শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*



৩. সুন্নাতের পুনর্জীবন ও বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান

ধর্মীয় সংস্কারে শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অন্যতম ভূমিকা ছিল, বিচ্যুত হওয়া সুন্নাতের পুনর্জীবিত করা একং সকল প্রকার বিদ‘আত ও নতুন সৃষ্টি হওয়া কোন আমলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, যা প্রথম শতাব্দীতে ছিল না। যেমন তিনি বলেন, ‘আমাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল- তাওহীদকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়া এবং নবীগণের সরদার মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাতের পুনর্জীবন করা’।[১] তিনি তাঁর লেখনি, বক্তব্য, পাঠদান ও মুনাযারা সহ সকল ক্ষেত্রে মুসলিম জাতিকে এ মর্মে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যে, সর্বদা সকল ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনার পরিপূর্ণ অনুসরণ করা এবং বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করা। অর্থাৎ তিনি সর্বদা সুন্নাতের পুনর্জীবন ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটন কামনা করতেন। তিনি সূরা আলি ‘ইমরানের ৩১ নং আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক আর আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর ও ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে আমার পদ্ধতির অনুসরণ কর। কেননা আমাকে তোমার নিকট রাসূল ও পথ প্রদর্শক হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। ...আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করবে না, অন্যান্য নতুন পদ্ধতির বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসার দিকে আহ্বান করবে, তাহলে সে মিথ্যুক। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তার থেকে মুক্ত’।[২] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন কোন শায়খ, ফকীর, দরবেশ, আলিম, মৌলভী, পিতা-মাতা, আমীর, সম্রাটের কোন রায় আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কোন কথা ও কাজের বিপরীতে হয়, তখন সেটকে প্রত্যাখ্যান করা ওয়াজিব। তবে কেউ যদি হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের কথা ও আমলকে গ্রহণ করে তাহলে সে মুসলিম নয়’।[৩]

মূলত শাহ ইসমাঈলের দা‘ওয়াত কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং বিদ‘আতকে প্রতিরোধ করার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি বিদ‘আত প্রতিরোধের বিষয়টি ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট গণ্য করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَا مِنْ نَبِىٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِىْ أُمَّةٍ قَبْلِىْ إِلَّا كَانَ لَهُ فِىْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّوْنَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُوْنَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُوْنَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوْفٌ يَقُوْلُوْنَ مَا لَا يَفْعَلُوْنَ وَيَفْعَلُوْنَ مَا لَا يُؤْمَرُوْنَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الْإِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ

‘আমার পূর্বে আল্লাহ এমন কোন নবীকে তাঁর উম্মতের মধ্যে প্রেরণ করেননি, যাদের মধ্যে তাঁর জন্য ‘হাওয়ারী’ এবং সাথীবৃন্দ ছিল না। তারা তাদের নবীর সুন্নাত গ্রহণ করত এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করত। অতঃপর এমন সব লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হল, তারা এমন কথা বলত, যা নিজেরা করত না। তারা এমন কাজ করত, যার নির্দেশ তাদের দেয়া হয়নি। অতএব যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজের হাত দ্বারা জিহাদ করবে, সে মুমিন। যে ব্যক্তি যবান দ্বারা জিহাদ করবে, সেও মুমিন এবং যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে, সেও মুমিন। এরপর এক সরিষাদানা পরিমাণও ঈমান নেই’।[৪]

উক্ত হাদীছের وَيَفْعَلُوْنَ مَا لَا يُؤْمَرُوْنَ ‘তারা এমন কাজ করত, যার নির্দেশ তাদের দেয়া হয়নি’ অংশের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় তারা বিদ‘আত আবিষ্কার করেছে। অতঃপর যারা হাত দিয়ে তার প্রতিহত করবে অর্থাৎ তাদেরকে শাস্তির ব্যবস্থা করবে, প্রহার করবে, সংস্কার করে দিবে এবং তাদের বিদ‘আতকে নষ্ট করে দিবে, তাহলে সে ঈমানের দিক দিয়ে পূর্ণ মুমিন। আর যে ব্যক্তি তাদেরকে ও তাদের এই বিদ‘আতী কাজকে অপসন্দ করবে, তাদের এ বিষয়কে সম্মান না করবে এবং মুখ দিয়ে তাদেরকে উপদেশ প্রদান করবে, তাহলে সে প্রথম পর্যায়ের মুমিন থেকে একটি কম মর্যাদার মুমিন। আর যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে বিদ‘আতকে ঘৃণা করবে, তাদের বিদ‘আতীকে কাজকে অস্বীকার করবে কিংবা তাদের এ বিষয়টি তার মন দিয়ে গ্রহণ করবে এবং অন্তরকে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট রাখবে, তাহলে তারাও মুমিন কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বশেষ স্তরের মুমিন। সুতরাং যে ব্যক্তি বিদ‘আতে লিপ্ত সে কিভাবে তার ঈমানে প্রত্যাবর্তন করবে?’[৫] এজন্য তিনি বলেছেন, ‘বিদ‘আতকারীর ভাগ্যে তওবাহ জোটে না। কেননা সে ভাল মনে করেই বিদ‘আত করে, যা তাকে তওবাহ করতে দেয় না’।[৬] যেমটি হাদীছে এসেছে, আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ حَجَرَ التَّوْبَةَ عَنْ كُلِّ صَاحِبِ بِدْعَةٍ ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিদ‘আতীকে তওবাহর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন’।[৭] সুফিয়ান আস-সাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

البدعة أحب إلى إبليس من المعصية والمعصية يتاب منها والبدعة لا يتاب منها

‘ইবলীসের কাছে অন্য যে কোন পাপের চেয়ে বিদ‘আত অতি প্রিয়। কেননা যে কোন পাপ থেকে তওবার সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদ‘আত থেকে তওবার সুযোগ থাকে না’।[৮]

শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) যেমন বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন, তেমনি বিদ‘আতী ফের্কাগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এজন্য তিনি বিদ‘আতী ফের্কা ছূফীবাদের মুখোশ উন্মোচন করে বলেন, ‘সত্যপথ থেকে বহিষ্কৃত ছূফীবাদের অনুসারীরা শরী‘আতকে পরিবর্তন করতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয় না বরং এই পরিবর্তন-পরিবর্ধনই তাদের মৌলিক কাজ। তারা সর্বদা বিদ‘আত ও শিরকী কাজের মত নিকৃষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা মানুষের মাঝে ইলহাদ বা ধর্মহীনতা ছড়িয়ে দেয়। সুতরাং যারা তাদের কথা ও কাজ অনুযায়ী আমল করবে, তাদেরকে হত্যা করতে হবে অথবা তা‘যীরের আলোকে বিচার করতে হবে’।[৯]

৪. জিহাদের সুন্নাতের পুনর্জাগরণ

হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যখনই কোন ব্যক্তি আল্লাহর দিকে, শিরক ও বিদ‘আতকে বাতিল গণ্য করার দিকে দা‘ওয়াত দেয় এবং জাহেলী অভ্যাস, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ তাক্বলীদকে প্রত্যাখ্যানের জন্য আহ্বান করে, তখন শত্রু ও বিরোধী পক্ষরা রীতিমত তার রিুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে শারীরিক যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি সহায়-সম্পদ, টাকা-পয়সাও অনেক নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য শরী‘আতে জিহাদ করাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং জিহাদকারীর জন্য অনেক মর্যাদা ও নেকীর কথা বলা হয়েছে। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার উপর অন্যান্য ফরয বিধানের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত। এই জিহাদের মাধ্যমে দ্বীন, ঈমান ও ‘আক্বীদাহ যেমন সংরক্ষণ করা যায়, তেমনি রাষ্ট্র এবং নিজের অর্থ-সম্পদ ও জমি-জায়গাও নিরাপদে রাখা যায়।[১০]

সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ভারতে জিহাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। শিখ ও ইংরেজ বিতরণের যুদ্ধে শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অবদান ছিল অপরিসীম। পাঞ্জাবে মুসলিমদের উপর শিখদের অবিরত লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর শুনে ও দীর্ঘ দু’বছর যাবৎ পাঞ্জাবের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বাস্তব অভিজ্ঞতা হাসিল করেন। অতঃপর দিল্লী ফিরে এসে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। অবশেষে সশস্ত্র প্রতিরোধই এর একমাত্র পথ হিসাবে তিনি সাব্যস্ত করেন ও সেমতে মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ইতিমধ্যে দেশ হতে ইংরেজ শাসন উৎখাতের উদ্দেশ্য নিয়ে সুদক্ষ সৈনিক সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দ্বিতীয়বার দিল্লী আগমনের খবর শুনে তিনি যেমন পথ খুঁজে পেলেন এবং বুযর্গ উস্তাদ ও চাচা শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘জিহাদ আবশ্যকতার’ ফৎওয়া পেয়ে[১১] ও তাঁর ইঙ্গিতে তিনি ও শায়খ আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ) সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণ করেন। শুরু হল জিহাদের পরিকল্পনা ও ব্যাপক প্রস্তুতি। সাইয়িদ আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) যুদ্ধের ময়দানের ‘আমীর’ হলেও আল্লামা ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন প্রধান সেনাপতি ও সকল বিষয়ের মূল পরিকল্পক। তিনিই ছিলেন জিহাদের প্রাণপুরুষ।[১২]

মুসলিমদের উপরে অমুসলিম শাসকদের ব্যাপক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদী জাযবা পুনরুদ্ধার ইত্যাদিই ছিল তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু। শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সকল বক্তব্যে একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন যে, মুসলিমদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা রয়েছে। ১. তাকে ‘হক’ ছেড়ে বাতিলকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ২. হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার কারণে বাতিলপন্থীদের হামলায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ৩. অথবা বাতিলকে সাহসের সঙ্গে মুকাবিলা করে হক-এর সার্বিক বিজয়লাভের পথ সুগম করতে হবে। তিনি জাতিকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে, প্রথমটি কোন বাঁচার রাস্তা নয় বরং ওটাই প্রকৃতপ্রস্তাবে মরণের রাস্তা। দ্বিতীয়টির পরিণতি বেশির বেশি এটাই হবে যে, তিলে তিলে মরতে হবে। কেবল তৃতীয় পথটিই এখন আমাদের জন্য খোলা রয়েছে। আর সেটা হল সরাসরি সম্মুখ মোকাবিলা বা জিহাদ। জিহাদ ত্যাগ করার কারণেই আজ মুসলিম সর্বত্র মার খাচ্ছে। দশ হাযার মাইল দূর থেকে নৌকা চালিয়ে বণিকের বেশে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলিম শক্তিকে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বিশাল ভারতীয় ভূখ-ের শাসন ক্ষমতা হতে উৎখাত করল। অথচ মুসলিমরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থে-বিত্তে, অভিজ্ঞতায় ও অস্ত্রশক্তিতে সেরা হওয়া সত্ত্বেও নির্বিবাদে মার খেয়ে যাচ্ছে। কেউ আপস করছে, কেউ এটাকে কপালের লিখন ধরে নিয়েছে, কেউ আপস করতে না পেরে ধুকে ধুকে মরছে। আর মুষ্টিমেয় কিছু লোক আত্মমর্যাদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা করছে। তিনি সাইয়িদ আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নেতৃত্বে জানমাল দিয়ে জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য সকল ভারতীয় মুসলিমের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। দেশব্যাপী এই প্রচারণার ফলে মুসলিমনরা জিহাদে উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন।[১৩] এভাবে দীর্ঘ এক বছর দশ মাস সর্বত্র দা‘ওয়াতী সফর শেষে জিহাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর জিহাদের স্থান হিসাবে সীমান্ত এলাকাকে নির্বাচন করা হয়।

বালাকোট প্রান্তরে বীরদর্পে যুদ্ধরত অবস্থায় প্রথমে শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাথার উপর গুলি লাগে। যাতে করে তার কপালের ক্ষতস্থান থেকে রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছিল এবং সমস্ত মুখম-ল ও দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। তখনও তিনি কাঁধে গুলিভর্তি বন্দুক ও হাতে খোলা তরবারী নিয়ে আমানুল্লাহ খানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন কোথায়’? তিনি বললেন, ‘ঐ দিকে গেছেন’। যেখানে বন্দুকের গুলি বৃষ্টির ন্যায় বর্ষিত হচ্ছিল। ‘ভাইয়েরা আমি যাচ্ছি’ বলে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) নিজের প্রাণের কোন পরোয়া না করে দ্রুতবেগে ঐ দলে ঢুকে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি ১২৪৬ হিজরীর ২৪ যিলক্বদ মোতাবেক ১৮৩১ সালের ৬ মে শুক্রবার বেলা ১১-টার সময় শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বালাকোট ময়দানে শাহাদত বরণ করেন ও সেখানেই সমাহিত হন।[১৪]

তিনি তাঁর এক ফারসী কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথে সম্পর্ক যারা রাখেন, তাদের নিজের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু সবকিছুকেই আল্লাহর রাস্তায় বাজি রাখা উচিত। এটাকে নিজের সৌভাগ্যই মনে করতে হবে। সমর্থনে, বিরোধিতায়, উত্থান-পতনে সবকিছুতেই নিজেকে আল্লাহর নিকট সপে দিতে হবে’।[১৫] বালাকোটের যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ ও শাহাদতবরণ উক্ত বক্তব্যের স্পষ্ট প্রমাণ বহণ করেন।

৫. রাজনৈতিক চিন্তাধারার সংস্কার

‘আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) প্রচলিত যুুলুম-শোষণের রাজনীতির সংস্কার সাধনেও আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য তিনি ‘মানছাবে ইমামত’ নামে ফারসী ভাষায় একটি গবেষণালব্ধ অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। রাজনৈতিক চিন্তাধারা সংস্কার প্রসঙ্গে উক্ত গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘সিয়াসাত বা রাজনীতির তাৎপর্য হল- ইমামত ও হুকুমতের মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাদের এমন আইনের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করা, যে আইন তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য কল্যাণপ্রদ। এখানে মৌলিক নীতি হবে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির জনগণের শোষণের পরিবর্তে নিঃস্বার্থভাবে তাদের কল্যাণ সাধন করা’।[১৬] অতঃপর তিনি রাজনীতিকে সিয়াসাতে ঈমানী ও সিয়াসাতে মুলতানী দু’ভাগে ভাগ করে ব্যক্তিশাসনের পরিবর্তে ঈমানী শাসনের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। সেই হারিয়ে যাওয়া ঈমানী শাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই ভবিষ্যত ঈমানী রাষ্ট্রের রূপকার ‘আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর হাতে জিহাদের বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন। আম্ব, পাঞ্জতার ও পেশোয়ারে তারই সূচনা করেছিলেন তাঁরা নিজেদের হাতেই। তাঁদের এই শুভসূচনা ভবিষ্যতের স্বাধীন ইসলামী আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রথম সূতিকাগৃহ বৈ কিছুই ছিল না।[১৭]

৬. হজ্জের ফরযিয়্যাতের পুনর্জীবন

ভাররে একশ্রেণীর আলেম ফৎওয়া প্রদান করেন যে, ‘রাস্তা নিরাপদ নয় এবং সমুদ্রও শরী‘আতের দিক থেকে একটি প্রতিবন্ধক এবং আল্লাহ তা‘আলা বাণী ‘যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার)[১৮]-এর পরিপন্থী, তাই হজ্জ ফরয নয়। আর এমতাবস্থায় হজ্জ করা আল্লাহর এই আদেশ ‘তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন কর না’[১৯]-এর বিরোধী’।[২০] তৎকালীন ‘আলিমগণের উক্ত অপব্যাখ্যার কারণে হজ্জ করা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথবা হজ্জ সম্পাদনকারীর সংখ্যা একেবারেই হ্রাস পেয়েছিল। অথচ এটা ছিল এক বিরাট ধর্মীয় বিকৃতি ও বড় ফিতনা। যা সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। এমতাবস্থায় মাওলানা আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ) এবং শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন দলীল দিয়ে অত্যন্ত জোরালোভাবে এর প্রতিবাদ করে হজ্জ ফরয হওয়ার পক্ষে ফৎওয়া লিখে দেন। উক্ত ফৎওয়াটি দিল্লীতে শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট পাঠালে তিনি তাকে জোরালেভাবে সমর্থন জানান।[২১]  উক্ত ফৎওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মুফাসসিরদের মুকুট, মুহাদ্দিছগণের গর্ব, আলিমগণের শিরোমণি মাওলানা আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ) এবং মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ছাহেবের লিখিত ফৎওয়াটি ছহীহ হাদীছ, উছূলে ফিক্বহ এবং ফিক্বহের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অনুযায়ী লিখিত। তাই তাদের সীলমোহর ও দস্তখতের পাশে আমিও আমার সত্যায়নের সীলমোহর লাগিয়ে দিলাম’।[২২] অতঃপর আমীর সাইয়েদ আহমাদ শহীদ একটি বিরাট কাফেলা নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।[২৩]

৭. বিধবা বিবাহের প্রচলন

তৎকালীন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহকে গর্হিত ও লজ্জাজনক কাজ বলে মনে করা হত। এমনকি হিন্দুস্তানের মুসলিমরা বিধবা মহিলার বিবাহকে পরিত্যাগ করাকে শরী‘আতসম্মত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তখন উক্ত প্রথার বিরোধিতা করা একেবারেই দুঃসাধ্য বিষয় ছিল। কিন্তু কোন বাধাকে পরোয়া না করে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘রাদ্দু বিদ‘আতির রুসূম’ গ্রন্থ লিখে তার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং সুন্নাহ ও ছাহাবীদের জীবনী বর্ণনার মাধ্যমে বিধবা মহিলার দ্বিতীয় বিবাহের সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করেন।[২৪]

উপসংহার

উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)। তাঁর দা‘ওয়াতের ফলে মানুষের মধ্য থেকে তাক্বলীদী গোঁড়ামি বিদূরিত হয় এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে মানুষ জীবন সমস্যার সমাধান তালাশে উদ্বুদ্ধ হয়। এজন্য মাওলানা সুলায়মান নাদভী (১৩০২-১৩৭২ হি./১৮৮৪-১৯৫৩ খ্রি.) বলেন, ‘মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) যে আন্দোলন নিয়ে উত্থান করেছিলেন, তা ফিক্বহের কয়েকটি মাসআলা মাত্র ছিল না বরং ইমামতে কুবরা, খালিছ তাওহীদ এবং ইত্তিবায়ে নববীর বুনিয়াদী শিক্ষার উপরে ভিত্তিশীল ছিল। ...এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হল ইত্তেবায়ে নববীর যে জাযবা হারিয়ে গিয়েছিল, তা বছরের পর বছরের জন্য পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। জিহাদের যে আগুন ঠা-া হয়ে গিয়েছিল, তা পুনরায় জ্বলে উঠেছিল’।[২৫]


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৯৭-৯৮; তাযকিরায়ে শহীদ, পৃ. ১৬-৪২ ও ১৪২।
[২]. তাযকিরাতুল ইখওয়ান, পৃ. ৬০।
[৩]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১৩৬।
[৪]. আবুল হাসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী আন-নাইসাপুরী, সহীহ মুসলিম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪৩১ হি./২০১০ খ্রি.), পৃ. ৪১, হাদীস নং-৫০।     
[৫]. তাযকীরুল ইখওয়ান, পৃ. ৬৫।     
[৬]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩।     
[৭]. আহমাদ ইবনুল হুসাইন ইবনু ‘আলী ইবনি মূসা আবী বাকর আল-বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, ১২তম খণ্ড (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৫৪, হাদীস নং-৯০১০।  
[৮]. ‘আলী ইবনুল জা‘দ ইবনু ‘উবাইদ আবুল হাসান আল-জাওহারী আল-বাগদাদী, মুসনাদু ইবনি জা‘দ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতু নাদির, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হি./১৯৯০ খ্রি.), পৃ. ২৭২, হাদীস নং-১৮০৯।  
[৯]. শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল, ছিরাতে মুস্তাকীম (লাহোর : আল-মাকতাবুস সালাফিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ. ৬৫।  
[১০]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১১৩।  
[১১]. মুহাম্মাদ বাশীর, আল-ইমামুল মুজাদ্দিুদুল মুহাদ্দিছ আশ-শাহ ওয়ালিউল্লাহ হায়াতুহু ওয়া দা‘ওয়াতুহু (ইসলামাবাদ : দারুল ‘ইলম, ১ম সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), পৃ. ২৭১।  
[১২]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃ. ২৫৯।  
[১৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬১-২৬২।  
[১৪]. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ), পৃ. ৪৭৮ ও ৪৮৯।  
[১৫]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯০।  
[১৬]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুল বারী, “সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর রাজনীতি”, মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, ঢাকা, ১০ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃ. ৭৩; গৃহীত : আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃ. ২৫৭-২৫৮।  
[১৭]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃ. ২৫৮।  
[১৮]. সূরাহ আলি ‘ইমরান : ৯৭।
[১৯]. সূরাহ আল-বাকারাহ : ১৯৫।
[২০]. মাওলানা খুররম আলী বালাহরী, গায়াতুল আওতার (‘দুররে মুখতার’-এর উর্দূ অনুবাদ), ১ম খণ্ড (প্রকাশনা স্থান ও প্রকাশনা সংস্থা বিহীন, ১২৭১ হি.), পৃ. ৫৫০ ‘হজ্জের শর্তাবলী’ অধ্যায়।
[২১]. তিনি বলেন, ‘যারা হজ্জ ফরয নয় বলে ফৎওয়া দিয়েছে তাদের দৃষ্টি দীনিয়াত, ফিকহ ও উসূলের উপর নয়। তারা কেবল যুক্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়। কয়েকটি প্রসিদ্ধ এবং অগ্রহণযোগ্য ফৎওয়ার উপর তাদের ‘ইলমের ভিত্তি। তাদের ফৎওয়ার উপর নির্ভর করা হলে এবং সেমতে আমল করলে পথভ্রষ্টতার দরজা খুলে যাবে এবং দ্বীনের আহকাম, ফারায়েয ও রুকনগুলো বরবাদ হয়ে যাবে। আজ হজ্জ বাদ পড়ে গেলে, কাল ছিয়াম এবং পরশু ছালাতের পালা আসবে। আর যাকাত তো আরো বেশি বিপদ ও সংখটের মধ্যে রয়েছে’। দ্রষ্টব্য : সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৫৬-২৫৭।
[২২]. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৫৮।
[২৩]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ১০৬-১০৭।
[২৪]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭-১০৮; শাহ ইসমাঈল শহীদ, রাদ্দুশ শিরক, তাহকীক : মুহাম্মাদ ‘আযীয শামস (লাহোর : আল-মাকতাবতুস সালাফিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৪ হি.), পৃ. ১১৮।
[২৫]. তারাজিমে ‘উলামায়ে হাদীছ হিন্দ (লায়লপুর-পাকিস্তান ছাপা), পৃ. ৩১ ‘ভূমিকা’ দ্র. ।




প্রসঙ্গসমূহ »: মনীষীদের জীবনী
সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রাহিমাহুল্লাহ) - প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
ড. মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিদায় - তানযীল আহমাদ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনকর্ম - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (২য় কিস্তি ) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (৩য় কিস্তি ) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ