সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন

আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)

-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী*



আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এক আলোকোজ্জ্বল জীবনের প্রতিবিম্ব। ইলমী জগতে বিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়। আধুনিক যুগে মুসলিম জাহানের একজন স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অসীম সাহস, সুদৃঢ় মনোবল আর ইখলাছ ভরা প্রত্যয় থাকলে আল্লাহর রহমতে কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ শতাব্দীর ‘শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ’ এ পরিণত হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আল্লামা আলবানী। আধুনিক বিশ্বে শায়খ আলবানীকে ইলমে হাদীছের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইলমুল জারহে ওয়াত তা‘দীলের[১] ক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র প্রতিভাধারী আলেম হিসাবে গণ্য করা হয়। ইলমে মুস্তালাহুল হাদীছের[২] ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বক্তিত্ব। তাই তো মুহাদ্দিছগণ বলেছেন, ‘আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) যেন ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ), হাফেয ইবনু কাছীর প্রমুখ ইলমুল জারহে ওয়াত তা‘দীলের আলেমদের যুগকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন!” তাই আসুন, হাদীছে নববীর এই নিরলস খাদেম, সালাফে ছালেহীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ, দাঈ, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে পরিচিত হই।

জন্ম ও পরিচয়

নাম : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন, পিতার নাম : আলহাজ্জ নূহ। দাদার নাম : নাজাতী। ডাক নাম : আবূ আব্দুর রহমান। ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনিয়ায় তার জন্ম হওয়ায় তাকে আলবানী বলা হয়। তিনি ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনিয়ার রাজধানী স্কোডার (ঝযশড়ফল্টৎ-বর্তমান নাম তিরানা) এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল দরিদ্র। কিন্তু দ্বীনদারী ও জ্ঞানার্জন তাদের দরিদ্রতার উপর ছিল বিজয়ী। তার পিতা ছিলেন আলবেনিয়ার একজন বিজ্ঞ আলেম। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য মানুষ তার কাছে ছুটে যেত। তিনি সাধ্যানুযায়ী মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান দিতেন এবং তাদেরকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করতেন। তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে শরী‘আহ বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ জাগু পাশ্চাত্য সেক্যুলার সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়ে নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করলে তিনি শিশু আলবানীকে নিয়ে স্বপরিবারে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হিজরত করেন।

শিক্ষা জীবন

দামেস্ক আসার পর আলবানীর বয়স প্রায় নয় বছর হলে তার পিতা তাকে সেখানকার ‘স্কুল অব এইড চ্যারিটি’ নামক একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানেই তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। প্রচলিত একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্বীন সম্পর্কে ভালো জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। বিধায় তার পিতা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ ছেলের পড়া-শোনার ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টি পোষণ করতেন। এ কারণে তিনি নিজে সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা সিলেবাস তৈরি করে তার মাধ্যমে তাকে আল-কুরআনুল কারীম, তাজবীদ, নাহু, ছরফ এবং হানাফী ফিক্বহ ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা দিতে লাগলেন। ফিক্বহের মধ্যে হানাফী ফিক্বহের অন্যতম কিতাব মুখতাছারুল কুদূরী পড়ান। তিনি তার পিতার কাছেই হাফস ইবনু আসেম এর রেওয়ায়েত অনুযায়ী কুরআনের হিফয সমাপ্ত করেন।

শায়খ আলবানীর শিক্ষকগণ

ইমাম আলবানীর শিক্ষকের সংখ্যা ছিল হাতেগণা কয়েকজন। যেমন, (১) তার পিতা শায়খ আলহাজ্জ নূহ। (২) তার পিতার বন্ধু বিশিষ্ট আলেম শাইখ সাঈদ আল-বুরহানীর নিকট কিশোর আলবানী হানাফী ফিক্বহের কিতাব মুরাকিল ফালাহ, নাহুর কিতাব শুযূরুয যাহাব এবং আধুনিক যুগের লিখা আরবী সাহিত্য ও ইলমুল বালাগাহর কিছু কিতাব পড়েন। (৩) এর পাশাপাশি তিনি তখনকার দামেস্কের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা মুহাম্মাদ বাহজা আল-বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশগ্রহণ করতেন। (৪) আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আরেকজন শায়খ হলেন আল্লামা রাবিগ আত-ত্বব্বাখ। তিনি সিরিয়ার অত্যন্ত বড়মাপের একজন আলেম ছিলেন। তিনি হালাবের আল্লামা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এই শায়খের নিকট তিনি হাদীছ পড়েন। অতঃপর তিনি আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে হাদীছের ইজাযা প্রদান করেন।

কর্ম জীবন

তিনি তার পিতার কাছেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শিখেন এবং এ ক্ষেত্রে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঘড়ি মেরামতকেই জীবিকার পেশা হিসাবে বেছে নেন। এই পেশায় তিনি ব্যক্তিগত পড়া-লেখা ও বিভিন্ন কিতাবাদি অধ্যয়নের পর্যাপ্ত সময় পান। এভাবে সিরিয়ায় হিজরতের মাধ্যমে তার জন্য আরবী ভাষা ও মূল উৎস থেকে শরী‘আতের জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়।

হাদীছ অধ্যয়নের প্রতি মনোনিবেশ

যদিও তার পিতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল তার ছেলে যেন হানাফী মাযহাবের তাক্বলীদ করে। যার কারণে তিনি তাঁকে ইলমে হাদীছ চর্চায় মনোনিবেশ করতে সতর্ক করতেন। তথাপি আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ইলমুল হাদীছ ও হাদীছ চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রেরণা যোগায় শায়খ মুহাম্মাদ রশীদ রেযা (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক প্রকাশিত ‘আল-মানার’ নামক একটি মাসিক ম্যাগাজিন। সেখানে হাদীছ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সন্দর্ভ প্রকাশিত হয় এবং তিনি সেগুলো নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন। এভাবে ধীরে ধীরে হাদীছ চর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তারপর ব্যাপক আগ্রহ সহকারে হাদীছ চর্চা শুরু করেন। ফলে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি হাদীছের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।

এবার তিনি হাদীছের সেবায় কলম ধরলেন। সর্বপ্রথম যে কাজটি করলেন তা হল, তিনি হাফেয ইরাকী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর লিখা المغني عن حمل الأسفار في تخريج ما في الإحياء من الأخبار নামক কিতাবটি কপি করে তাতে টীকা সংযোজন করলেন। শায়খের এই কাজটি তার সামনে হাদীছ নিয়ে গবেষণার বিশাল দরজা খুলে দেয়। এরপর ইলমে হাদীছ নিয়ে গবেষণা করা তার প্রধান কাজে পরিণত হয়। ক্রমেই তিনি দামেস্কের ইলমী জগতে এ বিষয়ে পরিচিতি লাভ করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে দামেস্কের ‘জাহেরিয়া লাইব্রেরী’ কর্তৃপক্ষ তার জন্য বিশেষ একটি কক্ষ নির্ধারণ করে দেয়, যেন তিনি সেখানে অবস্থান করে গবেষণাকর্ম চালাতে পারেন। সেই সাথে লাইব্রেরীর একটি চাবিও তাকে দেয়া হয় যেন তিনি যখন খুশি তাতে প্রবেশ করতে পারেন। তবে তিনি বই-পুস্তক লেখা শুরু করেন তার জীবনে দ্বিতীয় স্তরে। এই পর্যায়ে এসে তিনি সর্বপ্রথম যে গ্রন্থটি রচনা করেন তা হল, تحذير الساجد من اتخاذ القبور مساجد। এটি একটি দলীলনির্ভর তুলনামূলক আলোচনা ভিত্তিক ফিক্বহের কিতাব। এটি একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে। ইলমে হাদীছের রীতি অনুসারে হাদীছের তাখরীজ সংক্রান্ত প্রথম পর্যায়ের অন্যতম একটি গ্রন্থ হল, الروض النضير في ترتيب و تخريج معجم الطبراني الصغير, যা এখানো পা-ুলিপি আকারেই রয়েছে।

আল্লাহর রাসূল ধ-এর হাদীছের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মধ্যে সালাফী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। সেই সাথে সালাফী ধারার বিশ্ব বরেণ্য আলেম শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) এবং তার ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করার ফলে এই রীতির উপর তার দৃঢ়তা আরও মজবুত হয়।

শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এবার সিরিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াতের পতাকা তুলে ধরলেন। ফলে সিরিয়ার অনেক আলেম ওলামা তার সাক্ষাতে আসেন এবং শায়খ ও ঐ সকল আলেমদের মাঝে তাওহীদের বিভিন্ন মাসআলা, কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ, মাযহাবী গোঁড়ামি, বিদ‘আত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়। ফলে মাযহাবের অন্ধভক্ত গোঁড়া আলেম-ওলামা, ছূফি, বিদ‘আতী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন একশ্রেণীর নামধারী আলেমদের পক্ষ থেকে তিনি প্রচ- বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ সকল ব্যক্তিরা সাধারণ অজ্ঞ-মূর্খ লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। তাকে ‘পথভ্রষ্ট ওহাবী’ বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং জনসাধারণকে শায়খ থেকে সর্তক করতে থাকে।

অপরপক্ষে তার দাওয়াতের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন দামেস্কের ইলম ও পরহেজগারিতায় প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য আলেম-ওলামা। তারা শাইখকে তার দাওয়াতের পথে দৃঢ় কদমে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন। সে সকল ওলামার মধ্যে অন্যতম হলেন, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা বাহজাত আল-বাইতার, সিরিয়া মুসলিম যুবসংঘের প্রধান শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আল-ইমাম, শায়খ তাওফীক আল-বাযারাহ প্রমুখ।

শায়খ আলবানীর দাওয়াহ কার্যক্রম

তিনি প্রতি সপ্তাহে দু’দিন আক্বীদাহ, ফিক্বহ, উছূল এবং ইলমুল হাদীছ ইত্যাদি বিষয়ে দারস প্রদান করতেন। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও উপস্থিত হতেন। এতে তিনি যে সকল বইয়ের উপর দারস প্রদান করতেন সেগুলো নি¤œরূপ:

(১) ফাৎহুল মাজীদ : আব্দুর রহমান ইবনু হাসান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাব। فتح المجيد لعبد الرحمن بن حسن بن محمد بن عبد الوهاب

(২) আর-রওযাতুন নাদিয়াহ শারহুদ দুরারুল বাহিয়্যাহ লিশ শাওকানী শারহু ছিদ্দীক হাসান খাঁন। الروضة الندية شرح الدرر البهية للشوكاني شرح صديق حسن خان.

(৩) উছূলুল ফিক্বহ : আব্দুল ওয়াহাব খাল্লাফ। أصول الفقه لعبد الوهاب خلاف

(৪) আল-বায়িসুল হাসীস শারহু ইখতিছারি উলূমিল হাদীছ লি ইবনে কাছীর : আহমদ শাকির। الباعث الحثيث شرح اختصار علوم الحديث لابن كثير شرح احمد شاكر

(৫) মিনহাজুল ইসলাম ফিল হুকম : মুহাম্মদ আসাদ। منهاج الإسلام في الحكم لمحمد أسد

(৬) ফিক্বহুস সুন্নাহ : সাইয়েদ সাবিক। فقه السنه لسيد سابق

তিনি প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে দাওয়াতী সফরে বের হতেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি মাসে এক সপ্তাহ দাওয়াতী কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন জেলায় দাওয়াত নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি জর্দানের বিভিন্ন এলাকায়ও সফর করতেন এবং অবশেষে তিনি জর্দানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই কারণে তার কিছু দুশমন সিরীয় সরকারের কাছে তার ব্যাপারে চুগলখোরি করলে সরকার তাকে জেলে পাঠায়।

কষ্টে ধৈর্যধারণ ও হিজরত

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শায়খ সিরিয়া ক্ষমতাসীনদের নজরদারীতে পড়েন যদিও তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। যা তার সামনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তিনি দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রথমবার ৬৮ সালের আগে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে বন্দি ছিলেন একমাসের জন্য। এটা সেই কারাগার যেখানে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ৬৮ সালের যুদ্ধের সময় সিরীয় সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করে দিলে তিনিও মুক্ত হন। কিন্তু যুদ্ধ আরও কঠিন রূপ ধারণ করলে শায়খকে পুনরায় কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু এবার কেল্লা কারাগারে নয় বরং দামেস্কের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের আল-হাসাকা কারাগারে। শায়খ এখানে আটমাস অতিবাহিত করেন। কারাগারে অবস্থানের এই আটমাস সময়ে তিনি হাফেয মুনযেরীর লেখা মুখতাছার ছহীহ মুসলিম তাহক্বীক্ব করেন এবং সেখানে অন্যান্য বড় বড় রাজবন্দী ব্যক্তিত্বের সাথে মিলিত হন। পরবর্তীতে তিনি সিরিয়া ছেড়ে জর্ডানে পাড়ি জমান এবং রাজধানী আম্মানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

কার্যক্রম ও অবদান

শায়খের অনেক ইলমি অবদান ও খেদমত রয়েছে। যেমন,

(১) শায়খ দামেস্ক একাডেমীর কতিপয় শিক্ষকদের সাথে আল্লামা বাহজাত আল-বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশগ্রহণ করতেন। সে সকল শিক্ষকদের একজন হলেন ইযযুদ্দীন আত-তানূহী (রাহিমাহুল্লাহ)।

(২) দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ ফ্যাকাল্টির পক্ষ থেকে তাকে ‘ইসলামী ফিক্বহ কোষ’-এর বুয়ূ‘ বা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত হাদীছগুলো তাখরীজ করার জন্য মনোনীত করা হয়, যা ১৯৫৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

(৩) মিসর ও সিরিয়া একীভূত হওয়ার যুগে হাদীছের কিতাবসমূহ তাহক্বীক্ব ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শায়খকে এই প্রকল্প তত্ত্বাবধান কমিটির সদস্য হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়।

(৪) ভারতের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া বেনারসে হাদীছের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়ার জন্য তার নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু তৎকালীন ভারত-পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ চলছিল। তাই স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যাওয়া কঠিন হওয়ায় তিনি সেখানে যেতে অপারগতা পেশ করেন।

(৫) সঊদী আরবের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শায়খ হাসান আলুশ শাইখ আব্দুল্লাহ ১৩৮৮ হিজরীতে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের হায়ার ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্টডিজ বিভাগের ডীন হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন করেন কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

(৬) ১৩৯৫ হিজরী থেকে ১৩৯৮ হিজরী পর্যন্ত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসাবে তাকে মনোনীত করা হয়।

(৭) স্পেনের ‘মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’-এর আহ্বানে তিনি সেখানে গিয়ে অত্যন্ত সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে ‘আক্বীদা ও আহকাম উভয় ক্ষেত্রেই হাদীছ স্বয়ংসম্পন্ন প্রমাণ’ এই শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

(৮) কাতার সফরে গিয়ে সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের বিষয় ছিল, ‘ইসলামে সুন্নাহর মর্যাদা’।

(৯) সঊদী আরবের মহামান্য গ্রান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পক্ষ থেকে তিনি মিসর ও মরক্কো এর ফাতাওয়া ও গবেষণা বোর্ডের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের তাওহীদ ও কুরআন-সুন্নাহর দিকে আহ্বানের জন্য গঠিত একটি ইসলামী সংগঠনের প্রধান হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

(১০) তাঁকে দেশে-বিদেশে অনেক সম্মেলনে অতিথি হিসাবে আহ্বান করা হয়। কিন্তু তিনি তার জ্ঞান-গবেষণার কাজে ব্যস্ততার দরুন অনেক দাওয়াতে সাড়া দিতে পারেননি।

(১১) তিনি কুয়েত ও আরব আমিরাতে সভা-সেমিনারে অনেক বক্তব্য প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ইউরোপের কয়েকটি দেশে গমন করে সেখানকার মুসলিম অভিবাসী ও শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অনেক মূল্যবান দারস পেশ করেন। এছাড়াও তিনি ব্রিটেন এবং জার্মানিতে দাওয়াতী উদ্দেশ্যে সফর করেন।

(১২) শায়খের নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করে অগণিত ছাত্র বের হয়েছে, যারা পরবর্তীতে বড় বড় গবেষক হিসাবে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন।

ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কতিপয় ছাত্র

শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বিভিন্ন দেশ প্রচুর সফর করতেন। যার কারণে তার ছাত্রের সংখ্যাও প্রচুর, যারা তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কতিপয় ছাত্র হল, (১) আলামা ইহসান ইলাহী যহীর, (২) ডক্টর বাসিম ফায়সাল আল-জাওয়াবিরাহ, (৩) শায়খ হুসাইন ইবন আউদাহ আল উয়াইশাহ, (৪) আল্লামা শায়খ রবী ইবন হাদী আল-মাদখালী, (৫) শায়খ আলী হাসান আল-হালাবী, (৬) শায়খ মুক্ববিল ইবন হাদী আল-ওয়াদাঈ, (৭) শায়খ মাশহূর হাসান আলে সালমান এবং (৮) শায়খ জামীল যাইনূ। এছাড়াও অসংখ্য বড় বড় আলেম রয়েছেন, যারা শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এর সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করেছেন।

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


* দাঈ, যুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. হাদীছ বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত অবস্থা পর্যালোচনামূলক জ্ঞানকে ‘ইলমুল জারহে ওয়াত তা‘দীল’ বলা হয়।
[২]. যে ইলমের মাধ্যমে গ্রহণীয় বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দিক দিয়ে বর্ণনাকারী ও বর্ণিত হাদীছ বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমে মুস্তালাহুল হাদীছ’ বলা হয়।




ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (২য় কিস্তি ) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আলী আল-ইথিওপীর বিদায় : ঝরে গেল শরী‘আতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র - আযহারুল ইসলাম
আল্লামা নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
ড. মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিদায় - তানযীল আহমাদ

ফেসবুক পেজ