আল্লামা নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রাহিমাহুল্লাহ)
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী*
(২য় কিস্তি)
জীবন যুদ্ধে ছিদ্দীক হাসান খান
তিনি ২১ বছর বয়সে দিল্লী থেকে তাঁর জন্মস্থান কান্নৌজে ফিরে আসেন এবং কয়েক মাস অবস্থান করার পর তিনি জীবিকার সন্ধানে ভূপাল গমন করেন। কারণ পারিবারিকভাবে তারা তেমন সচ্ছল ছিলেন না। ভূপালে তিনি বিশিষ্ট সালাফী আলেম মন্ত্রী জামালুদ্দীন খান ছিদ্দিকী দেহলেবীর সাথে দেখা করেন। তার সাথে ছিদ্দীক হাসান খানের পারিবারিক সম্পর্ক থাকার সুবাদে তিনি তাঁকে সেখানে সসম্মানে থাকার ব্যবস্থা করেন এবং তার নাতীদের পড়া-শোনা করার দায়িত্ব দেন।
এছাড়াও মন্ত্রী জামালুদ্দীন খানের মধ্যস্থতায় ভূপালের রাণী সিকান্দার জাহান বেগমের সাথে তার পরিচয় হয়। রাণী তাকে তার বিশেষ দেওয়ানীতে লেখক হিসাবে নিয়োগ দানের পাশাপাশি তার উপর মসজিদে ইবরাহীম খান এ প্রতি শুক্রবারে ওয়ায-নছীহত করার দায়িত্ব অর্পন করেন।
কিন্তু ১২৭৩ হিজরী মোতাবেক ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের এক আলেমের সাথে ইলমী বিষয়ে তার মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় তাকে সরকারী দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। ফলে তিনি ভূপাল থেকে পিতৃভূমি কান্নৌজে ফিরে এসে মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কান্নৌজ ফিরার পথে তার ব্যাগ-ব্যাগজে চুরি হয়ে গিয়েছিল।
যাহোক, তিনি অল্প কিছু দিন সেখানে অবস্থান করার পর কাজের সন্ধানে কানপুর গমন করেন। কিন্তু সে সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হলে তিনি সপরিবারে বিলগ্রাম চলে যান এবং সেখানে তারা অতি কষ্টে জীবন-যাপন করতে থাকেন। কিন্তু তিনি সেখানে অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে ১২৭৬ হিজরী মোতাবেক ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পুরো কুরআনুল কারীম মুখস্থ করেন।
সে বছরের শেষ দিকে তিনি কান্নৌজে ফিরে আসেন। অতঃপর অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি কান্নৌজ থেকে মির্যাপুরে স্থানান্তিত হন। সেখান থেকে ২য় বারের মত ভূপাল গমন করেন। অতঃপর সেখান থেকে চলে যান টংক। টংকয়ে অবস্থানকালীন তাকে ভূপালের ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যে ভূপালে ডেকে পাঠানো হয়। সেই আহ্বানে তিনি সেখানে এসে নতুন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ভূপালের মন্ত্রীর মেয়ের সাথে বিয়ে
এখানে ১২৭৭ হিজরী মোতাবেক ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রী জামালুদ্দীন তার ছোট মেয়ে যাকিয়া বেগমের সাথে ছিদ্দীক হাসানের বিয়ে দেন। তিনি ছিলেন বিধবা। ছিদ্দীক হাসান খান তাঁর সহধর্মিণীর প্রশংসা করতেন। এ বিয়ের মাধ্যমে তিনি ভূপালের আমীর পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে স্থায়িত্ব লাভ করেন। তার এই সহধর্মিণী থেকে তিনি দু’সন্তানের জনক হন। একজনের নাম আবুল খায়ের মীর নূরুল হাসান খান তৈয়ব। অপরজনের নাম সৈয়দ শরীফ মীর নূরুল হাসান খান তাহির।
সরকারের উচ্চপদে উন্নীত
এদিকে ছিদ্দীক হাসান খাঁনের জ্ঞান-গরিমা, মেধা-পরিশ্রম ভূপালের রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফলে তিনি তাকে সরকারের উচ্চপদে উন্নীত করেন। তাকে ‘আল-ওয়াকায়ে’ নামক একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে তার নিকট শিক্ষা মন্ত্রণালয় অতঃপর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ সরকারী কোষাগারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
মায়ের মৃত্যু ও ক্ষমতার মসনদে নতুন রাণী শাহজাহান বেগম
এখানে সার্বিক অবস্থা ভালো হলে তিনি তার মা ও বোনদেরকে কান্নৌজ থেকে ভূপাল নিয়ে আসেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তার মা-জননী দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। এর ছয় মাস পরে তার বড় ও মেজো দু’বোনও মৃত্যুবরণ করেন। একই বছর রাণী সিকান্দার বেগমও ইহধাম ত্যাগ করেন। রাণীর মৃত্যুর পর ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন তার মেয়ে শাহজাহান বেগম।
ঐতিহাসিক হজ্জ সফর
১২৮৫ হিজরী মোতাবেক ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুম্বাই বন্দর থেকে হজ্জের উদ্দেশে বায়তুল্লাহর দিকে যাত্রা শুরু করেন। সফর ছিল পানি জাহাজের মাধ্যমে। যার কারণে তাকে এই সফরে অনেক কষ্ট ও ক্লেশের শিকার হতে হয়। কষ্টের আরেকটি কারণ হল, তার সফর সঙ্গীদের কিছু লোক ছিল যারা সাগরে ঝড় উঠলে গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করত। তিনি এ সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তার ঐতিহাসিক সফর কাহিনী ‘رحلة الصديق إلى البيت العتيق‘ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তার এ কষ্ট-ক্লেশকে মূল্যবান রত্ম ভা-ারে পরিবর্তন করে দেন। তিনি সফরের পুরো সময়টাকে ইলম চর্চার কাজে লাগান। তিনি এই সফরে মক্কা যাওয়ার পথে জাহাজে বসেই ইমাম ইবনু আব্দুল হাদী রচিত الصارم المنكي কিতাবটির অনুলিপি তৈরি করেন। তিনি বলেন, ‘সাগর পথে ভ্রমণের সময়গুলোকে আমি অনর্থক নষ্ট হতে দেইনি’।
ইয়ামানে যাত্রা বিরতি
তারা ইয়ামানের আদন হয়ে হুদায়দা বন্দরে যাত্রা বিরতি করেন। সেখানে তিনি কাজী হুসাইন ইবনু মুহসিন আল-আনছারী এবং তার ভাই যায়নুল আবেদীনের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। তাদের মেহমানদারীর প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘সেখানে ১২ দিন অবস্থান করি। সে সময় বিভিন্ন হাদীছের কিতাব অধ্যয়ন করতাম। ইলম চর্চায় প্রচুর ব্যস্ততার কারণে ফরয ছালাত ছাড়া মসজিদে যেতাম না’। তিনি সেখানে আল্লামা ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং আল্লামা আমীর সান‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মত ইয়ামানের আহলে সুন্নাহর বড় বড় আলেমদের লিখিত গ্রন্থগুলোর কিছু অধ্যয়ন করেন, কিছু ক্রয় করেন আর কিছু অনুলিপি তৈরি করে নেন। তার ক্রয়কৃত কিতাবগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত ইক্বতিযাউস সিরাতিল মুস্তাক্বীম আর ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত নায়লুল আওত্বার, ফাৎহুল কাদীর এবং ইরশাদুল ফুহূল। আরও ক্রয় করেন ইবনু আল্লান ছিদ্দীকীর হস্তলিখিত ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাৎহুল বারী। এটি তিনি ৬০০ স্বর্ণমুদ্রা দ্বারা ক্রয় করেন। পরবর্তীতে তিনি ফাৎহুল বারীর এই কপিটি তার নিজস্ব খরচে মুদ্রণ করেছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি উক্ত কিতাবগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। এগুলোর মধ্যে কোনটির ব্যাখ্যা করেন, কোনটি সংক্ষিপ্ত করেন এবং কোনটা পরিমার্জন করেন এবং সেগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। যার কারণে অধিকাংশ হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে ইমাম শাওকানীর সাথে তার ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি প্রসিদ্ধি অর্জন করে। উল্লেখ্য যে, তিনি মুজতাহিদ ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অনেক ছাত্রের নিকটও জ্ঞান অর্জন করেন। এ সকল ছাত্রদের নাম তিনি سلسلة العسجد في ذكر مشايخ السند কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
মক্কার পথে
যাহোক ইয়ামানের হুদায়দা থেকে সাগর পথে জেদ্দা বন্দরে পৌঁছেন যিলক্বদ মাসের শেষ দিকে। তারপর মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ আদায় করেন। অতঃপর হজ্জের সময় হজ্জ সম্পন্ন করেন। তিনি মক্কা থেকে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ ক্রয় করেন, কতিপয় ছোট-বড় কিতাব স্বহস্তে কপি করেন। যেমন ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত আস সিয়াসাতুশ শারঈয়্যাহ। আর কিছু কিতাব অন্যের মাধ্যমে কপি করিয়ে নেন। তম্মধ্যে একটি কিতাব হল, ইবনু নাসিরুদ্দীন (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত আর রাদ্দুল ওয়াফী।
মদীনার পথে
অতঃপর তিনি মক্কা থেকে মদীনা গমন করেন সফর মাসে। সেখানে ইবনুল হাজ্জ (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত আল মাদখাল গ্রন্থটি ক্রয় করেন।
ঘরে ফেরার পালা
অতঃপর মদীনা থেকে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে মক্কা আগমন করেন। ওমরাহ করার পর জেদ্দা হয়ে পুণরায় নিজ দেশে ফিরে আসেন। পথিমধ্যে জাহাজে বসেই সুনানে নাসাঈ কিতাবটি একটি মূলবান নুসখা থেকে কপি করেন। এই নুসখাটি তিনি তাকে ইজাযা প্রদানকারী শাইখ মুহাদ্দিছ ইয়াবূব দেহলবীর শ্বশুরের নিকট থেকে ধার নিয়েছিলেন। এটিতে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর টীকা সংযোজিত ছিল। পরে তিনি এটিকে মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি দুই হারাম তথা মক্কা ও মদীনায় প্রায় আঠারো মাস অবস্থান করেন। এসময় তিনি সেখানকার আলেমদের নিকট থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উপকৃত হন এবং তাদেরকেও উপকৃত করেন। তার এই হজ্জ সফরটি ইলম চর্চা ও কিতাব সংগ্রহের মধ্যমে সময়কে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এক অনবদ্য উদাহরণ হয়ে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান
ছিদ্দীক হাসান খান (রাহিমাহুল্লাহ) বহু মূল্যবান ও দুর্লভ কিতাবাদী এবং জ্ঞানের এক বিশাল ভা-ার নিয়ে হজ্জ থেকে ফিরে এসে ইলমের খেদমতের অবদান রাখার পাশাপাশি সরকারী দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। এরপর শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপক অবদানের কারণে ভূপালের মহীয়সী রাণী শাহজাহান বেগম তাঁর হাতে ভূপালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশে প্রচুর স্কুল, মাদরাসা, ইন্সটিটিউট, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। জ্ঞান চর্চার ভুবনে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, বহু দুর্লভ পা-ুলিপি ও মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করা। এ কাজের উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা, মদীনা, মিসর, আস্তানা (কাজাখিস্তানের রাজধানী ও প্রধান শহর) ইত্যাদি অঞ্চলে একদল আলেম, গবেষক ও লেখক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের জন্য তিনি ভাতারও ব্যবস্থা করেছিলেন।
ভূপালের রাণীর সাথে বিবাহ বন্ধন এবং ইলমের ময়দান থেকে রাজ সিংহাসনে আরোহণ
ভূপালের রাণী বেগম শাহজাহান একজন জ্ঞানবতী ও সম্মানিত মহিলা ছিলেন। তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করার পর তিনি বিধবা অবস্থায় জীবন-যাপন করছিলেন। কিন্তু তিনি একজন দ্বীনদার, ইলমের অধিকারী সম্মানিত ব্যক্তিকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। তাই তিনি তাঁর লেখক ও অনুবাদক ছিদ্দীক হাসান খানকে নির্বাচন করে তাকে বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ছিদ্দীক হাসান খান এই প্রস্তাব গ্রহণ করে হিজরি ১২৮৮ মোতাবেক ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর থেকে তিনি তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে ভূপালের শাসন ক্ষমতার দায়িত্ব নেন এবং তাকে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
রাষ্ট্রনায়ক যখন ইলম ও দাওয়াতের একনিষ্ঠ খাদেম
ভূপালের শাসনভার গ্রহণ করার পর তিনি সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে দেশের অবস্থার অগ্রগতি সাধিত হয়। মানুষের ধর্মীয়, নৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। তিনি সরকারী বিভিন্ন পদে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ দায়িত্বশীলদের থেকে প্রশাসনকে পরিচ্ছন্ন করে তদস্থলে যোগ্য ও কর্তব্যপরায়ণ দায়িত্বশীলদেরকে নিয়োগ প্রদান করেন।
আলেম-ওলামা তাঁর কাছে একত্রিত হতে থাকেন। তিনি তাদের জন্য উচ্চমানের বেতন-ভাতা চালু করেন এবং তাদেরকে ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ এর জন্য উৎসাহিত করেন। অনুরূপভাবে তাদেরকে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইলমে শরঈ, বিশেষ করে সালাফী আকীদা, ইলমুল হাদীছ প্রচার-প্রসার এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার প্রতি জনগণের মাঝে দাওয়াতি কাজ করতে উৎসাহিত করেন। ফলে দেশে ধর্মীয় দিক দিয়ে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়। এভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতার পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইলম ও দাওয়াতের একনিষ্ঠ খাদিম হিসাবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে রইলেন আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রাহিমাহুল্লাহ)।
হিংসা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুতি
তাঁর সফল রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বিশ্বব্যাপী কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইলম ও দাওয়াতের প্রসারের ফলে হিংসুকদের গাত্রদাহ হতে শুরু করে। ফলে তারা তৎকালীন দখলদার ইংরেজ শাসকদের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে চোগলখোরি করে এবং নানা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করতে থাকে। যার কারণে ইংরেজ শাসকরা তার স্ত্রীকে নির্দেশ দেয়, যেন ছিদ্দীক হাসান খানকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
প্রথম পর্যায়ে এটি প্রতিহত করা হলেও পরে তিনি নিজের জীবননাশ এবং ক্ষমতা হারানোর আশংকায় হিজরী ১৩০২ মোতাবেক ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে শাসন ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। কিন্তু শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে সরলেও তিনি সম্মান ও মর্যাদা সহকারে রাজ প্রসাদে লিখনি, জ্ঞান-গবেষণা ও অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।
অনন্তের পথে যাত্রা
তিনি ২৯ জুমাদাল আখেরা ১৩০৭ হিজরী মোতাবেক ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্মস্থান ভারতে উত্তর প্রদেশে তার পিতৃ ভূমি কান্নৌজে দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। তিনি দু’জন ছেলে রেখে যান। আল্লাহ তায়ালা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রাখুন, তাঁকে ক্ষমা করুন এবং ইলমকে পুনর্জীবিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপক অবদান এবং ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন। আমীন!
দৈহিক গঠন ও চারিত্রিক গুণাবলী
তিনি ছিলেন ফর্সা এবং মধ্যম গঠনধারী ব্যক্তিত্ব। শরীরে তেমন বার্ধক্য প্রকাশিত হয়নি। চুল ছিল কানের লতি পর্যন্ত। দানশীল ছিলেন। ভূপালে তাঁর মহামতি স্ত্রী শাহজাহান বেগমের পক্ষ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করার সময় তিনি অনেক ধন-সম্পদ আলেম-ওলামা এবং তালিবুল ইলমদের জন্য ব্যয় করেছেন। তাদের জন্য ভালো মানের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে তাদেরকে ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ করার কাজে উৎসাহিত করেছেন।
ইলম, আমল, সচ্চরিত্র এবং কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সেই সাথে তার মাঝে ছিল দয়া, অনুকম্পা, অনুদান, সাহসিকতা, স্থির চিত্ত, কর্ম দক্ষতার বিশেষ গুণ। তিনি বিলাসিতা মুক্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* দাঈ, যুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সালাফে ছালেহীন