বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত

-খত্বীব : শাইখ ড. আব্দুল্লাহ আল-বুয়াইজান

-অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*


[০৮ সফর ১৪৪২ হি. মোতাবেক ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]

মহান আল্লাহ্র প্রশংসা এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর শায়খ বলেন, আল্লাহ্র কিতাব হচ্ছে সর্বোত্তম বাণী ও শ্রেষ্ঠ দিশারী। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত হচ্ছে সেরা ও ন্যায়সংগত পন্থা ও মতাদর্শ। উত্তম আদর্শ রয়েছে তার অনুসরণে, পক্ষান্তরে বিদ‘আতে রয়েছে পদস্খলন ও ভ্রষ্টতা।

আল্লাহ্র বান্দাগণ! আল্লাহ্র নির্দেশ পালনের বিষয়ে আপনারা তাঁর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকুন। তিনি বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তবেই তিনি তোমাদের আমলকে ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করে, সেই তো মহা বিজয় লাভ করবে।

হে মুসলিমগণ! মসজিদগুলো হচ্ছে আল্লাহর ঘর এবং তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ স্থান। এগুলো তৈরি করা হয়েছে ইবাদত ও আল্লাহর যিকির করার জন্য, এখানে তারাই যাতায়াত করে যারা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা রাখে। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّمَا یَعۡمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰہِ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوۃَ  وَ اٰتَی الزَّکٰوۃَ وَ لَمۡ یَخۡشَ اِلَّا اللّٰہَ  فَعَسٰۤی اُولٰٓئِکَ اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُہۡتَدِیۡنَ.

‘তারাই তো মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি, ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব আশা করা যায় যে, তারা হবে সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা আত-তাওবা : ১৮)। এই মসজিদসমূহের আবাদ প্রকৃত মুমিন বান্দারা ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا کَانَ لِلۡمُشۡرِکِیۡنَ اَنۡ یَّعۡمُرُوۡا مَسٰجِدَ اللّٰہِ ‘মুশরিকরা আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে এমন হতে পারে না’ (সূরা আত-তাওবা : ১৭)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘সেই সব গৃহ, যাকে মর্যাদায় সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন; সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেই সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় কোনটিই আল্লাহ্র স্মরণ হতে এবং ছালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান করা হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সে দিনকে, যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে (সূরা আন-নূর : ৩৬-৩৭)।

যারা মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করে, মিনার ও মিহরাবসমূহ বন্ধ করে দেয়, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন,

وَ مَنۡ اَظۡلَمُ  مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰہِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡہَا اسۡمُہٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِہَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَہُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡہَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ لَہُمۡ  فِی الدُّنۡیَا خِزۡیٌ وَّ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ.  

‘আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্চনা ও আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৪)।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! মসজিদসমূহ হচ্ছে আল্লাহর ঘর, এগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান ও ভূখণ্ড এবং যারা তাদের রবের ইবাদত ও আনুগত্য করে তাদের ঠিকানা। আযানের মাধ্যমে প্রতিদিন মসজিদের মিনার হতে ‘আশহাদু আন-লা ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ তাওহীদের এই সাক্ষ্যবাণী বারবার উচ্চারিত হয়। এই মিহরাব ও মিম্বার হতেই ঈমানের বাণী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা অন্তরসমূহ ও শ্রবণশক্তিকে খুলে দেয় এবং শিরকের কুসংস্কারকে দূরীভূত করে।

ইসলামে এটাই (মসজিদ) শিষ্টাচার ও জ্ঞান চর্চামূলক প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে ছাহাবীগণের প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। ফলে তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও আমলের অধিকারী। ইসলামের প্রথম প্রাসাদ এটিই, যেখানে দা‘ওয়াতী কার্যক্রমের জন্য মিম্বার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে দা‘ওয়াত, জিহাদ ও উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম বিস্তৃত হয়েছে।

হে মুসলিমগণ! আল্লাহ্র নিকট উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ সম্মানজনক অন্যতম আমল হচ্ছে ‘আল্লাহ্র ঘর মসজিদসমূহ আবাদ করা’। তিনি বলেন, ‘তারাই তো মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি, ছালাত কায়েম করে.....’(সূরা আত-তাওবা : ১৮)। আর মসজিদের আবাদ বলতে তা তৈরি করা, সেখানে ইবাদত করা, ছালাত কায়েমের জন্য সেখানে গমন করা এবং যখনই মুয়াযযিন আযানে ‘হাইয়া ‘আলাছ ছালাহ’ বলে তখনি ছালাতের জন্য মসজিদমুখী হওয়াকে বুঝায়।

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আযান দেয়া ও প্রথম কাতারের ফযীলত সম্পর্কে মানুষ যদি জানত, আর তা পেতে লটারী করা ছাড়া যদি কোন উপায় না থাকত, তাহলে তারা লটারীর সাহায্য নিত। আর যদি তারা প্রথম ওয়াক্তে যোহরের ছালাত আদায়ের ফযীলত সম্পর্কে জানত, তাহলে তারা এর জন্য প্রতিযোগিতা করত। আর এশা ও ফজরের ছালাত [জামা‘আতে] আদায়ের কী ফযীলত তা যদি তারা জানত, তাহলে এ দু’ছালাতে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা উপস্থিত হত।[১]

আল্লাহ্র বান্দাগণ! যে সকল কাজে সম্মান বৃদ্ধি পায় ও পাপ মোচন করা হয় তার অন্যতম হচ্ছে, মসজিদে আসার জন্য বেশি বেশি পদচারণা করা। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَىْ مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوْا بَلَىْ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ عَلَىْ الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَى إِلَىْ الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ فَذَالِكُمُ الرِّبَاطُ.

‘আমি কি তোমাদের বলে দিব না, যার মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের গুনাহ মুছে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ১. কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণভাবে ওযূ করা ২. মসজিদ সমূহের দিকে অধিক পদচারণা ৩. এক ছালাতের পর পরবর্তী ছালাতের প্রতীক্ষায় থাকা। আর এটিই হচ্ছে রিবাত বা প্রহরী’।[২]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ أَوْ رَاحَ أَعَدَّ اللهُ لَهُ نُزُلَهُ مِنَ الْجَنَّةِ كُلَّمَا غَدَا أَوْ رَاحَ ‘যে সকাল-বিকাল মসজিদে যাবে, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তার জন্য প্রত্যেকবারের পরিবর্তে একটি মেহমানী প্রস্তত করে রাখবেন। যত সকাল-বিকাল সে যাবে’।[৩]

আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর ঘরের অগ্রদূতগণ, মসজিদের আবাদকারীগণ! আপনাদেরকে পরিপূর্ণ সুশীতল ছায়া লাভের স্বাগতম জানাই এবং আপনারা সর্বোত্তম ও ত্রুটিম্ক্তু জ্যোতি লাভের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা ছায়া দিবেন নিজের ছায়ায়, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে অন্যতম সেই ব্যক্তি, যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে লটকানো থাকে...’।[৪] বুরাইদা আল-আসলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, بَشِّرِ الْمَشَّائِيْنَ فِى الظُّلَمِ إِلَى الْمَسَاجِدِ بِالنُّوْرِ التَّامِّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘অন্ধকারে মসজিদের দিকে গমনকারীদের ক্বিয়ামতের দিন পূর্ণ জ্যোতির সুসংবাদ দাও।[৫]

অতএব আপনারা আল্লাহর ঘরের জন্য কিছু সময় নির্ধারিত করুন, কিছু ইবাদত আবশ্যকীয়ভাবে সেখানে পালন করুন এবং যা আপনাদের উপকারে আসবে এমন কিছু আমল নিজেদের জন্য অগ্রিম পেশ করুন যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন আপনাদেরকে সম্মানিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ مَا  تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ  عِنۡدَ اللّٰہِ ہُوَ خَیۡرًا وَّ اَعۡظَمَ اَجۡرًا  وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ  اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ  ‘আর তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম পাঠাবে, তোমরা তা পাবে আল্লাহর কাছে। তা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসাবে মহত্তর। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর; নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ২০)।

ছানী খুত্ববাহ

দ্বিতীয় খুত্ববাতে সম্মানিত খত্বীব মহান আল্লাহ্র প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ছালাত ও সালামের পরে বলেছেন, আল্লাহর বান্দাগণ! জামা‘আতের সাথে ফরয ছালাতগুলো আদায় করা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন ও ঈমানের পরিচায়ক। তাই আপনারা ছালাত আদায়কারীদের সাথে জামা‘আতে ছালাত আদায় করুন। আল্লাহর বান্দাগণ! জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করা অন্যতম উত্তম আমল, ফযীলতপূর্ণ ইবাদত ও শ্রেষ্ঠ নেকীর কাজ।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি আমাদের দেখেছি, জামা‘আতে ছালাত আদায় করা থেকে মুনাফিক্বরা ব্যতীত কেউ বিরত থাকত না। যাদের মুনাফিক্বী অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল অথবা রুগ্ন লোক। যদি কোন রুগ্ন লোক দু’ব্যক্তির উপর ভর করে চলতে সক্ষম হত সেও জামা‘আতে আসত। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে হেদায়াতের পথসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন। আর হেদায়াতের পথসমূহের মধ্যে মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায় করাও একটি হেদায়াতের পথ, যে মসজিদে আযান দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রাসূলুুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আগামীকাল আল্লাহর সাথে পূর্ণ মুসলিম হিসাবে সাক্ষাৎ করে সন্তুষ্ট হতে চায়, সে যেন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের প্রতি বিশেষভাবে যতœবান হয়, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের আযান দেয়া হয়। কেননা  আল্লাহ তা‘আলা তা তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের পথসমূহ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। কেননা এই ছালাতসমূহ হেদায়াতের পথসমূহের অন্যতম একটি। যদি তোমরা তোমাদের ঘরে ছালাত আদায় কর, যেভাবে মুনাফিক্বরা তাদের ঘরে ছালাত আদায় করে, তাহলে অবশ্যই তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করলে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে অতঃপর ঐ মসজিদসমূহের মধ্যে কোন মসজিদের দিকে গমন করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিটি পায়ের ধাপের বিনিময়ে একটি করে নেকী দান করবেন, তার মর্যাদা এক ধাপ উন্নত করবেন এবং তার একটি পাপ ক্ষমা করবেন। আমি আমাদের দেখেছি, জামা‘আতে ছালাত আদায় করা থেকে মুনাফিক্বরা ব্যতীত কেউ বিরত থাকত না, যাদের মুনাফিক্বী অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। কোন লোককে দু’ব্যক্তির উপর ভর করে এনে ছালাতের সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হত।[৬]

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, صَلَاةُ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلَاةَ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَّعِشْرِيْنَ دَرَجَةً ‘একাকী ছালাত আদায় করা অপেক্ষা জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করলে সাতাশ গুণ নেকি বেশি হয়’।[৭]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির জামা‘আতে ছালাত আদায় করার নেকী তার ঘরে কিংবা বাজারে ছালাত আদায় করা অপেক্ষা পঁচিশ গুণ বেশী। আর এটা তখনই হয়, যখন সে ওযূ করে এবং উত্তমরূপে ওযূ করে, অতঃপর মসজিদের দিকে বের হয়। আর তাকে ছালাত ব্যতীত অন্য কিছু বের করে না, তাই সে যত পদক্ষেপই করে, তার দরুন তার এক একটি মর্যাদা উন্নত করা হয় এবং তার দ্বারা তার এক একটি গুনাহ ক্ষমা করা হয়। অতঃপর যখন সে ছালাত আদায় করতে থাকে, তখন ফেরেশতাগণ এভাবে তার জন্য দু‘আ করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ছালাতের জায়গায় থাকে, اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ  اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ ‘হে আল্লাহ! আপনি তার প্রতি ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে রহম করুন। আর যখন তোমাদের কেউ যতক্ষণ ছালাতের অপেক্ষায় থাকে, ততক্ষণ যেন সে ছালাতেই থাকে’।[৮]

আল্লাহর বান্দাগণ !করোনা ভাইরাসের কারণে দূর্যোগ পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করায় মুসলিমদের জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করা স্থগিত হয়ে পড়ে, এমতবস্থায় যার হৃদয় মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত তিনি আরো ব্যথিত হয়ে পড়েন। ফলে মসজিদে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের জন্য তার আবেগ, আকাঙ্খা ও আকর্ষণ আরো প্রবল হয়ে উঠেছে! আল্লাহ তা‘আলা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, তিনিই দুরাবস্থা হতে উত্তোরনের পথ উম্মুক্ত করেছেন ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এই তো সকল মসজিদের দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে, তার চত্বর প্রস্তুত করা হয়েছে। আল্লাহর ঘরগুলো এখন তার আবাদকারী ও যিয়ারতকারীদের অপেক্ষায়, তার মিনারগুলো হতে উচুঁ স্বরে আযানের সুমধুর ধ্বনিতে ডেকে ডেকে বলা হচ্ছে, ‘হাইয়া ‘আলাছ ছালাহ, হাইয়া ‘আলাছ ছালাহ, হাইয়া ‘আলাল ফালাহ, হাইয়া ‘আলাল ফালাহ’। বায়তুল্লাহ, হারাম চত্বর ও মুসলিমদের ইবাদতের স্থানগুলো উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল প্রান্ত হতে ওমরাহ ও যিয়ারতকারীদের স্বাগতম জানানো হচ্ছে।

অতএব আপনারা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর শুকরিয়া আদায় করুন। মহামারীর অবশিষ্টাংশ তুলে নেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন, তিনি যেন এই মুছীবত-কষ্ট আমাদের থেকে সরিয়ে নেন এবং পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও সুস্থতা দান করেন। আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহর ঘরসমূহের [মসজিদ] অভিমূখে আগমণ করুন, আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া প্রদান করুন। তিনি যখন আপনাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকেন যা আপনাদেরকে প্রাণবন্ত, ত্রুটিমুক্ত, সৌভাগ্যবান ও হেদায়াতপ্রাপ্ত করে, তখন আপনারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দিন। আর আপনারা প্রত্যেক ছালাতে আপনাদের লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহকেই নির্ধারণ করুন এবং যখনই আযান দেয়া হয় তখনই ফরয ছালাতগুলোর প্রতি যতœশীল হোন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারাই তো মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি, ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব আশা করা যায় যে, তারা হবে সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা আত-তাওবা : ১৮)।

আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহ তা‘আলা এই বরকতপূর্ণ দেশের উপর যে ইহসান করেছেন; তাওহীদ, ঐক্য, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, হারামাইন শরীফাইন ও তার যিয়ারতকারীদের খেদমত করা, মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বারোপ, মানবিকতা ও এ দেশের প্রতিষ্ঠা লগ্ন হতে অদ্যাবধি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা ইত্যাদি এ সকল নে‘মতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব এবং এর নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, ধর্মীয় ঐক্য, দেশাত্ববোধ, দেশের জনগণ ও সরকারের সাথে সম্পৃক্ততা ও শাসকদের জন্য তাওফীক্ব কামনা করাও আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দেশ ও মুসলিম বিশ্বকে সবধরণের বিপদাপদ হতে রক্ষা করুন; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সাড়া প্রদানকারী।

পরিশেষে খত্বীব আল্লাহ্র প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ ও ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।

* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৫; ও ছহীহ মুসলিম, হা/৪৩৭।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫১; মিশকাত, হা/২৮২।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৬৯।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩১; তিরমিযী, হা/২৩৯১।
[৫]. তিরমিযী, হা/২২৩; আবূ দাঊদ, হা/৫৬১, সনদ ছহীহ; মিশকাত, হা/৭২১।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৪; মিশকাত, হা/১০৭২।
[৭]. ছহীহ বুখারী হা/৬৪৫; ছহীহ মুসলিম হা/৬৫০; মিশকাত, হা১০৫২।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত
চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
যালিমের পতন ও মযলুমের বিজয় অবধারিত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
শাসক নির্বাচন ও আনুগত্যের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলী - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ