আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছাত্রবৃন্দ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) কুরআন, হাদীছ ও ইলমের সকল বিষয়ে পাঠদান কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। নিম্নে তাঁর কতিপয় বিখ্যাত ছাত্রদের পরিচয় তুলে ধরব, যারা কুরআন ও সুন্নাহ এবং তার দা‘ওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রসারণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১. আশ-শায়খ সাইয়িদ ইমাম আহমাদ শহীদ বেরীলভী (১২০১-১২৪৬ হি./১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.)
শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনী গবেষক মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম মুহাম্মাদ গাউছ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ বেরীলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি শাহ ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট থেকে ‘আক্বীদাহ ও তাওহীদ এবং সুন্নাহ ও বিদ‘আত সম্পর্কে শিক্ষা অর্জন করেন, যদিও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইমারতের অধীনে থেকেই জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নের্তৃত্ব প্রদান করেন। দিল্লীতে থাকাবস্থায় তিনি শাহ ইসমাঈলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর সাইয়েদ আহমাদ, শাহ ইসমাঈল সহ অসংখ্য মুজাহিদ বালাকোটের যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন।[১]
ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন ও শরী‘আতের আইন-কানুন প্রবর্তন সাইয়িদ আহমাদ শহীদ বেরীলভী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনের প্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় লক্ষ্য ছিল। আর এজন্যই তিনি তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। এটাই ইতোঃপূর্বে আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করার তাঁর মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের সাথে সন্ধি করায় সাইয়িদ সাহেব মুসলিমদের ধর্মীয় সংস্কারের সাথে সাথে জিহাদ আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং পৃথকভাবে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়াস পান।[২] অতঃপর তিনি তৎকালীন ভারতের ইলমী রাজধানী দিল্লীর ওয়ালীউল্লাহ পরিবারের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। দিল্লীতে আগমনের পর উস্তাদ মাওলানা শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইঙ্গিতে মাওলানা ‘আব্দুল হাই ও তাঁরই ভ্রাতৃষ্পুত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণ করেন।[৩] উক্ত দু’জন মহান ব্যক্তির বায়‘আত গ্রহণের সাথে সাথে শাহ ওয়ালীউল্লাহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণও বায়‘আত গ্রহণ করেন।[৪] এরপর থেকেই শুরু হয় ভবিষ্যতের সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতিপর্ব।
অতঃপর প্রায় দু’বছর পর্যন্ত তিনি রোহিলাখণ্ড, আগ্রা, অযোধ্যার বিভিন্ন শহর ও স্থান যেমন মীরাট, মুযাফফরনগর, সাহারানপুর, মুরাদাবাদ, রামপুর, কানপুর, লাক্ষ্মৌ, বেনারস ইত্যাদি ভ্রমণ করতে থাকেন। ধর্মীয় সংস্কার ও জিহাদ সংগঠন উভয় কাজ একই সাথে করতে থাকেন। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও মাওলানা আব্দুল হাই (রাহিমাহুল্লাহ) ক্রমাগত জিহাদ ও শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে ওয়ায করতে থাকেন। মুসলিমদের মনমগজ জিহাদ ও শাহাদতের আগ্রহ এত গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মুসলিমগণ স্বেচ্ছায় আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করাকে সৌভাগ্যের বিষয় হিসাবে ভাবতে থাকেন।[৫] তাদের বক্তব্যে লোকেরা শিরক-বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কার হতে তওবা করে এবং দলে দলে সাইয়িদ আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট বায়‘আত করতে থাকে। এভাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ ব্যাপক দা‘ওয়াত তাবলীগের ফলে বায়‘আতকারীর সংখ্যা যেমন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তেমনি শিখ ও ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আগামী দিনের সর্বভারতীয় মুজাহিদ নেতা হিসাবে তাঁদের সম্মান সর্বসাধারণের হৃদয়ে গ্রোথিত হয়ে যায়।
২. আশ-শায়খ আব্দুল হক্ব বানারাসী (১২০৬-১২৭৬ হি.)
তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট থেকে হাদীছের কিতাবগুলো অধ্যয়ন করেন। নবাব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী আল-কানূজী (রাহিমাহুল্লাহ) (১২৪৮-১৩০৭ হি./১৮৩২-১৮৯০ খ্রি.) শায়খ আব্দুল হক বানারাসী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট ইজাযত প্রার্থনা করলে তিনি তাঁর ইজাযত প্রদান করেন এবং তাঁর ইজাযতে বলেন,
وقرأت أكثر كتب الحديث علي أسوة المحدثين وارث علوم سيد المرسلين العلامة النبيل مولانا الشيخ محمد إسماعيل الشهيد تغمده الله بغفرانه المديد
‘আমি ইলমসমূহের উত্তরাধিকারী সাইয়িদুল মুরসালীন আল্লামা নাবীল মাওলানা শায়খ মুহাম্মাদ ইসমাঈল আশ-শাহীদের নিকট থেকে মুহাদ্দিছগণের আদর্শের উপর হাদীছের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেছি। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বিস্তৃত ক্ষমা দ্বারা তাঁকে ঢেকে রাখুন’।[৬]
তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে অন্যতম শায়খ, আলিম ও মুহাদ্দিছ। কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা এবং কুসংস্কার, বিদ‘আত ও তাক্বলীদকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে বিখ্যাত আলিমগণের মধ্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। তিনি কোন মাযহাবকে প্রাধান্য দিতেন না এবং দ্বীনের কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কারো তাক্বলীদও করতেন না। বরং তিনি কিতাব ও সুন্নাহর দলীলের ভিত্তিতে আমল করতেন এবং ইজতিহাদ করতেন। তাঁর রচিত ‘আদ-দুররুল ফারীদ ফিল মানঈ মিনাত তাক্বলীদ’ নামক গ্রন্থে তিনি ইজতিহাদ ও তাক্বলীদের ব্যাপারে তাঁর ও আহনাফদের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। শাহ ইসমাঈলের সাথে হজ্জ সফরে গিয়ে বিদ‘আতের বিরোধিতা করার জন্য তাকে ‘ওয়াহহাবী’ নামে মিথ্যা অপবাদও প্রদান করা হয়। তিনি হানাফী হওয়া সত্ত্বেও ছহীহ হাদীছের উপর আমল করতে কখনো পরোয়া করতেন না।[৭]
৩. আশ-শায়খ বেলায়াত আলী ছাদেকপুরী (১২০৫-১২৬৯ হি./১৭৯০-১৮৫২ খ্রি.)
উলামায়ে রব্বানিইয়ীনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম শায়খ, আলিম, ইমাম ও মুহাদ্দিছ। তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট থেকে হাদীছের শিক্ষা অর্জন করেন। সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে হায়দারাবাদে দা‘ওয়াতি কাজের জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি সেখানে অবস্থান করেন এবং তাঁর দা‘ওয়াতী কাজের কারণে অসংখ্য মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা হেদায়াত দান করেন। ‘ইলম ও ‘আমলের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি কিতাব ও সুন্নাহর উপর আমলে উৎসাহী ছিলেন।[৮]
শায়খ বেলায়েত আলী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রচলিত সকল রসম-রেওয়াজ ও তাক্বলীদী গোঁড়ামি বাদ দিয়ে কেবল আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক ‘আমলের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছিলেন। নিজ এলাকায় থাকাকালীন তিনি আল-কুরআন ও বুলূগুল মারামের দারস প্রদান করতেন। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কিতাবগুলো ছাপিয়ে বিলি-বণ্টন করেন। হজ্জের সফরে তিনি ইয়ামানে চলে যান এভং খ্যাতনামা মনীষী ইয়ামানের বিচারপতি কাযী মুহাম্মাদ ইবনু আলী শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) (১১৭২-১২৫০ হি./১৭৫৮-১৮৩৫ খ্রি.)-এর নিকট হতে হাদীছের সনদ লাভ করেন ও তাঁর কিছু কিতাব সঙ্গে নিয়ে আসেন।[৯] নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (১২৪৮-১৩০৭ হি./১৮৩২-১৮৯০ খ্রি.) বলেন, ‘মাওলানা বেলায়েত আলী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন আমার শৈশবকালে কণৌজ আগমন করেন ও আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করেন, তখন তিনি আমাকে ‘বুলূগুল মারাম’ পড়ার উপদেশ দেন’।[১০] উক্ত বিষয়গুলো তাঁর হাদীছের প্রতি আন্তরিকতা ও আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। এছাড়া আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শিক্ষা, সংসর্গ ও প্রশিক্ষণের ফলে তাঁর মধ্যে থেকে তাক্বলীদী গোঁড়ামি দূর হয়ে যায় এবং সরাসরি সুন্নাহর উপর আমলের জাযবা সৃষ্টি হয়। তাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ওয়ায ও নসীহতের ফলে হিন্দুস্তানে ‘আমল বিল-হাদীছ’-এর চর্চা শুরু হয়ে যায় এবং তাক্বলীদের ভীত দুর্বল হয়ে যায়।[১১]
৪. আশ-শায়খ খুররম আলী আল-বালহূরী (মৃ. ১২৭১/১২৭৬ হি.)
বিখ্যাত আলিমগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছালিহ আলিম ছিলেন। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পরিবার থেকে তিনি অনেক উপকৃত হন। তিনি ‘মানঊ কিরায়াতিল ফাতিহাতি খালফাল ইমাম’ নামক মূল্যবান কিতাবের মুক্বাল্লিদ ছিলেন। কিন্তু শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথী হওয়ায় তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতকে অত্যন্ত কঠোরভাবে ভালোবাসতেন, সুন্নাহর রঙে রঞ্জিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সুন্নাহর উপরে দৃঢ় ছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। তিনি ‘নাছীহাতুল মুসলিম’ শীর্ষক তাওহীদ ও সুন্নাহর সমর্থনে একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া তিনি একজন মর্যাদাবান কবিও ছিলেন। জিহাদের ফযীলতের উপর তিনি একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন, যা মুজাহিদগণ যুদ্ধের মাঠে আবৃত্তি করতেন। এই কবিতার প্রভাব মুসলিমদের হৃদয়ে সম্প্রসারিত হলে ইংরেজ সরকার উক্ত কবিতা পাঠ ও প্রকাশের প্রতি নিষেধাজ্ঞারোপ করে।[১২]
৫. আশ-শায়খ জা‘ফর আলী আল-বাসতাভী (মৃ. ১২৮৮ হি.)
তিনি ইলম সম্প্রসারণে একজন বিখ্যাত সৎকর্মপরায়ণ শায়খ ও আলিম ছিলেন। শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করে যেসকল ফযীলতপূর্ণ আলিম বের হন তিনি তাদের অন্যতম। অতঃপর তিনি সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর দেশ নেপালের অন্তর্গত ‘বাসতী’ নামক উপত্যকার মধ্যবর্তী স্থানে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি তাঁর জীবনের অনেক বছর অবস্থান করেন। অতঃপর ‘মা-হুপুর’, ‘সিমরা’ ও গ্রামের অন্যান্য স্থানে কুরআন ও হাদীছ শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা অনেক অজ্ঞ, মূর্খ ব্যক্তিগণ হেদায়াত প্রদান করেন। তিনিই প্রথম মুজাহিদগণের অবস্থা ও তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন।[১৩]
৬. আশ-শায়খ আব্দুল হাদী আল-জুহমকাভী (১২০৫ হি.-১২৬৫ হি.)
তিনি দক্ষ আলিমগণের মধ্যে একজন অন্যতম সৎকর্মশীল আলেম ও শায়খ। আল্লাহ তা‘আলার মহান অনুগ্রহ দ্বারা তিনি ধন্য হয়েছেন। কেননা মূর্তি পূজারীদের ঘরে তাঁর জন্ম হয় এবং কুফরের উপর তিনি বেড়ে ওঠেন। অতঃপর শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও সাইয়িদ আহমাদ শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর দা‘ওয়াতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে হিকমাহ ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে মানুষের মাঝে দা‘ওয়াতী কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি আমৃত্যু অবিমিশ্রিত সুন্নাহ ও সালাফী মানহাজের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন।[১৪]
৭. আশ-শায়খ সাখাওয়াত আলী জৈনপুরী (১২২৫-১২৬৪ হি.)
তিনি বিখ্যাত আলিমগণের মধ্যে অন্যতম একজন মুহাদ্দিছ, বড় আলিম ও শায়খ ছিলেন। তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে মাতূলাত পাঠ করেন। তিনি লাক্ষেèৗতে শী‘আদের কবল থেকে বিশাল বড় একটি জামে মসজিদ অপসারণ করেন, সেখানে জুমু‘আর ছালাত ও জামা‘আতের ছালাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং কুরআন-সুন্নাহ শিক্ষার জন্য একটি মাদরাসা কায়েম করেন। তিনি অনেকগুলো কিতাবও রচনা করেছেন।[১৫]
৮. আশ-শায়খ জালালুদ্দীন আল-বানারাসী (১২১৯/১২২১ হি.-১২৭৭ হি.)
তিনি হাদীছ শাস্ত্রের অভিজ্ঞ একজন সুপণ্ডিত ও আলিম ছিলেন। তিনি তাক্বলীদকে প্রত্যাখ্যন করেন এবং হাদীছ ও প্রকাশ্য দলীলের আলোকে আমল করেন। তিনি লুগাহ, নাহু এবং কুরআন ও হাদীছ অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন।[১৬]
সুধী পাঠক! শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অসংখ্য ছাত্রের মধ্যে এ সংখ্যা অতি সীমিত। কলেবর বৃহৎ হওয়ার আশঙ্কায় তাঁর ছাত্রদের অবস্থা আমরা সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম।
‘আকীদাহ ও মানহাজ
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) সালাফে ছালিহীনের একজন সনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। সালাফী মানহাজ ছিল তাঁর লালিত মানহাজ। আহলেহাদীছ মাসলাকের ভিত্তিতে তিনি ইলম বিতরণ করতেন, দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং তার প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শায়খ নাযীর আহমাদ রহমানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
إن الشهيد رحمة الله كان متبعا لمسلك أهل الحديث ونصح الناس بإتباع ذلك المسلك
‘শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) আহলেহাদীছের মাসলাক বা কর্মপদ্ধতির অনুসরণ করতেন এবং মানুষদেরকে সেই কর্মপদ্ধতি অনুসরণের উপদেশে দিতেন’।[১৭]
তাঁর শরী‘আতের জ্ঞানে পূর্ণাঙ্গতার পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, তিনি ইজতিহাদের স্তরে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি কোন রায় বা ব্যক্তি অভিমত এবং মাযহাবের তাক্বলীদ করতেন না। বরং প্রতিটি বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হুকুম প্রদান করতেন। এই পৃথক বৈশিষ্ট্যের কারণে ইহছান ইলাহী যহীর (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ও তার কর্মপদ্ধতির একজন ‘অগ্রদূত’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। বরং তিনি ভারতের জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন অঞ্চলে ‘সালাফী ‘আকীদা পুনর্জাগরণ’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[১৮] তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত তাক্বলীদকে প্রতিহত করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার উপর কোন ফক্বীহ, ফক্বীর ও শায়খগণের রায়কে বাতিল করা, ‘আম ও খাছের মাঝে প্রচলিত বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সুন্নাহকে সম্প্রসারণ করার আন্দোলন করেছেন। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কথার বাইরে কোন কথাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন।[১৯] শরী‘আতের কোন বিধানের ক্ষেত্রে তিনি কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতেন। তবে যখন উদ্ভূত কোন সমস্যার যদি সমাধান সেখানে না পেতেন, তাহলে সালাফী আলেমগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন।[২০] এজন্য ‘উবাইদুল্লাহ সিন্ধী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যখন হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ পাঠ করে তিনি জামা‘আত গঠন করেছিলেন, তখন তিনি ছালাতে রফঊল ইয়াদাইন করতেন, জোরে আমীন বলতেন এবং শাফিঈদের ন্যায় সর্বাবস্থায় সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতেন’।[২১] মানুষেরা যখন কোন বিষয়ে মতবিরোধ ও মতপার্থক্যে নিমজ্জিদ হত, তখন তিনি মুহাদ্দিছগণের কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতেন এবং সকল প্রকার বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করতেন।[২২]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
*পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ‘তাযকিরায়ে শহীদ’, পৃ. ৭৫-এর বরাতে, জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬০।
[২]. ইসলামী বিশ্বকোষ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৮৭।
[৩]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃ. ২৫৬।
[৪]. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[৫]. ইসলামী বিশ্বকোষ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৮৭।
[৬]. ইত্তিহাফুন নুবালা, পৃ. ২৬৫-এর বরাতে, জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬১।
[৭]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬০-৬১।
[৮]. নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৫২৫; জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬০-৬১।
[৯]. নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ঈ ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১৩৪।
[১০]. সিদ্দীক হাসান খান, ইবকাউল মিনান বি ইলকাইল মিহান (লাহোর : দারুদ দা‘ওয়াতিস সালাফিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৬ খ্রি.), পৃ. ৪৪-৪৫।
[১১]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষতসহ, পৃ. ২৯৫।
[১২]. নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৫৮; তারাজিম উলামাই আহলিল হাদীছ, পৃ. ৫০৯; আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত, পৃ. ১৫৪; জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬২।
[১৩]. জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬২।
[১৪]. নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৯৩; জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬২।
[১৫]. প্রাগুক্ত।
[১৬]. তারাজিম উলামাই আহলিল হাদীছ, পৃ. ৩৪৫০; নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি‘ই ওয়ান নাওয়াযির, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১২০; জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল, পৃ. ৬৩।
[১৭] নাযীর আহমাদ রহমানী, আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত (বানারাস : আল-জামি‘আতুস সালাফিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৫ খ্রি.), পৃ. ৪৪; তারাজিমে ‘উলামাই হাদীস হিন্দ (দিল্লী : যিয়াদ বিরুকাই প্রেস, ১৩৫৬ হি.), ৬৭।
[১৮] ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৬৪; মুহাম্মাদ ইসমাঈল আস-সালাফী, আন-নাহযাতুস সালাফিয়্যাহ ফিল হিন্দ ওয়াল পাকিস্তান (মাতবূ‘ঊ মা‘আ তানবীরুল আয়নাইন, তা.বি.), পৃ. ৫ ; ইহসান এলাহী যহীর, আল-বেরেলবিয়্যাহ ‘আকাইদি ওয়া তারীখ (লাহোর: ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৩ হি.), পৃ. ১৬২।
[১৯] ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী আল-কানূযী, আদ-দ্বীনুল খালিছ, ২য় খণ্ড (কায়রো : মাকতাবাতু দারিত তুরাছ, তা.বি.), পৃ. ৬৭ ।
[২০] ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৬৫।
[২১] ‘উবায়দুল্লাহ সিন্ধী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ আওর উনকি সিয়াসী তাহরীক (লাহোর : আল-মাহমূদ একাডেমী, তা.বি.), পৃ. ৮৩।
[২২] ‘জুহূদুশ শাহ ইসমাঈল’, পৃ. ৯৪-৯৫।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মনীষীদের জীবনী