রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন

আল-কুরআন নাজাত লাভের মাধ্যম

খত্বীব : শায়খ ড. আলী বিন আব্দুর রহমান আল-হুযাইফী
অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*


[গত ১২ জিলক্বদ ১৪৪৪ হি. মোতাবেক ২ জুন, ২০২৩ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আপনারা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন- যিনি আপনাদেরকে তাঁর নে‘মতরাজি দ্বারা প্রতিপালন করেন এবং স্বীয় রহমতে আবৃত করেন। তিনি আপনাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছেন এবং অবাধ্যদেরকে ত্বড়িৎ শাস্তি দেন না। তিনি বলেন, یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ  اِلَی اللّٰہِ ۚ وَ اللّٰہُ  ہُوَ  الۡغَنِیُّ   الۡحَمِیۡدُ ‘হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী; আর আল্লাহ, তিনিই অভাবমুক্ত, প্রশংসিত’ (সূরা আল-ফাতির : ১৫)।

আল্লাহর বান্দাগণ! মহান আল্লাহ আপনাদের দ্বীন ও দুনিয়াবী কল্যাণ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন। তিনি এও জানেন যে, মানুষের জ্ঞান-গরিমা যতই উচ্চতর হোক না কেন, তাদের অভিজ্ঞতা যতই উন্নত হোক না কেন- তারা কখনো দুনিয়াবী ও পরকালীন সাধারণ রীতির রহস্য ভেদ করতে পারবে না। তাই তিনি নিজেই আপনাদের নিকট বান্দাদের ইহকালীন ও পরকালীন এ রীতির উপকরণগুলো বর্ণনা করেছেন এবং তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের দুর্ভাগ্যের কারণসমূহ থেকেও সতর্ক করেছেন; সুমহান রবের পক্ষ থেকে রহমত ও দয়া স্বরূপ এবং সৃষ্টির উপর হুজ্জত কায়েমের জন্য। যখন মুহাম্মাদ (ﷺ) জ্ঞান, হিকমত, স্বভাবগত, সৃষ্টিগত ও চরিত্রগত দিক থেকে পরিপূর্ণ এবং মানব জাতির সর্দার হয়েও তাঁকে আল্লাহ যতটুকু জানিয়েছেন তার বাইরে আর কিছুই জানতেন না এবং তিনি সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম সম্পর্কেও জানতেন না যতটুকু আল্লাহ তাঁকে কুরআন ও সুন্নাতের মাধ্যমে অহী করে জানিয়েছেন তা ব্যতীত; তখন তো এ উম্মতের অন্যদের ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্যের কারণ সম্পর্কে আরো অজ্ঞ থাকা স্বাভাবিক। তবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে তারা জানতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اَنۡزَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا ‘আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১১৩)। তিনি আরো বলেন,

وَ کَذٰلِکَ  اَوۡحَیۡنَاۤ  اِلَیۡکَ رُوۡحًا مِّنۡ اَمۡرِنَا ؕ مَا کُنۡتَ تَدۡرِیۡ مَا الۡکِتٰبُ وَ لَا  الۡاِیۡمَانُ وَ لٰکِنۡ جَعَلۡنٰہُ  نُوۡرًا نَّہۡدِیۡ  بِہٖ مَنۡ نَّشَآءُ  مِنۡ عِبَادِنَا ؕ وَ اِنَّکَ لَتَہۡدِیۡۤ  اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ  . صِرَاطِ اللّٰہِ  الَّذِیۡ  لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ و مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ اَلَاۤ  اِلَی اللّٰہِ  تَصِیۡرُ الۡاُمُوۡرُ.

‘আর এভাবে আমরা আপনার প্রতি আমাদের নির্দেশক্রমে অবতীর্ণ করেছি এক রূহ (কুরআন); আপনি তো জানতেন না কিতাব কী ও ঈমান কী পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি; আপনি অবশ্যই প্রদর্শন করুন সরল পথ। ঐ আল্লাহর পথ, যাঁর অধিপত্বে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে। সাবধান! সকল বিষয় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে’ (সূরা আশ-শূরা : ৫২-৫৩)। তিনি আরো বলেন,

وَ  لَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی . اَلَمۡ  یَجِدۡکَ یَتِیۡمًا فَاٰوٰی . وَ  وَجَدَکَ ضَآلًّا فَہَدٰی.

‘আর অচিরেই আপনার রব আপনাকে অনুগ্রহ দান করবেন, ফলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম অবস্থায় পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন; আর তিনি আপনাকে পেলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, অতঃপর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন’ (সূরা আয-যুহা : ৫-৭)। তিনি আরো বলেন,

وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الرُّوۡحِ ؕ قُلِ الرُّوۡحُ مِنۡ  اَمۡرِ رَبِّیۡ وَ مَاۤ  اُوۡتِیۡتُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ اِلَّا  قَلِیۡلًا    .وَ لَئِنۡ شِئۡنَا لَنَذۡہَبَنَّ بِالَّذِیۡۤ  اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَکَ بِہٖ عَلَیۡنَا  وَکِیۡلًا .    اِلَّا رَحۡمَۃً  مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ اِنَّ  فَضۡلَہٗ  کَانَ عَلَیۡکَ  کَبِیۡرًا.

‘আর আপনাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আপনি বলুন : রূহ হল আমার প্রতিপালকের হুকুম (সম্পর্কিত একটি বিষয়।) এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। ইচ্ছা করলে আমরা আপনার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তা অবশ্যই প্রত্যাহার করতে পারতাম; তাহলে আপনি এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে কোন কর্ম বিধায়ক পেতেন না। এটা প্রত্যাহার না করার আপনার প্রতিপালকের দয়া; আপনার প্রতি আছে তাঁর মহা অনুগ্রহ’ (সূরা আল-ইসরা : ৮৫-৮৭)।

কাজেই মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও বয়স যতই উন্নত, শক্তিশালী, বেশি ও দীর্ঘ হোক না কেন- তারা নবীদের উপর অবতীর্ণ অহী ছাড়া কোন অবস্থাতেই দুনিয়াবী ও পরকালীন সৌভাগ্যের পথ খুঁজে পাবে না। আর যেহেতু আল্লাহ জানেন যে, মানুষ হেদায়াতের বৃত্তান্ত জানতে ও শরী‘আতের বিভিন্ন বিধানের রহস্য জানতে অক্ষম, তাই আল্লাহ মানুষের নিকট এ বাস্তবতাটি বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَہُوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ  وَ اَنۡتُمۡ  لَا تَعۡلَمُوۡنَ.

‘কিন্তু তোমরা যা অপসন্দ কর; হতে পারে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা ভালোবাস হতে পারে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন তোমরা জান না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৬)।

তিনি মীরাছ সম্পর্কে বলেন,اٰبَآؤُکُمۡ وَ اَبۡنَآؤُکُمۡ لَا تَدۡرُوۡنَ اَیُّہُمۡ اَقۡرَبُ  لَکُمۡ نَفۡعًا ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ  اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمً ‘তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে উপকারে কে তোমাদের নিকটতর তা তোমরা জান না। এ বিধান আল্লাহর; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আন-নিসা : ১১)।

বহু আয়াতেই তিনি এমন অর্থবোধক কথা বলেছেন। তাছাড়া তিনি মাখলুকের রিযিকের দায়িত্ব নিয়েছেন মর্মে বলেন,  وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ  فِی الۡاَرۡضِ  اِلَّا عَلَی اللّٰہِ  رِزۡقُہَا  ‘আর যমীনে বিচরণকারী সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই’ (সূরা হূদ : ৬)।

অনুরূপভাবে তিনি নিজ অনুগ্রহ ও দয়ায় তাঁর বান্দাদের জন্য পূর্ণ হেদায়াতের পথ বর্ণনা করারও দায়িত্বও নিয়েছেন। তিনি বলেন, اِنَّ  عَلَیۡنَا لَلۡہُدٰی ‘নিশ্চয় আমাদের কাজ শুধু পথনির্দেশ করা’ (সূরা আল-লাইল : ১২)। তিনি আরো বলেন,

یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیُبَیِّنَ لَکُمۡ وَ یَہۡدِیَکُمۡ سُنَنَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ یَتُوۡبَ عَلَیۡکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ  عَلِیۡمٌ  حَکِیۡمٌ.

‘আল্লাহ ইচ্ছে করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আন-নিসা : ২৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,اِنَّ ہٰذَا  الۡقُرۡاٰنَ  یَہۡدِیۡ  لِلَّتِیۡ ہِیَ اَقۡوَمُ  ‘নিশ্চয় এ কুরআন হেদায়াত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম (সরল, সুদৃঢ়)’ (সূরা আল-ইসরা : ৯)। তিনি আরো বলেন, کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ ‘এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার’ (সূরা আলে-ইমরান : ১০৩)। হেদায়াতের বৃত্তান্ত ও ভ্রষ্টতার বৃত্তান্ত বর্ণনা করে দেয়ায় তা আল্লাহর স্বপক্ষে বান্দাদের উপর হুজ্জত কায়েম হয়েছে। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কুফুরী করুক। বস্তুত মানুষকে তাদের কর্ম অনুসারে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রতিদান দেয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

 فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَہٗ  .  وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ  شَرًّا یَّرَہٗ.  

‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকাজ করলে সে তাও দেখবে’ (সূরা আল-যিলযাল : ৭-৮)।

আমাদের রব চূড়ান্ত করেছেন, ফায়সালা দিয়েছেন ও ওয়াদা করেছেন যে, পার্থিব জীবনে ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সফলতা ও চিরসুখের জীবন নিহিত রয়েছে মাত্র দু’টি কালেমায়। আল্লাহর কালামের প্রতি ঈমান আনায় এবং আল্লাহর কালাম অনুপাতে আমল করায়। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰبَنِیۡۤ  اٰدَمَ  اِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ رُسُلٌ مِّنۡکُمۡ یَقُصُّوۡنَ عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِیۡ ۙ فَمَنِ اتَّقٰی وَ اَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ.

‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেন, যারা আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বিবৃত করবেন, তখন যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৫)।

তিনি আরো বলেন, فَمَنِ اتَّبَعَ ہُدَایَ  فَلَا  یَضِلُّ  وَ لَا  یَشۡقٰی  ‘যে আমার প্রদর্শিত সৎপথের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখকষ্ট পাবে না’ (সূরা ত্ব-হা : ১২৩)। এর ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لا يضل في الدنيا ولا يشقى في الآخرة ‘সে দুনিয়ায় বিপথগামী হবে না এবং পরকালে দুঃখকষ্ট পাবে না’।[১]

মানব ইতিহাস ও নিজ উম্মতের সাথে রাসূলদের ইতিহাস চাক্ষুস প্রমাণ করে যে, সৌভাগ্যবান, সফল, বিজয়ী, যমীনের সংস্কারক এবং দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও আখেরাতের আযাব থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ও শ্রেষ্ঠ মানুষ হল রাসূলগণ এবং তাদের অনুসারীগণ যারা আল্লাহর কালামের প্রতি ঈমান এনেছিলেন ও তদনুযায়ী আমল করেছিলেন। হে মুসলিম ভাই ! আপনি কি তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে চান না? প্রথম মানুষ আমাদের পিতা আদম (আলাইহিস সালাম) ভুল করার পর আল্লাহর কালামের প্রতি ঈমান আনা ও তদনুযায়ী আমল করার ফলেই তিনি মনোনয়ন ও হেদায়াত পেয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, فَتَلَقّٰۤی اٰدَمُ مِنۡ رَّبِّہٖ کَلِمٰتٍ فَتَابَ عَلَیۡہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ  التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ  ‘তারপর আদম তাঁর রবের কাছ থেকে কিছু বাণী পেলেন । অতঃপর আল্লাহ তাঁর তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনিই তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩৭)। তিনি আরো বলেন,

وَ عَصٰۤی  اٰدَمُ   رَبَّہٗ  فَغَوٰی  .  ثُمَّ  اجۡتَبٰہُ رَبُّہٗ  فَتَابَ عَلَیۡہِ  وَ  ہَدٰی.

‘আর আদম তাঁর রব-এর হুকুম অমান্য করলেন, ফলে তিনি ভ্রমে পতিত হলেন। তারপর তাঁর রব তাকে মনোনীত করলেন, অতঃপর তাঁর তাওবা কবুল করলেন ও তাঁকে পথনির্দেশ করলেন’ (সূরা ত্ব-হা : ১২১-১২২)।  আদম (আলাইহিস সালাম)-এর পর অন্যান্য নবী-রাসূলদেরকেও আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কালাম ও অহীর দ্বারা অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদের ও তাদের অনুসারীদের প্রশংসা করেছেন; যখন তাঁরা আল্লাহর আয়াতকে গ্রহণ করেছিল, সে অনুযায়ী আমল করেছিল ও মানুষকে সে পথে দাওয়াত দিয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন,

اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ مِنۡ ذُرِّیَّۃِ  اٰدَمَ ٭ وَ مِمَّنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوۡحٍ ۫ وَّ مِنۡ ذُرِّیَّۃِ  اِبۡرٰہِیۡمَ وَ اِسۡرَآءِیۡلَ ۫ وَ مِمَّنۡ ہَدَیۡنَا وَ اجۡتَبَیۡنَا ؕ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُ الرَّحۡمٰنِ  خَرُّوۡا  سُجَّدًا  وَّ  بُکِیًّا.

‘এরাই তারা, নবীদের মধ্যে আল্লাহ যাদেরকে অনুগ্রহ করেছেন, আদমের বংশ থেকে এবং যাদেরকে আমরা নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম। আর ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশোদ্ভূত, আর যাদেরকে আমরা হেদায়াত দিয়েছিলাম এবং মনোনীত করেছিলাম; তাদের কাছে দয়াময়ের আয়াত তেলাওয়াত করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ত সিজদায় এবং কান্নায়’ (সূরা মারইয়াম : ৫৮)।

সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর কালামের প্রতি ঈমান আনা এবং তদনুযায়ী আমল করাই হচ্ছে দুনিয়াবী সফলতা ও বিজয়, এতেই রয়েছে পরকালীন কল্যাণ। আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার পাশাপাশি ঈমানের রূকনগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন ব্যতীত আল্লাহ কোন বান্দার সৎকাজ কবুল করবেন না ও কাউকে জাহান্নামের আযাব থেকে নাজাত দিবেন না। সূরা আল-বাক্বারার শেষ অংশে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, রাসূলগণ ও তাদের অনুসারীরা এ ঈমানকে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি বলেন,

اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ  اُنۡزِلَ اِلَیۡہِ مِنۡ رَّبِّہٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَ مَلٰٓئِکَتِہٖ وَ کُتُبِہٖ وَ رُسُلِہٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ  اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِہٖ.

‘রাসূল তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে যা তাঁর কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮৫)।

এ জগৎ ও সমাজকে কেবল আল্লাহর কালাম, তাঁর শরী‘আত ও তাঁর কিতাবই সংস্কার করতে পারে; যা পর্যাপ্ত জীবিকা ও রিযিক লাভের মাধ্যম। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ لَوۡ  اَنَّ  اَہۡلَ الۡکِتٰبِ اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَکَفَّرۡنَا عَنۡہُمۡ سَیِّاٰتِہِمۡ وَ لَاَدۡخَلۡنٰہُمۡ  جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ  .  وَ لَوۡ اَنَّہُمۡ اَقَامُوا التَّوۡرٰىۃَ وَ الۡاِنۡجِیۡلَ وَ مَاۤ  اُنۡزِلَ اِلَیۡہِمۡ  مِّنۡ رَّبِّہِمۡ لَاَکَلُوۡا مِنۡ فَوۡقِہِمۡ وَ مِنۡ تَحۡتِ اَرۡجُلِہِمۡ.

‘আর যদি কিতাবীরা ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের পাপসমূহ অবশ্যই মুছে ফেলতাম এবং তাদেরকে সুখময় জান্নাতে প্রবেশ করাতাম। আর তারা যদি তাওরাত, ইঞ্জীল ও তাদের রবের কাছ থেকে তাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত করত, তাহলে তারা অবশ্যই তাদের উপর থেকে ও পায়ের নিচ থেকে রিযিক লাভ করত’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৫-৬৬)।

তাফসীরবীদগণ বলেন, ‘তাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল : আল কুরআন; কেননা এটা অন্যান্য কিতাবের সংরক্ষক ও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী। বরং ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষের অবস্থা ও তার জীবন কুরআন ব্যতীত অন্য উপায়ে সঠিক হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡیِیَنَّہٗ  حَیٰوۃً  طَیِّبَۃً ۚ وَ لَنَجۡزِیَنَّہُمۡ اَجۡرَہُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ  .  فَاِذَا  قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ  فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ مِنَ  الشَّیۡطٰنِ  الرَّجِیۡمِ.

‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেব। সুতরাং যখন আপনি কুরআন পাঠ করবেন তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন’ (সূরা আন-নাহাল : ৯৭-৯৮)। এখানে তিনি পবিত্র জীবন দানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর কুরআন পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন; যাতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত ও তদনুযায়ী আমল পবিত্র জীবন ও জান্নাতের নে‘মত লাভের মাধ্যম। বস্তুত জান্নাত ও তাতে বিদ্যমান চিরস্থায়ী নে‘মতসমূহ আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্যই নির্ধারণ করে রেখেছেন যারা তাঁর কালামে বিশ্বাস করে ও তদনুযায়ী আমল করে। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰعِبَادِ  لَا خَوۡفٌ عَلَیۡکُمُ  الۡیَوۡمَ  وَ لَاۤ اَنۡتُمۡ  تَحۡزَنُوۡنَ . اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ کَانُوۡا مُسۡلِمِیۡنَ . اُدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ  اَنۡتُمۡ وَ اَزۡوَاجُکُمۡ تُحۡبَرُوۡنَ . یُطَافُ عَلَیۡہِمۡ  بِصِحَافٍ مِّنۡ ذَہَبٍ وَّ اَکۡوَابٍ ۚ وَ فِیۡہَا مَا تَشۡتَہِیۡہِ  الۡاَنۡفُسُ وَ تَلَذُّ الۡاَعۡیُنُ ۚ وَ اَنۡتُمۡ  فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ .  وَ تِلۡکَ الۡجَنَّۃُ  الَّتِیۡۤ  اُوۡرِثۡتُمُوۡہَا بِمَا کُنۡتُمۡ  تَعۡمَلُوۡنَ . لَکُمۡ  فِیۡہَا  فَاکِہَۃٌ  کَثِیۡرَۃٌ  مِّنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ.

‘হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না। যারা আমার আয়াতে ঈমান এনেছিল এবং যারা ছিল মুসলিম। তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে; সেখানে মন যা চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয় তাই থাকবে। আর সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে। আর এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কাজের ফলস্বরূপ। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা খাবে’ (সূরা আয-যুখরুফ : ৬৮-৭৩)।

যারা আল্লাহর কালামে বিশ্বাস করে ও তদনুযায়ী আমল করে তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন। এ জাতীয় ঈমানের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যাদের প্রশংসা করেছেন তাদের অন্যতম হলেন সৃষ্টির মহাসম্মানিত ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ﷺ)। মহান আল্লাহ বলেন, فَاٰمِنُوۡا  بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہِ النَّبِیِّ  الۡاُمِّیِّ  الَّذِیۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ کَلِمٰتِہٖ وَ اتَّبِعُوۡہُ  لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ ‘কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূল উম্মী নবীর প্রতি যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহে ঈমান রাখেন। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৮)।

আল্লাহর নিকট এ সম্মানিত নবীকে আল্লাহ তা‘আলা এই পূর্ণাঙ্গ, সার্বজনীন শরী‘আত দ্বারা ভূষিত করেছেন। আর এ শরী‘আতের দৃষ্টিতে আল্লাহর নিকট সম্মান কেবল তাক্বওয়ার ভিত্তিতে। মানব জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা এ কুরআনের মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন যার মধ্যে তিনি সত্য বর্ণনা করেছেন যা নিয়ে আহলে কিতাবগণ মতবিরোধ করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ قَدۡ جَآءَکُمۡ  رَسُوۡلُنَا یُبَیِّنُ لَکُمۡ کَثِیۡرًا مِّمَّا کُنۡتُمۡ تُخۡفُوۡنَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ۬ؕ قَدۡ جَآءَکُمۡ  مِّنَ اللّٰہِ  نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ .  یَّہۡدِیۡ بِہِ اللّٰہُ مَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَہٗ سُبُلَ السَّلٰمِ  وَ یُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ بِاِذۡنِہٖ وَ یَہۡدِیۡہِمۡ  اِلٰی  صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ.

‘হে কিতাবীরা! আমাদের রাসূল তোমাদের নিকট এসেছেন তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি সে সবের অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করছেন এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিচ্ছেন। অবশ্যই আল্লাহর নিকট থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, এ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং তাদেরকে নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)।

অতঃপর এ উম্মী নবী ইবরাহীমী মিল্লাত নিয়ে আগমন করেন যার প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,

مَا کَانَ  اِبۡرٰہِیۡمُ یَہُوۡدِیًّا وَّ لَا نَصۡرَانِیًّا وَّ لٰکِنۡ کَانَ حَنِیۡفًا مُّسۡلِمًا ؕ وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ .  اِنَّ اَوۡلَی النَّاسِ بِاِبۡرٰہِیۡمَ لَلَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُ وَ ہٰذَا النَّبِیُّ وَ الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا ؕ وَ اللّٰہُ وَلِیُّ  الۡمُؤۡمِنِیۡنَ.

‘ইবরাহীম ইহুদীও ছিলেন না, নাসারাও ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। নিশ্চয় মানুষের মধ্যে তারাই ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতম যারা তাঁর অনুসরণ করেছে এবং এ নবী ও যারা ঈমান এনেছে; আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক’ (সূরা আলে-ইমরান : ৬৭-৬৮)।

আর এই শরী‘আতের পূর্ণাঙ্গতা ও দয়ার নিদর্শন হল, তা ইনছাফ, বিশ্বস্ততা ও হক্বের সাথে সকল মানুষের প্রয়োজন বাস্তবায়ন করে ও তাতে সাড়া দেয় এবং জীবনের সকল দিককে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে। কিছু মুসলিমদের মাঝে যেসব ত্রুটি দেখা যায় তা শরী‘আতের কারণে নয়, বরং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শরী‘আত বাস্তবায়নে অজ্ঞতার কারণে হয়ে থাকে। উম্মতের মাঝে আগত সমস্যা ও মাস’আলার সমাধানের ক্ষেত্রে সুমহান শরী‘আত অপারগ নয় এবং কখনো অপারগ হবে না। কেননা শরী‘আত ও হুকুম-আহকামের উৎস সুপ্রতিষ্ঠিত, যা পরিবর্তন হবে না এবং তাতে মানবীয় প্রবৃত্তি অনুপ্রবেশ করতে পারে না। শরী‘আতের আহকামসমূহ গ্রহণ করা হয় কুরআন হতে, যদি বিধানটি কুরআনে না থাকে তবে তা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত হতে গ্রহণ করা হয়। যদি সুন্নাতের মাঝে না পাওয়া যায় তবে তা ইজমা‘র ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়। আর ইজমা‘ হল, নতুন কোন হুকুমের ক্ষেত্রে মুজতাহিদ আলেমদের ঐকমত্য, তাদের বিরোধিতা করা বৈধ নয়; বস্তুত ইজমা‘ কুরআন সুন্নাহর দলীলের উপর নির্ভর করে হয়ে থাকে। যদি হুকুমটির ক্ষেত্রে ইজমা‘ না পাওয়া যায়, তবে বিশুদ্ধ কিয়াসের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়। কিয়াস হল, কোন শাখা মাস’আলাকে মৌলিক মাস’আলার সাথে সম্পৃক্ত করা একই কারণ বিদ্যমান থাকার কারণে। বিশুদ্ধ কিয়াসের উপর ছাহাবীগণ ও তৎপরবর্তী লোকেরা আমল করেছেন। বিশুদ্ধ কিয়াসের বিষয়ে ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) তার গুরুত্বপূর্ণ কিতাব ‘ই‘লামুল মুয়াক্কিইন আন রব্বীল আলামিন’ নামক গ্রন্থে এমন বিস্তারিত আলোচনা করেছেন যা পূর্বে কেউ করেননি। উদ্দেশ্য হল, ইসলামী শরী‘আত একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা যা মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তা আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের বাণীর উপর প্রতিষ্ঠিত। যে ব্যক্তি এটাকে আঁকড়ে ধরবে সে নাজাত পাবে, আর যে তা থেকে দূরে থাকবে সে ধ্বংস হবে। এই শরী‘আতের দৃষ্টান্ত হল, নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর নৌকার ন্যায়। যেমনভাবে আল্লাহ তা‘আলা যে ব্যক্তি তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁর শরী‘আত অনুযায়ী আমল করবে তার জন্য ইহকালীন সৌভাগ্য ও পরকালীন নে‘মতের ফয়সালা করেছেন, অনুরূপভাবে যে লোক তাঁর বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে ও সে অনুযায়ী আমল পরিত্যাগ করবে তার জন্য ইহকালীন শাস্তি ও দুর্ভাগ্য এবং পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নামের ফয়সালা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

اَلَمۡ  تَرَ  اِلَی الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ  اٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ اَنّٰی یُصۡرَفُوۡنَ . الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِالۡکِتٰبِ وَ بِمَاۤ  اَرۡسَلۡنَا بِہٖ رُسُلَنَا ۟ۛ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ .  اِذِ الۡاَغۡلٰلُ فِیۡۤ  اَعۡنَاقِہِمۡ وَ السَّلٰسِلُ ؕ یُسۡحَبُوۡنَ .  فِی الۡحَمِیۡمِ ۬ۙ ثُمَّ  فِی النَّارِ  یُسۡجَرُوۡنَ.

‘আপনি কি লক্ষ্য করেন না তাদেরকে যারা আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্ক করে? তাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে? যারা মিথ্যারোপ করে কিতাবে এবং যা সহ আমার রাসূলগণকে আমি পাঠিয়েছি তাতে; অতএব, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে যখন তাদের গলায় বেড়ী ও শৃংখল থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। ফুটন্ত পানিতে, তারপর তাদেরকে পোড়ানো হবে আগুনে’ (সূরা গাফির : ৬৯-৭২)।

পূর্ববতী জাতিগণ তো আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণেই ধ্বংস হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ تِلۡکَ عَادٌ ۟ۙ جَحَدُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ وَ عَصَوۡا رُسُلَہٗ وَ اتَّبَعُوۡۤا اَمۡرَ  کُلِّ جَبَّارٍ عَنِیۡدٍ  .  وَ اُتۡبِعُوۡا فِیۡ ہٰذِہِ  الدُّنۡیَا لَعۡنَۃً  وَّ  یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اَلَاۤ   اِنَّ  عَادًا کَفَرُوۡا  رَبَّہُمۡ ؕ اَلَا  بُعۡدًا  لِّعَادٍ  قَوۡمِ  ہُوۡدٍ.

‘আর এ আদ জাতি তাদের রবের নিদর্শন অস্বীকার করেছিল এবং অমান্য করেছিল তাঁর রাসূলগণকে এবং তারা প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারীর নির্দেশ অনুসরণ করেছিল। আর এ দুনিয়ায় তাদেরকে করা হয়েছিল লা‘নতগ্রস্ত এবং লা‘নতগ্রস্ত হবে তারা ক্বিয়ামতের দিনেও। জেনে রাখ! আদ সম্প্রদায় তো তাদের রবকে অস্বীকার করেছিল। জেনে রাখ! ধ্বংসই হচ্ছে হুদের সম্প্রদায় ‘আদের পরিণাম’ (সূরা হূদ : ৫৯-৬০)। অন্যান্য ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিরা তাদের মতই।

হে মানবম-লী! আপনাদের নিকট হেদায়াত ও মুক্তিপ্রাপ্তদের পথ সুস্পষ্ট এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ভ্রষ্টদের পথসমূহও পরিষ্কার। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ  اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ  وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ.

‘আর এ পথই আমার সরল পথ কাজেই তোমরা এর অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হও’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)।

দ্বিতীয় খুত্ববা

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন। কেননা একমাত্র মুত্তাক্বীগণই কল্যাণ লাভে সফলকাম হয়েছে। হে মুসলিমগণ! মহান আল্লাহ বলেন,

قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ  اَدۡعُوۡۤا  اِلَی اللّٰہِ ۟ؔ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ  اَنَا  وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ  وَ مَاۤ   اَنَا مِنَ  الۡمُشۡرِکِیۡنَ.

‘বলুন, এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি ডাকি জেনে-বুঝে, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ কতই না পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮)। হাদীছে এসেছে, তোমরা সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই অস্বীকার করল। কাজেই আপনারা নিজেদের কথা ও কাজকে আপনাদের রবের জন্য একনিষ্ঠ করুন। কেননা ইখলাছ ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল গ্রহণ করেন না। আর আপনারা বেশি বেশি দু‘আ করুন। কেননা দু‘আ করলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববা সমাপ্ত করেন।


* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু কাছীর, তাফসীর ইবনু কাছীর, ৫ম খ-, পৃ. ৩২২।




প্রসঙ্গসমূহ »: খুত্ববাতুল হারামাইন
ক্রোধ সংবরণ করার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
মানব জীবনে সফলতার উপায় - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আরাফাহর খুৎবাহ - অনুবাদ : ড. মুহাম্মাদ মানজুরে এলাহী
ফিতনার সময় রাসূূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মানহাজ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নবুওয়তের আলামতসমূহ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ইসলামী শরী‘আহর সৌন্দর্য - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ