কার্যকলাপে লিপ্ত মুত্তাকী ব্যক্তি অপেক্ষা হাজার গুণে ভাল’।[১৫]
শিরকের তাৎপর্য ও পরিধি বর্ণনায় শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখুন! নিশ্চয় শিরক বলতে কাউকে শুধু আল্লাহর সাথে তুলনা করা ও তাকে তাঁর সমপর্যায়ের মনে করা নয়; বরং শিরকের মূল হল, যেসব বিষয়কে মহান আল্লাহ নিজের সত্তাগত গুণ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন এবং বান্দার জন্য ইবাদতের নিদর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, তা যদি অন্যদের জন্য করা হয়, যেমন কারো উদ্দেশ্যে সিজদা করা, যব্হ করা ও নযর-নেওয়ায মানা, বিপদাপদের সময় তার কাছে প্রার্থনা করা, তাকে প্রত্যেক স্থানে আল্লাহর মত দ্রষ্টা মনে করা, তাঁর কর্তৃত্বের মধ্যে অন্যদেরও কিছু অংশ আছে বলে মনে করা ইত্যাদি প্রতিটি কাজ শিরক। এর দ্বারা ব্যক্তি মুশরিক হিসাবে গণ্য হয়। যদিও সে ব্যক্তি ধারণা করে যে, নিশ্চয় এই মানুষ, ফেরেশতা বা জিন, যার জন্য সে সিজদা করছে, যব্হ করছে, মানত করছে, যার কাছে সাহায্য চাচ্ছে সে ক্ষমতা ও মর্যাদায় আল্লাহর চেয়ে নি¤œ পর্যায়ের। একমাত্র মহান আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, সে তাঁর সৃষ্টি ও বান্দা। এ ব্যাপারে নবী, আউলিয়া, জিন, শয়তান, ভূত-প্রেত ও পরীর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যে ব্যক্তিই উপরিউক্ত আচরণ করবে, সে মুশরিক হয়ে যাবে। এজন্য মহান আল্লাহ ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের মূূর্তিপূজকদের ন্যায় তিরস্কার করেছেন, যারা তাদের নেতা ও পাদ্রীদের ব্যাপারে মুশরিকদের ন্যায় বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছিল’।[১৬]
মহান আল্লাহ এ সকল পথভ্রষ্ট বাড়াবাড়িকারীদের উপর রাগান্বিত হয়েছেন, যেভাবে মুশরিকদের উপর তাদের বাড়াবাড়ির কারণে রাগান্বিত হয়েছিলেন।... সুতরাং স্পষ্ট হল, মহান আল্লাহ তিনিই একমাত্র মহান কর্তৃত্বশীল, তিনি তাঁর রাজত্বে কাউকে অংশীদার ও অধিপতি করেন না। মানুষেরা তার প্রভুর কাছে একে একে উপস্থিত হবে, একজন অন্যজনকে বাধা দিতে পারবে না। কেউ কারো উকীল বা সাহায্যকারী হবে না। এ বিষয়ে আল-কুরআনে অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। যে ব্যক্তি আমাদের উল্লেখিত আয়াতসমূহের মধ্যে দু’টি অথবা তিনটি আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে শিরক ও তাওহীদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে। তার সামনে শিরক ও তাওহীদের মূলতত্ত্ব পরিষ্কার হবে’।[১৭]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
*পি-এইচ.ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. আল-কুরআনকে কেউ গভীরভাবে অনুধাবন করার প্রয়োজন বোধ করত না। ফলে এর উপর আমল করাও ছিল অবান্তর। কুরআন যেন মৃতব্যক্তির জন্য ছিল অর্থাৎ তিলাওয়াতের ছওয়াব রেসানির জন্য, জীবিতদের জন্য নয়। তা ছিল সর্বসাধারণের বোধগম্যের বাইরে। অতএব তা পাঠ করার মধ্যে গোমরাহির আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করা হত। আর আলিমরা শারঈ ও যরূরী ‘ইলম নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার সময়ই তারা পেত না। দ্রষ্টব্য : সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ), ৬ষ্ঠ খণ্ড (ঢাকা : মাকতাবাতুল হেরা, ২য় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০১৮ খ্রি.), পৃ. ৭৭।
[২]. মীর সাইয়েদ মুহাম্মাদ আপন, তাবসীরাতুন নাযিরীন (হস্তলিখিত পা-ুলিপি) (পাটনা : খোদা বখ্শ লাইব্রেরী, তা.বি.), পৃ. ৫৯।
[৩]. ইসমাঈল ইবনু ‘আব্দুল গনী ইবনু ওয়ালিউল্লাহ ইবনু ‘আব্দুর রহীম আল-‘উমরী আদ-দেহলভী, রিসালাতুত তাওহীদ (দামেস্ক : দারু ওয়াহইল কালাম, ১ম সংস্করণ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৪৬।
[৪]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১৩১।
[৫]. রিসালাতুত তাওহীদ, পৃ. ৫২-৫৩।
[৬]. শাহ ইসমাঈল শহীদ, তাযকীরুল ইখওয়ান (দেওবন্দ : মাকতাবাতুত তাহানুভী, তা.বি.), পৃ. ১৫৬।
[৭]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।
[৮]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১৩৩।
[৯]. মিরযা হায়রাত দেহলভী, হায়াতে তাইয়িবা (লাহোর : মাকতাবাতুস সালাম, ১৯৫৮ খ্রি.), পৃ. ৩৪৮-৩৪৯।
[১০]. রিসালাতুত তাওহীদ, পৃ. ৪৮।
[১১]. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৮৩।
[১২]. রিসালাতুত তাওহীদ, পৃ. ৪৯-৫০।
[১৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮-৪৯।
[১৪]. মুহাম্মাদ ইবনু ‘ঈসা ইবনু সাওরাতা ইবনু মূসা আত-তিরমিযী, সুনানুত তিরমিযী, ৫ম খণ্ড (মিশর : শিরকাতুন মাকতাবাতুন ও মাতবা‘আতুন মুসতফা আল-বাবী আল-হালাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৫ হি./১৯৭৫ খ্রি.), পৃ. ৫৪৮, হাদীস নং-৩৫৪০।
[১৫]. রিসালাতুত তাওহীদ, পৃ. ৯৬-৯৭।
[১৬]. সূরাহ আত-তাওবাহ : ৩১।
[১৭]. রিসালাতুত তাওহীদ, পৃ. ৫৪-৫৬।