রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন

সদাচরণ-ই হচ্ছে দ্বীন

-খত্বীব : শায়খ ছালেহ্‌‌ বিন আব্দুল্লাহ্‌‌ বিন হুমাইদ (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*


[গত ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪২ হি. মোতাবেক ০৬ নভেম্বর, ২০২০ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের প্রশংসা এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আমি নিজেকে এবং সকল মানুষকে আল্লাহভীরুতার উপদেশ দিচ্ছি। অতএব আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহ আপনাদের উপর দয়া করবেন। আল্লাহভীরু হচ্ছে সর্বোত্তম পাথেয়। জেনে রাখুন! পৃথিবীর যা ইচ্ছা তাই আপনি নিজের মালিকানাধীন করুন, সব কিছুর আপনি মালিক হয়ে যান। কিন্তু সকলের উপরে একটি সময় অবশ্যই আসবে, যখন যেভাবে খালি হাতে এসেছিলেন সেভাবে চলে যেতে হবে।

মানুষের আসল মূল্য হচ্ছে তার দ্বীন এবং উত্তম চরিত্র। মানুষের মূল্য এই নয় যে, কে কত বড় পোস্টে পৌঁছেছি এবং কে কত বড় উপাধি পেয়েছি। একজন বিনয়ী মানুষ নিজের মান-মর্যাদা সম্পর্কে নিশ্চিত জেনেই সে তার নমনীয়তা প্রকাশ করে। পক্ষান্তরে একজন অহংকারী নিজের দুর্বলতা এবং ত্রুটির কথা জেনেই সে অহংকার প্রদর্শন করে। হে আল্লাহর বান্দা! আপনি যদি কাউকে ঘৃণা করেন, তাহলে আপনার ভদ্রতা হচ্ছে যে, আপনি এমন আচরণ করবেন না যে অন্যরাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। হতে পারে যে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে ত্রুটি রয়েছে। যার ফলে আপনি তাকে ঘৃণা করছেন। সুতরাং মানুষের চরিত্রের বিষয়টি বা মানুষের আচার-আচরণের বিষয়টি স্রষ্টার জন্য। সৃষ্টির বিষয়টি স্রষ্টার জন্য ছেড়ে দিন। আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন তাদের সাথে আচরণ করবেন। সত্যিকার সুখ-শান্তি যদি হাসিল করতে হয়, তাহলে বিদ্বেষমুক্ত অন্তর তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শুভাকাক্সক্ষা রাখতে হবে। কোন কিছুকেই অলক্ষ্মী কুলক্ষণ মনে করলে হবে না এবং সুখ-শান্তি রয়েছে প্রতিনিয়ত এমন বন্ধুত্ব ও ভালবাসার অপেক্ষা করা যাবে না। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন,

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡیِیَنَّہٗ  حَیٰوۃً  طَیِّبَۃً وَ لَنَجۡزِیَنَّہُمۡ اَجۡرَہُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ.

‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কর্ম করবে, তাকে আমরা নিশ্চয় আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করব’ (সূরা আন-নাহল : ৯৭)।

হে মুসলিমগণ! উত্তম চরিত্র মানব জীবন গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত ও স্তম্ভ। উত্তম আচার-আচরণ ও ভাল কাজগুলো করার এবং মন্দ কথা ও কাজ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে মানুষ কল্যাণের দিকে অগ্রগামী হয় এবং সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়।

উত্তম চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যদি তা কোন মানব সমাজে বিদ্যমান থাকে, তাহলে সে সমাজ নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, পরস্পর সহানুভূতি এবং সহযোগিতার সাথে জীবন-যাপন করতে পারবে। এছাড়া এটা এমন গুণ, যা মানুষের ব্যক্তিত্বকে গঠন করে, তার সংকল্পকে শক্তিশালী করে, নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করে, যাবতীয় অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা দেয় এবং মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের পথকে সুগম করে। হে আল্লাহর বান্দারা! মানবিক মূল্যবোধ গঠন এবং উত্তম চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সদাচরণ। মহান আল্লাহ বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ.

‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত; এবং আপনি যদি কর্কশ ভাষী, কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে নিশ্চয় তারা আপনার সংসর্গ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কার্য সম্বন্ধে তাদের সাথে পরামর্শ করুন; অনন্তর যখন আপনি সংকল্প করেন তখন আল্লাহর প্রতি নির্ভর করুন এবং নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নির্ভরশীলগণকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَ قُلۡ لِّعِبَادِیۡ یَقُوۡلُوا الَّتِیۡ  ہِیَ  اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ یَنۡزَغُ بَیۡنَہُمۡ ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ کَانَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوًّا مُّبِیۡنًا ‘আমার বান্দাদেরকে যা উত্তম তা বলতে বল, শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৫৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَ اِذَاۤ  اَرَدۡنَاۤ  اَنۡ نُّہۡلِکَ قَرۡیَۃً  اَمَرۡنَا مُتۡرَفِیۡہَا فَفَسَقُوۡا فِیۡہَا فَحَقَّ عَلَیۡہَا الۡقَوۡلُ  فَدَمَّرۡنٰہَا  تَدۡمِیۡرًا

‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে (সৎকর্ম করতে) আদেশ করি; কিন্তু তারা সেথায় অসৎকর্ম করে; অতঃপর তার প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১৬)।

হে মুসলিমগণ! মুসলিম জাতির চরিত্র ও মূল্যবোধ তাদের দ্বীন এবং আক্বীদা থেকে জন্ম নেয়। তাদের মধ্যে যে ভাল আচরণ এবং মানবিক মূল্যবোধ রয়েছে সেটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং দ্বীন থেকে সৃষ্টি। শরী‘আতের বিধি-বিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল, সেটা হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য হল পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি। হে ভাইয়েরা! এ মানবিক মূল্যবোধ হচ্ছে এমন বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের মধ্যে থাকলে অন্যদের সাথে সে ভাল আচরণ করে থাকে।

ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, كاد الأدب أن يكون ثلثي الدين ‘আদব-কায়দা দ্বীনের দুই-তৃতীয়াংশের সমান’।[১] হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

فإن كثيرا من الناس يظن أن التقوى هي القيام بحق الله دون حقوق عباده وليس الأمر كذلك ، بل الجمع بين حقوق الله وبين حقوق عباده هو المطلوب شرعا ، وهو عزيز لا يقوى عليه إلا الكمل من الأنبياء والصديقين " 

‘অনেক মানুষ ধারণা করে যে, বান্দার হক্ব ছাড়া শুধু আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের হক্ব সম্পাদন করাই আল্লাহভীরুতা। বিষয়টি এমন নয়। বরং শরী‘আতের উদ্দেশ্য হল বান্দা আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের হক্ব আদায় করবে। আর এ রকম মানুষ পাওয়া খুব দুর্লভ ব্যাপার, যারা শুধু পূর্ণতা লাভের দিকে অগ্রসর আম্বিয়া এবং ছিদ্দীকীন ছাড়া’।[২] ইমাম মাহাসেবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দুর্লভ বিষয় হচ্ছে, দ্বীনের সাথে উত্তম চরিত্র গঠন এবং আমানতের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ’।[৩] ইয়াহইয়া ইবনু মা‘আয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

سوء الخلق سيّئة من لا تنفع معها كثرة الحسنات و حسن الخلق حسنة لا تضرّ معها كثرة السيئات

‘বদ চরিত্র এমন একটি অপরাধ, যার সাথে নেকীর আধিক্য কোন কাজে আসবে না। পক্ষান্তরে উত্তম চরিত্র এমন একটি নেকীর কাজ, যার সাথে পাপের আধিক্য কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[৪] হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ فُلَانَةً تُذْكَرُ مِنْ كَثْرَةِ صَلَاتِهَا وَصِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا غَيْرَ أَنَّهَا تُؤْذِيْ جِيْرَانَهَا بِلِسَانِهَا قَالَ هِيَ فِي النَّارِ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَإِنَّ فُلَانَةً تُذْكَرُ قِلَّةَ صِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا وَصَلَاتِهَا وَإِنَّهَا تَصَدَّقُ بِالْأَثْوَارِ مِنَ الْأَقِطِ وَلَا تُؤْذِيْ جِيْرَانَهَا قَالَ هِيَ فِي الْجَنَّةِ

‘জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অমুক মহিলা অধিক ছালাত আদায় করা, ছিয়াম রাখা এবং দান-ছাদাক্বাহ করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে সে মুখের দ্বারা তার প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। লোকটি আবার বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অমুক মহিলা যার সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে কম ছিয়াম পালন করে, দান-ছাদাক্বাও কম করে এবং ছালাতও কম আদায় করে; তার দানের পরিমাণ হল পনীরের টুকরা বিশেষ। কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয় না। তখন তিনি বললেন, সে জান্নাতী’।[৫]

হে আল্লাহর বান্দারা! মানুষ প্রথমেই আপনার ঈমান, ইবাদত এবং ছহীহ আক্বীদা দেখবে না, বরং তারা দেখবে আপনার চরিত্র, আচার-আচরণ কেমন। তাই কুরআন কারীম আপনার বক্ষে সংরক্ষণের আগে তার বিধানবলী আপনার চরিত্র এবং সকল কাজ কর্মের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক্ব দান করুন।

যে কোন মানুষ দ্বীন, দ্বীনের সৎ ভাবনা এবং দ্বীনের যে পূর্ণতা রয়েছে, সে সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে ইসলামের যে উত্তম আদর্শ এবং সত্যিকার মাপকাঠি রয়েছে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত, তা হচ্ছে- উত্তম চরিত্র গঠন। আর তা এভাবে হবে, আপনি নিজের জন্য ভালোবাসেন সেটা অন্যের জন্যও ভালোবাসুন। পরের জন্য তাই পসন্দ করবেন, যা আপনি নিজের জন্য পসন্দ করেন। আপনি নিজের জন্য যেমন সার্বিক কল্যাণ পসন্দ করেন, তেমনি অপরের জন্যও পসন্দ করবেন। আর মানুষের সাথে সে আচরণই করবেন, যে আচরণ আপনি অন্য মানুষ থেকে আশা রাখেন।

যেমন এ মর্মে বেশ কিছু হাদীছ রয়েছে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত। এমন ব্যক্তির মধ্যে দ্বীন কী করে থাকতে পারে যে ব্যক্তি বড়ই ইবাদত-গুজার, ফরয ও নফল ইবাদত করে, ছাদাক্বাহ করে, কিন্তু (অন্যের প্রতি) অত্যাচার করে? অধিনস্তদের বেতন নিয়ে টালবাহানা ও হয়রানী করে। মানুষের হক্ব নষ্ট করে। মানুষকে সম্মান করে তার পোস্ট ও মর্যাদা দেখে। কিন্তু মানুষের যে সত্যিকার অধিকার রয়েছে, সে অধিকারের খেয়াল রাখে না। মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করে। অহংকারের কারণে মানুষকে ছোট মনে করে এবং অন্যদেরকে ছোট করে দেখে। তার মধ্যে দ্বীন কোথায় রয়েছে? স্মরণ করুন! সর্বহারাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মূল্যবান হাদীছ। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা কি জান সবচেয়ে নিঃস্ব মানুষ কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব হল, যার কোন অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِيْ مَنْ يَأْتِي يَوْم الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَي مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِح فِي النَّارِ

‘আমার উম্মতের সবচেয়ে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের নেকী নিয়ে আসবে। আর অভিযোগকারী আসবে এ মর্মে যে, এই ব্যক্তি এই গালি দিয়েছে, এই অপবাদ দিয়েছে, এই অর্থ-সম্পদ ভক্ষণ করেছে, এই রক্ত অন্যায়ভাবে প্রবাহিত করেছে ও এই ব্যক্তিকে মেরেছে। সেদিন তার কোন অর্থ-সম্পদ না থাকায় অভিযোগ পেশকারীদেরকে তার নেকী থেকে প্রদান করা হবে। পরিশোধ হওয়ার পূর্বে তার নেকী শেষ হলে, তাদের পাপ নিয়ে এই ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[৬] আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন-আমীন।

হে মুসলিমগণ! মুসলিম ও মানব সমাজ শক্তিশালী হবে, যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উত্তম চরিত্রের উপর প্রতিপালন করি এবং তাদের সামনে আমরা উত্তম আদর্শ তুলে ধরতে পারি। এজন্য প্রয়োজন নিজেদেরকে উত্তম আদর্শবান হিসাবে গড়ে তুলা। হে মুসলিম ভাইগণ! যখন এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে তাহলে মনে রাখবেন যে, কচিকাচা ছেলে-মেয়েদের প্রতিপালনের প্রথম ক্ষেত্র হবে নিজ বাড়ি। বাড়িটাতে ইসলামিক পরিবেশ থাকতে হবে। উত্তম চরিত্র যেন সেখান থেকে শিখতে পারে। বাবা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকেই যেন মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা পায়। তারপরে মসজিদ, শিক্ষাঙ্গন, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজটা ইসলামী সমাজ হতে হবে। তারা সমাজের লোকজন থেকে ভাল চরিত্র শিখবে। আশেপাশের সঙ্গি-সাথীদের কাছ থেকে শিখবে। মুসলিমদের মিডিয়া, ইসলামিক মিডিয়া হতে হবে, যাতে করে সেখান থেকে ইসলামী মূল্যবোধ শিখতে পারে। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উত্তম চরিত্র গঠন। নেক সন্তান আল্লাহর বড় নে‘মত এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিশেষ অনুগ্রহ। তারা যেন আগামীতে শক্তিশালী হয় সে জন্য আমাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

হে মুসলিমগণ! হে ছেলে-মেয়েদের বাবা-মা! হে ছেলে-মেয়েদের প্রতিপালনকারী! শিক্ষক-শিক্ষিকা! আপনারা কচিকাচা তরুণ-তরুণীদেরকে এই শিক্ষা দেন যে, দ্বীন হচ্ছে পুরোটাই উত্তম চরিত্রের। উত্তম চরিত্র গঠন তখনই হবে যখন দ্বীনের সুরক্ষা করবে। আর দ্বীনের সুরক্ষা বা দ্বীনদার তখনই হতে পারবে, যখন উত্তম চরিত্র গঠন করতে পারবে। অতএব তরুণ-তরুণীদেরকে এমর্মে তারবিয়াত করুন যে, দ্বীন হচ্ছে মুচকি হেসে কথা বলার নাম, খুশি হওয়ার নাম এবং সামনে যারা রয়েছে তাদেরকে খুশি করার নাম। দ্বীন এই নয় যে, আপনি অমুককে গালি দিবেন, ভ্রু-কুঞ্চিত করে থাকবেন। দ্বীন হচ্ছে প্রশান্তি। আর মুচকি হাসা হচ্ছে ছাদাক্বাহ এবং ইবাদত। ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিন যে, মানুষের সাথে যেন হাসিমুখে কথা বলে এবং তাদের কথায় যেন নম্রতা থাকে। ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিন যে, অন্তর তখনই সুস্থ যখন তা হিংসা, শত্রুতা, লোক দেখানো কাজ এবং নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্ত থাকবে। যাতে করে অন্তর হবে সত্যবাদী, সুখী এবং সে অন্তর সকল মানুষকে ভালোবাসবে। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা দিন, ইবাদত শুধু মসজিদে সীমাবদ্ধ নয়। ইবাদত যেমন মসজিদে আদায় করতে হবে, তেমনই রাস্তা-ঘাটেও ইবাদত করতে হবে। যেখানে জনগণের প্রয়োজন পূরণ করা এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা সম্ভব হয়। যখনই কারও সাথে সাক্ষাৎ হবে চিনেন আর না চিনেন, তাদেরকে সালাম দিবেন এবং সালামের উত্তর নিবেন। শুদ্ধ সালাম শেখাবেন। অজ্ঞতাবশত শুদ্ধ সালামের বিরোধিতা করবেন না। আল্লাহ যেন সকল স্তরের মানুষকে এ অজ্ঞতা দূর করার তাওফীক্ব দান করেন-আমীন!!

ইসলামে ইবাদত যেমন মসজিদে রয়েছে, তেমনই অফিস-আদালত ও কর্মক্ষেত্রেও রয়েছে। আপনি যেখানে থাকবেন সেখানকার শৃঙ্খলা মেনে চলবেন। ইসলামের আলোকে সেখানকার যে দিক-নির্দেশনা রয়েছে সেসব মেনে চলবেন। এতদ্ব্যতীত সেখানে যারা আপনার সামনে আসে তাদের নিজেরদের প্রয়োজনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং তাদের সাথে শ্রদ্ধা, সম্মানের সাথে কথা বলবেন। রাস্তাঘাটে ও যানবাহনে চলাফেরার ক্ষেত্রে বড়দের সম্মান প্রদর্শন করবেন, ছোটদের স্নেহ করবেন। যে অসহায়-দুর্বল তার সাথে সহানুভূতির আচরণ করবেন। যে বিপদ-আপদে রয়েছে তাকে সাহায্য করবেন। যে অপারগ তার সহযোগিতা করবেন। হাটে-বাজারে দাঁড়িপাল্লা ঠিক ভাবে কায়েম করবেন এবং মানুষের যথাযথ হক্ব আদায় করবেন। যার যে অধিকার রয়েছে সে অধিকার তাকে দেবেন। ধোঁকাবাজি, প্রতারণা এবং মিথ্যার আশ্রয় নেয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন। ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি সমস্ত বান্দা ও সৃষ্টির হিসাব নিবেন। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে হিসাব নেয়ার জন্য নিযুক্ত করেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَا عَلَیۡکَ مِنۡ  حِسَابِہِمۡ  مِّنۡ شَیۡءٍ  وَّ مَا مِنۡ حِسَابِکَ عَلَیۡہِمۡ  مِّنۡ  شَیۡءٍ فَتَطۡرُدَہُمۡ  فَتَکُوۡنَ  مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ

‘তাদের হিসাব-নিকাশের কোন কিছুর দায়িত্ব আপনার উপর নেই এবং আপনার হিসাব-নিকাশের কোন দায়িত্ব তাদের উপর নেই। এরপরও যদি আপনি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেন, তাবে আপনি যালিমদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবেন’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫২)।

ছেলে-মেয়েদের জন্য সুস্পষ্ট করুন যে, চারিত্রিক দুর্বলতার একটি দিক হচ্ছে, নিজের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে সংশোধন না করে মানুষের দোষ-ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ছেলে-মেয়েদেরকে এই শিক্ষা দিন যে, মানুষের সাথে উদারতা এবং সদ্ব্যবহার দুর্বলতা নয়। বরং সেটি হচ্ছে সাহসী পদক্ষেপ ও বীরত্ব। তাতেই রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। ছেলে-মেয়েদের এ শিক্ষা দিন যে, মানুষ ভুল করলে তাদের ওজর ওযুহাত কবুল করবে। আর ছেলে-মেয়েরা যদি আপনার ভুল ধরিয়ে দেয় সেখানে ভুল স্বীকার করে নিবে। তাদেরকে শেখান যে, ভুল স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে একটি বীরত্ব ও ভদ্রতা এবং এটি হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তির কাজ। তাদেরকে এ শিক্ষা দিন যে, মতপার্থক্য থাকতে পারে, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে ভদ্রতা ও উত্তম চরিত্র রয়েছে, সেটা যেন আমরা উপেক্ষা না করি। আর মনে রাখবেন যে, যার সাথে আমার মতের ভিন্নতা রয়েছে তার মতটি আমার কাছে ভুল হলেও সেটা ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আমারটা ঠিক হলেও সেটি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেমন ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘যেটাকে আপনি ভুল মনে করছেন হতে পারে অন্যের দৃষ্টিতে সেটা ঠিক। এটাও হতে পারে আপনিও ভুলে আছেন। সুতরাং কখনও আপনি গায়ের জোর দেখাবেন না এবং কখনও হঠকারী আচরণ করবেন না। ছেলে-মেয়েদেরকে এই শিক্ষা দিন যে, সকল লোক তাদের মেহনতের পেশায় নিয়োজিত কঠোর পরিশ্রম করে। যারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রিযিকের সন্ধানে পরিশ্রম করে তাদের সাথে যেন নম্র আচরণ করে এবং তাদের জন্য ভাল দু‘আ করে। আল্লাহ যেন তাদের রিযিকের দ্বার প্রশস্ত করেন, তাদেরকে সম্মানজনক কাজ দান করেন, কর্মগুলোকে যেন সহজ করে দেন এবং রিযিকে বরকত দান করেন। আর সম্ভবপর হলে তাদেরকে সাহায্য করতে শেখান এবং তাদেরকে কষ্টের কাজগুলো লাঘব করুন। ছেলে-মেয়েদেরকে এসকল শিক্ষা দেবেন। তাদেরকে এটাও শিক্ষা দিবেন যে, যখন অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে দেখবে। কিংবা কোন হাসপাতাল অতিক্রম করবে, তখন অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা করবে, তাদের আরোগ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করবে। আল্লাহ যেন তাদের বালা-মুছীবত দূর করে দেন। বিপদগ্রস্তের বিপদ আল্লাহ দূর করে দেন। যদি সম্ভব হয় তাদেরকে দেখতে যাবে, সমবেদনা জ্ঞাপন করবে, তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে। এগুলো হচ্ছে উত্তম আচরণ। এগুলোই হচ্ছে সর্বোত্তম ইবাদত।

ছেলে-মেয়েদেরকে প্রতিপালন করুন হাসিমুখে কথা বলার উপর। তাদেরকে পরপোকারী হওয়া, ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা, দানশীলতা, ধৈর্য, দয়া-মায়া, কষ্টকর কাজে অভ্যস্ত হওয়া, অসহায়কে সাহায্য, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, বিরোধ যথাসাধ্য কমানোর এবং আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত অপরিচিতদের সাথে নম্র ভাষায় কথা বলার শিক্ষা দিন। তারা যেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, এই উত্তম চরিত্রগুলো তাদেরকে শিক্ষা দিন। তারা যেন পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় সকলের আদবের প্রতি খেয়াল রাখে, মানুষের সুখে-দুঃখে যত্ম করে, যে কোন স্তরের মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করে, যে কোন সমস্যায় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে, যে কোন বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এবং যে কোন আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নম্র আচরণের চেষ্টা করে। ছেলে-মেয়েদেরকে সময়কে যথাযথ মূল্যায়ন করার শিক্ষা দিন। তারা যেন সময়গুলোকে নষ্ট না করে এবং সময়ের অপচয় না করে। কাজকর্ম যেন সুষ্ঠুভাবে আদায় করে এবং সুষ্ঠু ও পবিত্র জীবন যাপন করে। সোজা পথে চলে, কখনো বক্র পথ অবলম্বন না করে। মেয়েদেরকে পর্দার শিক্ষা দিবেন।

অল্প ও সামান্য কাজ যা স্বর্ণ-রৌপ্যের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে। উত্তম চরিত্র হাশরের মাঠে দাঁড়ি-পাল্লায় অত্যন্ত ভারী হতে পারে। ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিন যে, একজন মানুষ তার উত্তম চরিত্রের কারণে ছিয়াম না রেখে ছিয়ামের ফযীলত পাবে। তাহাজ্জুত না পড়ে তাহাজ্জুতের ফযীলত পাবে, যদি সে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়। হে আল্লাহর বান্দারা! যে কোন সমাজে সুখ-শান্তিতে তখনি বসবাস করতে পারবেন, যখন সে সমাজে উত্তম আচার-আচরণের মাধ্যমে জনগণের মাঝে সম্পর্ক অটুট থাকবে। ইমাম গায্যালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

أَنَّ الْأُلْفَةَ ثَمَرَةُ حُسْنِ الْخُلُقِ وَالتَّفَرُّقَ ثَمَرَةُ سُوْءِ الْخُلُقِ فَحُسْنُ الْخُلُقِ يُوْجِبُ التَّحَابَّ وَالتَّآلُفَ وَالتَّوَافُقَ وَسُوْءُ الْخُلُقِ يُثْمِرُ التَّبَاغُضَ وَالتَّحَاسُدَ وَالتَّدَابُرَ

‘উত্তম চরিত্রের ফলাফল হচ্ছে সম্প্রীতি ভালোবাসা। আর মন্দ চরিত্রের ফলাফল হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। উত্তম চরিত্র ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ঐকমত্যকে অপরিহার্য করে। আর মন্দ চরিত্র পরস্পরে শত্রুতা, হিংসা এবং বিরোধিতা বৃদ্ধি করে’।[৭] ইমাম আবূ হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

حسن الخلق يذيب الخطايا كما تذيب الشمس الجليد زاد بن عَبد العزيز وان الخلق السيء يفسد العمل كما يفسد الخل العسل

‘উত্তম চরিত্র গুনাহগুলোকে গলিয়ে দেয় যেমন সূর্যের তাপ বরফকে গলিয়ে দেয়। আর বদ চরিত্র মানুষের নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয় যেমন সিরকা মধুকে নষ্ট করে দেয়’।

উত্তম চরিত্র ও মানবিক মূল্যবোধ প্রত্যেক মানুষকে কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করে এবং নিজের দায়িত্ব চেতনা সম্পর্কে সজাগ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ  وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ  بِالَّتِیۡ  ہِیَ  اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَہٗ  عَدَاوَۃٌ کَاَنَّہٗ  وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ  -  وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ  اِلَّا الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا ۚ وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ  اِلَّا  ذُوۡحَظٍّ  عَظِیۡمٍ  - وَ اِمَّا یَنۡزَغَنَّکَ مِنَ الشَّیۡطٰنِ نَزۡغٌ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ  ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

‘ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে, আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকে যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকে যারা মহা ভাগ্যবান। যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা আপনাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর আশ্রয় নিবেন। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা হা-মীম-আস-সাজদাহ : ৩৪-৩৬)।

সুতরাং যেটা বেশি উত্তম সেটা দিয়ে মন্দকে দূর করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা শুধু ভাল বলেননি, বেশী ভালর কথা বলেছেন। বেশী ভাল যদি আপনার কাছে থাকে তাহলে আপনি ভালতে যাবেন, মন্দতে যাবেন না। মন্দ দিয়ে মন্দকে কখনও দূর করা সম্ভব হবে না। সুতরাং যদি ভাল আচরণ করেন, তাহলে শত্রু অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে পরিণত হবে। এটা এমন বৈশিষ্ট্য, যা ধৈর্যশীল ছাড়া কেউ অর্জন করতে পারে না।  ধৈর্য না থাকলে কখনই ভাল আচরণ করা সম্ভব নয়। যে আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, তার সাথে ভাল কিছু করবেন এটা অত সহজ বিষয় নয়। ধৈর্যশীল হতে হবে। আর যে ভাগ্যবান সে এই গুণ অর্জন করতে সক্ষম। মন্দ আচরণ করতে শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়, প্ররোচিত করে। অতএব শয়তানকে সুযোগ দেবেন না। শয়তান যদি কুমন্ত্রণা দেয়, তাহলে তার অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন।

ছানী খুত্ববাহ

আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের প্রশংসা, তাঁর তাওহীদের ঘোষণা, নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালাম এবং ছাহাবী, আহলে বায়াত এবং উম্মতের জন্য দু‘আ করে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন,

হে মুসলিমগণ! মানবজাতির যখন চারিত্রিক অধঃপতন ঘটে এবং মানবিক মূল্যবোধ যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মানবজাতি ও তাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়। যে জাতি চরিত্রহীন, ব্যভিচার ও মদে ডুবে আছে। যে জাতি নবী-রাসূলগণের মানহানি করে। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বেয়াদবী করে, তাঁর অবমাননা করে, তাহলে জানতে হবে সে জাতি চরিত্রহীন। সুতরাং সেই জাতির সভ্যতা অচিরেই ধ্বংস হবেই ইনশাআল্লাহ। অত্যাচার, খুন-খারাবি এবং স্বৈরাচারী হয়ে কখনও উন্নতি করা এবং অগ্রগামী হওয়া যায় না। মানুষ যখন অত্যাচার করে, মানুষকে খুন করে এবং স্বৈরাচারী হয়, তখন মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। স্বার্থ হল সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনা। মানুষ যখন ব্যক্তি স্বার্থকে বড় করে দেখে, তখন মানুষের মাঝে আমীত্ব কাজ করে এবং আমীত্বের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফায়ছালা করে থাকে, তখনই মানবজাতির সর্বনাশ হয়।

বর্তমানে পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ খুন, হতাহত এবং আহত হচ্ছে। কত সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। যার মৌলিক কারণ আমিত্ব এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ। যখন মানুষের ধার্মিকতা দুর্বল হয়ে যায় এবং দ্বীনের সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়, তখন তাদের মূল্যবোধ শেষ হয়ে যায় এবং তারা চরিত্রহীন হয়ে যায়। যার ফলে দেখা যায় যে, মানুষ তাঁর মাতা-পিতার অবাধ্য হচ্ছে, মাতা-পিতাকে কষ্ট দিচ্ছে, মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি এবং বেঈমাণী করছে। সময়কে  নষ্ট করছে ও পাপের কাজে সবসময় ডুবে থাকছে। এভাবেই ভদ্রতা ও চরিত্র গঠনের মানসিকতা মানব সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বদ চরিত্র এমন একটি দোষ ও রোগ যে, যাতে মানুষ একেবারে দুনিয়ামুখী, পয়সামুখী এবং স্বার্থমুখী হয়ে যায়। আর এর কারণ হচ্ছে ইলম এবং আমল।

জ্ঞান আর কর্মকাণ্ডের মাঝে এবং ঈমান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। জ্ঞান আছে কিন্তু ঈমান নেই, জ্ঞান আছে কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ নেই। তখনি মানুষের মধ্যে চরিত্রহীনতা পরিলক্ষিত হয়। মূল্যবোধহীন মানুষ বিক্ষিপ্ত জীবন-যাপন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَمَنۡ یَّمۡشِیۡ مُکِبًّا عَلٰی وَجۡہِہٖۤ  اَہۡدٰۤی  اَمَّنۡ  یَّمۡشِیۡ سَوِیًّا عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

‘যে ব্যক্তি উপুড় হয়ে মুখে ভর দিয়ে চলে, সেই কি সঠিক পথপ্রাপ্ত, না-কি সেই ব্যক্তি যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে?’ (সূরা আল-মুলক : ২২)।

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন, কোন জাতি ততদিন পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকবে যতদিন তাদের মধ্যে মানবিক মূলবোধ ও উত্তম চরিত্র রয়েছে। আর সে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, যে জাতির চরিত্র ও মানবিক মুল্যবোধ ধ্বংস হয়ে গেছে। কোন জাতি তাদের ব্রেন-বুদ্ধি, বিদ্যা নেই বা তাদের সংখ্যা কম রয়েছে সেজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে, এমনটা নয়। মানব জাতির ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, মানব জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান না থাকা। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না থাকলে, সেই জাতি ধ্বংস হয়ে যায় এবং সকল রকমের উন্নতি ও অগ্রগতি থেকে বিচ্যুত হয়। আর সেই জাতিই বিজয় লাভ করে থাকে যে জাতি চরিত্রবান। মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাস এটাই প্রমাণিত হয়।

পরিশেষে খত্বীব আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। সকল মুসলিম ও ইসলামের জন্য কল্যাণের এবং নিরাপত্তার দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।
 

* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র : 
[১]. আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ, ছিফাতুছ ছাফওয়া (বৈরূত : দারুল মা‘রেফাহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯ হি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৫।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু সালিম আস-সাফারীনী, গিযাউল আলবাব শারহু মানযূমাতিল আদাব (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪২৩ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৪; ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল-আনছারী, শারহুল আরবা‘ঈন আন-নববী, পৃ. ১৯।
[৩]. গিযাউল আলবাব শারহু মানযূমাতিল আদাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৪।
[৪]. দ্র. আরশীফুল মাজলিসিল ‘ইলমী; www.majles.alukha.net.
[৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৯২৬; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৯০৯৯, সনদ ছহীহ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮১; মিশকাত, হা/৫১২৭।
[৭]. মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ গাযালী, ইহইয়ায়ু ‘উলূমিদ্দীন (বৈরূত : দারুল মা‘রেফাহ, তা.বি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: সুন্নাত আত্মশুদ্ধি
দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
শয়তানের চক্রান্ত এবং তার প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলী - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ফিতনার সময় রাসূূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মানহাজ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নবুওয়তের আলামতসমূহ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশসমূহ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ছহীহ আক্বীদার গুরুত্ব - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ