বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৪ অপরাহ্ন

প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে

সৈয়দ নাযীর হুসাইন দেহলভী

(১৮০৫-১৯০২ খ্রি./১২২০-১৩২০ হি.)

সৈয়দ নাযীর হুসাইন (রাহিমাহুল্লাহ) হিন্দুস্তানের বিহারের সুরজগড় গ্রামের পালতুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নানা কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। পনের বছর বয়সে তিনি পাটনার শহরতলীর একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে ছাত্র থাকা অবস্থায় একটি ইসলামী সভায় শাহ ইসমাইল শহীদ ও এরফান বেরীলভী আগমন করেন। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় পাটনার গান্ধী ময়দানে। এ দু’জনের দাওয়াতী কর্মকা- দেখে এবং তাঁদের ওয়ায শুনে বালক নাযীর হুসাইন আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন। দিল্লীর বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি পড়াশোনা করেন। যেমন আওরঙ্গবাদের ফেনজান কাটরা মসজিদে ও মাদরাসা কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে তিনি সেখানকার অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে পড়েন,

شرح الشمسية للقطب الرازى، نور الانوار، والحسامى  ومختصر المعانى، الاصول الكبرى وشرح الكافية للجامى  والزواهد الثلاثة، الصدرا والشمس البازغة على الشيخ شير محمد القندهارى وشرح السلم وشرح القاضى مبارك وشرح المطالع على الفلسفة المتبحرالمولوى العلامة جلال الدين الهراتى فقرأ المطول والتوضيح والتلويح ومسلم الثبوت وتفسير البيضاوي وقرا خلاصة الحساب  والقوشجى لبهاء الدين الأملى وتشريح الافلاك وشرح الجغمنى على مهندس عصره الشيخ محمد بخش الدهلوى وكنز العمال والجامع الصغير للحافظ السيوطي

وصحبه الشيخ اسحاق ثلاث عشر سنة وأخذ عنه مالم يأخذ أحد من تلامذته فبلغ فى مراتب الكمال وصار خليفة له فى غيابه و استفاض منه فيوضا كثيرة حتى أنه كان يفتى ويقضى بين الناس والاستاذ الشيخ ابراهيم يفرح بفتياه فلذلك استخلفه على مسنده عند هجرته إلى مكة المكرمة عام ١٢٥٨الهجرية

অবশেষে তিনি রহীমিয়া মাদরাসার নিয়মিত ছাত্র হিসাবে পড়াশুনা শুরু করেন। সেখানে তিনি ইসহাক্ব দেহলভী ও ইসমাইল শহীদকে তাঁর প্রিয় শিক্ষক ও মুহাদ্দিছ হিসাবে পেয়েছিলেন। অতঃপর ১২৫৮ হি. সালে ইসহাক্ব দেহলভী  মক্কা মুকাররমায় হিজরত করেন এবং তিনি আর ফিরে আসেননি। তাই তিনি রহীমিয়া মাদরাসার শিক্ষক ও অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১২৪৮ হি. সালে তিনি শাহ ওয়ালীউল্লাহর পরিবারে বিবাহ করেন ফলে ‘মিঞা’ উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়। অতঃপর তাঁকে উপাধি দেয়া হয় ‘শায়খুল কুল ফিল কুল’। সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ‘শামসুল ওলামা’ উপাধি প্রাপ্ত হন। এ প্রসঙ্গে তিনি স্বয়ং বলেছিলেন, ‘আল্লাহ আমাদের একনিষ্ঠ মুসলিম (হানীফাম মুসলিমা) উপাধি দান করেছেন, অন্য কোন উপাধি আমাদের কী প্রয়োজন’? তবুও তিনি ‘মিঞা’ উপাধিতে অধিক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সে সময়ের শ্রেষ্ঠ হাদীছ বিশারদ ছিলেন।

১২৮০ হিজরীতে তিনি ইংরেজ সরকার কর্তৃক বন্দি হয়ে রাওয়ালপি-ির জেলে একবছর অতিবাহিত করেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার তিনি হাদীছের শিক্ষা দানে ফিরে আসেন।

১৩০০ হিজরী সালে তিনি হজ্জ আদায় করতে মক্কা মুকাররমায় যান। শত্রুর দল তাঁর বিরুদ্ধে মক্কার গভর্নর বরাবর মিথ্যা অভিযোগ করলে তিনি সেখানেও গ্রেফতার হন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগসমূহ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তিনি মুক্তি পান এবং হজ্জ শেষে ফিরে এসে আবারও দরস-তাদরীসে মনোনিবেশ করেন।

তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহ্র গৌরব। একজন অনারব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর দরস-তাদরীসে ছাত্র হিসাবে উপস্থিত থাকতেন বহু আরবদেশসহ অন্তত পঁচিশের অধিক দেশের শতাধিক ছাত্র, প্রায় প্রতি শিক্ষাবর্ষেই।

তিনি আহলেহাদীছের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিছ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তবে তাঁর ক্লাসে নানা মতের ছাত্র থাকতেন। এমনকি দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকেই যেমন, কাসেম নানতুবী, রশিদ গাঙ্গুহী প্রমুখ তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানও তাঁর শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত রেফারেন্স গ্রন্থ ‘আসারুস সানাদীদে’ মিঞা নাযীর আহমাদ সম্পর্কে লিখেছেন,

جناب مولوی نذیر حسین سلمہ اللہ تعالیٰ

زبدہ اہل کمال اسوہء ارباب فضل و افضال مولوی نذیر حسین صاحب بہت صاحب استعداد ھین خصوصا فقہ میں ایسی استعداد کامل بھم پہنچائ ھے کہ اپنے نظائر و اقران  سے گوئے سبقت لےگئے ھیں- روایت کشی میں آ ج بے نظیر ھیں-

باوجود اس کمال اور  اس استعداد کے مزاج میں  خاکساری اور حلم گویا کوٹ کوٹ کر بھرا ھے باعتبار سن کے جوان باعتبار طبیعت حلیم اور وضع متین کے پیر

মর্মার্থ : ‘জনাব মৌলভী নাযীর হুসাইন, (আল্লাহ তাঁকে শান্তি দান করুন)। তিনি হলেন দক্ষতায় সেরাদের সেরা। উন্নত চরিত্রে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের যোগ্যতার অধিকারী। বিশেষত ফিক্বহের ক্ষেত্রে সমকালীন প-িতদের মধ্যে সবার শীর্ষে। হাদীছ বর্ণনায় আকাশচুম্বী উচ্চতায় বিরল দৃষ্টান্ত। এত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁর আচরণে বিনয় ও ন¤্রতা বিরাজ করত। সহিষ্ণুতার বিরল গুণগুলো যেন তাঁর মধ্যে মণিমুক্তার মত জলজল করত। তিনি ছিলেন যেন এখনও বয়সে তরুণ, মেযাজে সহিষ্ণুতা এবং গাম্ভীর্যে প্রবীণ’।

ইলম অনুসন্ধানে তিনি শহরে-বন্দরে

১২৩৭ হি. মোতাবেক ১৮২২ খ্রি. তিনি নিজ গ্রাম ছেড়ে পাটনার একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। সেই সময় পাটনার গান্ধী ময়দানে এক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দিল্লীর কয়েকজন শায়খ মেহমান হিসাবে আগমন করেন। যেমন শায়খ আহমদ বিন ইরফান বেরীলভী এবং শাহ ইসমাঈল দেহলভী। আরও একজন ছিলেন শায়খ আব্দুল হাই বিন হেবাতুল্লাহ বোরহানুভী। এই মেহমানবৃন্দের সান্নিধ্য বালক নাযীর হুসাইনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, তাদের কথা, আচরণ, আর উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি নিজের মধ্যে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা খুঁজে পান। তাঁর অন্তরে ঈমানী জযবা শুরু হয়। তিনি তাঁদের দ্বীনি আলোচনা শুনে জ্ঞানার্জনের জন্য পাটনা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।

সর্বপ্রথম তিনি ছাদেকপুর যান, ছাদেকপুর বিহারের অন্তর্গত একটি এলাকা। এখানে মিশকাত পর্যন্ত তিনি পড়াশুনা করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য উস্তায ছিলেন উস্তায শাহ মুহাম্মাদ হুসাইন। সেখান থেকে চলে যান উত্তর প্রদেশের গাজীপুরের একটি মাদরাসায়। এখান থেকে রাজধানী দিল্লীর দূরত্ব তিনশ’ কিলোমিটার। এখানে উল্লেখযোগ্য উস্তায পেয়েছিলেন মৌলভী আহমদ আলী তিশ্রিয়াকোটী ছাহেবকে। অতঃপর তিনি ইলাহাবাদ চলে যান, অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি দিল্লী পৌঁছলেন এবং দিল্লীর একাধিক মাদরাসা ও মসজিদে অবস্থান করে বড় বড় মাশায়েখদের নিকট থেকে উলূম ও ফনূনে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন।

১৮২৮ খ্রি. তিনি দিল্লী পৌঁছে আওরঙ্গবাদের ফেনজানি কাটরা মাদরাসার সুযোগ্য আসাতিযায়ে কেরামের নিকট থেকে উপরি বর্ণিত বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেন।

পড়াশোনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ

ছোটবেলা থেকেই তিনি মনোযোগী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি দিল্লী এসে দরসি কিতাবের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এ সময় দিল্লীতে দুটো বড় বড় পাবলিক লাইব্রেরী ছিল। একটি সরকারী, হাজার বছরের প্রাচীন, এখানে দ্বীনি কিতাবের সমাহার ছিল, দুর্লভ হস্তলিপি ছিল, মহামূল্যবান রেফারেন্স গ্রন্থাদি ছিল, কিন্তু প্রাচীনকালের বলে ব্যবহার উপযোগী ছিল না। তাই তিনি ক্ষমতাসীন স¤্রাটদের নিকট আবেদন জানান। অতঃপর লাইব্রেরীটি সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে সংস্কারের ছোঁয়া পেয়ে অত্যাধুনিক লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত হয়। এজন্য তিনি সরকারের প্রশংসায় নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।

অপর লাইব্রেরীটি ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী ও তাঁর সন্তানদের পারিবারিক লাইব্রেরী। শাহ আব্দুল আযীযের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই লাইব্রেরীটিও সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত, এই লাইব্রেরী থেকে তিনি বিশেষভাবে উপকৃত হন।

শায়খ ইসহাক্ব শাহ আব্দুল আযীযের মেয়ের সন্তান। তাই কালক্রমে তিনি এই লাইব্রেরীর তত্ত্বাবধায়ক হন। তিনি মক্কা মুকাররমায় চলে যাবার পর সৈয়দ নাযীর স্বয়ং এর মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাই তিনি এর উন্নয়ন ও সংস্কার করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কিতাবাদি সংগ্রহ করে লাইব্রেরীটিকে একটি অত্যাধুনিক লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত করেন।

উপরোল্লিখিত লাইব্রেরী দু’টি থেকে তিনি বিশেষভাবে উপকৃত হন। এর হস্তলিপিগুলোও ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল- ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের সময় এগুলোর অধিকাংশই হারিয়ে যায়। সৈয়দ নাযীর হুসাইন আযাদী আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

তিনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ সকলকেই অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। কারও সাথে হিংসা-বিদ্বেষ রাখতেন না। যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। ইবাদতে অধিক সময় অতিবাহিত করতেন। তাঁর ছালাত ছিল খুব ধীরে এবং লম্বা সময়ব্যাপী, বিশেষত রুকূ-সেজদায় তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতেন। দিনে রাতে সবসময় তিনি কুরআন-সুন্নাহর দরস-তাদরীসে সময় অতিবাহিত করতেন। তাঁর আক্বীদাও ছিল স্বচ্ছ, ছহীহ এবং আহলুস সন্নাহর সালাফদের মত। তাঁর ছালাত ও তেলাওয়াতে ছিল ক্রন্দন এবং খুশূ‘-খুযূ‘। তিনি প্রত্যহ ফজর শেষে মুছল্লীদের ওয়ায শুনাতেন। আল্লাহ তাঁকে তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যা সাধারণত অন্যদের মধ্যে পরিলক্ষিত হত না।

প্রথমতঃ তিনি অত্যধিক তাক্বওয়ার অধিকারী ছিলেন। তিনি অত্যধিক সহিষ্ণু, লোভহীন ও দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন এবং ছিলেন ভীষণ লজ্জাশীল।

দ্বিতীয়তঃ তিনি কুরআন, তাফসীর, ফিক্বহ ও আরবী ব্যাকরণে পারদর্শী ও দক্ষ ছিলেন।

তৃতীয়তঃ তাঁর ছাত্রদের সংখ্যা ছিল বেশি এবং তাদের মধ্যে থাকতেন অসংখ্য গুণী, ভদ্র, দক্ষ ও অনুসন্ধিৎসু গবেষক।

শায়খের উপাধি

শায়খের উপাধিসমূহের মধ্যে ‘মিঞা’ উপাধি ছিল সবচেয়ে পসন্দের। উল্লেখ্য যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ আল্লামা দেহলভীর উপাধি ছিল এটি। তাঁর চার সন্তানের সকলেই এই উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। অতঃপর শাহ আব্দুল আযীযের নাতি শায়খ ইসহাক্ব মুহাদ্দিছ দেহলভী হওয়ার পর তাঁকেও ‘মিঞা ছাহেব’ বলা হত। তিনি মুহাজির হয়ে মক্কা মুকাররমায় চলে যাওয়ার সময় সৈয়দ নাযীর হুসাইনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং ‘মিঞা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে সৈয়দ নাযীর হুসাইন নিজের নামের সাথে উস্তাযের দেয়া এই উপাধি বা লক্ববকে গর্বের বিষয় মনে করতেন।

‘শায়খুল কুল ফিল কুল’ উপাধি

১৩০০ হিজরী সনে সৈয়দ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী মক্কা মুকাররমায় হজ্জ উদ্দেশ্যে গমন করেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের অগণিত ছাত্র ও ভক্তরা তাঁকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানান। সংবর্ধনা সমাবেশে বক্তারা তাঁকে এই অভিনব উপাধিতে ভূষিত করেন। এর অর্থ হল- ‘তিনি সব বিষয়ে সবার শায়খ’।

শামসুল ওলামা উপাধি

জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় অগাধ পা-িত্যের জন্য ইংরেজ সরকার কর্তৃক তিনি ‘শামসুল ওলামা’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ উপলক্ষে তিনি তাঁর  অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘পবিত্র কুরআন ঘোষিত একনিষ্ঠ মুসলিম (হানীফাম মুসলিমা) হল সবচেয়ে উত্তম উপাধি, এসব দিয়ে কী হবে?’

আল্লামা মুহাদ্দিছ হুসাইন বিন মুহসিন শায়খ নাযীর হুসাইনের কাছে এক পত্র লিখেন। উক্ত পত্রে তিনি শায়খকে যে সকল উপাধিতে ভূষিত করেন তাহল- ‘রাইসুল আতক্বিয়া ওয়াল মুহাদ্দিছীন’, ‘যুল হুসনাইন (ইলম ও বংশ মর্যাদা)’, ‘রাঈসুল ওলামা আল-মুহাক্কিক্বীন’, ‘ঊমদাতুল আতক্বিয়া’, ‘বাকিয়াতুস সালাফ’, ‘যিনাতুল খালাফ’ প্রভৃতি।

কাযী বশীরুদ্দীন কানূজী কর্তৃক প্রদত্ত লক্বব

‘যুবদাতুল মুহাক্কিক্বীন’, ‘ঊমদাতুল আতক্বিয়া’, ‘আওলিয়ায়ে আছর’ এবং ‘আকাবিরে ওলামায়ে দাহর’।

শায়খ শামসুল হক আযীমাবাদী কর্তৃক প্রদত্ত উপাধিসমূহ

‘শায়খুল ইসলাম’, ‘মুফতিউল আনাম’, ‘মুহাদ্দিছ আল-আছর, ‘ফক্বীহুদ দাহর’, ‘কুদ্ওয়াতুন নুজাবা’, ‘শায়খুল আরব ওয়াল ‘আজম’, ‘যুবদাতুন নাসিকীন’, ‘ঊমদাতুল মুফাসসিরীন’।

এত সব উপাধিতে ভূষিত আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় শায়খ  ইমাম আস-সালাফী শায়খ সৈয়দ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)।

প্রধান মুহাদ্দিছের আসন অলংকৃত

শায়খ ইসহাক্বের স্থলাভিষিক্ত হয়েই তিনি আগের ধারাবাহিকতায় ফাতাওয়া বোর্ডের প্রধান এবং রাঈসুল মুহাদ্দিছীনের পদ অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘদিন এই পদে থেকে হাদীছ, তাফসীর ছাড়াও বিভিন্ন ফুনূন ও উছূলের কিতাবাদি দক্ষতার সাথে তাদরীস করতেন।

আল্লাহ তাঁকে অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা দান করেছিলেন। তিনি দরস-তাদরীসের বাইরে অন্য কোন ব্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন না।

তাঁর জ্ঞানগভীর আলোচনায় অংশ নিতে হিন্দুস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্র আসতেন এমনকি আরব-আজমের পঁচিশটি দেশের ছাত্র আসতেন।

তিনি শিরক-বিদ‘আতমুক্ত সমাজ গঠনের ব্রত নিয়ে কাজ করতেন।  

وَ اللّٰہُ  مُتِمُّ  نُوۡرِہٖ  وَ لَوۡ  کَرِہَ  الۡکٰفِرُوۡنَ

‘আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপসন্দ করে’ (সূরা আছ-ছফ্ফ : ৮)।

তাঁর জীবনের পরীক্ষা ও বাঁধাসমূহ

শায়খ নাযীর হুসাইন একজন সফল শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর খ্যাতি, যশ, অসংখ্য ছাত্রের উপস্থিতি এবং ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখে দিশেহারা একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। অতীতের সফল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেমন মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)সহ অসংখ্য মনীষীর জীবন দূর্বিষহ করা হয়েছিল, তাঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি, যদিও ঐসব সমালোচনাকারী হিংসুকদের অনেকেই শায়খকে স্বচক্ষে দেখেওনি। এটা ছিল কেবলই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা।

ফলে শায়খ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শত্রুরা ইংরেজ প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে তাঁকে দীর্ঘদিন একটির পর আরেকটি পরীক্ষার সম্মুখীন করে। তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালীর সাথেও এমন আচরণ করেছিল হিংসুক শত্রুর দল।

শায়খ নাযীর হুসাইনের বিরুদ্ধে মূলত কুৎসা রটানো হয়েছিল

তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ বিরোধী ও সুন্নাহ প্রতিপালনে শৈথিল্য প্রদর্শনকারী, আরও কত কি!

তাই ইংরেজ সরকার তাঁকে বন্দি করে ১৮৬৩ খ্রি. সালে রাওয়ালপি-ির কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। পূর্ণ এক বছর তিনি জেল-জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করেন এবং জেলখানায় অসংখ্য ছাত্র ও ভক্তকে দ্বীনের দা‘ওয়াত দেয়ার সুযোগ পান। ইংরেজরা যখন লক্ষ্য করলেন জেলের ভেতরেও জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে, তখন তাঁকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হন। এরপর তিনি পূর্বের ন্যায় আবারও শিক্ষকতার পেশায় ফিরে আসেন এবং যথারীতি হাদীছ চর্চা শুরু করেন।

১৮৮২ সালে তিনি হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররমায় যান। সেখানেও শত্রুর হাত প্রলম্বিত হয়। মক্কার গভর্নর তাঁকে আটক করে জেলে পাঠান। অনুসন্ধানের পর তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগসমূহ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ফলে তিনি মুক্তি পান এবং দেশে ফিরে পুনরায় শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হন। এরপরও বিরোধী শক্তি তাঁকে ‘কাফির’ ও ‘বিদ‘আতী’ বলে অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। অতীতের সংস্কারপন্থী অসংখ্য সালাফী আলেমও বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন।

শায়খ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী ছিলেন তাক্বওয়া, পরহেযগারী, আমানতদারী, দিয়ানতদারী, ইলম ও আমলের একজন পূর্ণাঙ্গ নমুনা। তাঁর মধ্যে ছিল দুনিয়াবিমুখতা, আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল, সত্যবাদিতা, আল্লাহভীতি, মানুষের সাহায্যবিমুখতা এবং অনন্য রাসূল-প্রেম ।

সমকালীন ওলামায়ে কেরাম তঁর সম্পর্কে ধারণা রাখতেন যে, তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির ও ইলমে হাদীছের সুদক্ষ সমঝদার একজন মুহাদ্দিছ।

তাঁর এক ছাত্র শায়খ শামসুল হক্ব আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) এ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে,

إنه امتحن واوذى مرات وكم من حاسد افتروا عليه بالاباطيل والاكاذيب وكم من معاند تقولوا عليه ما لم يقل به وَ سَیَعۡلَمُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَیَّ  مُنۡقَلَبٍ  یَّنۡقَلِبُوۡنَ لكن هو لا يخاف فى الله لومة لائم ولا يخاف الا الله

‘তিনি অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। কত হিংসুক তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যা রটনা করেছে। কত হঠকারী তাঁর  বিরুদ্ধে এমন বাজে মন্তব্য করেছে, যা তিনি কখনোই বলেননি। ‘অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোন্ স্থলে এরা প্রত্যাবর্তন করবে’ (সূরা আশ শু‘আরা : ২২৭)। এসব সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সত্য পথে অবিচল থাকতেন এবং নিন্দুকের নিন্দা পরওয়া করতেন না। বরং একমাত্র আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকতেন’। রাহিমাহুল্লাহ।

তাঁর খ্যাতিমান কয়েকজন ছাত্রের তালিকা

সৈয়দ নাযীর হুসাইনের মাদরাসার ছাত্রাবাসের রেকর্ড বইয়ের সূত্র অনুযায়ী শেষ সাত বছরে বার হাজার ছাত্র ভর্তি হয়েছিলেন। এ সংখ্যা অনাবাসিক ছাত্র বাদেই, অর্থাৎ যারা নিজ নিজ বাড়ি থেকে এসে পাঠ গ্রহণ করে ছুটি হলে চলে যেতেন। তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাদের নাম ভর্তি রেজিস্টারে থাকার কথা।

তিনি ষাট বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন। সুতরাং তাঁর ছাত্রের সংখ্যা অগণিত ছিল। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার ছাত্র পরবর্তীকালে খ্যাতিমান স্কলার হয়েছেন, কেউ লেখক, কেউ সমালোচক এবং কেউ দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে। এদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

আমাদের দেশে তথা বাংলা-আসামে তাঁর অসংখ্য ছাত্র ছিলেন। জয়ঈয়তে আহলেহাদীছের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল কাফী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সম্মানিত পিতা আবদুল হাদী, জয়পুরহাট‌ বানিয়াপাড়ার মুহাম্মাদ হুসাইন, ঘোড়াঘাটের আবদুল গফুরসহ অনেক নামের তালিকা ‘আহলেহাদীছ পরিচিতি’ গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহিল কাফী (রাহিমাহুল্লাহ)।

সৈয়দ নাযীর হুসাইন ১২৯৩ বঙ্গাব্দে বাংলা পরিভ্রমণকল্পে এদেশে আগমন করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের দেবকু-, রাজশাহীর জামিরা, যোগীপাড়া এবং রংপুরের লালবাড়ি প্রভৃতি স্থান সফর করেন।

আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বইটিতে উল্লেখ করেন যে, দীর্ঘ দুই বছর পরিশ্রম করে অর্ধশত নাম তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে যে সকল নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, সেই তালিকা আরও বড়। ‘আহলেহাদীছ পরিচিতি’ থেকে নামগুলো এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি না। আগ্রহীরা উক্ত গ্রন্থ থেকেই দেখে নিবেন।

সৈয়দ নাযীর হুসাইন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর গ্রন্থাবলী

তিনি লেখালেখিতে কখনো তেমন ব্যস্ত হননি। হলে হাদীছ-তাফসীরের উপর তাঁর অগাধ পা-িত্য ফুটে উঠত। যা সমসাময়িক কারো পক্ষে সম্ভব হত না। তিনি বরং পাঠদানেই অধিক সময় ব্যয় করতেন। তবে তাঁর অসংখ্য লিখিত ফাতাওয়া মাসায়েল ছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐ সব ফাতাওয়া একত্রে জমা করলে বহুখ-ের গ্রন্থ হত। তবুও যা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে-

‘মি‘আরুল হক্ব (উর্দূতে)’, ‘ওয়াকি‘আতুল ফাতওয়া ওয়া দাফিআতুল বিলওয়া’, ‘ছবূতুল হাক্কিল হাকীক’, ‘আল-মাসায়েল আল-আরবা‘আ’, ‘তাহাল্লিউন নিসা বিয-যাহাব’ এসবই উর্দূ ভাষায় রচিত কিতাব।

‘ফালাহুল ওলী বিইত্তেবায়িন নাবী’, ‘মাজমূ‘আতু বাযিল ফাতওয়া’। এ দু’টি প্রবন্ধ ফারসি ভাষায় রচিত। ‘রিসালাতুন ফী ইবতালি মাওলিদিন নাবী’। এটি আরবী ভাষায় রচিত।

তাঁর এক ছাত্র শায়খের ফাতাওয়াসমূহ দু-খ-ে একত্রিত করে নাম দিয়েছেন ‘ফাতাওয়া নাযীরিয়া’।

মৃত্যু

১০ রজব ১৩২০ হি. মোতাবেক ১২ অক্টোবর ১৯০২ খ্রি. সোমবার দিল্লীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
ড. মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিদায় - তানযীল আহমাদ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনকর্ম - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
সৈয়দ নাযীর হুসাইন দেহলভী - প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রাহিমাহুল্লাহ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জীবন ও কর্ম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
শাহ আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রাহিমাহুল্লাহ) - প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম

ফেসবুক পেজ