আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা
-খত্বীব : শায়খ আব্দুল মুহসিন আল কাসেম (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*
[গত ১১ যিলক্বদ, ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ১০ জুন, ২০২২ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]*
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা যথাযথভাবে আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন এবং গোপনে ও একান্তে তাকে সমীহ করে চলুন।
হে মুসলিমগণ! আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের বিশাল মর্যাদা রয়েছে। আর জ্ঞান বৃদ্ধি ও অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যমে অর্জিত ‘ইয়াকীন/নিশ্চিত বিশ্বাস’র অবস্থান সাধারণ জ্ঞানের চেয়ে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন এবং তা ঈমানের সর্বোচ্চ স্তরের একটি শাখা। মুমিনদের মধ্যে সুনিশ্চিত বিশ্বাস পোষণকারীগণ একটি বিশেষ দল, যারা অন্য মুমিনদের থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও প্রশান্তির অধিকারী। যেমনভাবে ইহসানের অবস্থান শারীরিক আমলে, তেমনি ‘ইয়াকীন’ তথা নিশ্চিত বিশ্বাসের অবস্থান অন্তরের আমলে। তবে এর অধিকারীগণ বিভিন্ন স্তরের হয়ে থাকেন; আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাসের বাস্তবায়ন হল, তাঁর সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করা যা তদানুযায়ী আমলকে আবশ্যক করে; আর এটাই ঈমানের সবচেয়ে সম্মানজনক স্তর, নবীদের প্রতীক ও মুমিনদের বৈশিষ্ট্য।
ঈমানের সাথে ইয়াকীনের গুরুত্ব তেমনি যেমন দেহের মধ্যে আত্মার মর্যাদা। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, (সমস্ত বিশ্বাসের সমন্বয় হল ইয়াকীন/নিশ্চিত বিশ্বাস।) যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ঈমানী শক্তির সাথে আরো ঈমান বৃদ্ধির ইচ্ছা পোষণ করলেন; তখন তাকে আসমান ও জমিনের রাজত্ব দর্শন করালেন, যাতে তিনি উক্ত উচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ کَذٰلِکَ نُرِیۡۤ اِبۡرٰہِیۡمَ مَلَکُوۡتَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لِیَکُوۡنَ مِنَ الۡمُوۡقِنِیۡنَ.
‘এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব দেখাই, যাতে তিনি নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হন’ (সূরা আল-আন’আম : ৭৫)।
ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, অর্থাৎ এ দু’টোর সৃষ্টির প্রতি তাঁর দৃষ্টি প্রদানে ‘আল্লাহর রাজত্ব ও সৃজনে তিনিই একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং তিনি ছাড়া কোন প্রভু নেই’- এর উপর প্রমাণ বহনের কারণ তাঁর নিকট সুস্পষ্ট হয়েছে।
নবীদের পর নিশ্চিত বিশ্বাসীগণই মানুষের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন; তাদের পরিপূর্ণ দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে। আবূ বকর ইবনু আইয়াশ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ما سبقهم أبو بكر بكثرة صلاة ولا صيام ولكن بشيء وقر في قلبه ‘ছাহাবীদের উপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অধিক ছালাত বা ছিয়াম পালন করে অগ্রগামী হননি। বরং তিনি তাদের চেয়ে অগ্রণী হয়েছিলেন এমন কিছুর দ্বারা যা তার অন্তরে ভর করেছিল -অর্থাৎ স্থির ও সুদৃঢ় হয়েছিল’।[১]
নিশ্চিত বিশ্বাসীগণই বিভিন্ন নিদর্শন ও প্রমাণের উপর গভীর দৃষ্টিপাত করে উপকার লাভ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ فِی الۡاَرۡضِ اٰیٰتٌ لِّلۡمُوۡقِنِیۡنَ ‘আর নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য যমীনে অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা আয-যারিয়াত : ২০)। আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীর মধ্য থেকে বিশ্বাসীদেরকে হেদায়াত ও সফলতার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ . اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ .
‘আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে, আর যারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী। তারাই তাদের রবের নির্দেশিত হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪-৫)।
আর যার অন্তরকে ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস স্পর্শ করে, তার মাঝে আল্লাহর প্রিয় অন্তরের ইবাদতসমূহ -যেমন ভয়, আশা, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি- সর্বোচ্চ পূর্ণতা লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, فالإيمان قلب الْإِسْلَام ولبه وَالْيَقِين قلب الْإِيمَان ولبه ‘ইসলামের মূল ও শ্রেষ্ঠাংশ হল ঈমান। আর ঈমানের মূল ও শ্রেষ্ঠাংশ হল ইয়াকীন/দৃঢ় বিশ্বাস’।[২] আর দৃঢ় বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর উপাস্যতা এবং এই জগতে তাঁর প্রভুত্বের উপর দৃঢ় বিশ্বাস।
আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁকে জানা ও তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদানের সহজাত বৈশিষ্ট্যের উপর। আর প্রতিটি মাখলুকই তার অন্তরে আল্লাহর একত্ব, তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি এবং তাঁর ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,
فَاَقِمۡ وَجۡہَکَ لِلدِّیۡنِ حَنِیۡفًا ؕ فِطۡرَتَ اللّٰہِ الَّتِیۡ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیۡہَا ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِخَلۡقِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ٭ۙ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ.
‘অতএব আপনি একনিষ্ঠ হয়ে দ্বীনের জন্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আল্লাহর ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি) যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন’ (সূরা আর-রুম : ৩০)।
মানুষের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এই ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি) দ্বারাই সমস্ত রাসূলগণ তাদের উম্মতের উপর দলীল পেশ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, اَفِی اللّٰہِ شَکٌّ فَاطِرِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ‘আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে, যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা? (সূরা ইবরাহীম : ১০)। অর্থাৎ তোমরা জান ও স্বীকৃতি দাও যে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বতায় কখনো কোন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণকারী নির্দশনসমূহে গভীর দৃষ্টিপাত করতে উৎসাহিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ فِی الۡاَرۡضِ اٰیٰتٌ لِّلۡمُوۡقِنِیۡنَ . وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ .
‘আর নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য যমীনে অনেক নিদর্শন রয়েছে। এবং তোমাদের মধ্যেও। তোমরা কি অনুধাবন করবে না? (সূরা আয-যারিয়াত : ২০-২১)। আল্লাহকে জানা, তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ পেশ ও তাঁর ইবাদতের হক্বদার হওয়ার বিষয়ে অগণিত পথ-পদ্ধতি রয়েছে। প্রতিটি বস্তুতেই তাঁর নির্দশন বিদ্যমান। জগতের সবকিছুই তাঁর প্রমাণ বহন করে। মহান আল্লাহ বলেন,یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ یُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ بِلِقَآءِ رَبِّکُمۡ تُوۡقِنُوۡنَ ‘তিনি আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার’ (সূরা আর-রা’দ : ২)। কুরআনের রীতি হল তাওহীদুর রুবূবিয়্যাতের মাধ্যমে তাওহীদুল উলূহিয়্যাতকে সাব্যস্ত করা। আর তাঁর রুবূবিয়্যাত তাঁর উলূহিয়্যাতকে আবশ্যক করে।
আল্লাহর অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর সৃষ্টিকূল। জগতে যা কিছু রয়েছে তার সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ; এটা মানুষ তখনই উপলব্ধি করতে পারবে যখন মানুষের বিবেক ও ফিতরাতে বদ্ধমূল হবে যে, সৃষ্টিজীব নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না, সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কোন কিছু অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। আর প্রতিটি পরিণতিই তার কারণের সাথে সম্পর্কিত। মহান আল্লাহ বলেন,
اَمۡ خُلِقُوۡا مِنۡ غَیۡرِ شَیۡءٍ اَمۡ ہُمُ الۡخٰلِقُوۡنَ . اَمۡ خَلَقُوا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ بَلۡ لَّا یُوۡقِنُوۡنَ .
‘তারা কি ¯্রষ্টা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই ¯্রষ্টা? নাকি তারা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না’ (সূরা আত-তূর : ৩৫-৩৬)।
ছোট মাছি ও বিশাল আসমান তাঁর বড়ত্ব ও একত্বের প্রমাণ বহন করে। মহান আল্লাহ বলেন,اِنَّ اللّٰہَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَہَا ‘নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জাবোধ করেন না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৬)।
তাঁর অনেক সৃষ্টি রয়েছে যা চমৎকার দলীলস্বরূপ, যা তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণকে আবশ্যক করে এবং তাঁর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী ও কর্মসমূহের নির্দেশ করে। তিনি অস্তিত্বহীনতা থেকে সৃষ্টিজীবকে অস্তিত্বে এনেছেন এবং বস্তুসমূহ ও তার বৈশিষ্টাবলীকে সৃজন করেছেন। আর সেগুলোকে বিভিন্ন পর্যায় ও অবস্থায় পরিবর্তিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ فِیۡ خَلۡقِکُمۡ وَ مَا یَبُثُّ مِنۡ دَآبَّۃٍ اٰیٰتٌ لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ‘আর তোমাদের সৃষ্টি ও জীব-জন্তুর বিস্তারে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করে’ (সূরা আল-জাসিয়া : ৪)। আর এগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলীর পরিবর্তনকে চাক্ষুস প্রমাণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ.
‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯০)।
তিনি যমীনকে সমতল এবং চলাচল ও বিচরণ উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। আর এটাকে অনড় পর্বত দ্বারা স্থির করেছেন যেন অধিবাসীদের নিয়ে তা হেলে না পড়ে এবং তাতে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সব ধরণের জীব-জন্তু। তিনি আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষন করে তা দ্বারা সব ধরণের কল্যাণকর উদ্ভিদ জোড়ায় জোড়ায় উদগত করেন- শস্যদানা, আঙ্গুর, জয়তুন, ডালিম, বাগানসমূহ ও ফলমূল যেগুলোকে একই পানি দ্বারা সেচ দেয়া হয়, অথচ তার ধরণ ও স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন হয়।
আর চতুষ্পদ জন্তুর বিস্ময়কর বহু শ্রেণী ও বিরল প্রজাতি রয়েছে যা আহারকারীকে তৃপ্ত করে, আরোহীকে বহন করে এবং তার মালিকের প্রয়োজন পূরণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, اَللّٰہُ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَنۡعَامَ لِتَرۡکَبُوۡا مِنۡہَا وَ مِنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ ‘আল্লাহই তোমাদের জন্য গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা এদের কতকের উপর আরোহন করতে পার আর কতক তোমরা খেতে পার (সূরা আল-গাফির : ৭৯)। আর কিছু রয়েছে এমন যা তার দিকে দৃষ্টিপাতকারীকে আনন্দিত করে। মহান আল্লাহ বলেন,وَ لَکُمۡ فِیۡہَا جَمَالٌ حِیۡنَ تُرِیۡحُوۡنَ وَ حِیۡنَ تَسۡرَحُوۡنَ ‘আর তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে সৌন্দর্য যখন সন্ধ্যায় তা ফিরিয়ে আন এবং সকালে চারণে নিয়ে যাও’ (সূরা আন-নাহল : ৬)। আর এগুলো ভার বহন করে এক দেশ হতে অন্য দেশে নিয়ে যায়। এগুলোর চামড়া পোশাক, লোম শীত নিবারক ও পশম সৌন্দর্যের উপকরণ। মহান আল্লাহ বলেন, ہٰذَا خَلۡقُ اللّٰہِ فَاَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقَ الَّذِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ ‘এটা আল্লাহর সৃষ্টি! সুতরাং তিনি ছাড়া অন্যরা কী সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও (সূরা লুকমান : ১১)।
সমুদ্র যাতে রয়েছে বিস্ময়কর সব বিষয়; এটা রিযিক, ধনভান্ডার, মণিমুক্তা ও মূল্যবান ধাতু দ্বারা পরিপূর্ণ। যার পৃষ্ঠদেশে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য বোঝাই জাহাজ চলাচল করে; যাকে চতুর্পাশ থেকে উত্তাল তরঙ্গ আঘাত করে অথচ তা সুউচ্চ পাহাড়ের মত অটল থাকে। এর দিকে দৃষ্টিপাতকারী আল্লাহর একত্বতায় ঘোষণা করে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ تَرَی الۡفُلۡکَ مَوَاخِرَ فِیۡہِ وَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِہٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ.
‘আর তুমি তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করতে দেখতে পাও; এবং এটা এ জন্যে যে, তোমরা যেন তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সূরা আন-নাহল : ১৪)।
আর সুউচ্চ আসমান যা তারকারাজি দ্বারা সুসজ্জিত। যাকে তিনি দিক ও সময় নির্দেশক করেছেন, যা জল-স্থলের অন্ধকারে পথহারা লোকদের পথ দেখায়। যাতে রয়েছে বিশাল সূর্য যার তাপ থেকে সৃষ্টিজীব উপকৃত হয়। তাতে আরো রয়েছে আলোকজ্জ্বল চাঁদ যা রাতকে করে আলোকিত, দৃষ্টিপাতকারীকে করে পুলকিত এবং দিকভ্রান্তকে দেখায় পথ।
স্বয়ং মানুষের মাঝেই তার ¯্রষ্টার উপর বিরাট দলীল রয়েছে। যিনি তাকে মূল্যহীন নিকৃষ্ট পানি দ্বারা অস্তিত্বহীনতা থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে পরিবর্তন করেছেন অস্থি-মাংসে, অতঃপর তাকে ভিন্ন অবয়বে পরিণত করেছেন। সে শুনতে ও দেখতে পায়, কথা বলতে ও চুপ থাকতে পারে, দেয়া-নেয়া করতে পারে এবং যাওয়া-আসা করতে পারে। তিনি তাকে অজ্ঞতার পরে জ্ঞান দান করেছেন, দরিদ্রতার পরে সম্পদশালী করেছেন, বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা সৌন্দর্যম-িত করেছেন, তাকে তার কল্যণের দিকে পথ নির্দেশ করেছেন, তাকে উত্তম আকৃতি দিয়েছেন, তার মর্যাদাকে উন্নীত করেছেন এবং আশপাশের সবকিছুকে তার অধিনস্ত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
سَنُرِیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُ الۡحَقُّ.
‘অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব, বিশ্বজগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তিনিই সত্য’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৫৩)।
মহান আল্লাহ যেমনিভাবে সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে তাকে উত্তম ও পরিপূর্ণরূপে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাকে সুদৃঢ় ও মজবুতভাবে তৈরী করেছেন। যা তিনি সৃষ্টি করেছেন তাতে তিনি বান্দার কল্যাণকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সৃষ্টির বিভিন্ন অংশের মাঝে সামঞ্জস্যতা ও তার বৈচিত্রের পরিপূর্ণতার মাঝে সৃষ্টির প্রতি তাঁর গুরুত্ব প্রতিভাত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِیۡۤ اَعۡطٰی کُلَّ شَیۡءٍ خَلۡقَہٗ ثُمَّ ہَدٰی ‘যিনি সকল বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর সঠিক পথ নির্দেশ করেছেন’ (সূরা ত্ব-হা : ৫০)।
আর তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণসমূহের মধ্য হতে অন্যতম হল- তিনি যে পৃথিবী অভিনবভাবে সৃষ্টি করেছেন তা সুবিন্যস্ত হওয়া এবং অলঙ্ঘনীয় ও অপরিবর্তনীয় রীতিতে তার আবর্তিত হওয়া; যাতে কোন ধরণের অহেতুক বিষয়, বিশৃঙ্খলা, ত্রুটি ও গোলযোগ নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
لَا الشَّمۡسُ یَنۡۢبَغِیۡ لَہَاۤ اَنۡ تُدۡرِکَ الۡقَمَرَ وَ لَا الَّیۡلُ سَابِقُ النَّہَارِ وَ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ.
‘সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সাতার কাটে’ (সূরা ইয়াসীন : ৪০)।
মহান আল্লাহ সৃষ্টির জন্য যে নীতি নির্ধারণ করেছেন এবং বান্দাদের জন্য যা চয়ন করেছেন পৃথিবীতে তার চেয়ে কোন সূক্ষ্ম নীতি নেই। তিনি বৈপরীত্যপূর্ণ বস্তুসমূহ সৃষ্টি করেছেন যাতে উপকার পূর্ণতা পায় এবং পরস্পর বিপরীতমুখী বস্তুকে একত্রিত করেছেন যেন তাঁর হিকমত প্রকাশ পায়; দিন ও রাত, গরম ও ঠান্ডা এবং অন্ধকার ও আলো। তথাপি সকল কিছুই সুনির্দিষ্ট পরিমাণে যা সূক্ষ্ম পরিমাপে চলমান, যার মাঝে কোন বৈপরীত্য ও গরমিল নেই। মহান আল্লাহ বলেন, مَا تَرٰی فِیۡ خَلۡقِ الرَّحۡمٰنِ مِنۡ تَفٰوُتٍ ‘পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন অসামঞ্জস্যতা দেখতে পাবে না’ (সূরা আল-মুলক : ৩)।
তিনি রিযিক বন্টন করেছেন, অনুভূতিশক্তি ও ক্ষমতা দিয়েছেন, বুদ্ধি-বিবেক ও জ্ঞান দান করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তুকে পথ নির্দেশ করেছেন- যাতে তার কর্মের অবলম্বন ও জীবিকার স্থায়ীত্ব রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِیۡ خَلَقَ فَسَوّٰی . وَ الَّذِیۡ قَدَّرَ فَہَدٰی.
‘যিনি সৃষ্টি করেন, অতঃপর সুঠাম করেন। আর যিনি নির্ধারণ করেন অতঃপর পথ নির্দেশ করেন’ (সূরা আল-আ’লা : ২-৩)। পাখিরা প্রভাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হয় আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। আর তিমি সমুদ্রের গভীরে তার রিযিক থেকে বঞ্চিত হয় না। মৌমাছি সকল ফলমূল থেকে আহার গ্রহণ করে এবং পর্বত চূড়ায় গৃহ নির্মাণ করে। পিপিলিকা তার গর্তে উপকারী খাদ্য সঞ্চিত করে। আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক মাতৃগর্ভের ভ্রুণ এবং নির্জন মরুপ্রান্তের প্রাণির নিকটও পৌঁছে যায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার কর্মসমূহের উপর অন্য কেউ ক্ষমতা রাখে না এবং তাতে অন্য কেউ শরিক হতেও পারে না। তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনি মৃত থেকে জীবিতকে এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। তিনি সকালকে প্রস্ফুটিত করেন এবং রাতকে করেছেন প্রশান্তিময়।
যারা তাঁর সাথে কুফরী করেছে তাদেরকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, তারা তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দিতা করুক বা তাঁর কর্মে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক যেন তাদের অপারগতা ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ لَنۡ یَّخۡلُقُوۡا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجۡتَمَعُوۡا لَہٗ ؕوَ اِنۡ یَّسۡلُبۡہُمُ الذُّبَابُ شَیۡئًا لَّا یَسۡتَنۡقِذُوۡہُ مِنۡہُ ؕ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الۡمَطۡلُوۡبُ.
‘হে লোকসকল! একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না; যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭৩)।
তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাঁর বাণীর মত বা অনুরুপ সামান্য বাণী যেন তারা নিয়ে আসে কিন্তু তারা সক্ষম হয়নি। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ.
‘আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩)।
পৃথিবীতে যা কিছু আছে- চলমান ও স্থির, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, ছোট ও বড়; তা মহান ¯্রষ্টার অস্তিত্ব, তাঁর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ও সক্ষমতা, তাঁর সুক্ষ্ম কর্ম ও দক্ষতা, তাঁর ব্যাপক প্রজ্ঞা এবং তাঁর বিস্তৃত দয়ার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহর মহত্ব ও সৌন্দর্য্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি অনু-পরমাণুতে তাঁর অস্তিত্ব ও পরিপূর্ণতার প্রতি আহ্বান করে। সৃষ্টিকুলের নিকট তাঁর প্রভুত্ব সুস্পষ্ট হয় তাঁর প্রতি তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার মাধ্যমে। তিনি ব্যতীত অস্তিত্বময় সকল কিছুর ¯্রষ্টা তিনিই। জগতের সকল ঘটনার উদ্ভাবকও তিনি।
যার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে তন্মধ্যে অন্যতম হল, তাঁর শরী‘আতের ব্যাপারে গবেষণা করা, যা তিনি পূর্ণাঙ্গরুপে সুদৃঢ় করেছেন এবং যাতে রয়েছে সর্বাধিক সত্য সংবাদ ও সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ বিধি-বিধান।
আর নবীগণের জীবনী আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসকে বৃদ্ধি করে। তাঁরা সকলেই উত্তম চরিত্র ও ফযিলতপূর্ণ আমলের নির্দেশ দিয়েছেন। তারা যা নিয়ে আগমণ করেছেন তা সুস্থ্য বিবেক ও সঠিক সহজাতের অনুকূল। তারা যেসব কল্যাণ নিয়ে আগমণ করেছেন তার সমুদয় আয়ত্ব করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে দুনিয়াতে যত কল্যাণ ও সৎকর্ম রয়েছে তা যা তাঁরা তাদের রবের পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছেন তারই প্রতিফলন।
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবীকে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী দিয়ে সহায়তা করেছেন, যার প্রতি মস্তক অবনত হয়। সেগুলো এমন অকাট্য প্রমাণ যা তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে পথ-প্রদর্শন করে এবং এমন দলীল যা তাদের সত্যবাদী হওয়াকে আবশ্যক করে। নিজেদের জন্য ‘দৃঢ় বিশ্বাস’ প্রার্থনা করা এবং তা মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করা তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰہٖمُ رَبِّ اَرِنِیۡ کَیۡفَ تُحۡیِ الۡمَوۡتٰی ؕ قَالَ اَوَ لَمۡ تُؤۡمِنۡ ؕ قَالَ بَلٰی وَ لٰکِنۡ لِّیَطۡمَئِنَّ قَلۡبِیۡ.
‘আর যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার রব! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন আমাকে দেখান, তিনি বললেন, তবে কি তুমি ঈমান আননি? তিনি বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ, কিন্তু আমার মন যেন প্রশান্ত হয়!’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৬০)।
আর মূসা (আলাইহিস সালাম) ফেরাউনের সাথে বিতর্ক করেছিলেন যখন সে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতকে অস্বীকার করে নিজের জন্য দাবী করেছিল। ফলে তিনি তার যুক্তি- প্রমাণ খ-ন করেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,
قَالَ فِرۡعَوۡنُ وَ مَا رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ . قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنِیۡنَ.
‘ফেরাউন বলল, সৃষ্টিকুলের রব আবার কী? মূসা বললেন, তিনি আসমানসমূহ ও যমীন এবং তাদের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও’ (সূরা আশ-শুআ’রা : ২৩-২৪)।
বান্দা হল ফেতনার লক্ষ্যবস্তু। আর শয়তান বান্দার হৃদয়ে সন্দেহ-সংশয়ের আগুন প্রজ্জ্বলন করতে এবং হৃদয় থেকে দৃঢ় বিশ্বাসকে নড়বড়ে করতে চায়। সুতরাং যে ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তা রবের অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করবে অথবা তার ফিতরাতে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের প্রতি বদ্ধমূল দৃঢ় বিশ্বাসকে অহংকার বশতঃ উপেক্ষা করবে, তাহলে সে ব্যক্তির বক্ষ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে যাবে, মনে হবে যেন সে কষ্ট করে আকাশে উঠছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রুবূবিয়্যাতকে অস্বীকার করল প্রকৃতপক্ষে সে তার হৃদয় যা সত্য হিসাবে বিশ্বাস করেছিল -সেটাকেই অস্বীকার করল। মহান আল্লাহ বলেন, وَ جَحَدُوۡا بِہَا وَ اسۡتَیۡقَنَتۡہَاۤ اَنۡفُسُہُمۡ ظُلۡمًا وَّ عُلُوًّا ‘আর তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে নিশ্চিত সত্য বলে গ্রহণ করেছিল’ (সূরা আন-নামল : ১৪)। বান্দা তার দ্বীনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে, তাই উপহাসকারীদের পরিহার করার মাধ্যমে তার দ্বীনকে সুরক্ষিত রাখা আবশ্যকীয় কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِذَا رَاَیۡتَ الَّذِیۡنَ یَخُوۡضُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا فَاَعۡرِضۡ عَنۡہُمۡ حَتّٰی یَخُوۡضُوۡا فِیۡ حَدِیۡثٍ غَیۡرِہٖ.
‘আর আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, যারা আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গ শুরু করে’ (সূরা আল-আন’আম : ৬৮)।
আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসে অটল থাকার অন্যতম মাধ্যম হল, আল্লাহর আনুগত্যের উপর অবিচল থাকা, অধিক পরিমাণে তাঁর ইবাদত করা, সৎব্যক্তিদের সহচর্য গ্রহণ করা, পাপাচার পরিহার করা, গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা, উপকারী জ্ঞান অর্জন করা, আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী নিয়ে গবেষণা করা এবং নিজের ও জগতের মাঝে এগুলোর প্রভাব অবলোকন করা। আর এগুলোর সমন্বিতরূপ হচ্ছে- বেশি বেশি মহাগ্রন্থ আল কুরআন তেলাওয়াত করা, সে অনুযায়ী আমল করা এবং সর্বদা আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া।
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তাঁর একত্বতায় দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেছিলেন,
فَمَنْ لَقِيْتَ مِنْ وَرَاءِ هَذَا الْحَائِطِ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ .
‘এই বাগানের বাইরে এমন যার সাথে তোমার দেখা হয়; যে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এ সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই’ তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে দাও’।[৩]
অতঃপর হে মুসলিমগণ! আমাদের রব মহা সত্য যাতে কোন সন্দেহ নেই; তাঁর নাম আল-হাক্ব/মহাসত্য, আর হক-ই তাঁর বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর অস্তিত্ব হচ্ছে প্রমাণিত মহা সত্য বিষয়। মহান আল্লাহ বলেন, ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡحَقُّ وَ اَنَّ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِ الۡبَاطِلُ ‘এগুলো প্রমাণ যে, আল্লাহ তিনিই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে, তা মিথ্যা (সূরা লোকমান : ৩০)।
আর মৌলিক ঈমানের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু’ এর অন্যতম শর্ত। সন্দেহ-সংশয়, দ্বিধা ও অবিশ্বাসের সাথে ঈমান থাকতে পারে না। সুতরাং দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না। আর মানুষ তার অন্তরে ইলম ও দৃঢ় বিশ্বাসকে অনুধাবন করে যেমন সে তার অন্যসব উপলব্ধি ও চলাচলকে অনুধাবন করে। যে ব্যক্তিকে ‘ইয়াকীন’ তথা দৃঢ় বিশ্বাস দান করা হয়েছে সে কখনো অসন্তুষ্টিবশত তার দ্বীন থেকে ফিরে যেতে পারে না। আর সে আল্লাহর দাসত্বের সোপানে উন্নীত হতে থাকে, অবশেষে সে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ حَقُّ الۡیَقِیۡنِ . فَسَبِّحۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الۡعَظِیۡمِ.
‘নিশ্চয় এটা সুনিশ্চিত সত্য। অতএব আপনি আপনার মহান রবের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন’ (সূরা আল-ওয়াক্বিয়াহ : ৯৫- ৯৬)।
দ্বিতীয় খুত্ববা
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! কোন বান্দা ঈমানের প্রকৃত অবস্থায় পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তার থেকে সংশয় দূর হয়, রেসালাতের সত্যতায় সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকে, রবের পরিপূর্ণতায় দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, সবকিছু বাদে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে এবং মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থানকে বিশ্বাস করে।
আর সমস্ত রেসালাতের মূল বিষয় এসব মূলনীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত। মূল ঈমান সাব্যস্ত হবে না ও তা ফলপ্রসূ হবে না যদি ব্যক্তি সেটাকে সংশোধনের মাধ্যমে যতœ না নেয়; যাতে সেটাকে কোন সংশয় দূর্বল করতে না পারে অথবা কোন ফেতনা তার উপর প্রভাব বিস্তার না করে। দৃঢ় বিশ্বাস বর্ধিত করা এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সর্বাবস্থায় অতীব জোরালো বিষয়। আর বিশেষ করে সংশয়ে আপতিত হওয়ার সময় ইয়াকীন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। মুমিন ব্যক্তি নিজেই তার নফসের হিসাবকারী; সন্দেহ ও সংশয়ে আপতিত হলে সে তার নফসের খোঁজ-খবর নিবে। তখন সে যদি ইয়াকীন/বিশ্বাসের দূর্বলতা অনুভব করে, তাহলে যা তাকে শক্তিশালী করে সেদিকে আশ্রয় নেয় এবং যা তাকে সুদৃঢ় করে সেদিকে দ্রুত ছুটে চলে। অতঃপর জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তা‘আলা আপনাদেরকে তাঁর নবীর উপর সালাত ও সালাম পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
অতঃপর খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি উপর দরূদ পাঠ করেন। ছাহাবীদের মর্যাদা বর্ণনা করেন এবং মুসলিম উম্মার জন্য দু‘আ করার মাধ্যমে খুত্ববা শেষ করেন।
* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।
তথ্যসূত্র :
[১]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, আল-মুনতাক্বী মিন মিনহাজিল ই‘তিদাল, পৃ. ৩৮৫; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমাদন ইবনু ক্বাসিম, আবূ বকর ছিদ্দীক আফযালুছ ছাহাবাতি, পৃ. ৩৯।
[২]. ইবনুল কাইয়িম, আল-ফাওয়াইদ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৯৩ হি.), পৃ. ৮৫।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩১।
প্রসঙ্গসমূহ »:
খুত্ববাতুল হারামাইন