যৌন হয়রানির ভয়াবহতা ও প্রতিকার
-খত্বীব : শায়খ স‘ঊদ বিন ইবরাহীম আশ-শুরাইম (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*
[গত ২৮ রজব, ১৪৪২ হি. মোতাবেক ১২ মার্চ, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ ও সালামের পর সম্মানিত খত্বীব বলছেন, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী এবং সবচেয়ে উত্তম আদর্শ হচ্ছে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ। আর সবচেয়ে জঘন্য কাজ হচ্ছে ধর্মের নামে নব আবিষ্কৃত শিরক-বিদ‘আত। মনে রাখবে, জ্ঞানী ঐসব ব্যক্তিরা যারা নিজের হিসাব নিজেরাই করে এবং মৃত্যুর পরে যে স্থায়ী জীবন রয়েছে তার জন্য কর্মতৎপর হয়। আর অপারগ ঐসব ব্যক্তিরা, যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে কর্মহীন থাকা সত্ত্বেও বড় বড় আশা রাখে।
অতঃপর সম্মানিত খত্বীব বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা যিনি প্রজ্ঞাবান, যিনি সবকিছুর সূক্ষ্ম খবর রাখেন, তিনি নর ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েও সৃষ্টি করেছেন। একজনের বৈশিষ্ট্য আরেকজনের তুলনায় ভিন্ন ভিন্ন। আবার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এমন রয়েছে, যাতে নর-নারী উভয় শরীক রয়েছে। যেমন একজন পুরুষের নারীর দিকে আকর্ষণ রয়েছে, তেমনি একজন নারীর পুরুষের দিকে আকর্ষণ রয়েছে। এভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সকলকে সৃষ্টি করেছেন। তবে এই আকর্ষণের ক্ষেত্রে তিনি সীমানা নির্ধারণ করেছেন এবং সীমানাকে শক্ত বেড়াজাল দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে করে প্রত্যেকের ইযযত-আবরুর সুরক্ষা করা সম্ভব হয়। মানবজাতির ইযযত-আবরুর সুরক্ষার জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যাকে ইসলামী শরী‘আতে ‘আয-যারুরাতুল খামছ’ বলা হয়। যেগুলো প্রতিটি মানুষের জন্য ও মানবজাতির নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক। তন্মধ্যে মান-ইযযতের হেফাযত করা এবং আত্মমর্যাদার সুরক্ষার ব্যবস্থা করা অন্যতম। এই বিষয়গুলোর উপর সকল আসমানী মিল্লাত বা দ্বীন একমত। বিশেষ করে ইসলামের বক্তব্য স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও পরিপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে যে, চরিত্র হচ্ছে যে কোন জাতির স্তম্ভ। তাই উত্তম আখলাক-চরিত্র গঠন করার জন্য আমাদেরকে সর্বদা প্রচেষ্টা করতে হবে। এই আখলাক বা চরিত্র যাতে নষ্ট হয় কিংবা উত্তম চরিত্রকে ছিদ্র করে এমন যেসব বিপরীত বিষয় রয়েছে সেগুলো থেকে সতর্ক-সাবধান থাকতে হবে। কেননা মানব জীবনের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য উত্তম চরিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আর মানুষের আখলাক-চরিত্র যদি নিচে নেমে যায়, তাহলে সে কোনদিন উন্নতি করতে পারে না। আর পার্থিব উন্নতি, যে উন্নতিতে আধ্যাত্মিকতা ও উত্তম চরিত্র গঠন নেই; এমন উন্নতির কোন মূল্য নেই। বর্তমান সমাজের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে একটি খারাপ দৃশ্য পরিদৃষ্ট হয়, যা বড়ই বিরক্তিকর এবং মানব সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক। অথচ যে সকল জ্ঞানী-গুণীরা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন, জ্ঞান চর্চা করছেন, যারা মানবজাতির তারবিয়াতে লেগে আছেন, সেই ধ্বংসাত্মক বিষয় নিয়ে তারা বড়ই চিন্তিত। যে বিষয়টিকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং বিচার বিভাগের বিশেষজ্ঞগণ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এছাড়া বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়াতে সে বিষয়গুলো খুব বেশি দেখতে পাচ্ছি বা শুনতে পাচ্ছি, তা হচ্ছে মানুষের ইয্যত-আবরুর ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি করা অথবা যৌন হয়রানির কাছে চলে যাওয়া। এই যৌন হয়রানির বলতে কী বোঝানো হয়েছে? মূলত পুরুষ হোক অথবা নারী হোক একজন অপরজনের ওপর আক্রমণ করবে, সীমালংঘন করবে। সেটা ইশারা-ইঙ্গিতে হতে পারে, কুদৃষ্টিপাত করে হতে পারে, স্পর্শ করার মাধ্যমে হতে পারে, স্পষ্ট ভাষায় যৌন প্রস্তাবের মাধ্যমে হতে পারে অথবা ইশারা ইঙ্গিত করে কারো আত্মমর্যাদা নষ্ট করা হতে পারে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে নর ও নারীর এরকম আচরণ হতে পারে ইত্যাদি।
যৌন হয়রানির যে অর্থের দিকে আমরা ইঙ্গিত করলাম সেটা একটি চরম নোংরা অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা। যার সমাধান করা এবং সামলানো অত্যন্ত যরূরী হয়ে পড়েছে। সেটা জনসম্মুখে হোক অথবা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হোক। এছাড়া যৌন হয়রানি শুধু নারী জাতির সাথেই খাছ নয়। বরং কখনো কখনো পুরুষদের সাথেও হয়ে থাকে। কখনো কখনো কচিকাঁচা শিশুদের সাথেও হয়ে থাকে।
পুরুষ এবং নারীদের মাঝে যৌন হয়রানি একটি বড়ই খারাপ চরিত্র। বিশেষ করে যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছে এবং যাদের মধ্যে কোন ধর্মীয় মূল্যবোধ নেই। তারা যা ইচ্ছা তাই করে থাকে। যেখানে ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা চলাফেরা করে থাকে। সচ্চরিত্র তাদের কাছে কোন মূল্যই নেই এবং একজন অপরজনের শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও তাদের মাঝে অনুপস্থিত। সেটা অজ্ঞতার কারণে হোক অথবা অন্তর পাপিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার কারণে হোক। যে রোগের ভয়াবহতা ও পরিণাম শুধু ব্যক্তির সাথে সীমিত নয়, বরং ব্যক্তি থেকে এর ভয়াবহতা পরিবারে নেমে আসে। আর পরিবার যেহেতু সমাজেরই প্রধান অংশ, সেহেতু ধীরে ধীরে তা পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলে।
হে আল্লাহর বান্দারা! মনে রাখবেন, এই যৌন হয়রানি ব্যভিচারের মন্ত্র এবং একটি পাশবিক চরিত্র। সেটা জনসম্মুখে হোক অথবা যে কোন জায়গায় হোক না কেন। যারা একে অপরের অধিকারের পরোয়া করে না।
যৌন হয়রানি কখনো কখনো পোশাক পরিচ্ছেদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। নর হোক কিংবা নারী, তারা এমন অশালীন পোশাক পরিধান করে থাকে, যাতে অন্যরা আকৃষ্ট হয়। আবার যৌন হয়রানি কখনো কখনো ভাষার দ্বারা হয় না, বরং অবস্থা দ্বারা হয়ে থাকে। কথা বলে না কিন্তু চলা-ফেরার মাধ্যমে যৌন হয়রানি করে থাকে। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন যে, কারো যদি চালচলন অথবা পোশাক-আশাক এরকম হয়, তার মানে এই নয় যে, আপনার জন্য হয়রানি করা বৈধতার প্রমাণ মিলে বা বৈধতার সুযোগ আসে। সুতরাং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং যে যতটা অপরাধ করবে তাকে ততটুকু অপরাধী বলে গণ্য করা হবে।
অতএব যে কোন উপায়ে যৌন হয়রানি হোক না কেন, তা প্রতিরোধ করা এবং সমাজ থেকে নির্মূল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যৌন হয়রানি যাতে করে না ঘটে, তাই ঘটার আগেই তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেটা হবে একজন ব্যক্তির মান-মর্যাদার খেয়াল রেখে এবং একজন মুসলিমের দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রে সৎ চরিত্রের যে একটি ভাল প্রভাব রয়েছে এবং সৎ চরিত্রের গুরুত্ব রয়েছে সেটি অনুধাবন করার মাধ্যমে। যাতে করে সমাজে মানুষ শান্তভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। আর যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটেই যায়, তাহলে তার উচিত শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে যৌন হয়রানির প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
মনে রাখবেন, যারা এই রকমের খারাপ চরিত্রের মানুষ তাদের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিম্নের হাদীছ বলা যেতে পারে। যেমন, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَا أَدْرَكَ ذَلِكَ لَا مَحَالَةَ فَزِنَا الْعَيْنِ النَّظَرُ وَزِنَا اللِّسَانِ الْمَنْطِقُ وَالنَّفْسُ تَمَنَّىْ وَتَشْتَهِىْ وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ كُلَّهُ وَيُكَذِّبُهُ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানের জন্য ব্যভিচারের অংশ নির্ধারণ করে রেখেছেন। যা সে অবশ্যই লাভ করে থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখের যেনা দেখা, জিহ্বার যেনা কথা বলা এবং অন্তরের যেনা আকাঙ্ক্ষা করা ও কামনা করা। অতঃপর গুপ্তাঙ্গ সেটাকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে’।[১] উক্ত হাদীছে স্পষ্ট হল যে, মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা যেনা-ব্যভিচার ঘটে থাকে।
যৌন হয়রানি শুধু মানুষের প্রবৃত্তির কারণে হয় না। কখনো কখনো কুপ্রবৃত্তি অনুসরণ ছাড়া এবং শারীরিক চাহিদা ছাড়াও বালা ও ফেতনা হিসাবেও ঘটে থাকে। আর ঐ ফিতনা এমন কিছু ব্যক্তি ঘটিয়ে থাকে যাদের অন্তর আল্লাহ তা‘আলা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে অথবা তাদের অন্তরের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে এই মর্মে একটি ঘটনা রয়েছে। জাবির ইবনু সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, কূফাবাসীরা সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন এবং ‘আম্মার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কূফার লোকেরা সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে এও বলে যে, তিনি ভালোরূপে ছালাত আদায় করতে পারেন না। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, হে আবূ ইসহাক্ব! তারা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, আপনি না-কি ভালোরূপে ছালাত আদায় করতে পারেন না। সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছালাতের অনুরূপই ছালাত আদায় করে থাকি। তাতে কোন ত্রুটি করি না। আমি এশার ছালাত আদায় করতে প্রথমে দু’রাক‘আত একটু দীর্ঘ ও শেষের দু’রাক‘আত সংক্ষেপ করতাম। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আবূ ইসহাক্ব! আপনার সম্পর্কে আমারও এই ধারণা। অতঃপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কূফার অধিবাসীদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গে কূফায় পাঠান। সে ব্যক্তি প্রতিটি মসজিদে গিয়ে সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল এবং তাঁরা সকলেই তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। অবশেষে সে ব্যক্তি বনূ আব্স গোত্রের মসজিদে উপস্থিত হয়। এখানে উসামা উবনু কাতাদা নামে এক ব্যক্তি (যাকে আবূ সা‘দাহ ডাকা হত) দাঁড়িয়ে বলল, যেহেতু তুমি আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছ (তখন বলছি), ‘সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কখনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে যান না, গণীমতের মাল সমভাবে বণ্টন করেন না এবং বিচারে ইনসাফ করেন না’। তখন সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, মনে রেখো, আল্লাহর কসম! আমি তিনটি দু‘আ করছি হে আল্লাহ! যদি আপনার এ বান্দা মিথ্যাবাদী হয়, লোক দেখানো এবং অপপ্রচারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে ১. তার হায়াত বাড়িয়ে দিন, ২. তার অভাব বাড়িয়ে দিন এবং ৩. তাঁকে ফিতনার সম্মুখীন করুন। পরবর্তীকালে লোকটিকে (তার অবস্থা সম্পর্কে) জিজ্ঞেস করা হলে সে বলত, আমি বয়সে বৃদ্ধ, ফিতনায় লিপ্ত। সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দু‘আ আমার উপর লেগে আছে। বর্ণনাকারী আব্দুল মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পরে আমি সে লোকটিকে দেখেছি, অতি বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার ভ্রু চোখের উপর ঝুলে গেছে এবং সে রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করত এবং তাদের চিমটি দিত’।[২] নাউযুবিল্লাহ।
পরবর্তীতে দেখা যায় যে, ঐ ব্যক্তি বৃদ্ধাবস্থায় মেয়েদের গায়ে হাত দিত, চিমটি দিত। তাকে জিজ্ঞেস করা হত, তুমি এত বুড়ো হয়ে গেছ আর তোমার এরকম বদচরিত্র কেন? তুমি এরকম কাজ কেন করছ? তোমার কি শারীরিক চাহিদা থেকে গেছে? তখন সে বলত, আমি খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। ফিতনায় পড়ে গেছি। সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বদদু‘আ আমাকে লেগে গেছে। কিন্তু সমাধান আর কিছু নেই। এজন্য কখনো জেনে বা অজান্তে অপরাধ করবেন না, মানুষের হক নষ্ট করবেন না। কারো উপর যুলম-অত্যাচার করবেন না।
শরী‘আতে যে দৃষ্টি সুনির্ধারিত এবং যুক্তিসম্মত তা বাস্তবভাবেই সত্য। ইসলামী শরী‘আয় যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে বর্ণিত বিধি-বিধানগুলো ফিক্বহের কিতাবাদিতে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করা যেতে পারে এবং যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়া এবং তাদেরকে সোজা করা সম্ভব হতে পারে। ফিক্বহের কিতাবগুলোতে প্রশাসনের ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। কেননা এই প্রশাসনের মাধ্যমে বাঁকা মানুষদেরকেও সোজা করা যেতে পারে।
বড়ই খুশির বিষয় হবে, যখন জনগণ দেখবে যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন যাদেরকে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে যারা অপরাধী, তারা তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দিচ্ছেন এবং তাদের খোঁজখবর রাখছেন। যাতে করে মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। ইসলামী শরী‘আহর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বান্দার হক্বের রক্ষণাবেক্ষণ করা। যাতে করে কোন মানুষের অধিকার নষ্ট না হয় এবং তার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা যায়। কেননা বান্দার হক্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক্বের উপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ আল্লাহর হক্বের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা উপেক্ষা করবেন, মাফ করবেন, তিনি গাফূরুর রহীম। পক্ষান্তরে বান্দার হক্ব ততক্ষণ আল্লাহ মাফ করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার কাছে মুক্তি লাভ না করবে ক্ষমা নেয়ার মাধ্যমে অথবা তার যথাযথ হক্ব আদায় করার মাধ্যমে। এজন্য ইসলামী শরী‘আতে আত্মমর্যাদা সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ বর্ণিত হয়েছে। যার কিছু সম্পর্ক হচ্ছে ব্যক্তিজীবনের সাথে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
وَ لَا تَقۡرَبُوا الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَ مَا بَطَنَ
‘তোমরা অশ্লীল কথা-কাজের কাছে যেও না। সেটা প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫১)।
আবার কিছু বিধি-বিধান এমন রয়েছে, যেগুলো ব্যক্তিজীবন ও সমষ্টিগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন লোকদের উদ্দেশ্যে একটি খুৎবাহ দিলেন। তিনি বললেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَىُّ يَوْمٍ هَذَا قَالُوْا يَوْمٌ حَرَامٌ قَالَ فَأَىُّ بَلَدٍ هَذَا قَالُوْا بَلَدٌ حَرَامٌ قَالَ فَأَىُّ شَهْرٍ هَذَا قَالُوْا شَهْرٌ حَرَامٌ قَالَ فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِىْ بَلَدِكُمْ هَذَا فِىْ شَهْرِكُمْ هَذَا
‘হে লোক সকল! আজকের এ দিনটি কোন্ দিন? সকলেই বললেন, সম্মানিত দিন। অতঃপর তিনি বললেন? এ শহরটি কোন্ শহর? তাঁরা বললেন, সম্মানিত শহর। অতঃপর তিনি বললেন, এ মাসটি কোন্ মাস? তাঁরা বললেন, সম্মানিত মাস। তিনি বললেন, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের ইয্যত-সম্মান তোমাদের জন্য তেমনি সম্মানিত, যেমন সম্মানিত তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ শহর এবং তোমাদের এ মাস’।[৩]
ইসলামের পূর্ণতার একটি দিক হচ্ছে যে, ইসলামের বিধি-বিধানসমূহ যুক্তিবিরোধী নয়, বরং যুক্তিসংগত। বরং ইসলাম কখনো কখনো যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে বুঝাতে শিক্ষা দিয়েছে। শুধু ইসলামের বিধি-বিধান বর্ণনা করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল- সেটা যদি যুক্তিসংগত হয়, তাহলে কখনো কখনো যুক্তি দিয়ে বুঝানো। যেটা ক্ষেত্র বিশেষ বেশি উপকারী হবে। যে ব্যক্তি কারো যৌন হয়রানি করতে যায়, সেই ব্যক্তি যদি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখে যে, যার সাথে এই খারাপ আচরণ করছে, সে কারো বোন, কারো মা, কারো মেয়ে। ঠিক তেমনি তারও মা রয়েছে, তারও বোন রয়েছে, তার হয়ত মেয়ে রয়েছে অথবা তার খালা-ফুফু ইত্যাদি রয়েছে। এই বিষয়গুলো একটু চিন্তা করলেই সতর্ক-সাবধান হয়ে যাবে যে, আমি এরকম কাজ করতে পারি না। কারণ আমারও মা-বোন রয়েছে, আমারও বংশের মেয়েরা রয়েছে।
এই মর্মে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটি হাদীছ রয়েছে। জনৈক যুবক নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে আসল। এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! (এই যুবক অবিবাহিত ছিল এবং তার যৌন চাহিদার বড়ই তাড়না ছিল, বরদাস্ত করতে পারছিল না। ঈমানের দুর্বলতাও ছিল।) আমাকে আপনি ব্যভিচারের অনুমতি দিয়ে দেন। সেখানে ছাহাবায়ে কেরাম যারা ছিলেন তারা দেখলেন যে, এই ছেলে তো বড় বেয়াদব। ব্যভিচার করার জন্য অনুমতি চাইছে! তারা তাকে ধমকাতে শুরু করলেন। আর বলতে লাগলেন, খবরদার! তুমি কী কথা বলছ? বেয়াদবী করছ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে কাছে নিয়ে এসো। সেই কাছে এসে বসল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! বলতো তুমি যে ব্যভিচারের অনুমতি চাচ্ছ, তুমি কি তোমার মায়ের সাথে ব্যভিচার পসন্দ করবে। কেউ যদি ব্যভিচার করে? সে বলল, না! আল্লাহর কসম করে বলছি। আল্লাহ আমাকে আপনার ওপর কুরবান করুন, উৎসর্গ করুন। কখনোই এটা হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন, তাহলে অন্য মানুষেরা নিজ মায়ের জন্য কখনো সেটা মেনে নেবে না। তুমি যেমন মেনে নিতে পার না, তেমন তাদেরও তো মা কেউ আছে। সুতরাং তারা মেনে নিতে পারে না মায়েদের ক্ষেত্রে। চলো ঠিক আছে। তোমার মেয়ে যদি থাকে, তোমার মেয়ের জন্য বরদাস্ত করবে কেউ যদি ব্যভিচার করে? সে বলল, না! হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহর কসম করে বলছি কখনো বরদাস্ত করব না। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে আপনার ওপর উৎসর্গ করুন। অন্যান্য লোকেরাও মেয়েদের জন্য সেটা কখনো পসন্দ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমার বোনের জন্য? তোমার বোনের সাথে কেউ যদি ব্যভিচার করে? সে বলল, না! আল্লাহ কসম করে বলছি। আল্লাহ আপনার উপর আমাকে উৎসর্গ করুন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে অন্যান্য মানুষেরা তাদের বোনদের জন্য পসন্দ করবেন না। যার সাথে যেনা করতে যাচ্ছ, সে কারো মা, কারো মেয়ে, কারো বোন। বলবেন, ‘তোমার ফুফুর সাথে যদি ব্যভিচার করতে চাই। সে বলল, না! আল্লাহর কসম করে বলছি এটা হতেই পারে না। তাহলে অন্য লোকেরাও তাদের ফুফুদের জন্য পসন্দ করবেন না। তোমার খালার সাথে কেউ যদি ব্যভিচার করে? না! আল্লাহর কসম করে বলছি কখনো হতে পারে না। আল্লাহ আপনার উপর আমাকে উৎসর্গ করুন। তাহলে অন্য মানুষেরাও তাদের খালাদের সাথে এই কাজ পসন্দ করবে না। কী করে তুমি এর জন্য অনুমতি চাইছ? তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার গায়ে হাত রাখলেন। আর তার জন্য তিনটি দু‘আ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আল্লাহ! এই যুবক ছেলেটির অতীতে যে গুনাহ হয়েছে আপনি তা মাফ করে দিন। অন্তরকে পাক-পবিত্র করে দিন, রোগ মুক্ত করে দিন। কেননা এর অন্তর ব্যাধিগ্রস্থ এবং তার লজ্জাস্থানকে সুরক্ষিত করুন। তারপর এই যুবক কোনদিন খারাপ চরিত্রের দিকে ফিরে যায়নি।[৪]
ছানী খুত্ববাহ
দ্বিতীয় খুত্ববাতে সম্মানিতে খত্বীব আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে বলেন যে, হে আল্লাহর বান্দারা! যেনা-ব্যভিচার থেকে বা বদচরিত্র থেকে বেঁচে থাকো। কেননা সচ্চরিত্র এবং সতীত্ব বজায় রাখা এটি কাক্সিক্ষত চরিত্র। প্রত্যেকের এরকমের আকাক্সক্ষা হওয়া উচিত যে, আমার চরিত্র যেন সচ্চরিত্র হয় এবং আমার সতীত্ব যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। আল্লাহ তা‘আলা এব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন,
وَ لۡیَسۡتَعۡفِفِ الَّذِیۡنَ لَا یَجِدُوۡنَ نِکَاحًا حَتّٰی یُغۡنِیَہُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ
‘যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই, আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে’ (সূরা আন-নূর : ৩৩)। অর্থাৎ ঐসব লোকেরা যারা বিয়ে করতে সক্ষম নয়, তারা যেন সচ্চরিত্রের অধিকারী হয় এবং যেনা-ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহক্রমে সচ্ছল করে দিচ্ছেন না, অভাবমুক্ত করে দিচ্ছেন না, বিয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না, ততদিন হারাম থেকে তারা বেঁচে থাকবে। তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন এবং হালাল রুযির ব্যবস্থা করে দিবেন।
সচ্চরিত্র হচ্ছে উন্নত ও উত্তম চরিত্র। এই চরিত্রে প্রতিটি ব্যক্তিটিকে সুসজ্জিত হওয়া উচিত। যাতে করে নিজের কুপ্রবৃত্তি এবং তার যৌন চাহিদাকে লাগাম লাগিয়ে তা কন্ট্রোল করতে পারে এবং পাশবিক চরিত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে। যাতে করে মানুষ এমন জায়গায় না পৌঁছিয়ে যায়, যার পরিণাম ভাল না।
সচ্চরিত্র সর্বদাই কল্যাণকর। এমনকি যাদের যৌন চাহিদা নেই কিংবা শারীরিক কোনরকমের চাহিদা নেই, তাদের ক্ষেত্রে সচ্চরিত্র বড়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন,
وَ الۡقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیۡ لَا یَرۡجُوۡنَ نِکَاحًا فَلَیۡسَ عَلَیۡہِنَّ جُنَاحٌ اَنۡ یَّضَعۡنَ ثِیَابَہُنَّ غَیۡرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیۡنَۃٍ ؕ وَ اَنۡ یَّسۡتَعۡفِفۡنَ خَیۡرٌ لَّہُنَّ ؕ وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
‘আর বৃদ্ধ নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খুলে রাখে; তবে এটা হতে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আন-নূর : ৬০)।
সুতরাং প্রত্যেক ঐসব লোকেরা, যারা এই যৌন হয়রানি করতে চায়, তাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত যে, সে যখন যৌন হয়রানির দিকে অগ্রসর হয়, তখন যদি তার রূহ কবয করার জন্য মালাকুত মাউত এসে হাজির হয়। আর এ অবস্থায় তার মরণ চলে আসুক তা কি কেউ পসন্দ করবে? কখনো না! অথচ যেকোন সময় মরণ চলে আসতে পারে। চিন্তা করুন এই বদচরিত্র নিয়ে মারা গেলেন। তারপরে আপনাকে কবরে কবরস্থ করা হল। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপনার নিকট মুনকার-নাকীর এসে বসিয়ে দিল। এটা কি পসন্দ লাগবে যে, এরকম বদচরিত্র নিয়ে আপনি কবরে চলে যান। চিন্তা করুন যে, বদচরিত্রের অধিকারী আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা হাশরের মাঠে হাজির করলেন। সেখানে এমন হাহাকার অবস্থা হবে, তখন আমলনামা ডানহাতে আসবে না বামহাতে আসবে। এরূপ অবস্থা কি আপনার পসন্দ লাগবে যে, এমন পাপের অবস্থায় আপনি দুনিয়া থেকে চলে যান? চিন্তা করুন যে, আপনাকে এক সময় সেই জাহান্নামের উপর দিয়ে যে পুল আল্লাহ রব্বুল আলামীন প্রতিষ্ঠিত করবেন সেই পুলছিরাত পার করতে হবে। সেখানে আপনি বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন যে, সেখানে মুক্তি পাবেন না জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবেন। আপনি এই পাপের অবস্থায় দুনিয়া থেকে চলে যান এটা কি পসন্দ করছেন? যে সময় দাঁড়িপাল্লা কায়েম করা হবে। আর নেকি-গুনাহ মাপা হবে; সেই সময় মানুষের হাহাকার অবস্থা হবে যে তার নেকির পাল্লা ভারী হচ্ছে না হালকা হচ্ছে? কী যে অবস্থা? আর এরকম পাপের বোঝা নিয়ে আল্লাহর সামনে যদি হাজির হয়ে যান এটা কি আপনি পসন্দ করেন? এরকমই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে যখন দ-ায়মান হবেন এবং আল্লাহর প্রতিটি ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন। সেই সময় এই পাপের বোঝা নিয়ে হাজির হবেন এটা কি আপনি চান? সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারী যাতে করে আল্লাহকে ভয় করেন এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নির্ধারিত সীমারেখার যেন সীমালংঘন না করেন সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে একটি হাদীছ রয়েছে, ‘আত্বা ইবনু আবূ রাবাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমাকে একবার ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বললেন, (‘আত্বা!) আমি কি তোমাকে একটি জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এই কালো মহিলাটি হচ্ছে জান্নাতী। সে একবার নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হই এবং উলঙ্গ হয়ে যাই। আল্লাহর নিকট আমার জন্য দু‘আ করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তুমি ইচ্ছা করলে ছবর করতে পার। তাহলে তোমার জন্য জান্নাত রয়েছে। আর যদি ইচ্ছা কর আমি তোমার জন্য দু‘আ করব। আল্লাহ যেন তোমাকে আরোগ্য দান করেন। সে বলল, আমি ছবর করব। অতঃপর বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি উলঙ্গ হয়ে যাই। দু‘আ করুন, আমি যেন উলঙ্গ না হই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জন্য দু‘আ করলেন’।[৫] সুবহানাআল্লাহ। দুনিয়াতে এই রোগের উপর ধৈর্যধারণের জন্য জান্নাতের সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন এই মহিলা।
চিন্তা করুন! এই বৃদ্ধা কালো মহিলা কত বড় সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি কত বড় নেককার ছিলেন। যে তার ইযযতের সুরক্ষার জন্য এবং আত্মমর্যাদার জন্য, হেফাযতের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দু‘আ করতে বলেছেন, যাতে করে জনগণের সামনে তার শরীর থেকে কাপড় খুলে না যায়। এটি হচ্ছে সত্যিকারার্থে সচ্চরিত্র। আর জান্নাতীদের চরিত্র এমনটাই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে প্রতিযোগিতা করা উচিত। সুতরাং প্রতিটি মুসলিম নর এবং নারীর জন্য আবশ্যক হচ্ছে যে, প্রত্যেকে একে অপরের শ্রদ্ধা-সম্মান করবেন এবং ইযযত-আবরুর রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। নিজের যেমন আত্মমর্যাদার খেয়াল রাখবেন তেমন অন্যের আত্মমর্যাদার খেয়াল রাখবেন, ইযযত-আবরুর খেয়াল রাখবেন। আর সুশৃঙ্খলভাবে জীবন-যাপন করবেন। জনগণের অধিকারের ক্ষেত্রে সতর্ক-সাবধান।
যার অন্তর পাপিষ্ট, যার অন্তরে যেনা-ব্যভিচারের ব্যাধি রয়েছে, সে ব্যক্তি হচ্ছে রোগী। এরকম রোগীকে সমাজের সুস্থ ভাল মানুষদের কাছে আসতে দেবেন না। এরকম কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ ব্যক্তির কাছে যেন অবতরণ না করে। যেমন কীট-পতঙ্গ আগুন দেখলে ঝাঁপ দেয়। কখনো এমনটা করবেন না যে কীট-পতঙ্গের মত আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন। অর্থাৎ খারাপ জায়গায় ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন। সমাজের মানুষরা এমনটা করবেন না। এরকম রেশমের কাপড় যদি আগুনের পাশে রেখে দেন, তো অবশ্যই রেশমের কাপড়কে জ্বালিয়ে দেবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এজন্য সতর্ক-সাবধান করে, নর এবং নারীকে সম্বোধন করে ইরশাদ করছেন,
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِہِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَہُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ - وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ اِلَّا مَا ظَہَرَ مِنۡہَا
‘(হে নবী!) আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; এটা তাদের জন্য পবিত্রতম; তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। ঈমান আনয়নকারী নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; তারা যেন তার মধ্যে যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের অলংকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে’ (সূরা আন-নূর : ৩০-৩১)।
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন এই খুত্ববার মাধ্যমে আমাদের সকলকে উপকৃত করেন এবং চরিত্রবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। সবসময় নিজের চরিত্রকে ভালো রাখার তাওফীক্ব দান করেন। আর যেকোন রকমের পদস্খলন ও ফিতনা থেকে হেফাযত করেন। নারীদেরকে পুরুষদের ফিতনা থেকে এবং পুরুষদেরকে নারীদের ফিতনা থেকে হেফাযত করেন। দুনিয়ার প্রকাশ্য ও গোপন ফিতনা সহ অন্যান্য যত ফিতনা রয়েছে সবগুলো থেকে যেন আমাদের ও গোটা মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করেন-আমীন!!
* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী হা/৬২৪৩, ‘অনুমতি’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; ছহীহ মুসলিম হা/২৬৫৭, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; মিশকাত, হা/৮৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫৫।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৩৯।
[৪]. আহমাদ, হা/২২২৬৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৭০।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭৬; মিশকাত, হা/১৫৭৭।
প্রসঙ্গসমূহ »:
হালাল-হারাম