কষ্টের পরেই সুখ আছে
-খত্বীব : শায়খ হুসাইন আলে শায়খ (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*
[গত ০৬ রবি. আখের ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ১২ নভেম্বর, ২০২১ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! আমাদের রবের কিতাব আল-কুরআনে এমন কিছু রয়েছে, যা কঠিন ও দূরাবস্থায় আমাদেরকে দৃঢ়তার দিকে পরিচালিত করে এবং বিপদ ও বালা-মুছীবতে আমাদের হৃদয়ে সুধারণা ও আশা জাগ্রত করে।
আল্লাহর কিতাবের দু’টি আয়াত, যার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ঔষধের ন্যায় কার্যকরী ও উপকারী; তা থেকে বিশ্বাসী আত্মা আনন্দিত হয় এবং ভাগ্যবানের বক্ষ প্রসারিত হয়। ফলে সে কষ্টের পর সুখ এবং বিপদের পর উত্তরণ ও স্বস্তির প্রত্যাশা করে। সেই আয়াত দু’টির আলোয় আলোকিত এমন হৃদয়ে কখনো হতাশা প্রবেশ করে না এবং সে অনুযায়ী আমলকারীর অন্তরে কোন নিরাশা আশ্রয় নিতে পারে না। সে আয়াত দু’টি হল, আল্লাহর বাণী,
فَاِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا - اِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا
‘সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে। নিশ্চয় কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে’ (সূরা আল-ইনশিরাহ : ৫-৬)। আসমান যমীনের চাবিকাঠি যার হাতে সেই সত্তার পক্ষ থেকে ওয়াদা যে, প্রত্যেক কষ্টের পরে স্বস্তি ও উত্তরণ রয়েছে এবং যেকোন বিপদের পরেই মাওলার পক্ষ থেকে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য প্রতিশ্রুতি এই যে, যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিনয়াবনত হয়ে তাঁর নিকট আশ্রয় নিবে, তিনি তাকে সকল দুশ্চিন্তা, সংকীর্ণতা ও দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসার পথ বের করে দিবেন। মহান আল্লাহ বলেন,
فَاِذَا رَکِبُوۡا فِی الۡفُلۡکِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اِذَا ہُمۡ یُشۡرِکُوۡنَ
‘অতঃপর তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধ হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। তারপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৬৫)।
যুন-নূন ইউনুস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দু‘আ বিপদগ্রস্ত যে কেউ উক্ত দু‘আ করলে মহান আল্লাহ তার বিপদ দূর করবেন। এ মর্মে আল্লাহ বলেন,
وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّہَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ - فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ ۙ وَ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡغَمِّ ؕ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘আর স্মরণ করুন যুন-নূনকে, যখন তিনি ত্রুুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমরা তাঁকে পাকড়াও করতে পারব না। তারপর তিনি অন্ধকারে এ আহ্বান করেছিলেন যে, আপনি ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই; আপনি কতইনা পবিত্র ও মহান, নিশ্চয় আমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছি। তখন আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হতে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমরা মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৭-৮৮)।
পরম দয়ালু, সহিষ্ণু, করুণাময়, দাতা, অমুখাপেক্ষী ও আরোগ্য দানকারীর তরফ থেকে সত্য প্রতিশ্রুতি যে, যে ব্যক্তি তাঁর বড়ত্বের সামনে বিনয়াবনত হয়, তাঁর শক্তি-প্রতিপত্তি ও অহংকারের সামনে অবনত হয়, রবের সামনে তার অন্তরকে বিনম্র রাখে এবং তাঁর আদেশ পালনে স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অনুগত রাখে তিনিই তার দুশ্চিন্তায় যথেষ্ট হয়ে যান এবং তার যাবতীয় চিন্তা, টেনশন, বিপদ ও পরিতাপকে দূর করে দিবেন। কাজেই যে ব্যক্তি উক্ত আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে তার হৃদয় পরিচ্ছন্ন হবে, বক্ষ প্রসারিত হবে এবং আশা-আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পাবে। আর তখনই সে উত্তরণের পথ ও স্বস্তি লাভ করবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি কঠিন অবস্থা ও বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, আপনি আপনার রবের দ্বারস্ত হোন দু‘আ ও বিনয়তা প্রকাশ করার মাধ্যমে এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণ, আগ্রহ ও ভয় প্রকাশ করার মাধ্যমে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اَیُّوۡبَ اِذۡ نَادٰی رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الضُّرُّ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ - فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ فَکَشَفۡنَا مَا بِہٖ مِنۡ ضُرٍّ
‘আর স্মরণ করুন আইয়ূবকে, যখন তিনি তাঁর রবকে ডেকে বলেছিলেন, আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। অতঃপর আমরা তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলাম’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৩-৮৪)।
একমাত্র আল্লাহই সংকীর্ণতাকে প্রশস্থতায়, দারিদ্রতাকে অভাবমুক্ত অবস্থায় ও দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে রূপান্তরিত করেন। কাজেই হে আল্লাহর বান্দা! আপনি সততা, নিষ্ঠা, ভক্তি ও নম্রতার সাথে তাঁর নিকটেই সাহায্য কামনা করুন এবং সুখে-দুঃখে আপনার মাওলার যথাযথ তাক্বওয়া (আল্লাহর ভয়) অবলম্বন করুন; তবেই আপনি আপনার সাহায্য-সহযোগিতায়, সমর্থনে, যোগানদানে, সহজকরণে ও উত্তরণে তাঁকে কাছে পাবেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مَخۡرَجًا - وَّ یَرۡزُقۡہُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ
‘আর যে কেউ আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দিবেন এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রিযিক দান করবেন’ (সূরা আত-ত্বালাক : ২-৩)। তিনি আরো বলেন, سَیَجۡعَلُ اللّٰہُ بَعۡدَ عُسۡرٍ یُّسۡرًا ‘অবশ্যই আল্লাহ কষ্টের পর দিবেন স্বস্তি’ (সূরা আত-ত্বালাক : ৭)।
অতএব আপনি আপনার রবের প্রতি সুধারণা পোষণ করুন এবং তাঁর কাছেই বিপদমুক্তি, সুখ ও ভাল কিছুর প্রত্যাশা করুন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে খবর পৌঁছলে যে, আবূ উবায়দাহ (আলাইহিস সালাম) সিরিয়াতে অবরুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে লোকজন ষড়যন্ত্র করছে। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখে বললেন, ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। জেনে রাখুন, মুমিনের উপর যখনই কোন বিপদ আসুক না কেন আল্লাহ তা দূরীভূত করে দেন। আর একবারের কষ্ট কখনো দুইবারের সুখ ও আনন্দের উপর প্রাধান্য লাভ করতে পারে না’।[১]
হে মুসলিম ভাই! দূরাবস্থায় আপনি সুন্দরভাবে ধৈর্যধারণ করুন; যাতে কোন হতাশা, অভিযোগ ও নিরাশা নেই। কেননা যে আল্লাহকে ভয় করে সে নাজাত পায়, আর যে তাঁর সাথে একনিষ্ঠ আচরণ করে তার সকল মুছীবত দূর হয়ে যায়। কাজেই আপনি তাঁর কাছে আশ্রয় নিন এবং তাঁর প্রতি বিনীত ও নতজানু হোন এবং তাঁর নিকটতর হোন; তাহলে মহা শক্তিমান, প্রতাপশালী, দয়াময় ও সাড়া প্রদানকারীর পক্ষ থেকে আপনার জন্য সব ধরনের সাহায্য, সফলতা ও সমাধান আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَ قَالَ رَبُّکُمُ ادۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ‘আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)। তাই আপনি অমুখাপেক্ষী মহান দয়াময়ের করুণা ও অনুগ্রহের বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন; কেননা এ বিশ্বাসই নাজাতের মাধ্যম, নিরাপত্তা ও শান্তির পথ। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ ۙ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لِیۡ وَ لۡیُؤۡمِنُوۡا بِیۡ لَعَلَّہُمۡ یَرۡشُدُوۡنَ ‘আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৬)।
যে ব্যক্তি বিপদে তার রবের দ্বারস্থ হয়- সে দুশ্চিন্তার পর আনন্দের, কষ্টক্লান্তির পর আরাম ও সুখের এবং রোগ-বালাই এর পর সুস্থতার সুসংবাদ গ্রহণ করুক। মহান আল্লাহ বলেন, اَمَّنۡ یُّجِیۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاہُ وَ یَکۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَ یَجۡعَلُکُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ ‘নাকি তিনি, যিনি আর্তের ডাকে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তোমরা খুব অল্পই শিক্ষা গ্রহণ করে থাক’ (সূরা আন-নামল : ৬২)। তিনি আরো বলেন, اَلَاۤ اِنَّ نَصۡرَ اللّٰہِ قَرِیۡبٌ ‘জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৪)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, وَأَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ وَأَنَّ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ‘জেনে রাখ, বিজয় বা সাহায্য আছে ধৈর্যের সাথে, মুক্তির উপায় আছে কষ্টের সাথে এবং কঠিনের সঙ্গে সহজ জড়িত আছে’।[২]
দ্বিতীয় খুত্ববাহ
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! বান্দার বিপদাপদ দূর করা ও তাদের কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার আল্লাহর ওয়াদার পাশাপাশি মুসলিম বান্দা যেসব দুঃখ, কষ্ট ও বিপদে জর্জরিত হয়, সেগুলোর মাধ্যমে তিনি তাদের গুনাহ মোচন করে দেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে ও ছওয়াবের আশা করে, সে ছওয়াব পায় ও ধৈর্যের প্রতিদান লাভ করে। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
مَا يُصِيْبُ الْمُؤْمِنَ مِنْ وَصَبٍ وَلَا نَصَبٍ وَلَا سَقَمٍ وَلَا حَزَنٍ حَتَّى الْهَمِّ يُهَمُّهُ إِلَّا كُفِّرَ بِهِ مِنْ سَيِّئَاتِهِ
‘কোন মুমিন ব্যক্তির উপর যে ব্যথা-বেদনা, রোগ-ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট পৌঁছে, এমনকি দুর্ভাবনা পর্যন্ত এ সবের মাধ্যমে তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়’।[৩]
পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।
* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/১৬২১।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮০৩; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৬৩০৪, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৩৮২।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭৩; তিরমিযী, হা/৯৬৬।
প্রসঙ্গসমূহ »:
খুত্ববাতুল হারামাইন