রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫:৩৬ পূর্বাহ্ন

মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব

-খত্বীব : শায়খ আহমাদ বিন তালেব বিন হামীদ
-অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*


[গত ০৭ শাওয়াল ১৪৪৪ হি. মোতাবেক ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন,یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ  اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২)। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ بَثَّ مِنۡہُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِہٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ  رَقِیۡبًا

‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের তাক্বওয়া অবলম্বন কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তাঁর থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন; আর তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক্ব দাবী কর এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক’ (সূরা আন-নিসা : ১)। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ قُوۡلُوۡا  قَوۡلًا  سَدِیۡدًا  - یُّصۡلِحۡ  لَکُمۡ  اَعۡمَالَکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ  وَ رَسُوۡلَہٗ  فَقَدۡ  فَازَ  فَوۡزًا عَظِیۡمًا

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং সঠিক কথা বল। তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৭০-৭১)।

নিশ্চয় মহাসত্য বাণী হল আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম আদর্শ হল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে দ্বীনের মধ্যে নব-আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ। আর দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নব-আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, যার পরিণাম জাহান্নাম।

হে মুমিনগণ! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে বান্দাদের জন্য তাঁর গুণাবলীর জ্যোতি প্রকাশ করেছেন। তিনি যখন মর্যাদা, বড়ত্ব ও মহত্ত্বের চাদরে জ্যোতি প্রকাশ করেন, তখন মস্তকসমূহ অবনত, অন্তরসমূহ বিনয়ী ও আওয়াজ নীচু হয়ে আসে এবং পানিতে লবণ যেমন মিশে যায় তেমনি অহংকার নিঃশেষ হয়ে যায়।

আবার তিনি যখন তাঁর নামের পূর্ণতা ও গুণের সৌন্দর্য এবং স্বীয় সত্ত্বার পূর্ণতার পরিচায়ক নিপূণ কর্মযজ্ঞ নিয়ে আবির্ভূত হন, তখন তাঁর সৌন্দর্যের গুণাবলী ও পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যাবলী হতে বান্দা যতটুকু জানে তদানুযায়ী তার হৃদয়ে ভালোবাসার শক্তি সুদৃঢ় হয়। তখন বান্দার অন্তর তাঁর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া যাবতীয় বিষয় হতে মুক্ত থাকে। বস্তুত রবের প্রতি তার এ ভালোবাসা প্রকৃতিগত, কৃত্রিম নয়।

আর যখন তিনি দয়া, অনুগ্রহ, সহানুভূতি ও ইহসানের গুণে প্রকাশিত হন, তখন বান্দার আশার শক্তি জেগে উঠে, তার আকাক্সক্ষা বিস্তৃত হয় ও প্রত্যাশা জোড়ালো হয়। সে রবের পানে যাত্রা করে ও প্রত্যাশার গতিকে তীক্ষ্ণ করে। বস্তুত আশা-আকাক্সক্ষা যত তীব্র হয় কাজের প্রচেষ্টাও তেমন ঐকান্তিক হয়।

পক্ষান্তরে তিনি যখন ন্যায়পরায়নতা ও বদলা গ্রহণ এবং ক্রোধ, রাগ ও শাস্তির গুণে প্রকাশিত হন, তখন নফসে আম্মারা তথা কুমন্ত্রণা দানকারী নফস পরাভূত হয় এবং প্রবৃত্তি, রাগ, খেল-তামাশা, অবৈধ আকাক্সক্ষা ইত্যাদির প্রতি তার শক্তি বাতিল বা দুর্বল হয়ে যায়। আর উদাসীনতার লাগাম সংকুচিত হয়ে আসে; ফলে নফসে পর্যাপ্ত ভয়, আশঙ্কা ও সতর্কতা উপস্থিত হয়।

আবার যখন তিনি আদেশ, নিষেধ, ওয়াদা, উপদেশ, রাসূল প্রেরণ, কিতাব নাযিল, শরী‘আত প্রণয়ন ইত্যাদি গুণে বিকশিত হন, তখন তা থেকে তাঁর আদেশ মানা ও বাস্তবায়ন করার শক্তি জাগ্রত হয়। তা প্রচার করা, উপদেশ গ্রহণ করা, তা স্মরণ করা ও অন্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়া, সংবাদকে সত্যায়ন করা, আদেশ মানা ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার শক্তি জেগে উঠে।

তিনি যখন সবকিছুর শ্রবণ, দর্শন ও জানার গুণে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন বান্দার মাঝে লজ্জাশক্তি সক্রিয় হয়ে উঠে। তাই সে রবের নিকট এ বিষয়ে লজ্জা পায় যে, তিনি তাকে এমন অবস্থায় দেখবেন যা তিনি অপছন্দ করেন, বা তার এমন কথা শুনবেন যা তিনি ঘৃণা করেন অথবা তার এমন গোপনীয়তা জানবেন যা তাকে ক্রোধান্বিত করে। ফলশ্রুতিতে তার চলাফেরা, কথাবার্তা ও চিন্তা-ভাবনা শরী‘আতের গ-ির মধ্যে থাকে, স্বীয় মেজাজ ও প্রবৃত্তির অধীনে নয়।

পুনরায় তিনি যখন যথেষ্টতা, পর্যাপ্ততা, মানুষের কল্যাণ সাধন, তাদেরকে রিযিক প্রদান, বিপদমুক্তি দান এবং তাঁর অলীদেরকে সাহায্য করা, রক্ষা করা ও বিশেষভাবে তাদের সাথে থাকার গুণে আবির্ভূত হন, তখন বান্দার মাঝে তাঁর প্রতি তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতার শক্তি জাগ্রত হয়। বান্দা তাঁর প্রতি ও যা তার সাথে ঘটে তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং এতে সে এমন আচরণ করে যা তার মহান রবকে খুশী করে ।

তাওয়াক্কুল এমন একটি অর্থ যা বান্দার জ্ঞান ও ধারণাকে আল্লাহর সামর্থ ও যথেষ্টতা এবং বান্দার জন্য তাঁর সুন্দর চয়ন ও এর উপর তার নির্ভরতা এবং তার জন্য আল্লাহ যা নির্ধারণ করেন ও যা চয়ন করেন তাতে বান্দার সন্তোষ প্রকাশ- এর সাথে সংযোগ করে দেয়।

মহান আল্লাহ যখন প্রতাপশালীতা ও বড়ত্বের গুণে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন প্রশান্ত হৃদয় তাঁর মহত্ত্বের সামনে অবনত হয়, তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তির সামনে বিনম্র হয়, তাঁর অহংকার ও আত্মমর্যাদার সামনে নতিস্বীকার করে এবং তার দেহ-মন বিনীত হয়। ফলে এটা ব্যক্তির হৃদয়ে, মুখে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ও চাল-চলনে প্রশান্তি ও গাম্ভীর্যতা বৃদ্ধি করে এবং তার উদাসীনতা, দাপট ও দাম্ভিকতা দূর করে।

সুতরাং বান্দা যখন তার রবকে চিনতে পারবে, তখন এ বাস্তব ঐশী গুণাবলী তাকে আল্লাহর প্রতি বিশেষ মহব্বত পোষণ ও তাঁর সাক্ষাত লাভের আকাঙ্খাকে অনিবার্য করে দিবে। তাকে পেয়ে প্রফুল্ল ও আনন্দিত হওয়া, তাঁর সেবায় আত্মতৃপ্তি, তাঁর নৈকট্য লাভের প্রতিযোগিতা করা, আনুগত্য করে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ, তাঁর যিকির উচ্চারণ, সৃষ্টিকে ছেড়ে তাঁর পথে আসা ইত্যাদিকে আবশ্যক করে দেয়। তখন সবকিছু বাদে কেবলমাত্র আল্লাহই তার ধ্যাণ-জ্ঞান হয়।

তেমনিভাবে তাঁর প্রভুত্বের বাস্তব গুণাবলী তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করা, তাঁর মুখাপেক্ষী হওয়া এবং তাঁর নিকটেই সাহায্য কামনা করা, বিনীত হওয়া ও নতিস্বীকারকে আবশ্যক করে।

দ্বিতীয় খুত্ববা

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আল্লাহর বান্দাগণ! রবের পরিচয় সম্পর্কে যার জ্ঞান পরিপূর্ণ হয়েছে, সে-ই তো আল্লাহর উপাসত্যের মাঝে প্রভুত্ব, তাঁর প্রভুত্বের মাঝে উপাসত্য, তাঁর রাজত্বে প্রশংসা, তাঁর মার্জনায় শক্তি, তাঁর ফয়সালা ও তাকদীর নির্ধারণে হিকমত, বিভিন্ন বালা-মুছীবতে তাঁর নে‘মত, নিবারণের মাঝে দান, তাঁর অবিনশ্বরতায় দয়া, অনুগ্রহ, ইহসান ও কৃপা ইত্যাদি অবলোকন করতে পারে। তাঁর শাস্তিতে ইনসাফ, তাঁর ক্ষমা, গোপন রাখা ও এড়িয়ে যাওয়ায় বদান্যতা ও অনুগ্রহ, তাঁর আদেশ ও নিষেধে প্রজ্ঞা ও নে‘মত, তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধে প্রভাব, সুযোগ দানে তাঁর সহনশীলতা, তাঁর পথে অগ্রসরে বদান্যতা এবং তাঁর পথ থেকে বিমূখ হলে তাঁর অমুখাপেক্ষিতাকে দেখতে পারে।

ফলে সে আসমানসমূহে আরশের উপর একজন চিরঞ্জীব অধিপতিকে প্রত্যক্ষ করতে পারে- যিনি তাঁর বান্দাদের যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন, আদেশ ও নিষেধ করেন, রাসূলদের প্রেরণ করেন, কিতাব নাযিল করেন এবং সন্তুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হন, প্রতিদান ও শাস্তি দেন, প্রদান ও নিবারণ করেন, কাউকে সম্মানিত ও কাউকে অপদস্ত করেন, কাউকে উন্নত ও কাউকে অবনত করেন। তিনি সাত আসমানের উপর থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু দেখেন, শুনেন ও জানেন। তিনি যা ইচ্ছে তাই করেন। তিনি সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত; সব রকমের দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। ক্ষুদ্র বস্তু বা তার চেয়েও অতিক্ষুদ্র কোন কিছুই তাঁর অনুমতি ছাড়া নড়ে না এবং তাঁর অজান্তে গাছের পাতাও ঝড়ে না। কেউ তাঁর নিকটে তাঁর অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আত করতে পারবে না। তাঁর বান্দাদের জন্য তিনি ব্যতীত কোন সাহায্যকারী নেই, নেই কোন সুপারিশকারী।

পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববা সমাপ্ত করেন।

* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।




প্রসঙ্গসমূহ »: খুত্ববাতুল হারামাইন
আল-কুরআন নাজাত লাভের মাধ্যম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ফিতনার সময় রাসূূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মানহাজ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সদাচরণ-ই হচ্ছে দ্বীন - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
উদাসীনতার কুফল এবং এর প্রতিকার - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ