শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(শেষ কিস্তি)
ধর্মীয় সংস্কারে শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অবদান
শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন তৎকালীন জ্ঞানাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি অতীব ধর্মপরায়ণ এবং গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ধর্মীয় সংস্কারে তাঁর অবদান ছিল মূলত নিবর্তনমূলক। তিনি ক্ষুরধার লেখনি ও তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামের খিদমত করেন। পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইন্তিকালের পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন তিনি। তাঁর যুগে শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রচার-প্রসার তৎপরতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, গোটা ভারতবর্ষের সকল শিক্ষা কেন্দ্র তাঁর কেন্দ্রীয় শিক্ষাগার থেকে উপকার লাভ করে। পিতার ইন্তিকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর মূলমন্ত্র ‘সকল বিধান বাতিল কর’ কেবল কিছু ব্যক্তির মধ্যে সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শাহ ‘আব্দুল আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর যুগে উক্ত বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনা দেশের আপামর জনগণের চেতনায় উন্নতি লাভ করে। হাজার হাজার যুবক উক্ত চেতনা বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে দেয়। ফলে সংস্কার আন্দোলনের ধাক্কা এশিয়ার দূর-দূরন্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।[১] পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সংস্কার কার্যক্রমকে মোটামুটি ৫টি শাখায় ভাগ করা যায়। যা শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেটাই ছিল শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সংস্কার কার্যক্রম। সেগুলো নিম্নরূপ :
১). আল-কুরআনের প্রচার ও প্রসার
অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস আল-কুরআন থেকে তৎকালীন মুসলিমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। আরবী ভাষা না জানার কারণে কুরআন পড়াটা তাদের নিকট ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এজন্য শাহ সাহেব কুরআনুল কারীমের ভাষান্তরের কাজ করে এবং মুসলিমদের মাঝে কুরআনের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যাতে করে মুসলিমদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসগুলোর সংস্কার করা যায় এবং চিরশাশ্বত দ্বীন ইসলামের সাথে জনগণের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়।[২]
উক্ত ধারাবাহিকতায় শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) সাধারণ মানুষের নিকট কুরআন পৌঁছান, এর মাধ্যমে বাতিল আক্বীদা-বিশ্বাস ও ভ্রান্ত নিয়ম-কানুন সংস্কার করেন এবং আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করার প্রচেষ্টা করেন। তিনি একাজে অনেক অগ্রগতি লাভ করেন। প্রতি সপ্তাহে বুধ ও শুক্রবারে কুরআনের দরস প্রদান করতেন। সেখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষভাবে এবং সাধারণ মানুষরা অত্যন্ত আগ্রহ-উচ্ছ্বাসের সাথে দারস গ্রহণ করত। যে দরসের মাধ্যমে আক্বীদা সংশোধনের এক শক্তিশালী কর্মসূচি শুরু হয়। যেমন, পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) আল-কুরআনের اِعۡدِلُوۡا ۟ ہُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ‘তোমরা ন্যায়বিচার কর, এটা তাক্বওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮) আয়াত পর্যন্ত দারস শেষ করে তিনি ইন্তিকাল করেন। অতঃপর পুত্র শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) এখান থেকেই শুরু করেন এবং اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمْۡ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্ত্বাক্বী’ (সূরাহ আল-হুজুরাত : ১৩) আয়াত পর্যন্ত দারস প্রদান করেন।[৩] মুহতারাম শায়খের দারসে কুরআনের এই খিদমতকে তাঁরই এক ছাত্র লিপিবদ্ধ করে সূরাহ আল-মুমিনূন থেকে সূরাহ ইয়াসীন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ পারার তাফসীর সংকলন করেছেন। অতঃপর তাঁরই আরেক ছাত্র শাহ রফীউদ্দীন মুরাদাবাদী ‘ইফাদাতে আযীযিয়্যা ওয়া তাহক্বীক্বাতি নাফীসাহ’ নামে এটি সংকলন করেন।[৪] এছাড়া তিনি ফারসী ভাষায় ‘ফাতহুল ‘আযীয’ নামে একটি বিখ্যাত তাফসীর প্রণয়ন করেন।[৫] আল-কুরআনের এই ব্যাপক প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের যেমন সংস্কার হয়েছে, তেমনি তাদের মন-মস্তিষ্ক তাওহীদের মিষ্টতা ও কুরআনী স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে।
২). হাদীছের দারস ও তার সম্প্রসারণ
উপমহাদেশের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘ইলমে হাদীছের খুব একটা বেশি প্রচলন ছিল না। তাই শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছের প্রচার ও প্রসারকে তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন। একারণে তিনি হাদীছের পাঠদান ও গ্রন্থ রচনা উভয় খিদমতই আঞ্জাম দেন।[৬] উল্লেখ্য, তিনি উপমহাদেশে ‘ইলমে হাদীছের এমন খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, ইতিপূর্বে এই ভূখণ্ডের কোন আলিমের কল্পনাতেও কখনো আসেনি। তৎপরবর্তী সময়ে শাহ সাহেবের সম্মানিত পুত্রগণ হাদীছের পাঠদান ও গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে ‘ইলমে হাদীছের প্রসারের জন্য সীমাহীন চেষ্টা করেন। অনুরূপভাবে শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দারসে হাদীছের মেয়াদ ছিল প্রায় চৌষট্টি বছর। এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কেবল দারস-তাদরীস প্রদান করেছেন এমনটি নয়, বরং হাদীছ বিষয়ক গ্রন্থও রচনা করেছেন। যেমন ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন’, যেখানে মুহাদ্দিছগণের জীবনী উল্লেখিত হয়েছে এবং ‘আল-উজালাতুন নাফি‘আহ’।[৭]
এতদ্ব্যতীত তিনি হাদীছশাস্ত্রের এমন এমন সুযোগ্য-সুবিজ্ঞ শিক্ষক ও একান্ত শাগরিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যারা শুধু ভারতবর্ষেরই নয় বরং সুদূর হিজায পর্যন্ত দারসে হাদীছের কল্যাণের ধারা প্রসারিত করেছিলেন এবং এক কল্যাণময় নতুন বিশ্ব গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।[৮] এজন্য উপমহাদেশে হাদীছের প্রচার ও প্রসারের জন্য শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট ঋণী।[৯]
৩). শী‘আ মতবাদ খণ্ডন ও প্রত্যাখ্যান
হিজরী দশ শতকের শুরুতেই যখন ইরানে শী‘আ মতবাদকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয় এবং সুন্নী মতাদর্শকে ইরান থেকে প্রায় নির্বাসিত করা হয়, তখন থেকেই ভারতেও শী‘আ মতবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সাফাবী শাসনের দ্বিতীয় শাসক তুহমাসফ (মৃ. ৯৮৪ হি.)-এর শাসনামলে মীর গিয়াসুদ্দীন মানুছূর[১০] (মৃ. ৯৮৪ হি.)-এর ভারতীয় শাগরিদ আমির ফাতহুল্লাহ শিরাজী (মৃ. ৯৯৭ হি.)-এর মাধ্যমে ভারতবর্ষে শী‘আ মতবাদের উত্থান ঘটে।[১১] পরবর্তীতে ভারতবর্ষে শী‘আ মতবাদের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। ফলে রাফেযী ও শী‘আ মতবাদের প্রতিরোধ ও এর প্রভাব থেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকে সংরক্ষণ করার জন্য ভারতগুরু শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০৩-১৭৬২ খ্রি.) ‘ইযালাতুল খিফা’ নামক একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি উক্ত গ্রন্থ রচনার প্রাথমিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনায় বলেন, ‘এ যুগে শী‘আ ধর্মমত গ্রহণের বিদ‘আত চালু হয়েছে। সর্বসাধারণের মন-মানসিকতা তাদের সৃষ্ট সংশয়-সন্দেহে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকের মনে খুলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফতের নিশ্চয়তার ব্যাপারে নানা ধরনের সন্দেহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে’।[১২]
শী‘আ মতবাদের খণ্ডন ও প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে শাহ সাহেব যে পথের সূচনা করেছিলেন, সে পথের পূর্ণাঙ্গতা ও শক্তিদান করেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনিও তাঁর যুগে শী‘আ মতবাদের খণ্ডন করে ‘তুহফায়ে ইছনা ‘আশারিয়্যা’ নামে একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি গ্রন্থটি মোট ১২টি অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত করেছেন। প্রথমত এ গ্রন্থে শী‘আ মতবাদের উত্থান ও তাদের দলে-উপদলে বিভক্ত হওয়ার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। অনুরূপভাবে শী‘আ মতবাদের প্রবীণ আলিম ও তাদের রচনাবলীর পরিচিতি রয়েছে। এরপর খিলাফতের আলোচনা এবং ছাহাবায়ে কিরামের উপর নানা অভিশাপ ও ভর্ৎসনার বিবরণ এবং তার জবাবসমূহের উপর ক্ষান্ত করার স্থলে মৌলিক মাসায়েল, খোদায়িত্ব, নবুওয়াত, পরকাল ও ইমামত (শাসনব্যবস্থ)-এর উপর স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। অতঃপর তিন খলীফা, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) এবং অন্যান্য সছাহাবায়ে কিরামের উপর শী‘আ মতালম্বীদের পক্ষ থেকে যেসব আপত্তি-অভিযোগ ও বিষোদগার করা হয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে। তারপর শী‘আ মতবাদের বৈশিষ্ট্য, তাদের সংশয়-সন্দেহ ও উগ্রতার সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের ভুলভ্রান্তি ও কুধারণাগুলোর পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সর্বশেষ অনুচ্ছেদে মহব্বত ও ঘৃণা প্রসঙ্গে আলোচনা রয়েছে, যা দশটি ভূমিকায় পরিবাপ্ত।[১৩]
গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনায় উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, ‘এদেশে আমরা যেখানে বসবাস করছি আর এ যুগে আমরা যা পেয়েছি, এখানে ‘ইছনা আশারিয়্যাহ’ মতবাদের প্রচার-প্রসার ও প্রচলন এমান পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, (সুন্নীদের) খুব কম ঘরই এমন পাওয়া যাবে, যে ঘরের দু’য়েকজন এ মতবাদের অনুসারী ও এ আক্বীদা-বিশ্বাসের প্রতি আসক্ত বা অনুরাগী নেই। তাদের অধিকাংশ লোকই ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ এবং নিজ পূর্বপুরুষদের জীবনালেখ্য ও নীতিমালা সম্পর্কে উদাসীন পরিলক্ষিত হয়। যখন বিভিন্ন বৈঠক ও মাহফিলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, তখন গোলমেলে বক্রকথা ও অপ্রাসঙ্গিক কথায় কাজ সারতে চেষ্টা করে। সে লক্ষ্যে আল্লাহর ভরসায় এই পুস্তিকা রচনা করা হয়েছে, যাতে তর্ক-বিতর্কের সময় এ মতবাদের আনুগত্য প্রাচীন ফলক থেকে আসতে না পারে; স্বয়ং নিজের মূলনীতি অস্বীকারকারী না হয় আর যেসব বিষয় বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল, তাতে সংশয়-সন্দেহের অবকাশ না দেয়’।[১৪]
সমকালীন যুগে উক্ত গ্রন্থের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ধর্মীয় বিষয়সমূহের সংরক্ষণ সংস্থা’র হায়দারাবাদ জেলার সাবেক প্রধান মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শারওয়ানী, যার বংশ শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) ও তাঁর খলীফাগণের সাথে সম্পৃক্ত, তিনি বলেন, لقد قام هذ الكتاب فو وجه السيل الجارف من التشيع سدا منيعا ‘এ গ্রন্থ রচনার ফলে শী‘আ মতবাদের ক্রমবর্ধমান প্লাবন প্রতিরোধে একটি মযবুত বাধের কাজ করেছে’। এমনকি এ গ্রন্থটি শাহ ছাহেবের জীবদ্দশায় ১২১৫ হিজরীতে ছাপা হয়ে ব্যাপক সমাদর লাভ করে।[১৫]
শুধু তাই নয়, উক্ত গ্রন্থটি শী‘আ মতালম্বীদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। তারা বিভিন্ন লেখনী ও সংকলনের মাধ্যমে উক্ত বইয়ের জবাব রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তন্মধ্যে ‘আবকাতুল আনওয়ার ফী ইমামাতিল আইম্মাতিল আতহার’ নামক গ্রন্থটি তার বাস্তব প্রমাণ। কেননা উক্ত গ্রন্থের লেখক হলেন- মৌলভী সাইয়েদ হামিদ হোসাইন কানতুরী (মৃ. ১৩০৬ হি.)। গ্রন্থটি ৮ খণ্ডে সমাপ্ত। এ কিতাবের স্থুলতা এতই বেশি যে, প্রথম খণ্ডে র পৃষ্ঠা ১২৫১, দ্বিতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৯৭৭, তৃতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৬০৯, চতুর্থ খণ্ডের পৃষ্ঠা ৩৯৯, পঞ্চম খণ্ডের পৃষ্ঠা ৭৪৫, ষষ্ঠ খণ্ড পৃষ্ঠা ৭০৪। বাকীগুলোও এরূপ সংখ্যক পৃষ্ঠায় রচিত হওয়ার অবস্থা দেখে পূর্ণ কিতাবটি এরকম ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত করেন।[১৬]
৪). ইংরেজশক্তির বিরোধিতা ও মুসলিমদের জাতীয় নিরাপত্তা
১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা যখন দিল্লী দখল করে নেয়, তখন তারা সম্রাটকে পদচ্যুত করে তার সিংহাসন দখল না করে বরং নিজেদের দেশে তথা ইংলান্ডে চালু থাকা নিয়ম-পদ্ধতি প্রবর্তন করে। যার ওপর ভিত্তি করে ইংরেজরা দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেটা হল- সম্রাটকে তার নিজ সিংহাসনে বহাল রাখা এবং সকল কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে নিয়ে আসা। তখন গোট দেশে ঘোষণা করা হল-
خلق خدا كے ملك بادشاه سلامت كا الو حكم كمبني بهادر كا
‘ভূমি আল্লাহর, রাজত্ব মহান স¤্রাটের আর কর্তৃত্ব থাকবে কোম্পানী বাহাদুরের’।[১৭] শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ কর্তৃক উক্ত মূলনীতির মাধ্যমে আল্লাহর প্রভুত্ব ও তাঁর পরাক্রমশীলতার প্রতি সমর্থন করে ধর্মের আঁচল দু’হাতে ধরে রাখা হয়েছে। সাথে সাথে মোঘল স¤্রাট ও তৈমুর বংশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশকেও সংরক্ষণ করা হয়েছে। সরকারী কাজ কারবার যা এতদিন হিন্দু-মুসলিম আমীর-উমারা ও মন্ত্রীদের হাতে ন্যাস্ত ছিল তা এখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। এভাবে সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে শুধু এগুলোর যথার্থ সংরক্ষণের অঙ্গীকার ব্যক্তই নয় বরং হিন্দুদের সামাজিক বিষয়াদির দায়িত্ব তাদের প-িত শ্রেণীর হাতে আর মুসলিমদের সামাজিক বিষয়াদির দায়িত্ব তাদের কাযীদের হাতে অর্পণ করে সংস্কৃতি ও সভ্যতার স্বায়ত্বশাসনও ঘোষণা করা হয়েছে।[১৮]
উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে বাংলা সহ গোটা ভারতবর্ষকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলা যাবে, না-কি পরাধীন রাষ্ট্র? এরূপ রাষ্ট্রকে ‘দারুল ইসলাম’ জ্ঞান করা হবে, না-কি ‘দারুল হারব’? কেননা যদি ‘দারুল হারব’ হয়, তাহলে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে অন্যথা হিজরত করতে হবে। আর যদি ‘দারুল ইসলাম বা দারুল আমান’ হয়, তাহলে সরকারের সাথে যুদ্ধ করা চলবে না, যদিও সরকার অমুসলিম হয়। এরকম ভয়ংকর ও কঠিন পরিস্থিতিতে ভারততœ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জৈষ্ঠ পুত্র এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) স্পষ্ট ভাষায় ও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঐ মুহূর্তে ভারতকে ‘দারুল হারব’ বা শত্রুকবলিত রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে ফারসী ভাষায় এক দুঃসাহসী ফৎওয়া প্রদান করেন। আমরা উক্ত ফৎওয়ার আরবী সংস্করণটি উল্লেখ করছি,
إن حكم إمام المسلمين في هذه المدينة (دلهي) غير نافذ و حكم الحكام النصرانيين نافذ متبق بدون معارضة ونقد. وإن ما يسميه الفقهاء بإجراء أحكام الكفر يراد به أن يكون الكفار أصحاب حكم و سلطة من شؤون إدارة البلاد و تنظيم الرعية وأخذ الجبايات وتعشير أموال التجارة و تعزير السراق وقطاع الطرق والفصل في الخصومات والتعزير علي عامة الجرائم وإن كانوا لا يتعرضون لبعض الأحكام الإسلامية كإقامة الجمعة والعيدين والأذان وذبح البقر ولكن الأصل الأصيل أن تكون هذه الشؤون المتقدمة الذكر تحت رحمتهم وفي دائرة نفوذهم
إننا نري بأم أعيننا أنهم يهدمون المساجد علنا ولا يسمح لأي مسلم أو ذمي أن يدخل هذه المدينة أو نواحيها إلا بإذنهم ولا يمنعون الوافدين من الخارج والمسافرين والتجار لمصالحهم الذاتية ولكن الوجهاء الأخرين كشجاع الملك ولا يتي بينكم. لا يمكن أن يدخلوا المدينة بغير إذنهم إن حكم النصاري يسود من مدينة دلهي إلي كلكته
نعم إنهم لم ينفذوا أحكامهم في بعض المناطق يمينا و شمالا كحيدر أباد ولكهنؤ ورامفور. إما لأجل مصالحهم الخاصة أو لأن حكام هذه الولايات خضعوا لسطانهم وقبلوا طاعتهم
‘এ শহরে (দিল্লীতে) মুসলিমদের শাসকের হুকুম মূলত কার্যকর নেই। খ্রিষ্টান শাসকদের হুকুম অতিমাত্রায় চালু রয়েছে। ফক্বীহগণ যাকে কাফিরের আহকাম বাস্তবায়ন বা কুফরী শাসন বলেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল- রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রজাসাধারণের বন্দোবস্ত, ট্যাক্স-কর, ব্যবসার সম্পদের একদশমাংশ উসুল করা, চোর-ডাকাতের শাস্তি বিধান, বিচারকার্য ও অপরাধ দমনে কাফিরগোষ্ঠী ব্যক্তিগতভাবে শাসক ও স্বাধীন। যদি কোন কোন ইসলামী বিধান পরিপালন করে যেমন, জুমু‘আহ, দুই ঈদ, আযান ও গরু কুরবাণী ইত্যাদিতে তারা আপত্তি নাও করে, তথাপি মূলকথা এটাই যে, এসব বিষয়ে তাদের দয়া-করুণার উপরই হচ্ছে।
আমরা দেখেছি, তারা মসজিদগুলো নির্বিচারে ধ্বংস করছে। কোন মুসলিম কিংবা (অমুসলিম) যিম্মী তাদের অনুমতি ছাড়া এই শহর ও এর উপকূলে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে তারা বহিরাগত মুসাফির ও বণিকদের নিষিদ্ধ করে না। কিন্তু অন্যান্য পদমর্যাদার অধিকারী লোক যেমন শুজাউল মালিক, বেলায়েতী বেগম প্রমুখ তাদের অনুমতি ছাড়া এসব শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। এ দিল্লী থেকে কলকাতা পর্যন্ত খ্রিষ্টানদের শাসন-কর্তৃত্ব বিস্তৃত।
তবে ডানে-বামে যেমন হায়দারাবাদ, লাক্ষ্মৌ ও রামপুরে তারা তাদের হুকুম জারি করেনি। কোথায় তো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তাকীদে আর কোথাও সেসব রাজ্যের শাসনকর্তা তাদের অনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার কারণে’।[১৯]
সুধী পাঠক! উক্ত ফৎওয়া ঘোষণার পর যেসকল সাধারণ মুসলিম ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন এবং তাদের স্বশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সিদ্ধান্ত খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাদের জন্য সকল অস্পষ্টতা দূর করে গন্তব্যের পথ খুলে দেয়। এমনকি তৎকালীন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মারাঠাদের সাথে মুসলিমের মধ্যকার প্রাচীন শত্রুতামূলক মনোভাব নির্মূল হয়ে যায়। তখন মুসলিম ও মারাঠা একযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এছাড়া শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত ফৎওয়া ধর্মীয় সংস্কারে যে দুঃসাহসী অনুপ্রেরণা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৫). বাহাছ ও মুনাযারা
‘মুনাযারা’ অর্থ কোন বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করা, চাই সেটা ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্য কোন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক। উপমহাদেশে মুনাযারার ইতিবৃত্ত অনেক প্রলম্ভিত। স¤্রাট আকবারের সময়ে উপমহাদেশে খ্রিষ্টান পাদ্রীদের সাথে মুনাযারার পরম্পরা শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর যুগে মুনাযারা বেশ গতি লাভ করে। কারণ ঐ সময় সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইংরেজরা ইংল্যান্ড থেকে আসার আসার সময় পাদ্রীদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। যাতে করে এখানে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারের মাধ্যমে মানুষদেরকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার মিশন চালানো যায়। উদ্দেশ্য ছিল যে, এভাবে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসার লাভ করবে এবং ইংরেজ শাসনও সুদৃঢ় হবে। শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) এ বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তিনি খ্রিষ্টানদের মুকাবিলা করতেন। নি¤েœ খ্রিষ্টানদের সাথে শাহ শাহেবের কতিপয় বাহাছ-মুনাযারা ও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হল :
ঘটনা-১ : একদা শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) দিল্লীর জামে মসজিদে কুরআন মাজীদের দরস দিচ্ছিলেন। ইত্যবসরে একজন পাদ্রী এসে বললেন, আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। প্রশ্নটা হল- মুসলিমদের নবীকে পৃথিবীতে দাফন করা হয়েছে এবং আমাদের নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে আল্লাহ আকাশে স্থান দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের নবীর মর্যাদা মুসলিমদের নবীর চেয়ে বেশি বলে প্রতীয়মান হল। তখন শাহ ছাহেব অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে উত্তরে বলেন, ‘এ দলীল দ্বারা আমাদের নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর উচ্চমর্যাদা প্রমাণিত হয় না। কারণ ফেনা সর্বদা সমুদ্রের উপরে থাকে আর মুক্তা থাকে মাটির নিচে’। এ উত্তরে ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে ফেনা এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মুক্তার সাথে তুলনা করা হয়েছে।[২০]
ঘটনা-২ : জনৈক পাদ্রী শাহ ছাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নবী কি আল্লাহর বন্ধু’? তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ। পাদ্রী বললেন, আপনার নবী কি হুসাইনকে হত্যার সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেননি যে, আমার দৌহিত্রকে হত্যা থেকে বাঁচানো হোক? না-কি প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ কবুল করেননি। তখন শাহ ছাহেব উত্তরে বলেন, ‘আমাদের নবী আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ বলেছিলেন, তোমার নাতিকে লোকেরা শহীদ করেছে। আর শহীদের মর্যাদা অনেক বেশি। কিন্তু এ সময় আমার পুত্র ঈসার কথা মনে পড়ছে, যাকে তার অনুসারীরা শূলে বিদ্ধ করেছিল।[২১] উল্লেখ্য, শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রীর প্রশ্নের জবাবে তার বিশ্বাস অনুযায়ী উক্ত জবাব প্রদান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পুত্র নন বরং তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল ছিলেন। এছাড়া খ্রিষ্টানরা তাকে শূলেও বিদ্ধ করেনি বরং আল্লাহ তাাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন (সূরা মারইয়াম : ৩০; সূরা আন-নিসা : ১৫৭-১৫৮)।
৬). যোগ্য কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ গঠন
‘সকল বিধান বাতিল কর’ এ বৈপ্লবিক আহ্বান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন যোগ্য কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা। পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) যে বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) তা বাস্তবে রূপদানের জন্য ক্ষেত্র, ময়দান ও যোগ্য কর্মী বাহিনী তৈরি করে সর্বাত্মক বিপ্লব সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দারস-তাদরীস, তারবিয়াত-তাযকিয়া এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পরিস্থিতি ও সময়ের চাহিদা এবং দ্বীনের মৌলিক অভীষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী দাওয়াত ও সংস্কারকর্মের আঞ্জাম দিয়েছিলেন, সংগ্রাম ও জিহাদের ঝা-া উত্তোলন করেছিলেন। শাহ ছাহেবের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা এমন কতিপয় সুউচ্চ যোগ্যতা, দুর্লভ সাহসিকতা ও বিস্ময়কর ইচ্ছাশক্তির অধিকারী আধ্যাত্মিক ক্ষমতা-সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের পৃষ্ঠপোষকতার কাজ নিয়েছেন, যারা হাজার হাজার মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং এক পূর্ণ শতক সামলে রেখেছেন।[২২] তন্মধ্যে কয়েকজন হল- আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ), সাইয়েদ আহমাদ শহীদ বেরেলভী (রাহিমাহুল্লাহ), মাওলানা ‘আব্দুল হাই বাড়হানুভী (রাহিমাহুল্লাহ), শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক (রাহিমাহুল্লাহ) এবং শাহ মুহাম্মাদ ইয়াকূব (রাহিমাহুল্লাহ)। এতদ্ব্যতীত মাওলানা মুফতি এলাহী বখ্শ কান্ধালভী (রাহিমাহুল্লাহ), মাওলানা ইমামুদ্দীন দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ), মাওলানা হায়দার আলী রামপুরী টুঙ্কী (রাহিমাহুল্লাহ), ‘মুনতাহাল কালাম’ গ্রন্থের রচয়িতা মাওলানা হায়দার আলী ফায়যাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ), মাওলানা রশীদুদ্দীন দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং মুফতি সদরুদ্দীন দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ অন্যতম।[২৩]
উপসংহার
উপরিউক্ত উলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশ-বেনিয়াদের উপর্যপুরী ষড়যন্ত্র-সংঘাত, নির্যাতন-নির্বাসন, মুসলিমদের আক্বীদা-বিশ্বাসের মূলোৎপাটন, শিরক-বিদ‘আতের ছড়াছড়ি, শী‘আদের বিভ্রান্তিকর আক্বীদাহ-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার, শিক্ষা-সংস্কৃতির করুণ পরিণতির এহেন সংকটকালীন মুহূর্তে শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) অন্ধকারে আলোর দিশারীর ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি ‘ইলমী জগতে যেমন জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে জগৎময় জ্ঞান বিতরণ করেছেন। তিনি দাওয়াত ও তাবলীগ এবং তারবিয়াতের মাধ্যমে এমন সকল শাস্ত্রীয় বিদ্বান ও প-িত এবং প্রবীণ অধ্যাপক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যেসকল সংস্কার আন্দোলন ও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর নেতৃবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন তাদের মাধ্যমে ভারতবর্ষ যেমন ব্রিটিশমুক্ত হয়েছিল, তেমনি গোটা বিশ্বব্যাপী ‘ইলমের বিচ্ছুরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। বলা যায় যে, হিজরী তেরো শতক ছিল শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা, পথ-প্রদর্শন ও মানুষ গড়ার শতাব্দী।
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[১]. উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য, পৃ. ৫৬।
[২]. উপমহাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) আল-কুরআনের দ্বিতীয় ফার্সি অনুবাদক ছিলেন। তাঁর অনুবাদ ও তাফসীরের নাম ‘ফাতহুর রহমান’ (فتح الرحمن)। উপমহাদেশের অগণিত প্রকাশক অসংখ্যবার এই অনুবাদটি প্রকাশ করেছে। উলামায়ে কিরামের মাঝে এটি দারুণভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে এবং বহুল পঠিত হয়েছে। সাথে সাথে মুসলিমরা তার এই অনুবাদকে বিশুদ্ধতম অনুবাদ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তদ্বারা আলিমগণ উপকৃত হয়েছেন। অথচ পরিতাপের বিষয় হল- কুরআনের এই অনুবাদ করার অপরাধে দিল্লীর দুষ্ট আলিমরা তাঁকে কাফির আখ্যা দিয়ে হত্যার ফৎওয়া জারি করে এবং লোকজনকে তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। দ্রষ্টব্য : ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদামাতিল কুরআনিল কারীম (বানারাস : জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০০ হি./১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ১১।
[৩]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৮৭।
[৪]. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদামাতিল কুরআনিল কারীম, পৃ. ১৩।
[৫]. ‘আব্দুল হাই আল-হুসানী, আছ-ছাক্বাফাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল হিন্দ (প্রকাশনা স্থান বিহীন : মুওয়াসসাসাতু হিন্দাভী লিত তা‘লীমী ওয়াছ ছাকাফাহ, ২০১২ খ্রি.), পৃ. ১৫১।
[৬]. তিনি হাদীছের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালিক’-এর দু’টি ব্যাখ্যা গ্রন্থ লিখেন। একটি হল- ‘আল-মুছাফ্ফা’ (المصفَّي), যা আরবী ভাষায় প্রণীত। অপরটি হল- ‘আল-মুসাওয়া’ (المسوَّي), যা ফারসী ভাষয় প্রণীত। তাছাড়া তিনি ছহীহুল বুখারীর শিরোনামের ব্যাখ্যা সম্বলিত ‘শারহু তারাজুমি আবওয়াবি ছহীহিল বুখারী’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। অতঃপর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (حجة الله البالغة) লিপিবদ্ধ করেন। যে গ্রন্থের একটি বৃহদাংশ বিষয় হাদীছের উপর ভিত্তিশীল। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টি, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলি হাদীছ কী আওয়ালিয়াত (ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা), অনুবাদ : নূরুল ইসলাম (রাজশাহী : শ্যামলবাংলা একাডেমী, মার্চ ২০১৫ খ্রি.), পৃ. ৪২-৪৩।
[৭]. আছ-ছাক্বাফাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল হিন্দ, পৃ. ১৪৪; রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯০; ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা, পৃ. ৪৩-৪৪।
[৮]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯০।
[৯]. আছ-ছাক্বাফাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল হিন্দ, পৃ. ১২৮-১২৯।
[১০]. তিনি শাসক তুহমাসফ এর সময়কার একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। সাথে সাথে শিরাজের মাদরাসায়ে মানসূরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
[১১]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪০৯।
[১২]. মুহাদ্দিছু হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, ইযালাতুল খিফা ‘আন খিলাফাতিল খুলাফা, ১ম খণ্ড (প্রকাশনা স্থান, সংস্থা, সংস্করণ ও সাল বিহীন), পৃ. ৪।
[১৩]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৭।
[১৪]. শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী, তুহফায়ে ইছনা ‘আশারিয়্যাহ (লাক্ষ্মেী : মাতবা‘আ নওলকিশোর, ১৩২৫ হি.), পৃ. ২।
[১৫]. মাক্বালাতে তারীকাত, পৃ. ৩৩; গৃহীত : রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৮।
[১৬]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯৫।
[১৭]. উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য, পৃ. ৯৯-১০০।
[১৮]. উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য, পৃ. ৯৯-১০০।
[১৯]. শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয দেহলভী, আল-ফাতাওয়াউ আল-‘আযীযিয়্যাহ, ১ম খণ্ড (দিল্লী : মাতবা‘ঊল মুজতাবায়ী, তা.বি.), পৃ. ১১৪; রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭০১।
[২০]. বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়াত (ভারতীয় উপমহাদেশের আলেহদাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা), পৃ. ৭৫-৭৬।
[২১]. উল্লেখ্য, শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রীর প্রশ্নের জবাবে তার বিশ্বাস অনুযায়ী উক্ত জবাব প্রদান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পুত্র নন বরং তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল ছিলেন। এছাড়া খ্রিষ্টানরা তাকে শুলেও বিদ্ধ করেনি বরং আল্লাহ তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। দ্রষ্টব্য : সূরাহ মারইয়াম : ৩০; সূরাহ আন-নিসা : ১৫৭-১৫৮; বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়াত (ভারতীয় উপমহাদেশের আলেহদাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা), পৃ. ৭৫-৭৭।
[২২]. রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দা‘ওয়াতি ফিল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭০৫।
[২৩]. প্রাগুক্ত, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭০৫-৭১২।