দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব
-খত্বীব : শাইখ ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান বুয়াইজান (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : শায়খ হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*
[গত ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪২ হি. মোতাবেক ১৩ নভেম্বর, ২০২০ তারিখের মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]
প্রথম খুত্ববাহ
মাননীয় খত্বীব হাম্দ ও ছানার পর বলেন, আল্লাহর বান্দাগণ! আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বনের অছিয়ত করছি। কেননা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলকে আল্লাহ তা‘আলা এই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَ لَقَدۡ وَصَّیۡنَا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ اِیَّاکُمۡ اَنِ اتَّقُوا اللّٰہَ.
‘তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকেও নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর’ (সূরা আন-নিসা : ১৩১)।
হে মুসলিমগণ! জ্ঞানার্জন হচ্ছে উন্নতিসাধন ও মুক্তির সোপান এবং বিজয় ও সফলতা লাভের মাধ্যম। দুনিয়ায় যা দ্বারা অলংকৃত হওয়া যায় তার মধ্যে এটা সবচেয়ে সম্মানজনক বস্তু এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের অধিক সম্মানিত ও ধন্য করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ دَرَجٰتٍ.
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ১১)।
জ্ঞান হচ্ছে সমাজ বিনির্মাণের মূল চালিকা শক্তি, যা সমাজ ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায়, তার অবকাঠামো ও কর্তৃত্ব সম্প্রসারণে, তার পতাকা সমুন্নত করতে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা রাখে। জ্ঞানই ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড, তার সফলতার উচ্চাসনে আরোহণের সোপান, উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরিকারী এবং জাতিকে পুণর্জাগরণকারী। এর কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বহু জাতিকে সম্মানিত করেছেন, ফলে তারা উন্নতি সাধন করেছে। আবার তিনি এর কারণেই অনেক জাতিকে বঞ্চিত করছেন, ফলে তারা অনুন্নত হয়ে পিছপা রয়েছে। তাই তো আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ ہَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ.
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না- তারা কি সমান? বস্তুত জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আয-যুমার : ৯)।
আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানীদেরকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন নিজের সাথে তাদেরকে উল্লেখ করে এবং স্বীয় তাওহীদের উপর তাদেরকে সাক্ষী রেখে তিনি বলেন,
شَہِدَ اللّٰہُ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ اُولُوا الۡعِلۡمِ قَآئِمًۢا بِالۡقِسۡطِ.
‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আর ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮)।
এরাই মূলত আল্লাহকে বেশী ভয় করে এবং এরাই অধিক পসন্দনীয় মানুষ। আল্লাহ বলেন, اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰہَ مِنۡ عِبَادِہِ الۡعُلَمٰٓؤُا ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা ‘আলিম তারাই কেবল তাঁকে ভয় করে’ (সূরা আল-ফাত্বির : ২৮)।
এরাই কল্যাণ, মর্যাদা ও সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে তিনি দ্বীনের ইলম ও জ্ঞান দান করেন। সঠিক পথের সন্ধানীরা তাদের কাছ থেকেই পথ নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং তাদের জ্ঞানের আলো নিয়ে হেদায়াতপ্রাপ্তরা আলোকিত হয়। আল্লাহ বলেন, فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘সুতরাং যদি তোমরা না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৭)। তিনি আরো বলেন, وَ تِلۡکَ الۡاَمۡثَالُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ ۚ وَ مَا یَعۡقِلُہَاۤ اِلَّا الۡعٰلِمُوۡنَ ‘আর এ সকল দৃষ্টান্ত আমরা মানুষের জন্য দিই; কিন্তু শুধু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এটা বুঝে’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৩)।
আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত তাদের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন বিধানে তাদের ছাপ রেখেছেন; কেননা তারাই তো নবীদের ওয়ারিশ। হাদীছে এসেছে, আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছি,
‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতাগণ জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। আসমান যমীনের সকলেই, এমনকি পানির মাছসমূহও আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। একজন ইবাদতগুজার ব্যক্তির উপর একজন আলেম-জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা তেমনি, যেমন তারকারাজির উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। আর আলেমগণ হচ্ছেন নবীগণের ওয়ারিছ। নবীগণ দীনার-দিরহাম ওয়ারিছী স্বত্ব হিসাবে রেখে যাননি। বরং তারা মীরাছ হিসাবে রেখে গেছেন ’ইলম’- জ্ঞান। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম লাভ করেছে, সে পূর্ণ অংশই লাভ করতে পেরেছে’।[১]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা জ্ঞানার্জন করুন। কেননা এতেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,
اَلدُّنْيَا مَلْعُوْنَةٌ مَلْعُوْنٌ مَا فِيْهَا إِلَّا ذِكْرَ اللهِ وَمَا وَالَاهُ أَوْ عَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا.
‘দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবই অভিশপ্ত, তবে আল্লাহর যিকির ও তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অন্যান্য আমল ছাড়া অথবা আলেম ও বিদ্যান্বেষী ছাড়া’।[২]
আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা শিখুন ও বিদ্যা অন্বেষণ করুন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য রাস্তায় বের হয়, আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের কোন একটি গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং পরস্পর মিলে তা অধ্যায়নে লিপ্ত থাকে, তখন তাদের উপর শান্তিধারা অবতীর্ণ হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, ফেরেশতারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকটে যারা আছে তাদের কাছে এদের কথা আলোচনা করেন। যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, বংশ মর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারে না’।[৩]
আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা শিখুন ও বিদ্যা অন্বেষণ করুন। কেননা এটা জান্নাতীদের পথের নির্দেশক, একাকীত্বের সঙ্গী, শত্রুকে মোকাবেলা করার অস্ত্র। এতেই রয়েছে উচ্চ মর্যাদা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ১১)।
আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা শিখুন, জ্ঞানার্জন করুন। কেননা এটাই হৃদয়ের আত্মা, চোখের জ্যোতি। এর মাধ্যমেই ব্যক্তি সম্মানজনক অবস্থা ও গুণীদের কাতারে পৌঁছতে পারে, হালাল-হারাম সম্পর্কে জানতে পারে। এর মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা অনেক জাতিকে মর্যাবান করেন, ফলে তিনি তাদেরকে সততা ও কল্যাণের এমন পৃষ্ঠপোষক করেন ও তাদেরকে নেতৃত্ব দেন, যার ফলে তাদের পদাঙ্ক ও কর্ম অনুসরণীয় হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَہِدَ اللّٰہُ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۙ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ اُولُوا الۡعِلۡمِ قَآئِمًۢا بِالۡقِسۡطِ ؕ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ.
‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আর ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮)।
আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা শিখুন, জ্ঞানার্জন করুন। কেননা জ্ঞানার্জনেই তাক্বওয়া বিদ্যমান। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই কেবল তাঁকে ভয় করে’ (সূরা আল-ফাত্বির : ২৮)। জ্ঞান অন্বেষেণ করা একটি ইবাদত, যে ব্যক্তি জানে না তাকে শিক্ষা দেয়া ছাদাক্বার সমতুল্য। আর যোগ্যদের মাঝে তা বিতরণ করাও পূণ্যের কাজ, সঠিক জ্ঞান লাভের প্রচেষ্টা করা জেহাদ সমতুল্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর মুমিনদের সকলের একসাথে অভিযানে বের হওয়া সংগত নয়। অতঃপর তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে। যাতে তারা সতর্ক হয়’ (সূরা আত-তওবাহ : ১২২)।
দ্বিতীয় খুত্ববাহ
হাম্দ ও ছানার পর খত্বীব ছাহেব বলেন, আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় শিক্ষা প্রদানই লালনপালন ও তারবিয়াতের মূল বিষয়। এতেই সচ্চরিত্র গঠন ও মূল্যবোধের বীজ বপন হয়। এর মাধ্যমেই ভুল সংশোধন, অপব্যাখ্যার অপনোদন ও সংশয় নিরসন হয়।
জ্ঞানই সুরক্ষিত দুর্গ ও মজবুত ভিত্তি। ফেৎনা, বিপদাপদ ও দুর্যোগের সময় এর মাধ্যমেই দৃঢ়তা, স্থিতিশীলতা ও বিচক্ষণতা প্রকাশ পায়। অতএব আপনারা সন্তানদেরকে সুশিক্ষা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দানের প্রতি সজাগ থাকুন। সন্তানের সততা, সমাজ গঠন ও প্রজন্মের সুশিক্ষা নিশ্চিত করণে আপনারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠনগুলোকে সহায়তা করুন। হাদীছে এসেছে, ‘আপনারা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। একজন পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের ও তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সেও তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শুনে রাখুন! আপনারা সকলেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেকেই আপন অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন’।[৪]
হে পিতামাতাগণ! বিধি মোতাবেক আপনারা স্বীয় সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের জন্য দায়বদ্ধ। তাই আপনারা সেই কর্তব্য পালনে পূর্ণ প্রচেষ্টা করুন, সন্তানদেরকে উত্তম নছিহত ও পরামর্শ দিন, তাদের শিক্ষার মাধ্যম, প্রোগ্রাম ও কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে দেখভাল করুন, তাদের সুশিক্ষা প্রদানে শিক্ষক ও মুরুব্বীদেরকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিন। সাধ্যমত তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করুন। আশা করা যায় যে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আপনাদেরকে সুসন্তান দান করবেন এবং তাদেরকে উপকারী জ্ঞান দান করবেন। মনে রাখবেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, একটি মহৎ ও স্থায়ী সৎকাজ এবং ছাদাক্বায়ে জারিয়া, যার ফল মৃত্যুর পরও বিদ্যমান। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُوْ لَهُ.
‘যখন কোন লোক মারা যায়, তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিন প্রকার আমল ছাড়া। যথা : ছাদাক্বায়ে জারিয়া। এমন ‘ইলম, যা দ্বারা অন্যরা উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দু‘আ করে’।[৫]
অতএব আপনাদের সন্তান ও বংশের কল্যাণার্থে উত্তম পন্থা অবলম্বন করুন; তাদেরকে সুশিক্ষা ও তারবিয়াত দেয়া, অবসর সময়গুলোর সদ্ব্যবহার করা, সৎ ও আনুগত্যমূলক কাজে উৎসাহ প্রদান এবং কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি জোর তাক্বীদ প্রদান করা। তবেই আশা করা যায় যে, তাদের দু‘আ ও হেদায়াতের বদৌলতে আপনাদেরকে অনুগ্রহ করা হবে। আপনারা তো জানেন না, তাদের মধ্যে কার দ্বারা আপনারা বেশী উপকৃত হবেন। জ্ঞান চর্চার জন্য অবশ্যই কিছু সময় রাখুন, আপনাদের সন্তানদেরকে পড়ালেখায় কঠোর পরিশ্রমী হতে উৎসাহ প্রদান করুন। কেননা এটা সুশিক্ষা দেয়ার উত্তম উপায়, ত্রুটিমুক্ত হতে দৃঢ় বিশ্বাস জোগায়, বিপদে অধিক নিরাপদ, বালা-মুছীবত ও সংকটকালে দৃঢ়চেতা ও ধৈর্যশীল করে তুলে। এটা সর্বোত্তম সৎকাজ, নৈকট্য ও উচ্চ মর্যাদা লাভের অন্যতম উপায়।
হে অভিভাবকবৃন্দ! হে শিক্ষকবৃন্দ! আপনারা নিজেরা উত্তম আদর্শবান হোন, এই প্রজন্মের সন্তানেরা আপনাদের হাতে আমানত। জাতির ভবিষ্যত আপনাদের দায়িত্বশীলতার সাথে সম্পৃক্ত। অতএব খুব সাবধান, সতর্ক হোন, নিজ নিজ দায়িত্ব রক্ষার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন! আমানত রক্ষায় আল্লাহকে ভয় করুন! আপন অধীনস্তদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন!
সন্তানদের মাঝে ধার্মিকতা ও মুল্যবোধের বীজ বপন করুন, জ্ঞান চর্চাকে তাদের ভালোবাসায় পরিণত করুন, তাদেরকে সততা ও উত্তম চরিত্রের উপর লালন-পালন করুন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا
‘যে ব্যক্তি সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে, তার জন্য সে পথের অনুসারীর সমান ছওয়াব রয়েছে। এতে তাদের কারো প্রতিদান হতে কিছুই কমবে না’।[৬]
অতএব আপনাদেরকে স্বাগতম; নবীগণ ও সৎকর্মশীলদের পরেই আপনারা শিক্ষা দানের গুরুদায়িত্বে রয়েছেন। নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ তা‘আলা শিক্ষক হিসাবেই প্রেরণ করেছেন। জ্ঞান চর্চায় লেগে থাকা, জ্ঞানের সেবা ও প্রচারে এবং কলাণ সাধনে ও মানুষকে সুশিক্ষা দানের জন্য মনোনীত হওয়ায় আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাই। আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, আপনারাই তো এ মহৎ কাজে ঈর্ষানুভব করেন। তাই নিয়ত পরিশুদ্ধ করে ছওয়াবের আশা করুন। আপনারা উত্তম কাজের যা কিছু নিজেদের জন্য পেশ করবেন তা আল্লাহর কাছে পাবেন।
আল্লাহর বান্দাগণ! ইসলামের সর্বজনীন একটি মূলনীতি হল- ঐক্য ও একতাবদ্ধতার মূলনীতি এবং দলাদলি ও মতবিরোধ থেকে সতর্কতাবলম্বন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১০৩)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি করো না’ (সূরা আশ-শূরা : ১৩)। এই বরকতময় দেশে আমাদের উপর আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ যে, আমরা বিশুদ্ধ আক্বীদাকে ধারণ করেছি, শরী‘আত মোতাবেক শাসন কার্য পরিচালনা, কুরআন ও সুন্নাহর মানহাজ অনুযায়ী চলা এবং মুসলিম জামা‘আত ও নেতৃত্বের উপর অবিচল রয়েছি।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ ও পথচ্যুত দল থেকে সাবধান ও সতর্ক করে বিশদ বিবরণসহ ‘উচ্চ উলামা পরিষদ’ কর্তৃক বিবৃতি এসেছে। তাই একজন মুসলিমের উচিত কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, সালাফে ছালেহীনের মানহাজে চলা এবং এ সকল সত্যবিমুখ দল ও জামা‘আতকে পরিহার করতঃ এদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত না করা ও কোন রকম সহানুভূতি না জানানো। আল্লাহই সত্য ও হেদায়াতের উপর মুসলিমদের মতকে একত্রিত করার যিম্মাদার, তিনিই সুমহান দানশীল, দয়ালু।
* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৪১; তিরমিযী, হা/২৬৮২; মিশকাত, হা/২১২, সনদ ছহীহ।
[২]. তিরমিযী, হা/২৩২২; ইবনু মাজাহ, হা/৪১১২; মিশকাত, হা/৫১৭৬, সনদ হাসান।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫; মিশকাত, হা/২০৪।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯; মিশকাত, হা/৩৬৮৫।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৩১; আবূ দাঊদ, হা/২৮৮০।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৯; মিশকাত, হা/১৫৮।