ড. মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিদায় :
ইলমে ফিক্বহের একটি নক্ষত্রের পতন
-তানযীল আহমাদ*
গত ২৯ শে অক্টোবর’১৯ মঙ্গলবার যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ, উছূলবিদ, মুফাস্সির ও আরবী ভাষার প্রাজ্ঞ আলিম ড. মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত্যু বরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানাকাশ থেকে একটি নক্ষত্রের পতন হল। যে উলামায়ে কেরাম একবিংশ শতাব্দীতে ইলমে নববীর দ্যুতি, কালামুল্লাহর সঠিক, সাবলীল ও জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা, ফিক্বহের অতুলনীয়, আকর্ষণীয় ও বাস্তবসম্মত প্রয়োগনীতি, উছূলে ফিক্বহ ও আরবী ভাষার ঋদ্ধ প-িত হিসাবে জ্ঞানী মহলে সর্বজনবিদিত- তাদের মধ্যে ড. মুখতার শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) প্রথমসারির একজন। তাঁকে আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ উছূলবিদ বললেও অত্যুক্তি হবে না। পিতা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাস্সির ও আরবী ভাষার অতুলনীয় প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর যোগ্য সন্তান হিসাবে ড. মুহাম্মাদ মুখতার স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। নীচে তার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হল।
নাম ও বংশ পরিচয়
নাম- মুহাম্মাদ মুখতার। পিতার নাম- মুহাম্মাদ আল-আমীন (বিখ্যাত আলিম ও ‘আযওয়াউল বায়ানের’ রচয়িতা)। দাদার নাম- মুহাম্মাদ মুখতার এবং পরদাদার নাম- আব্দুল ক্বাদীর। বংশ- যানাকী (جنكي)। জন্মস্থান- শানক্বীত (شنقيط), মৌরিতানিয়া। জীবনকাল- ১৯৪২-২০১৯ ঈসায়ী, মৃত্যুকালে বয়স ছিল ৭৭ বছর।
শানক্বীত : ইলমি মাজালে বাগদাদ, বোখারা, সমরকন্দ আর নিসাপুরের প্রতিচ্ছবি
মুহাম্মাদ মুখতার আফ্রিকা মহাদেশের মৌরিতানিয়ার উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত শহর শানক্বীতে একটি ইলমি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘শানক্বীত’ হল পুরো আফ্রিকা অঞ্চলের জ্ঞান ও জ্ঞানীদের আত্মাস্বরূপ। এখানে ইলমের এমন আশ্চর্যজনক খেদমত হয়েছে, যা কল্পনাতীত। আধুনিকতার স্পর্শ ছাড়াই প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলের এই শহর (গ্রাম বলাই ভাল) এমন ভূবন বিখ্যাত বিদ্বানের জন্ম দিয়েছে যাদের সংস্পর্শে মুসলিম বিশ্বের ইলমের লালনকেন্দ্রগুলোও আন্দোলিত হতে বাধ্য হয়েছে। ইমাম হাযরামী, হাবীব বুন্নাহ, মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পদচারণায় ধন্য হয়েছে ‘শানক্বীত’। আর শানকীতের মত প্রসিদ্ধ বিদ্যানগরীতে জন্মগ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করেন এমন বিদ্বানের সংখ্যাও অগণিত। আরবী ভাষায় ইতক্বান, কাব্যচর্চায় অসামান্য পারদর্শিতা অর্জন, তাফসীরের দূর্লভ ব্যাখ্যা, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ ও মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) বিদ্যায় অসাধারণ পা-ুলিপি রচনায় শানক্বীতের অবদান সুবিদিত। ছাহাবী উক্ববা বিন নাফি‘ঈ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দৌহিত্র হাবীব বিন আবু উবায়দা ১০৬ হিজরীতে মৌরিতানিয়ার উত্তরে জনমানবহীন একটি মরু অঞ্চলে কূপ খনন করেন। মরুভূমীতে খাবার পানির ভয়াবহ সংকটের জন্য কূপ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। উত্তর আফ্রিকার মুসলিমগণ সেই কূপের পাশ দিয়ে হজ্জ আদায় করতে মক্কা গমন করা আরম্ভ করেন। কালক্রমে সেই কূপকে কেন্দ্র করে যে বসতি গড়ে উঠে এবং হজ্জযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের বিশ্রামের স্থানটিই ভূ-মানচিত্রে ‘শানক্বীত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ইসলামী জ্ঞানের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়তে থাকে এক সময়ের জনমানবহীন শানক্বীত থেকে। শানক্বীতে এখনো বাচ্চারা কাষ্ঠফলকে লেখাপড়া করে। মরুভূমির উঁঁচু টিলার ছায়া দেখে মুছল্লিগণ ছালাতের সময় নির্ধারণ করে। বড় বড় গবেষক আলিমগণ হস্তলিপি আকারে সংরক্ষিত কিতাবাদি থেকে গবেষণা করেন। অধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে প্রকাশিত সাজানো গোছানো পরিপাটি কিতাবাদি তাদের নিকট একেবারেই অপ্রতুল। শানক্বীতের অধিকাংশ বাচ্চারা শৈশবকালেই কুরআন মুখস্ত করে। এরপর প্রাথমিক মাদরাসায় ভর্তি হয়। আমরা যে বিদ্যাপিঠগুলোকে মাদরাসা বলে অভিহিত করে থাকি, শানক্বীতে তা ‘মাহযারা’ নামে পরিচিত। সেখানকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মুখস্থ শক্তি ও কবিতা চর্চা এত বেশি জনপ্রিয় যে, শানক্বীতকে উলামায়ে কেরাম بَلَدُ الشُّعَرَاءِ وَالْحَفَظَةِ অর্থাৎ কবি ও হিফকারীদের শহর বলে থাকেন। আপনি সেখানকার একজন সাধারণ মেষ চালককে জিজ্ঞেস করলেও সে গড়গড় করে আরবী কবিতা আবৃত্তি করবে। গৃহাভ্যন্তরে নারীদেরও একই অবস্থা।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
শানক্বীতে উল্লেখযোগ্য একটি কাবীলা (গোত্র) হল ‘যানাকী’। এ গোত্রের একটি বিখ্যাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)। পিতা বিখ্যাত আলিম, তাফসীর ও আরবী ভাষাবিজ্ঞানের অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি শাইখ আল্লামা মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ), যিনি ‘আযওয়াউল বায়ান’ তাফসীর গ্রন্থের রচয়িতা। মুহাম্মাদ মুখতার (রাহিমাহুল্লাহ) বাল্যকালে পিতা-মাতার নিকটে পবিত্র কুরআন হিফয করে স্থানীয় মাহাযারায় কিছুকাল লেখাপড়া করেন। এরপর পারিবারিকভাবে সঊদী আরবে চলে আসেন। ‘মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’-এর পরিচালনাধীন একটি মাহাদে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ করে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শারী‘আহ অনুষদের আওতাধীন ‘উসূলে ফিক্বহ’ বিষয়ে অনার্স (১৩৯৬ হি.), মাস্টার্স (১৪০১ হি.) ও পি-এইচ.ডি (১৪০৪ হি.) ডিগ্রী অর্জন করেন। মাস্টার্সে তার গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল القدح في البينة في القضاء। পিএইচডির জন্য তিনি প্রথমে নির্বাচন করেছিলেন ইমাম ইবনু আব্দুল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ইযতিযকার’-এর কিছু অংশের তাহক্বীক্ব। কিন্তু পরবর্তীতে অন্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এরপর তিনি যে অভিসন্দর্ভটি রচনা করেন তার শিরোনাম ছিল (اَحْكَامُ الْجِرَاحَةِ الْطِّبِّيَةِ وَالْأَثَارُ الْمُتَرَتَّبَةُ عَلَيْهَا)। অনন্য সাধারণ এই অভিসন্দর্ভটি প্রথম স্থান অধিকার করে এবং তিনি একাডেমিক লেভেলের সর্বশেষ ডিগ্রী পি-এইচ.ডি (ডক্টরেট অফ ফিলোসফী) অর্জন করেন।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী
মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকম-লী হল- ১. আল্লামা মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) (শাইখের পিতা)। ২. আল্লামা আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)। ৩. আল্লামা আব্দুল মুহসিন আল আব্বাদ (হাফি.)। ৪. শাইখ উমার আব্দুল আযীয মুহাম্মাদ (যিনি শাইখের পি-এইচ.ডি থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন)। ৫. শাইখ মুহাম্মাদ মাখলূফ- যার নিকট তিনি ফিক্বহের বিখ্যাত কিতাব ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ অধ্যয়ন করেন। শাইখ মাখলূফই মুহাম্মাদ মুখতার শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইলমি জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) নিজেই বলেন, ‘শাইখ মাখলূফের ইলম দ্বারা আমি অনেক উপকৃত হয়েছি’। নাহু (আরবী ব্যাকরণ), আরবী ভাষা ও ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ তিনি চমৎকার পদ্ধতিতে পাঠ দান করতেন। বিদায়ার প্রত্যেকটি মাসআলার ক্ষেত্রেই তিনি ইমামগণের উক্তি, দলীল ও প্রণিধানযোগ্য মতামত উল্লেখ করতেন।
শাইখ যুবাইদী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকটে তিনি সময়ের সঠিক মূল্যায়ন রপ্ত করা শিখেছেন বলে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন।
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, বর্তমান দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বান আল্লামা আব্দুল মুহসিন আল আব্বাদ (রাহিমাহুল্লাহ) শাইখের শিক্ষক ছিলেন। তার সম্পর্কে শাইখ শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তিনি ভিসি থাকাকালীন সময়েও আমাদের সাপ্তাহিক দু’টি ক্লাস নিতেন। ক্লাসে আসলে তিনি সাধারণ অধ্যাপকদের মত আচরণ করতেন। কখনো নিজেকে ভিসি মনে করতেন না।
কর্মক্ষেত্র
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে সেখানেই অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে উছূলে ফিক্বহ বিভাগের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উছূলে ফিক্বহ বা ফিক্বহ বিষয়ে যারা পি-এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন, তাদের অনেকের গবেষণা পত্রের মুশরিফ বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
সদস্য, শরী‘আহ অনুষদ পরিষদ, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, শিক্ষা পরিষদ, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ, সঊদী আরব ।
এছাড়াও শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) শিক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ ও হাদীছ বিভাগে পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে কাজ করেন। শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) উছূলে ফিক্বহ, ফিক্বহ ও তাফসীরের মোট পাঁচটি উন্মুক্ত দারস প্রদান করতেন মাসজিদে নববীতে। প্রত্যেক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের পর তিনি পাঁচটি দারস প্রদান করতেন। সোম ও বৃহঃপতিবার মসজিদে কুবায় দারস দিতেন। আবার কখনো জেদ্দা, মক্কা ও মদীনা এই তিন জায়গায় পালাক্রমে দারস প্রদান করতেন।
রচনাবলী
শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর লেখনীর খেদমতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হল প্রাচীন পা-ুলিপি তাহক্বীক্ব করে তা প্রকাশের উপযোগী করে তোলা- যা অনেক জটিল প্রক্রিয়া। অন্যটি হল তার নিজস্ব কিছু মূল্যবান রচনা।
তাহক্বীক্ব
দিরাসাহ ওয়া তাহক্বীক্ব শারহু মারা-কিস সাঊদ (دراسة و تحقيق شرح مراقي السعود)। এ বইটি ইমাম মুহাম্মাদ আল-আমীন বিন আহমাদ যাইদান যানাকী (রাহিমাহুল্লাহ) (যিনি ‘শাইখ মুরাবিত’ নামে পরিচিত) কর্তৃক রচিত।
এই বইটির পা-ুুলিপি সংগ্রহের জন্য শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) সঊদী আরব থেকে মৌরিতানিয়ার নিজ শহর শানক্বীতে গমন করেন। সেখানকার এক প্রাচীন লাইব্রেরী থেকে তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, শানক্বীতের আলেমগণের হস্তলিপিতে মরক্কো ও আন্দালুসের (স্পেনে) হস্তলিপি পদ্ধতির ছাপ রয়েছে। ফলে বইটি তাহক্বীক করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। তারা অনেক সময় আরবী বর্ণ ق-এর নুকতা নীচে, আবার কখনো দু’টি নুকতার বদলে একটি নুকতা ব্যবহার করত।
দিরাসাহ ওয়া তাহক্বীক কিতাবু সালাসিলিয যাহাব (دراسة و تحقيق كتاب سلاسل الذهب)। এ বইটি ইমাম যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক রচিত। শাইখ বলেন, এই কিতাবটির মূল পা-ুুলিপি সংগ্রহের জন্য আমি মিশরে যাই। সেখানে حجية السنة-এর লেখক শাইখ আব্দুল গনী আব্দুল খালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে দেখা করলে তিনি আমাকে তার সন্ধান দেন। আমি মিশরের আরেকটি প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহশালা থেকে তা সংগ্রহ করি। সম্ভবত ইমাম যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর এই বইটির একটিই পান্ডুলিপি ছিল। পৃথিবীর অন্য কোথাও এর কোন কপি ছিল না।
দিরাসাহ ওয়া তাহক্বীক কিতাবু তাকরীবিল উছূল ইলা ইলমিল উছূল (دراسة و تحقيق كتاب تقريب الاصول إلى علم الوصول), আবুল কাসিম মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন জুযাই আল গারনাতী (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক রচিত।
দিরাসাহ ওয়া তাহক্বীক কিতাবু লুকতাতিল আযলান… (دراسة و تحقيق كتاب لقطة العجلان وبلة الظمان)। এ বইটি ইমাম যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক রচিত।
নিজস্ব রচনা
তা‘আরুজুল কিয়াস ওয়া খবারুল আহাদ (القياس تعارض الآحاد و خبر)। ২. আত-তা‘আরুজ….(التعارض معناه وحكم وقوعه في الأدلة الشرعية)। ৩. আত-তারজীহ… (الترجيح في أخبار الاحد والقياش)। ৪. দাফউত তা‘আরুজ (دفع التعارض بالجمع)। ৫. আত-তারজীহ…(الترجيح معناه وحكمه ومورده)।
উপরের লেখনীগুলো দেখলে সহজেই বুঝা যায় যে, শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) শরী‘আতের বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর বিপরীতমুখী দলীলসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধনের উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শরী‘আতের দলীলসমূহের মধ্যে মূলত কোন বৈসাদৃশ্য নেই। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে হলেও আসলে সেগুলোর মাঝে কোন বিপরীতমুখিতা নেই। আর আমি আমার রচনার মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
দারস প্রদান পদ্ধতি
শাইখ ড. মুখতার শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দারস ছিল ইলমে ভরপুর। তার ছাত্ররা বলেন, ‘শাইখ যখন দারস দিতেন, তখন খুব মনোযোগের সাথে দারস দিতেন। ছাত্ররা সামান্য কোন এলোমেলো করতে পারত না। দারসের সময় পারস্পরিক কথা বা মেসওয়াক করা তিনি একেবারেই অপসন্দ করতেন। তিনি বলতেন, এতে ইলমের মর্যাদাহানি হয়। তিনি যখন ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ পড়াতেন, তখন তার ইলমের গভীরতা, ফুরু‘আত সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা, ইমামগণের উক্তিসমূহের মাঝে তুলনামূলক বিশ্লেষণ, শরী‘আতের নুছূছ-এর যথাযথ প্রয়োগ দক্ষতা প্রকাশ পেত। তিনি ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’-এর প্রতিটি মাসআলার সাথে আইম্মায়ে কেরামের উক্তি, প্রত্যেক মাযহাবের স্ব স্ব দলীল, প্রতিটি দলীলের ইলমি তাহক্বীক, প্রাধান্যতম মত ও সেই মতের পক্ষের শক্তিশালী দলীল ও ক্ষুরধার যুক্তি অত্যন্ত সাবলীলতার সাথে উপস্থাপন করতেন। ইবনু রুশদের ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ তার কন্ঠস্থ ছিল। এর প্রতিটি মাসআলার মূল ও শাখা প্রশাখায় তিনি অবাধ বিচরণ করতে পারতেন। নিজে মালিকি মাযহাবের হলেও বিশুদ্ধ দলীল পেলে সাথে সাথে তা গ্রহণ করতেন। মাযহাবী সংকীর্ণতা তাকে কখনো পেয়ে বসেনি।’
ব্যক্তিগত অধ্যয়ন
শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তা দু’টি ঘটনা দ্বারা সহজেই অনুমেয় হবে।
একবার এক ছাত্র শাইখকে বললেন, ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) এই বিষয়ে এরকম ফাতাওয়া দিয়েছেন। তখন শাইখ বললেন, কই না তো। আমি ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া (২০ খ-ে প্রকাশিত) তিন বার পড়েছি। কোথাও তো এমনটি পাইনি। ছাত্রটি একথায় হতভম্ব হয়ে গেল।
পাঠক! অনেকের জানা থাকার কথা যে, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিখ্যাত ফাতাওয়ার সংকলন ‘মাজমু‘ঊল ফাতাওয়া লি ইবনি তাইমিয়াহ’ মোট বিশ খ-ে কায়রোর দারুল হাদীস প্রকাশ করেছে। যা দশ সহ¯্রাধিক পৃষ্ঠারও অধিক। এমন বই তিনবার পড়ে ফেলা এবং সেটার সকল মাস‘আলা নখদর্পনে থাকা কত বড় বিদ্বানের কাজ হতে পারে তা কি আপনি চিন্তা করতে পারেন?
আরেকবার অন্য এক ছাত্র এসে শাইখের নিকট একটি কায়েদা (মূলনীতি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। শাইখ তখন তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অধ্যয়নরত ছিলেন। ছাত্রকে বললেন, অমুক বইয়ের ঐ অধ্যায়ে দেখ। সেখানে এই বিষয়ে আলোচনা আছে। ছাত্রটি বইটি হাতে নিয়ে যথাস্থানে সমাধান পেল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বইটি ইমাম যারকাশী রচিত الخرقى شرح مختصر ছিল। যা একেবারেই নতুন প্রকাশিত হয়েছে। একদম নতুন বই পড়ে আত্মস্থ করে রাখা আসলেই শাইখের প্রচুর মুতালা‘আ, পরিশ্রম, লেখাপড়ার প্রতি চরম আগ্রহ ও ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ।
বাবার স্মৃতিচারণ
শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বাবা ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাস্সির, আরবী ভাষাবিদ আল্লামা মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি বিজ্ঞমানের উছূলী আলেম। তার পাণ্ডিত্যের মূল্যায়নের জন্য দুই জন বিদ্বানের উক্তিই যথেষ্ট।
সঊদী আরবের বিখ্যাত আলেম শাইখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, رجل ملئ علما من رأسه إلى أخمص قدميه ‘তিনি এমন ব্যক্তি, যার আপাদমস্তক ইলমে পরিপূর্র্ণ’।
আরব বিশ্বের সুপরিচিত আলেম ও আল্লামা শানক্বীতির ছাত্র ড. বকর আবু যাইদ বলেন,
لو كان في هذا الزمان أحد يستحق أن يسمى شيخ الإسلام فهو هو
‘যদি বর্তমান যুগে কাউকে শাইখুল ইসলাম বলা হতো তাহলে তিনিই একমাত্র এর উপযুক্ত ছিলেন।’
তাঁর কৃতিত্বের আরেকটি স্বাক্ষর হল- আল কুরআনের তাফসীর ‘আযওয়াউল বায়ান’ রচনা। মুসলিম বিশ্বে সর্বমহলে এর গ্রহণযোগ্যতাই লেখকের ইখলাছ, ছিদক, ও ইলমি মর্যাদার সাক্ষ্য প্রদান করে।
মুখতার শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বাবা আমাদেরকে কখনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে বাধ্য করেননি। লেখাপড়ার ব্যাপারে তিনি আমাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের সম্মানিত পিতা দারস প্রদানে কখনো কোন চিরকুট নিয়ে যেতেন না। সবকিছুই স্মৃতি থেকে বলতেন। শাইখ ‘উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে আব্বাজানের খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। উভয়ের মাঝে ভালবাসাপূর্ণ চিঠি আদান-প্রদান হত। আব্বাজানের সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন শাইখ আতিয়্যাহ মুহাম্মাদ সালিম। (যিনি আযওয়াউল বায়ানের সূরা হাশর থেকে শেষ পর্যন্ত তাফসীর করে সেটাকে পূর্ণতা দেন। কারণ আল্লামা শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) পুরো তাফসীর শেষ করার পূর্বেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।) অন্যান্য বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে আব্দুল্লাহ দাইয়ান, সালিহ লুহাইদান, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ও ড. আব্দুল মুহসিন আত তুর্কি উল্লেখযোগ্য।
পিতার শেষ অছিয়াত সম্পর্কে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আব্বাজান আমাদেরকে সবসময় উপদেশ দিতেন, আমরা যেন আমাদের জিহ্বাকে হেফাজত করি। তিনি জোর দিয়ে বলতেন, কেউ যদি আমাকে গালমন্দও করে তবুও তোমরা তার বিরুদ্ধে কখনো মুখ খুলবে না। ছবর ইখতিয়ার করবে।
শাইখের অছিয়াত
ফাহাদ আব্দুল মালিকের উপস্থাপনায় ‘সফহাত মিন হায়াতি’ নামক একটি অনুষ্ঠানে এসে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) সকলের প্রতি যে অছিয়াত করেন তাতে মূলত তাঁর শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের অছিয়াতেরই প্রতিধ্বনি হয়েছে। তিনি বলেন,
‘বর্তমান যুগে আলেম উলামাদেরকে মানুষ অজ্ঞতাবশত বিভিন্ন গালমন্দ করে থাকে। তাদের ক্ষুদাদপি ইখতিলাফ নিয়ে তাদেরকে ভিন্ন মানহাজের আলেম বলে দূরে সরিয়ে দেয়। এই প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তালিবুল ‘ইলম ও উলামায়ে কেরামকে এই পরিস্থিতিতে আমি তাদের জিহ্বার হেফাজকত করার ও ছবর করার বিশেষ উপদেশ দিচ্ছি। তবে সত্য ও সঠিক কথা নববী মানহাজ মুতাবিক সাহসের সাথে উচ্চারণ করার ও মিথ্যা পরিহার করার অছিয়াত করছি। আমাদেরকে অবশ্যই সঠিকটা বলতে হবে আর মিথ্যা পরিহার করতে হবে’।
গত ২৯ অক্টোবর বিশ্ববরেণ্য এই আলিমের বিদায়ে সত্যিই মুসলিম উম্মাহ তার এক কর্মঠ, যোগ্য, বিদগ্ধ পণ্ডিত ও দ্বীনের একজন নিশানদারকে হারাল। মদীনার ‘বাকী কবরস্থান’-এ তাকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাকে ছিদ্দীক ও ছালিহীনদের কাতারে শামিল করুন-আমীন!!
(সূত্র : (১). আরবী টিভি চ্যানেলে দেয়া শাইখের বিশেষ সাক্ষাৎকার ‘সফহাত মিন হায়াতি’। (২). শাইখের বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকা। (৩). আল জাজিরা নেট। (৪). বিভিন্ন আরবী প্রবন্ধ। (৫). উইকিপিডিয়া ইত্যাদি হতে সংগৃহীত।)
* শিক্ষক, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।