সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন

মানব জীবনে সফলতার উপায়

-খত্বীব : শায়খ ফয়সাল বিন জামীল আল-গাজ্জাউঈ (হাফিযাহুল্লাহ)
অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*


[১৬ জুমা. আখের ১৪৪২ হি. ২৯ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, প্রত্যেক মানুষ সফল হতে চাই। কিন্তু সফলতার উপায় সম্পর্কে মানুষের মত নানা রকমের রয়েছে। একেকজন একেকরকম বিষয়কে সফলতা মনে করে এবং নিজ নিজ জায়গায় ইচ্ছামত নিজের সফলতায় পৌঁছাতে চেষ্টা করে। (সম্মানিত খত্বীব কিছু হাদীছ নিয়ে এসে সফলতার ব্যাখ্যা করেছেন) যেমন, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (একদা ছাহাবীদেরকে) জিজ্ঞেস করলেন,

مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ أَنَا قَالَ فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ أَنَا قَالَ فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِيْنًا؟ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ أَنَا قَالَ فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيْضًا؟ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ أَنَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ  ৎمَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ .

‘আজ তোমাদের মধ্যে কে ছিয়াম অবস্থায় সকাল করেছ? আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে জানাযার ছালাতে শরীক হয়েছ? আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে দরিদ্রকে আহার প্রদান করেছ? আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে রোগীকে দেখতে গিয়েছ? আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এ সৎগুণগুলো যার মধ্যে একত্রিত হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[১]

ইনি হচ্ছেন আবূ বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। ছাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ এবং ঈমানের দিক থেকে পরিপূর্ণ। বহুমুখী নেকীর কাজে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। আগে বাড়ার ও সৎকাজের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পরবর্তী মুসলিমদের জন্য উত্তম আদর্শ।

হে আল্লাহর বান্দারা! মানব জীবনে সফলতা এমন একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, যার জন্য মানুষ সচেষ্ট হয়। এই সফলতা লাভ করার জন্য সচেষ্ট হওয়া পরিশ্রমী মানুষের সুন্দর বৈশিষ্ট্য। যারা নিজেদের সময়ের যত্ন নেয় এবং সময়কে এমন কাজে লাগায়, যা তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষেত্রে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে। সুতরাং নিজের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, শক্তি এবং সারা জীবনটাকে এমন ভাল কাজে নিয়োজিত করা উচিত, যার ফলাফল সুন্দর হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, কতক মানুষ এমনকি মুসলিম সমাজেও এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা নিজেদের সময়টাকে অসার কাজে কাটিয়ে দেয়। নিজেদের আয়ুকে নিস্ক্রিয়ভাবে অতিবাহিত করে। তাদের অভ্যাস হচ্ছে অবহেলা এবং লক্ষণ হচ্ছে অলসতা। তারা কোন কাজ করলে সুষ্ঠুভাবে করে না। জীবনে তাদের কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। সামান্য তুচ্ছ কিছু হাসিল হলেই তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় লেখাপড়া করলে যদি ৩৩ মার্ক পেয়ে যায় তাতেই খুশি। জীবনে কখনো কোন বড় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। যাতে করে কোন রকমের ফলাফল দেখা যায় না।

মানবজাতি অবহেলা করার কারণেই জীবনে ব্যর্থতার স্বীকার হয়। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। ‘আমর ইবনু মায়নূন আওদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক ব্যক্তিকে নছীহতস্বরূপ বললেন,

اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.

‘পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি কাজ করাকে গণিমত মনে কর। (১) তোমার বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে। (২) রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে। (৩) দরিদ্রতার পূর্বে অভাবমুক্ত থাকাকে। (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে হায়াতকে।[২]

নে‘মতের ব্যাখ্যা


নে‘মত-১ : বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকাল। এব্যাপারে আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়ার কারণ হল- যাতে করে এই যৌবনকালকে আমরা মূল্যবান মনে করি। কারণ এই সময়টি মানুষের সক্রিয়তার সময়। যত এ্যাক্টিভিটি দেখাতে পারে যৌবনকালে সেটা অন্য সময় সম্ভব নয়। সুতরাং ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে, কল্যাণমূলক যেকোন কাজের ক্ষেত্রে, অবস্থার পরিবর্তনের পূর্বে, বার্ধক্য আসার পূর্বে, দুর্বল হয়ে যাওয়ার পূর্বে যেন এই সময়টাকে তথা যৌবনকালকে মূল্যবান সম্পদ মনে করে সবসময় ভাল কাজে নিয়োজিত রাখে। কেননা এমন একটা সময় আসবে যখন ভাল কাজ করতে মন চাইবে কিন্তু শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন সেই রকমের কোন ফলাফল দেখাতে পারবে না। মন চাইবে কাজ করার কিন্তু শরীরে কাজ করার ক্ষমতা থাকবে না।

নে‘মত-২ : ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতা। এতে সতর্ক করা হয়েছে যে, মানুষের যে সুস্থতা রয়েছে এবং সুস্থ অবস্থায় যে মানুষের শরীরে শক্তি এবং সক্রিয়তা থাকে এবং প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে সতেজ থাকে আর কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকে সেটাকে মূল্যবান মনে করা। কারণ সবসময় একই অবস্থা থাকবে না। কত শত লোককে আমরা দেখছি সুস্থ রয়েছে, হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সবল রয়েছে দুর্বল হয়ে পড়ল, রোগে আক্রান্ত হল। সুতরাং সুস্থতার যে সময়টা পেয়েছে, সেটাকে যদি মূল্যবান না মনে করে এবং সেটাকে মূল্যবান কাজে না লাগাতে পারে, তাহলে আক্ষেপ করতে হবে। আর এর চেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে যে, সুস্থতার সময়কে কেউ যদি পাপ কাজে অতিবাহিত করে তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। কেননা সময় যখন হাত থেকে ফুরিয়ে যাবে, তখন আক্ষেপ করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।

নে‘মত-৩ : দারিদ্র্যতার পূর্বে স্বচ্ছলতা। তোমার দারিদ্র্যের পূর্বে, তুমি যে অভাবমুক্ত ও স্বচ্ছল রয়েছে তাকে ভাল কাজে লাগাও। সুতরাং মানুষ যেন তার ধন-সম্পদ ভাল কাজে এবং বহুমুখী জনকল্যাণমূলক কাজে লাগায়। মনে রাখতে হবে, নিজের কাছে যে সম্পদ রয়েছে তা সবসময় থাকবে না। এক সময় হয়তো সেটা হাত থেকে চলে যাবে অথবা সেটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। সুতরাং ধন-সম্পদ আল্লাহ সন্তুষ্টির কাজে লাগাতে হবে। জ্ঞানী মানুষ ধন-সম্পদের ফেতনায় লিপ্ত হবে না। বরং ধন-সম্পদকে তুচ্ছ মনে করবে। সেটাকে অন্তরে স্থান দিবে না রবং হাতের মুঠোয় স্থান দিবে।

নে‘মত-৪ : ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়। অনেক সময় আমরা অবসর সময় কাটায়। এই অবসর সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে এবং উপকারী কাজে লাগাতে হবে। যদি আমরা এই অবসর সময়ের ত্রুটি করি, অবহেলা করি, তার যথাযথ মূল্যায়ন না করি, তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা এতই ব্যস্ত হয়ে যাব যে, মন চাইলেও কিছু করার সুযোগ থাকবে না।

নে‘মত-৫ : মৃত্যুর পূর্বে জীবন। এখানে বড়ই শিক্ষনীয় বিষয় হল- পৃথিবীতে মানুষের জীবন চিরস্থায়ী নয়। সবার জন্য মৃত্যু অবধারিত। জ্ঞানী মানুষ সবসময় নিজ জীবনকে আল্লাহর আনুগত্য, নেকী এবং আখিরাতের জন্য পাথেয় গ্রহণের কাজে নিয়োজিত রাখে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে যেন তাওফীক্ব দান করেন।

সময়ের গুরুত্ব


মুসলিম জীবনে সময়ের গুরুত্ব আরো বেশি। কেননা মানুষ যতদিন পৃথিবীতে থাকবে অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, ততদিন যথাসাধ্য কিছু না কিছু কল্যাণমূলক কাজ করতেই থাকবে। চাই সেটা দ্বীনের ক্ষেত্রে হোক কিংবা দুনিয়ার ক্ষেত্রে হোক। এব্যাপারে সে কখনো পিছপা হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنْ قَامَتِ السَّاعَةُ وَبِيَدِ أَحَدِكُمْ فَسِيْلَةٌ فَإِنِ اسْتَطَاعَ أَنْ لَا يَقُوْمَ حَتَّى يَغْرِسَهَا فَلْيَفْعَلْ

‘তোমাদের কারও হাতে চারাগাছ আছে এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত হবে, সে ব্যক্তি চারাগাছটি রোপণ করতে সক্ষম না এরপরও সে যেন তা রোপণ করার চেষ্টা করে’।[৩] উক্ত হাদীছে মানুষের কর্মজীবনের উপর ব্যাপকভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুতরাং মানুষকে কর্মঠ হতে হবে এবং সময়কে সবসময় ভাল কাজে লাগাতে হবে।

হে আল্লাহর বান্দারা! আমরা যখন মানবজীবনে মেহনত, পরিশ্রম, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং মানুষের  যে ক্ষমতা রয়েছে তাকে ভাল, নেকী ও কল্যাণমূলক কাজে অতিবাহিত করার বিষয়টি আলোচনা করব, তখন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিত্বের নাম আমাদের সামনে আসবে তিনি হচ্ছেন গোটা বিশে^র মানুষের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ ইমাম, সাইয়িদুল মুরসালীন, খাত্বামুন নাবিইয়ীন মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। যিনি জীবনে সবচেয়ে সুউচ্চ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যখন আমরা তাঁর জীবনে ইবাদত-বন্দেগী, নেকী ও আল্লাহভীরুতার ময়দানে দেখব, তখন উপলব্ধি করব যে, তিনিই সবচেয়ে ইবাদতগুজার এবং বেশি আল্লাহভীরু ছিলেন। এমনকি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করতেন যে, যার ফলে তাঁর দুই পা ফেটে যেত, ফুলে যেত। তিনি মানবজাতিকে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে এবং দাওয়াতের প্রদানের ক্ষেত্রেও আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের সাহায্যে, মানবজাতির উপকার, হিতাকাক্সক্ষী, সঠিক পথ প্রদর্শনের এবং তাদের কল্যাণ কামনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনকল্যাণমূলক কাজ, দান-খয়রাত, মানুষের উপকার এবং প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রেও চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।

একজন মুমিন সবসময় কাজে মেহনত করে থাকে, যে কাজই করুক না কেন সেটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে এবং জাতিকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করে। এটি যুগের পরিক্রমায় ভাল মানুষ ও আল্লাহভীরুদের চরিত্র। যারা আমাদের জন্য আদর্শ ইমাম ছিলেন। যারা হচ্ছেন কল্যাণের ক্ষেত্রে অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। যারা তাদের ইন্তিকালের পরে মানুষের জন্য উত্তম স্মৃতি ছেড়ে গেছেন। ফলে তারা অনেক আগে দুনিয়া থেকে চলে গেলেও তাদের কথা মানুষেরা শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা ও প্রশংসা করে এবং তাদের জন্য দু‘আ করে থাকে।

এ ব্যাপারে যুগে যুগে যে উত্তম দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেন প্রখ্যাত ছাহাবী সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। যিনি ইসলাম গ্রহণ করে মাত্র ছয় বছর বেঁচেছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে রক্তক্ষরণে ইন্তিকাল করেছিলেন। তিনি ইসলামের জন্য এত বেশি কাজ করেছেন যে, আমাদের মত কোন মানুষ যদি যুগ যুগ ধরে মুসলিম হয়ে বেঁচে থাকে, তাও হয়তো করা সম্ভব হবে না। হাদীছে এসেছে, জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,اهْتَزَّ الْعَرْشُ لِمَوْتِ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ ‘সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মৃত্যুতে আরশ কেঁপে উঠেছিল’।[৪]

আরেকজন মহান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন প্রখ্যাত তাবিঈ, সায়্যিদুত তাবিঈ ‘আত্বা ইবনু আবী রাবাহ (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি তাঁর যুগে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। অনেক ওলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, ‘আত্বা ইবনু আবী রাবাহ (রাহিমাহুল্লাহ) দেখতে কালো, কুৎসিত, কানা মানুষ ছিলেন। তার নাক চ্যাপ্টা এবং পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ছিলেন। পা অক্ষম, অচল, খোঁড়া এবং অন্ধ ছিলেন। কিন্তু তার জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ৭০ বার হজ্জ করেছেন। বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরেও তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করতেন। একটানা দাঁড়িয়ে থেকে সূরা আল-বাক্বারাহ থেকে দু’শ আয়াত পাঠ করতেন। কোন নড়াচড়া করতেন না।[৫] মানুষ যখন চেষ্টা করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক্ব দিয়ে থাকেন।

সুধী পাঠক! উক্ত দৃষ্টান্তদ্বয়ে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে যে, মুসলিম যতই বালা-মুছীবত ও বিপদাপদের সম্মুখীন হোক না কেন সবসময় সে শক্তিশালী থাকবে। কখনো হতাশাগ্রস্ত হবে না, মনোবল দুর্বল হবে না, নিজেকে অপারগ মনে করবে না এবং মানুষের উপকারের জন্য এবং কিছু দিয়ে যাবার জন্য কখনো কার্পণ্য করবে না।

আরেকটি উত্তম দৃষ্টান্ত হল- হাম্মাদ ইবনু সালামা (রাহিমাহুল্লাহ)। একজন প্রখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিছ। যাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ বলা হয়েছে। তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁকে যদি বলা হত আগামীকালকে তো আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। অথচ তিনি যে আমল করেন তার চেয়ে বেশি আমল করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। যদিও তিনি সবসময় নেক আমল করতেন। ছালাতের মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করেন। সবসময় নেকীর কাজে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।[৬] সুতরাং কতই না ক্ষতিগ্রস্ত ঐসব লোকেরা, যারা নিজের জীবন বিভিন্ন পাপে জড়িয়ে রাখে, অবহেলায় সময় কাটিয়ে দেয়, দুনিয়া থেকে যখন চলে যায় তখন তাদের কোন স্মৃতি থাকে না। ক্বিয়ামতের দিনে সর্বহারা হয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে।  

ইসলামের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র হচ্ছেন ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ)। যাকে বলা হয় ‘আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ’। তাঁর জীবনীতে অনেক কিছু বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন ‘আলেম, ফক্বীহ ও সাহিত্যিক। তিনি নাহু বা আরবী গ্রামারে মাহের ছিলেন। এছাড়া বিখ্যাত ভাষাবিদ ও কবি ছিলেন। তিনি মিষ্টিভাষী ছিলেন এবং অলংকারপূর্ণ আরবী ভাষা বলতেন। সাথে সাথে তিনি আখিরাতমুখী, দুনিয়াবিমুখ, তাক্বওয়াশীল, লজ্জাশীল, চরিত্রবান ছিলেন এবং মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করতেন। তিনি ছিলেন একজন বীরপুরুষ, বড়ই শক্তিশালী ও অত্যধিক দানশীল। দীর্ঘ সময় ধরে ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। তাঁর অন্তরে আল্লাহভীতি পূর্ণ মাত্রায় ছিল। সুবিচার কায়েম করতেন, কখনো অসার কোন কথা বলতেন না। যেমনটা ইমাম নাসাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

لا نعلم في عصر ابن المبارك أجل من ابن المبارك ولا اعلى منه ولا أجمع لكل خصلة محمودة منه.

‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর যামানায় তাঁর চেয়ে মহান ব্যক্তি এবং মর্যাদাবান ব্যক্তি আমরা কাউকে দেখিনি। প্রত্যেক প্রশংসনীয় গুণাবলী তার মধ্যে ছিল’।[৭]

নারীদের ক্ষেত্রে অনেকে এরকম ছিলেন, যারা সুন্দর সুন্দর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন এবং মানবজাতির ও মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। তাদের একজন হচ্ছেন আব্বাসীয় খলীফা হারুন রশীদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর স্ত্রী যুবাইদা বিনতে জাফর আল মুনছূর (রাহিমাহুল্লাহ)। তাঁর অনেক ফযীলতের দিক রয়েছে। তিনি বড়ই জ্ঞানবতী, দ্বীনদার এবং অলঙ্কারপূর্ণ সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি নেক, জনকল্যাণমূলক কাজকে অত্যন্ত পসন্দ করতেন আর তাতেই তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। গরীব-মিসকীনদের উপর অত্যন্ত বেশি দরদী ছিলেন ও বড়ই দানশীলা ছিলেন। আল্লাহর রাস্তায় সবকিছু তিনি ব্যয় করতেন। তিনি হাজীদের জন্য মিনা, ‘আরাফাহ, মুজদালিফা ও মক্কায় যে পানির ব্যবস্থা করেছেন যা ‘নাহারে যুবাইদা’ বা ‘আইনে যুবাইদা’ নামে পরিচিত। এটি তাঁর নেক আমলের দৃষ্টান্ত পেশ করার জন্য যথেষ্ট।

আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এক বৃদ্ধার। একদিন এক বৃদ্ধা মহিলা তার প্রতিবেশী মারা যাওয়ার কারণে কাঁদছেন। এ সময় তাকে জিজ্ঞেস করা হল যে, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন, جاورنا وما فينا إلا من تحل له الصّدقة ومات وما فينا إلا من تجب عليه الزكاة ‘এই মৃত ব্যক্তি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা যখন তার পাশে বসবাস শুরু করি, তখন আমাদের জন্য যাকাত হালাল ছিল। কিন্তু আজ তিনি ইন্তিকাল করেছেন। আমরা এত স্বচ্ছল হয়েছি (তার দান-খয়রাতে এবং আর্থিক সহযোগিতায় যে) আমাদের প্রত্যেকের উপর যাকাত ফরয হয়ে গেছে’।[৮] এভাবে যুগে যুগে অনেক আল্লাহর নেক বান্দা যারা বহুমুখী নেক কাজ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আর তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন, মানবজাতির উপকার করেছেন।

হে মুসলিমগণ! জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি জীবনে কিছু করতে চাইবে সে কিছু দিয়ে যেতে পারবে। চিন্তা করুন তাদের জীবনী নিয়ে, যারা জীবনে মেহনত-পরিশ্রম করেছে তারাই কিছু ভাল কাজ করে যেতে পেরেছে। মানবজাতিকে কিছু দিয়ে গেছে এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে কিছু নিয়ে যেতে পেরেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ارۡکَعُوۡا  وَ اسۡجُدُوۡا وَ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمۡ وَ افۡعَلُوا الۡخَیۡرَ لَعَلَّکُمۡ  تُفۡلِحُوۡنَ.

‘হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ‘ কর, সিজদা কর এবং তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর যাতে সফলকাম হতে পার’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭৭)।

আল্লাহ তা‘আলা যেন কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা আমাদের জন্য বরকত দান করেন এবং যে সকল আয়াত ও হিকমাহ রয়েছে, তার দ্বারা যেন আমাদের উপকৃত করেন। এই বলে খত্বীব মহোদয় তাঁর প্রথম খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।

ছানী খুত্ববাহ


হাম্দ ও ছানার পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, যারা কর্মক্ষেত্রে অগ্রগামী, মেহনতী, পরিশ্রমী, যারা কিছু দিয়ে গেছে ও করে গেছে এবং কিছু স্মৃতি ছেড়ে গেছে, তাদের একদল হচ্ছেন আল্লাহর দ্বীনের দাঈ। যারা দাওয়াতের ময়দানে কাজ করে গেছেন। যাদের ভালো কাজ দ্বারা শুধু তারাই উপকৃত হননি, বরং অন্যদেরকেও উপকৃত করেছেন এবং অন্যদেরকে রাস্তা দেখিয়েছেন। তারা আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন। তাদের হাতে অসংখ্য মানুষ হেদায়াত পেয়েছে। শিরক-বিদ‘আত, গোমরাহী এবং পাপাচার থেকে মুক্ত হয়ে কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে এসেছে। বহু মানুষ হেদায়াত পেয়েছে। কতক মানুষ আছে যারা অমুসলিমদের দাওয়াতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং তাদের হাতে বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আবার কেউ আছেন যারা অনেক মসজিদ, ইসলামী প্রতিষ্ঠান এবং মাদরাসা তৈরি করেছেন। কেউ দ্বীনের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের অনেক ছাত্র রয়েছে। যারা কুরআন-সুন্নাহর তা‘লীম দিয়েছেন। কেউ কেউ কুরআনের হাফেয এবং ক্বারী ছিলেন। যারা অনেক হাফেয ও ক্বারী তৈরি করেছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই লিখেছেন। যুগে যুগে যা থেকে মানবজাতি উপকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। কেউ কেউ জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। যারা সমাজের অসহায়, দুর্গত; তাদের জন্য বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আবার কেউ কেউ ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াক্ফ করে গেছেন।

আবার কেউ এমন আছেন যারা জনগণের মাঝে যদি কোন রকমের মনোমালিন্য বা বিবাদ দেখা দিয়েছে, তাহলে তারা সেখানে বিচার-সালিশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং মানুষের মাঝে যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে সেই সম্পর্ককে ভালো সম্পর্কের দিকে নিয়ে এসেছেন। তারা ইছলাহ ও মীমাংসার কাজ করেছেন। এটিও ভালো কাজ। কেউ কেউ মানুষের বিভিন্ন রকমের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। কেউ সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ ভালো জনকল্যাণমূলক প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছেন অথবা কোন নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে উম্মত উপকৃত হয়েছে। এরকমই যেকোন ক্ষেত্রে হোক না কেন যারা নিজে উপকৃত হয়েছে এবং অন্যদের উপকার করেছে আর পৃথিবীতে কিছু ভালো কাজ ছেড়ে গেছে তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ہُوَ اَنۡشَاَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ وَ سۡتَعۡمَرَکُمۡ فِیۡہَا ‘তিনি তোমাদেরকে যমীন হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে তাতে আবাদ করেছেন’ (সূরা হূদ : ৬১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ‘তোমরা স্ব-স্ব জীবনের জন্য যে সৎকর্ম অগ্রে প্রেরণ করেছ, তা আল্লাহর নিকট প্রাপ্ত হবে; তোমরা যা করেছ নিশ্চয় আল্লাহ তার পরিদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১০)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا  تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ  عِنۡدَ اللّٰہِ ہُوَ خَیۡرًا وَّ اَعۡظَمَ اَجۡرًا ‘তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম প্রেরণ করবে তোমরা তা আল্লাহর নিকট পাবে। ওটা অধিক ভালো এবং পুরস্কার হিসাবে অনেক বড়’ (সূরা আল-মুজ্জাম্মিল : ২০)।

হে আল্লাহর বান্দারা! রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর আরেকটি হাদীছ, যা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি, তিনি বলেছেন,اِحْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَاتَعْجِزْ ‘যে কাজে তোমার উপকার হবে, তার প্রতি আগ্রহ রাখ এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য কামনা কর আর দুর্বলতা প্রদর্শন কর না’।[৯]

অতএব আমাদেরকে এমন কাজ করতে হবে, এমন কথা বলতে হবে, এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যা আমাদের, দেশবাসী এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য উপকারী। এর জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে। কখনো দুর্বলতা প্রদর্শন করা যাবে না।

একজন মুমিন ব্যক্তি সবসময়ই কর্মঠ এবং সক্রিয় হবে। সব সময় আগে বাড়ার চেষ্টা করবে। মেহনতী-পরিশ্রমী হবে এবং জাতিকে কিছু দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, কিছু ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। একজন মুমিন ব্যক্তি কখনো অলস ও অপারগ হবে না। মানুষ যদি নিজেকে দুর্বল মনে করে, সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করে, সবসময় মনে করে যে, আমি ব্যর্থ, অলসতায় ও অবহেলায় জীবন কাটায়, সময়কে নষ্ট করে আর ঘুমিয়ে সময় পার করে অথবা ফালতু কাজে সময় নষ্ট করে, জীবনে কোন কিছুই না নিজের জন্য করতে পারল, না জাতির জন্য করতে পারল, না উম্মতের জন্য করতে পারল। এর চাইতে খারাপ মানুষ আর কেউ হতে পারে না।

সুতরাং মনে রাখবেন প্রতিটি মানুষের মধ্যে অনেক প্রতিভা লুক্বায়িত রয়েছে। এই প্রতিভাকে কাজে লাগাতে হবে এবং ভালো কাজের দিকে নিয়ে যেতে হবে। নিজের উপকারের সাথে সাথে পরের উপকার করার চেষ্টা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে নিজেকে কখনো ছোট ও তুচ্ছ মনে করবেন না। শয়তান কখনো যেন অলস অথবা পিছপা না করে দেয়। তোমার দ্বারা কিবা হবে? তুমি কী? সবসময়ই উচ্চাকাক্সক্ষী ও সৎ আকাঙ্ক্ষা রাখতে হবে। সবসময় নিজের অবস্থার পরিবর্তন ও সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। রবের কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে।

মনে রাখবেন, অভ্যাসের দাস হয়ে যাওয়াই বদভ্যাস। অভ্যাস হচ্ছে সবাইকে দেখছেন যে, সাধারণ মানুষ আর সবাই এইরকম সাধারণ জীবন-যাপন করছে। আমার আশেপাশে কেউ এমন বড় ব্যক্তি নেই। সুতরাং আমিও তাদের একজন। না! এটি হচ্ছে অভ্যাসের দাস হয়ে যাওয়া। এটি হচ্ছে বদভ্যাস। অভ্যাসের দাস হয়ে যাওয়া হচ্ছে বদভ্যাস। যদি কোন রকমের গোলযোগ ও ত্রুটি দেখেন, সেই ত্রুটি কাটিয়ে আগে বাড়ার চেষ্টা করবেন এবং কাজকে আরো ভালো করার চেষ্টা করবেন। পিছনে কখনো সরবেন না। আর মনে রাখবেন যে, যে ব্যক্তি সামনে বাড়ে না বরং যেখানে আছে সেখানেই থেকে যায়, আগে কদম বাড়ায় না, সেই ব্যক্তি সেখানে স্থির থাকতে পারে না। যখনই থেমে যাবে, তখন স্বাভাবিক ধীরে ধীরে পিছপা হয় যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে, কাজ আর ভালো থাকবে না, মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। আর মানুষের শুধু শুধু আশা আকাক্সক্ষা আর চিন্তা-চেতনা কোন কাজে আসবে না। বিভিন্ন রকমের উন্নতির চিন্তা করছেন, বড় বড় আশা-আকাক্সক্ষা রাখছেন, এই হব সেই হব, এই করব সেই করব। কিন্তু কর্মতৎপরতা নেই। এতে কোন লাভ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি কাজের ময়দানে না নামবেন এবং আপনার নিজের অবস্থাকে ভালো দিকে পরিবর্তন করে না নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে তাওফীক্ব দান করুন।

হে মুসলিমগণ! আমাদের জীবনের যে সময়গুলো রয়েছে, তা অত্যন্ত মূল্যবান। মনে রাখবেন যে, আমরা যে জীবন অতিবাহিত করছি, এই জীবনটা আমাদের জন্য মূল্যবান সম্পদ। যদি আমরা নিজেদের সময়গুলোর হেফাযত না করি এবং মূল্যবান মনে না করি, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। সুতরাং আপনি আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করুন। ভুলভ্রান্তি যদি হয়ে থাকে খালেছ অন্তরে তওবা করে ফিরে আসুন। তাক্বওয়ার পাথেয় হাসিল করুন এবং মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত নেক কাজ করতে থাকুন। নিজের জন্য কিছু অগ্রিম পাঠাবার চেষ্টা করুন। এমন ভাল কাজ করার চেষ্টা করুন, যে কাজ দ্বারা নিজে উপকৃত হতে পারবেন এবং অন্যদের উপকৃত করতে পারবেন। এই রকম চিন্তা-চেতনা রাখুন এবং এর জন্য উদগ্রীব হন। ছাদাক্বায়ে জারিয়ার জন্য সচেষ্ট হোন। এই দুনিয়ার বাজার জমজমাট রয়েছে এবং এখানে বাজারের জন্য মূল্য ও পণ্যও আপনার কাছে মওজুদ রয়েছে। এমন একটা সময় আসবে যখন এই দুনিয়ার বাজার শেষ হয়ে যাবে এবং পণ্যও থাকবে না। সেদিন কিছুই করতে পারবেন না। যেদিন হবে ক্ষতির দিন। সেদিন যালেম অর্থাৎ যে অবহেলা ও অলসতায় সময় কাটিয়ে দিয়েছে, যে ব্যক্তি পাপের জীবন-যাপন করেছে, সেই ব্যক্তি দাঁতে আঙ্গুল দিয়ে কামড় দিবে আর বলবে, হায়! যদি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর পথ ধরে নিতাম। আল্লাহ তা‘আলা যেন আমাদেরকে এ ভাল কথাগুলো বুঝার, সে অনুযায়ী আমল করার, দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী  হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। আল্লাহ আমাদের হায়াতে যা কিছু দিয়েছেন তাতে যেন সার্বিক বারাকাহ দান করেন-আমীন!!

পরিশেষে খত্বীব আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য কল্যাণের ও নিরাপত্তার দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।


* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০২৮; মিশকাত, হা/১৮৯১।
[২]. তিরমিযী, হা/২৫০৩; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১০২৪৮; মিশকাত, হা/৫১৭৪, সনদ ছহীহ।
[৩]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৪৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩০০৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮০৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬৬।
[৫]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৪২৩; সিয়ারু আ‘লামুন নুবালা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৮৫।
[৬]. মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু উছমান আয-যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফ্ফায, ১ম খ-, পৃ. ১৫১; ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২।
[৭]. ইমাম নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/২৫৩৮; তাহযীবুত তাহযীব, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮।
[৮]. আবুল ফারজ আব্দুর রহমান আল-জাওযী, আখবারুয যুরাফ ওয়াল মুতামাজিনাইন, পৃ. ১৫৩।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪; মিশকাত, হা/৫২৯৮।




জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কোমল ও নম্র আচরণ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আরাফাহর খুৎবাহ - অনুবাদ : ড. মুহাম্মাদ মানজুরে এলাহী
যালিমের পতন ও মযলুমের বিজয় অবধারিত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ