প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে
সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রাহিমাহুল্লাহ)
প্রখ্যাত তাবেঈ, যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, খ্যাতনামা আবিদ সাঈদ ইবনু জুবায়ের ৪৬ হিজরীতে কূফা নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় হিবরুল উম্মাহ ইবনু আব্বাস, ইবনু ওমর ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখ জলীল কদর ছাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন এর নিকট থেকে ইলম অর্জন করেছেন। তিনি বড় মাপের একজন আবিদ ছিলেন। প্রতি তিনরাত ও তিন দিনে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন, রাতের অধিকাংশ সময় তাহাজ্জুদের ছালাতে দীর্ঘ সময় তেলাওয়াত করতেন। দিনের বেলায় ও দীর্ঘ সময় তেলাওয়াত করতেন। ফলে প্রতি তিন দিনের মধ্যে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। যেহেতু তিনি কূফা নগরীতে বসবাস করতেন, দেশের জ্ঞান পিপাসু ছাত্রদের তিনি দ্বীন শেখাতেন। তাই কালক্রমে তাবিঈন ওলামায়ে কেরামের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। এক বছর ওমরাহ পালন করতেন পরবর্তী বছর হজ্জ করতেন।
উমাইয়্যা শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের যুল্মের বিরুদ্ধে সমালোচনার কারণে তিনি জীবনের প্রায় দশটি বছর ফেরারী জীবন-যাপন করতে বাধ্য হন। এসময় তিনি আব্দুর রহমান ইবনুল ‘আছ‘আছ’ নামক একজনের সঙ্গী ছিলেন। এক সময় মক্কা নগরীতে অবস্থান নিরাপদ ভেবে সেখানে আশ্রয় নেন, কিন্তু তদানীন্তন মক্কার শাসক খালিদ বিন আব্দুল্লাহ আল কুসারী হাজ্জাজের আদেশে তাঁকে হাজ্জাজের নিকটে পাঠিয়ে দেন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আস-সাকাফী বন্দী সাঈদ ইবনু জুবায়েরের সাথে খুব রূঢ় আচরণ করেন। অশ্লীল বাক্যবানেও সাঈদ ইবনুল জুবায়ের ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি হাজ্জাজের প্রতি বদ দু‘আ করতে বাধ্য হন। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে,
اللهم لا تسلطه على أحد يقتله بعدى
‘হে আল্লাহ! আমার পর এই হাজ্জাজ আর কাউকে যেন হত্যা করার শক্তি না পায়!
ইবনু জুবায়ের ১১ রামাযান ৯৫ হিজরীতে শাহাদতবরণ করেন বটে, কিন্তু হাজ্জাজ বাকি জীবন কাটিয়েছেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, কিছুক্ষণ পর পর চিল্লায়ে উঠতেন, আর বলতেন
ما لى يا سعيد بن جبير ؟
‘আমার কী হলো ওহে সাঈদ ইবনু জুবায়ের’?
সত্য সত্যই হাজ্জাজের নির্মম নির্যাতনে এরপর আর কাউকে জীবন দিতে হয়নি।
হাজ্জাজ এবং সাঈদ ইবনু জুবায়েরের মধ্যে কী সংলাপ সংঘটিত হয়েছিল তার উল্লেখযোগ্য অংশ নি¤েœ তুলে ধরা হলো :
হাজ্জাজ : তোমার নাম কী?
সাঈদ : সাঈদ ইবনু জুবায়ের।
হাজ্জাজ : না, তুমি শাকী ইবনু কুসাইর।
সাঈদ : আমার মা আমার নাম আপনার চেয়ে অধিক অবগত ছিলেন।
হাজ্জাজ : তুমি শাকী (হতভাগা) এবং তোমার মাও হতভাগিনী (শাকিয়্যা)।
সাঈদ : গায়েবের খবর আপনি না বরং আমার আল্লাহই জানেন।
হাজ্জাজ : তোমার জন্য এই পৃথিবীকে আগুনের লেলিহান শিখা বানিয়ে ছাড়ব।
সাঈদ : এ কাজটি আপনার আয়ত্ত্বাধীন বিশ্বাস থাকলে আপনাকেই উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করতাম।
হাজ্জাজ : মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্পর্কে তোমার মতামত কী?
সাঈদ : নাবীউর রাহমাহ ওয়া ইমামুল হুদা।
হাজ্জাজ : আলী বিন আবূ তালেব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে তোমার মতামত কী? উনি কি জান্নাতে না জাহান্নামে?
সাঈদ : আমি জান্নাতে গিয়ে এর অধিবাসীদের দেখার সুযোগ পেলে অবশ্যই বলতে পারতাম।
হাজ্জাজ : অন্যান্য খলীফাদের সম্পর্কে তোমার মতামত কী?
সাঈদ : আমি তো কারো উকীল নই।
হাজ্জাজ : তাদের মধ্য হতে কে তোমার অধিক পসন্দের?
সাঈদ : আমার সৃষ্টি কর্তাকে যিনি অধিক সন্তুষ্টকারী।
হাজ্জাজ : কে আল্লাহকে অধিক সন্তুষ্টকারী?
সাঈদ : এ খবর তো একমাত্র তিনিই জানেন।
হাজ্জাজ : ও বুঝেছি, তুমি আমার কাছে সত্য কথা বলতে অস্বীকার করছ?
সাঈদ : আমি মিথ্যা বলা পসন্দ করি না।
হাজ্জাজ : তোমার মুখে হাসি নেই কেন?
সাঈদ : মন খারাপ থাকলে মুখে হাসি থাকে না।
হাজ্জাজ এসকল প্রশ্ন করে সাঈদ ইবনু জুবায়ের ঢ়-কে ঘায়েল করতে না পেরে অর্থ-বিত্ত ও পার্থিব পদ-মর্যাদা দিয়েও তাঁকে পরীক্ষা নেন, কিন্তু কোনভাবেই তিনি হাজ্জাজ এর ফাঁদে পা ফেলেননি।
অঢেল অর্থ-বিত্ত সামনে দেখে সাঈদ ইবনু জুবায়ের হাজ্জাজকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ওহে হাজ্জাজ! ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি পার হতে এসবের ভূমিকা কতটুকু? আল্লাহর শপথ! আমি দুনিয়া ও এর সম্পদের মুখাপেক্ষী নই।
এবার হাজ্জাজ সাঈদকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ‘ওয়ালুল লাকা ইয়া সাঈদ’। হে সাঈদ! তোমার জন্য ধ্বংস। সাঈদ জবাব দিলেন, জান্নাত থেকে সরিয়ে দিয়ে কাউকে জাহান্নামে ছুড়ে ফেলে দেয়া হলে সেই ব্যক্তির জন্যই কেবল ‘ওয়ল’।
অতঃপর
হাজ্জাজ : তুমি আমার কাছ থেকে কী ধরনের মৃত্যু চাও?
সাঈদ : আপনি নিজের জন্য কোন্ ধরনের মৃত্যু চান, বেছে নিন। কেননা আমাকে যেভাবে হত্যা করবেন, ক্বিয়ামতের দিন ঠিক ঐভাবেই আল্লাহর বাহিনীর হাতে আপনার মৃত্যু ঘটবে।
হাজ্জাজ : তুমি কি আমার কাছ থেকে ক্ষমা আশা কর?
সাঈদ : ক্ষমা তো কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
হাজ্জাজ জাল্লাদকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার নিকট থেকে একে নিয়ে যাও এবং শীঘ্রই হত্যা কর।
সাঈদের হাতে হ্যান্ড কাপ পরিয়ে যখন বাইরে নেয়া হচ্ছিল। স্বজন ও ভক্তরা কাঁদছিল, তাদের উদ্দেশ্য তিনি বলেছিলেন, তোমরা কাঁদছ কেন? আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু হয় না, তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল,
مَاۤ اَصَابَ مِنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ نَّبۡرَاَہَا ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ.
‘পৃথিবীতে অথবা তোমাদের উপর যে মুসিবত আসে, তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে, আল্লাহর পক্ষে এটি খুবই সহজ কাজ’ (সূরা আল-হাদীদ : ২২)।
অতঃপর সাঈদ সশব্দে হাসলেন।
হাজ্জাজ এ খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে আবার ডেকে পাঠালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হাসছো কেন?
হাজ্জাজ আপনার দুঃসাহস এবং আপনাকে শাস্তি দেয়া বিষয়ে আল্লাহর ধৈর্য দেখে হাসছি।
হাজ্জাজ বললেন, ওকে এখনই আর আমার সামনেই হত্যা কর।
সাঈদ ক্ষীণ শব্দে উচ্চারণ করলেন,
اِنِّیۡ وَجَّہۡتُ وَجۡہِیَ لِلَّذِیۡ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ حَنِیۡفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ.
‘আমার মুখম-লকে আমি সনিষ্ঠভবে সেই মহান সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি যিনি নভোম-ল ও ভূ-ম-ল সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা আল-আন‘আম : ৭৯)।
হাজ্জাজ বললেন, দেখ! ও যেন ক্বিবলামুখি হয়ে মরার সুযোগ না পায়। একথা শুনে সাঈদ পড়লেন,
فَاَیۡنَمَا تُوَلُّوۡا فَثَمَّ وَجۡہُ اللّٰہِ
‘অতএব তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সে দিকেই আল্লাহর মুখ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৫)।
হাজ্জাজ নির্দেশ দিলেন যে, ওর মুখ মাটির সাথে চেপে ধরে হত্যা কর। এবার তিনি পড়তে লাগলেন,
مِنۡہَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَ فِیۡہَا نُعِیۡدُکُمۡ وَ مِنۡہَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی
‘আমরা মাটি হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিব এবং তা হতে পুনর্বার বের করব’ (সূরা ত্বো-হা : ৫৫)।
হাজ্জাজ জোরে জোরে বলতে লাগনে, ওকে যব্হ কর, যব্হ কর! তখন সাঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) হাসতে হাসতে অন্তর থেকে উচ্চারণ করলেন,
فَاَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهِ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
প্রসঙ্গসমূহ »:
সালাফে ছালেহীন