বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ অপরাহ্ন

প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশসমূহ

-খত্বীব : শায়খ ছালেহ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-হুমাইদ
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*


[২৩ মুহাররম ১৪৪২ হি. মোতাবেক ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুম‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর মুহতারাম শায়খ বলেন,

‘হে মানুষ! আমি নিজেকে এবং আপনাদেরকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ভয়-ভীতির অছিয়ত করছি। আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুন। আল্লাহকে ভয় করুন। সত্যিকার অর্থে সম্মান রয়েছে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতে, মান-ইজ্জত রয়েছে নেকীর কাজে। আর সকল লাঞ্ছনা রয়েছে পাপাচারে। যদি আল্লাহ তা‘আলা আপনার থেকে বিমুখ না হন, যতই মুছিবত জীবনে আসুক না কেন, সেটি আপনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নে‘মত।

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে যে ব্যক্তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক রাখবে, আল্লাহ তাকে নিজের জন্য মনোনীত করবেন। যে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিবে, তাকে তিনি আশ্রয় দিবেন। যে আল্লাহর উপর সবকিছুই সোপর্দ করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হন। যে নিজেকে তার রবের কাছে বিক্রি করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নেন। যা একজন ভাল মানুষের গন্তব্যস্থল।

মানবজীবন হচ্ছে কয়েকটি স্তরের নাম। আদম সন্তান কিছুদিন পৃথিবীতে অবস্থান করবে। অতঃপর সেখান থেকে পাড়ি দিতে হবে। প্রত্যেকটি শ্বাস আমাদেরকে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে দিচ্ছে। আমাদের জীবনে যা আশা-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং জ্ঞানী ঐ ব্যক্তি, যে প্রতিদিন নিজের আত্মপর্যালোচনা করে এবং উপকারী কাজ করে। বিশেষ করে স্থায়ী জগতে তথা পরকালে যা তার কাজে আসবে এমন আমল করে। অতএব সুস্থতা ও শক্তিশালী হয়ে পৃথিবীতে ভাল কাজে অগ্রগামী হতে হবে, যাতে করে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে উত্তম পাথেয় নিয়ে হাজির হওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یَوۡمَئِذٍ تُعۡرَضُوۡنَ  لَا تَخۡفٰی مِنۡکُمۡ خَافِیَۃٌ ‘সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে এবং তোমাদের কিছুই গোপন থাকবে না’ (সূরা আল-হাক্কাহ : ১৮)।

হে মুসলিমগণ! এক বছর পার হয়ে নতুন বছর শুরু হয়েছে। সুতরাং সৌভাগ্য ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজের দ্বীন এবং সময়গুলোর সুরক্ষা করেছে এবং নেকীর কাজে লাগিয়েছে। আর আক্ষেপ, দুর্ভোগ ঐসব লোকদের জন্য, যারা সীমালঙ্ঘন করে ও বাড়াবাড়ি করে। সুতরাং তাদের পরিণাম ব্যথা ও আক্ষেপ ছাড়া কিছুই নেই।

মানবজীবন হচ্ছে বছরের পর বছর পার হয়ে যাওয়ার নাম। মানুষের আয়ু বেশ কিছুদিনের সমষ্টির নাম। এতে কতক মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে। তারপরে মাটির তলায় চলে যাচ্ছে। শিশু যৌবনে পদার্পণ করছে। আর তারপরে ধীরে ধীরে তারও পরিণাম তাই হচ্ছে। প্রত্যেকেই নিজের ক্ষেতে ব্যস্ত। যে যেমন ক্ষেত করবে, সে তেমন ফসল পাবে। মানুষের যত কর্মকাণ্ড রয়েছে সব সংরক্ষিত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হল- মৃত ব্যক্তিদের জীবন নিয়ে একটু চিন্তা করা। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন যাদের আপনজন হারিয়েছে তাদের অন্তরে ধৈর্য ধরার তাওফীক্ব দান করেন এবং যে সময়টুকু আয়ু অবশিষ্ট রয়েছে তাতে আমাদের নেক কাজের তাওফীক্ব দান করেন। প্রত্যেক অসুস্থ ব্যক্তিকে আল্লাহ পূর্ণ শেফা দান করেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের যাবতীয় প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করি। ওয়াল-হামদুলিল্লাহ ‘আলা কুল্লি হাল।

হে মুসলিম ভাইগণ! কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থপূর্ণ অমীয় উপদেশ, যা ‘ওলামায়ে কেরাম ও পণ্ডিতগণ যুগে যুগে বলেছেন। যেখানে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষানীয় বিষয় রয়েছে। তার মাধ্যমে আমরা আত্মপর্যালোচনাও করতে পারব। সে রকম কিছু প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ নিম্নে তুলে ধরা হল :

দুনিয়া হচ্ছে বালা-মুছিবতে ঘেরা। দুনিয়া মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। দুনিয়া ধ্বংসশীল। একই অবস্থায় কখনো থাকবে না। দুনিয়ার মানুষ কখনো নিরাপদ নয়। যদি কখনো খুশি ও সুখের দিন থাকে তো কখনো আবার দুশ্চিন্তা ও বালা-মুছিবতের দিন। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দা! আপনি মনে করছেন যে, দুনিয়া খুব আমোদ-ফুর্তির জায়গা। কিন্তু তার পর পরেই দেখবেন দুনিয়া কান্নাকাটিরও জায়গা। আপনি মনে করছেন যে, এগুলো দুনিয়ার বৈশিষ্ট্য; না, এই পৃথিবীতে দুনিয়ার কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং দুনিয়ায় যারা বসবাস করছে, তাদের পরিবর্তন এসেছে। কেননা মানুষ কখনো হাসে কখনো কাঁদে এটাই তার প্রমাণ।

হে ভ্রাতৃমণ্ডলী! মানুষের পরিণাম কী, তা মানবজাতি থেকে আড়ালে রাখা হয়েছে। আমরা কিছুই জানি না যে, আমাদের পরিণামে কী রয়েছে বরং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ইচ্ছাই সেখানে বাস্তবায়ন হবে। আদম সন্তান আশা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞাত। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত। যদি আমরা ভাল আমল করি, তাহলে সৌভাগ্যবান হতে পারব। আর যদি ভাল আমল না থাকে, তাহলে পরিতাপ ছাড়া কিছুই থাকবে না। মনে রাখবেন, মানুষ নিজের জন্য উপকার-অপকারের ক্ষমতা রাখে না। এমনকি সে হায়াত-মউতের মালিক না, সুখ-দুঃখেরও মালিক না। বরং সবকিছুর মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীন।

জ্ঞানীদের কথা হচ্ছে, মানুষকে খুশি রাখা এমন একটি টার্গেট, যেটা হাসিল করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর মানুষকে কখনো সন্তুষ্টি করতে পারবেন না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি এমন একটি মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, যা কখনো ছাড়া যাবে না। সুতরাং যা হাসিল করা সম্ভব নয় অর্থাৎ মানুষকে রাজি করা সেটা নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কখনো পরিত্যাগ করা চলবে না ও ছাড়া যাবে না। ‘ওলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, আকাশসমূহ এবং যমীন সৃষ্টির আগে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর প্রজ্ঞার চূড়ান্ত ফায়ছালা প্রদান করেছেন যে, যে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করবে সে সম্মানিত হবে। আর যে নাফরমানি করবে সে লাঞ্ছিত হবে। সুতরাং জানতে হবে যে, আমাদের ইজ্জত-সম্মান নেকীর কাজের সাথে সম্পৃক্ত, না-কি পাপের সাথে সম্পৃক্ত। কেননা যতটা সৎ জীবন-যাপন করবেন ততবেশি সম্মানিত হবেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীর নিকট আপনার ইজ্জত-সম্মান স্থায়ী করে দিবেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন সকলকে হেফাযত করুন।

ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আল্লাহ তা‘আলা যা মনোনীত করেছেন এবং তার নে‘মতকে পরিপূর্ণ করেছেন। এমন পরিপূর্ণ দ্বীন, যেখানে কোন ঘাটতি নেই। এমন শক্তিশালী দ্বীন, যা কখনো দুর্বল হবার নয়। এমন সুরক্ষিত দ্বীন, যা কোনদিন ধ্বংস হবার নয়, নিশ্চিহ্ন হবার নয়। তবে ইসলামের ইতিহাসে বহু উত্থান-পতন হয়েছে আর ভবিষ্যতেও হবে। বালা-মুছিবত আসবে যার মাধ্যমে সত্যবাদীদেরকে চেনা যাবে তাদের ধৈর্য এবং দৃঢ়তার মাধ্যমে আর যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে চেনা যাবে দুর্দিনে। ইসলামের নিদর্শনাবলী ও দ্বীনের বিধি-বিধানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, এটি একটি মহান দ্বীন। যার আদর্শ, সুন্নাত এবং ফরয সুপ্রতিষ্ঠিত।

হে প্রিয় মুসলিম ভাইগণ! যে আল্লাহ তা‘আলাকে চিনবে তার জীবনটা সুখ-শান্তিতে ভরে যাবে এবং তার থেকে সৃষ্টির সকল ভয় দূরীভূত হবে। জান্নাতের সবচেয়ে সর্টকাট রাস্তা হচ্ছে অন্তরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। অতএব অন্তরকে পরিষ্কার রাখুন, জান্নাতের রাস্তা সহজ হয়ে যাবে। আর অন্তর ততক্ষণ পর্যন্ত সুস্থ ও ছহীহ-সালামত থাকবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তরকে তাওহীদ পরিপন্থী বিষয়গুলো থেকে নিরাপদ রাখা না যাবে। আর সবচেয়ে বড় তাওহীদ পরিপন্থী বিষয় হচ্ছে শিরক এবং কুফর। তাই অন্তরকে শিরকমুক্ত ও কুফরমুক্ত করুন এবং সুন্নাহ বিরোধী কাজ বিদ‘আত থেকে মুক্ত করুন। সাথে সাথে মানুষের কুপ্রবৃত্তি, যা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ বিরোধী তা থেকে অন্তরকে পাক-পবিত্র করান। এতদ্ব্যতীত যে উদাসীনতা, গাফলতি আল্লাহর যিকির-আযকারে বাধা প্রদান করে তা থেকেও অন্তরকে মুক্ত করুন। এছাড়ও মনের এমন খারাপ চাহিদা থেকে অন্তরকে পবিত্র করুন, যা মানুষের নিষ্ঠা, ইখলাছ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি থেকে দূরে রাখে।

হে আল্লাহর বান্দা! রিযিক নিয়ে কখনো চিন্তা করবেন না। রিযিক বণ্টিত বিষয়, আল্লাহ তা‘আলা তা বণ্টন করে দিয়েছেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কখনো বিচলিত হবেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত তাক্বদীরের ফায়ছালাই হচ্ছে চিরসত্য। সুতরাং এ বিষয়ে কখনো ঘাবড়াবেন না।

অন্তরকে সর্বদা তিনটি খারাপ দোষ থেকে পবিত্র করুন।  ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং লোক দেখানো কাজ। অন্তরকে তিনটি ভালো বৈশিষ্ট্য দিয়ে সুসজ্জিত করুন। সততা, ইখলাছ (নিষ্ঠা) এবং আল্লাহভীরুতা। তিনটি ক্ষেত্রে নিজেকে সুরক্ষা করুন। আল্লাহ তা‘আলার সামনে আত্মসমর্পন করুন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্ভেজাল অনুসরণ করুন এবং সুখে-দুঃখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।

মনে রাখবেন, দু’টি এমন বস্তু রয়েছে যা ক্ষণস্থায়ী, স্থায়ী নয়। যৌবন এবং শক্তিমত্তা। দু’টি এমন জিনিস রয়েছে, যা মানুষের জন্য উপকারী। উদারতা এবং উত্তম চরিত্র। দু’টি এমন বস্তু রয়েছে, যা মানুষকে উপরে উঠিয়ে দেয়, সম্মানিত করে। বিনয়ী হওয়া এবং মানুষের পাশে দাঁড়ান। দু’টি এমন বস্তু রয়েছে, যা বালা-মুছিবতকে দূর করে। ছাদাক্বাহ করা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বহাল রাখা।

মানুষের অন্তরের বিদ্বেষ ও শত্রুতা দূর করার এবং অন্তরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক হল- নম্রতার সাথে কথা বলা, মানুষের চোখের আড়ালে তার জন্য দু‘আ করা এবং নিজের ধন-সম্পদ ব্যয় করে সমবেদনা জ্ঞাপন করা। দুস্থ-অসহায়দের পাশে দাঁড়ান এবং তাদেরকে শারীরিক-মানসিক সহযোগিতা করা।

হে আল্লাহর বান্দারা! মানুষের উপকার করলে ভালবাসা পাওয়া যায়। কষ্ট দিলে বিদ্বেষ-শত্রুতা ছড়ায়। মানুষের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করলে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের সাথে একমত হওয়ার চেষ্টা করলে ভালবাসা ও সম্প্রীতি যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সততা ও আস্থাকে ফিরিয়ে আনা যায়। মিথ্যাচারিতা মানুষের মধ্যে অপবাদ সৃষ্টি করে এবং উত্তম চরিত্র মানুষের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি করে। আর বদ চরিত্র ঘৃণা সৃষ্টি করে। যদি আপনি চান যে, আমি লোকজনের সাথে ভালভাবে চলাফেরা করব, ভাল সম্পর্ক রাখব, তাহলে আপনি চরিত্রবান হয়ে যান। নরম ভাষায় কথা বলুন। লৌকিকতা বর্জন করুন এবং মানুষের সাথে মিশুক হওয়ার চেষ্টা করুন। বিরোধিতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। জেনে রাখুন!  (আল্লাহ তা‘আলা আপনাদেরকে হেফাযত করেন) কুপ্রবৃত্তি জ্ঞানী মানুষকেও প্রতারিত করে এবং সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। আর শত্রুতা মানুষকে হিতাকাক্সক্ষী হওয়া, সুবিচার করা থেকে বাধা প্রদান করে এবং বক্র পথে পরিচালিত করে। যে ব্যক্তি বন্ধু-বান্ধবের সাথে সততার আচরণ করবে, সে ব্যক্তি মানুষের যেসব ওযর, অজুহাত রয়েছে সেগুলো সাদরে গ্রহণ করবে। দোষত্রুটিকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে এবং ভুলত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে।

মানুষ প্রশংসা ভালবাসে। সুতরাং কারো বৈধ প্রশংসা করতে কৃপণতা করবেন না। তবে মুনাফিকী থেকে সাবধান। কারো মিথ্যা প্রশংসা করবেন না। যদি কোন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি আপনার কাছে আসে, তাহলে তার কথা মনোযোগী হয়ে শুনুন। যদি কেউ আপনার কাছে ভুল স্বীকার করে, তাহলে তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখুন। যদি কোন অভাবী মানুষ আপনার কাছে আসে, তাহলে তার জন্য আপনি ব্যয় করুন।

হে প্রিয় ভাইয়েরা! যদি ‘সোস্যাল মিডিয়ার ফিতনা’ থেকে এবং তা নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। কারণ, যারাই এই সোস্যাল মিডিয়ায় মেতে উঠেছে তাদের অন্তর তাতেই ব্যস্ত থেকেছে এবং দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়গুলো নষ্ট হয়েছে। লাভ কম, ক্ষতি বেশি হয়েছে। সারা দিনরাত ইন্টারনেট নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু আধাঘণ্টা কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত নসীব হয় না। বড়ই দুঃখের বিষয়। মানুষের সমালোচনা করা আর তাতেই ব্যস্ত থাকা, এটি সর্বহারার লক্ষণ। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় তার জীবনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং সে মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে।

সাবধান! যদি মানুষের বেশি বেশি প্রশংসা হয়, তাহলে সেটা আপনাকে অনেক সময় ক্ষতি করবে। মনে রাখবেন, জ্ঞানী হচ্ছে তিন শ্রেণির মানুষ। যে ব্যক্তি দুনিয়া তাকে ছাড়ার আগে সে দুনিয়া ছেড়ে দিল। কবরের প্রবেশ করার আগেই সে কবরের ঘর নির্মাণ করতে পারল অর্থাৎ সেখানে সুখ-শান্তি পাবে তার ব্যবস্থা করতে পারল আর রবের সাথে সাক্ষাতের আগেই রবকে রাজি করতে পারল। সত্যিকার অর্থে সম্মানিত সে ব্যক্তি, যে নিজেকে সম্মানিত মনে করে না। সবচেয়ে বিনয়ী সে ব্যক্তি, যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে না। মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে ব্যক্তি, যে মানুষের বেশি উপকার করতে পারে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন,

فَاَمَّا مَنۡ اَعۡطٰی وَ اتَّقٰی - وَ صَدَّقَ بِالۡحُسۡنٰی  - فَسَنُیَسِّرُہٗ  لِلۡیُسۡرٰی - وَ اَمَّا مَنۡۢ  بَخِلَ وَ اسۡتَغۡنٰی - وَ  کَذَّبَ بِالۡحُسۡنٰی - فَسَنُیَسِّرُہٗ  لِلۡعُسۡرٰی - وَ مَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُ  مَا لُہٗۤ  اِذَا تَرَدّٰی

‘অনন্তর যে দান করে ও মুত্তাক্বী হয়, যা উত্তম তাকে সত্য মনে করল, অচিরেই আমরা তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। পক্ষান্তরে কেউ কার্পণ্য করল ও বেপরওয়া হল। আর উত্তম জিনিসকে মিথ্যা মনে করল, অচিরেই তার জন্য আমরা সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ এবং তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে পতিত হবে জাহান্নামে’ (সূরা আল-লাইল : ৫-১১)।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে কুরআনুল কারীমের আদর্শ দিয়ে এবং নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত দিয়ে উপকৃত হবার তাওফীক্ব দান করেন।

ছানী বা দ্বিতীয় খুত্ববাহ

দ্বিতীয় খুত্ববাহতে সম্মানিত খত্বীব মহোদয় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ছালাত ও সালামের পরে বলেছেন,

হে আল্লাহর বান্দা! কুরআনুল কারীম আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এমন একটি মহাগ্রন্থ ও আসমানী কিতাব, যা আপনার জীবনের হেফাযত করবে। আপনার সৌভাগ্যের বাস্তবায়ন করবে। এ কিতাব আপনার যে মিশন ও ডিউটি তা বিষদভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব রবের ইবাদত করতে থাকুন মৃত্যু আসা পর্যন্ত এবং আপনি আপনার কথা-বার্তায় সংযত হৌন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,وَ قُلۡ لِّعِبَادِیۡ یَقُوۡلُوا الَّتِیۡ  ہِیَ  اَحۡسَنُ ‘আমার বান্দাদেরকে বলে দিন তারা যেন সবচেয়ে ভাল কথা বলে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৫৩)।

আপনার চলাফেরাকে সীমিত করুন। দাম্ভিকতার সাথে পৃথিবীতে চলাফেরা করবেন না। কেননা প্রত্যেক দাম্ভিক, অহংকারীকে আল্লাহ পসন্দ করেন না, ধ্বংস করে দেন। আপনার আওয়াজকে সংযত করুন। আওয়াজকে নিচু করুন। মজলিসের হেফাযত করুন। কারো গীবত করবেন না, কেননা ব্যক্তিজীবনে যেখানে কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নেই। খাদ্য পানীয় আপনি সঠিকভাবে গ্রহণ করুন এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا  تُسۡرِفُوۡا ‘খাও এবং পান কর। তবে সীমালঙ্ঘন কর না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩১)। এ ভাল বৈশিষ্ট্যগুলো নিজের মধ্যে একত্রিত করার চেষ্টা করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন,

وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِہٖ عِلۡمٌ  اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ  کُلُّ  اُولٰٓئِکَ کَانَ عَنۡہُ  مَسۡـُٔوۡلًا

‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছে পড় না। নিশ্চিত কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬)। সুতরাং আল্লাহ আপনাদের উপর রহম করুন। জেনে রাখুন! যদি শুকরিয়া আদায় করা পরিত্যাগ করেন, তাহলে আল্লাহর নে‘মতের বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হবেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, অবশ্যই অবশ্যই আমি বৃদ্ধি করে দিব’ (সূরা ইবরাহীম : ৭)। যে আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হবে আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫২)। যে দু‘আকে পরিত্যাগ করে, আল্লাহর কাছে দু‘আ করে না, সে ব্যক্তি দু‘আ কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, اُدۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ‘আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া বাদ দিবে, সে ব্যক্তি মুক্তিলাভ করতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَ مَا کَانَ اللّٰہُ مُعَذِّبَہُمۡ وَ ہُمۡ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَ ‘যে জাতি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে, সেই জাতিকে আল্লাহ শাস্তি দেন না’ (সূরা আল-আনফাল : ৩৩)।

সুতরাং আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। যদি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে চান, নিজের মুক্তির পথ সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে এই আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنۡ اَبۡصَرَ فَلِنَفۡسِہٖ  وَ مَنۡ عَمِیَ  فَعَلَیۡہَا  ‘যে ব্যক্তি নিজের গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করবে, সে নিজেরই কল্যাণ সাধন করবে। আর যে অন্ধ থাকবে, সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১০৪)। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِہٖ وَ مَنۡ  اَسَآءَ فَعَلَیۡہَا ‘যে সৎ আমল করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ আমল করলে তার প্রতিফল সেই ভোগ করবে’ (সূরা হা-মীম-আসসাজদাহ : ৪৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, مَنِ اہۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَہۡتَدِیۡ لِنَفۡسِہٖ  وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡہَا ‘যারা সৎপথ অবলম্বন করবে তারা তো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য সৎপথ অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে তারা তো পথভ্রষ্ট হবে নিজেদের ধ্বংসের জন্য’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১৫)। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন, وَ مَنۡ یَّبۡخَلۡ  فَاِنَّمَا یَبۡخَلُ عَنۡ نَّفۡسِہٖ  وَ اللّٰہُ الۡغَنِیُّ  وَ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ ‘যারা কার্পণ্য করে তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদেরই প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ یَّکۡسِبۡ اِثۡمًا فَاِنَّمَا یَکۡسِبُہٗ عَلٰی نَفۡسِہٖ  ‘যে ব্যক্তি গুনাহ উপার্জন করবে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই গুনাহ উপার্জন করল’ (সূরা আন-নিসা : ১১১)।

এটি হচ্ছে সত্যিকার কথা। এ হচ্ছে মানুষের দায়িত্বের সীমারেখা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন, کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا کَسَبَتۡ رَہِیۡنَۃٌ ‘প্রত্যেক মানুষ নিজ কৃতকর্মের কাছে দায়বদ্ধ’ (সূরা আল-মুদদাছছির : ৩৮)। প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু করবে তার সাথে সে বাধা থাকবে। কাউকে অন্যের ভুলত্রুটি, ওযর পেশ করতে হবে না। কে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল, কে ভুলপথে চলে গেল, কে জাহান্নামের পথে চলে গেল ইত্যাদি সে সম্পর্কে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন না। কে লাঞ্ছিত হল এবং কে আল্লাহর দ্বীনকে, আল্লাহর দ্বীনের খেদমতকে অসহায় ছেড়ে দিল, সে সম্পর্কেও আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে না। আপনাকে শুধু আপনার সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং আপনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। নিজের আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক্ব, আমল ঠিক করার চেষ্টা করুন এবং মানুষের কল্যাণ করুন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন তাওফীক্ব দান করেন। ছালাত ও সালাম আমাদের প্রিয় নবী, শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহ এবং ইসলামকে যেন সম্মানিত করেন। ইসলাম ও মুসলিমদের ব্যাপারে যারা শত্রুতা করে, ক্ষতি করে আল্লাহ তাদেরকে যেন অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন আমাদের উপর রহম করেন এবং আমাদের গুনাহখাতাগুলো মাফ করে দেন-আমীন!!

* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।




প্রসঙ্গসমূহ »: খুত্ববাতুল হারামাইন
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
মানব জীবনে সফলতার উপায় - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ক্রোধ সংবরণ করার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
উদাসীনতার কুফল এবং এর প্রতিকার - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশসমূহ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
শাসক নির্বাচন ও আনুগত্যের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কোমল ও নম্র আচরণ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ