রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৭:২৩ পূর্বাহ্ন

নেক কাজে অটলতা

-খত্বীব : শায়খ ড. বান্দার বিন আব্দুল আযীয বালীলাহ (হাফিযাহুল্লাহ)
- অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*


[গত  ১৩ যিলহজ্জ, ১৪৪২ হি. মোতাবেক ২৩ জুলাই, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আল্লাহকে ভয় করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন। একথা সর্বদা হৃদয়ে জাগ্রত রাখুন যে, তিনি সবসময় আপনাদেরকে দেখছেন, যাকে মুরাকাবাতুল্লাহ বলা হয়। এছাড়া তাঁর নাফারমানিও করবেন না। জেনে রাখুন যে, তিনিই হচ্ছেন একমাত্র সত্য মা‘বূদ। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَنَّمَاۤ  اِلٰـہُکُمۡ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ فَاسۡتَقِیۡمُوۡۤا اِلَیۡہِ وَ اسۡتَغۡفِرُوۡہُ ؕ وَ وَیۡلٌ  لِّلۡمُشۡرِکِیۡنَ

‘নিঃসন্দেহে তোমাদের মা‘বূদ একমাত্র মা‘বূদ। অতএব তাঁরই পথে অটলতা অবলম্বন কর এবং তারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য’ (সূরা হামিম আস-সিজদাহ : ৬)।

হে মুসলিমগণ! আমরা গোটা বছরের মধ্যে যিলহজ্জ মাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনগুলো অতিক্রম করলাম। সেই সাথে সাথে হজ্জের মোবারক দিনগুলোও পার করলাম। যে গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ দিনগুলো আমাদেরকে বহুমুখী নে‘মত উপহার দিয়েছে এবং আমাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমত আনয়ন করেছে। এ দিনগুলোতে আমরা যে আমলসমূহ করলাম, তার সবকিছু সংরক্ষিত রয়েছে। সুতরাং মুবারকবাদ তাদের জন্য যারা এতে সফলতা লাভ করতে পারল। আর দুর্ভোগ ও আক্ষেপ ঐসব লোকের জন্য, যারা কল্যাণ ও নেকীর পথ থেকে বঞ্চিত থাকল।

মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হল- আমল আমাদেরকে নিয়মিত করে যাওয়া। তাই আমাদেরকে নেকীর কাজে সর্বদা অটল থাকতে হবে। নেকীর কাজ কতই না সুন্দর লাগে যদি নেকীর পর নেকী হতে থাকে, কল্যাণের পর কল্যাণ হতে থাকে, ভালো কাজের পর ভালো কাজ করতে থাকেন। কতই না সুন্দর কতই না চমৎকার হয়, যদি নেক আমলগুলো মানুষ একটির পর একটি সম্পাদন করতে থাকে। এগুলো হচ্ছে আমাদের স্থায়ী সৎকর্ম, যা সবসময় আমাদের সাথে থাকবে। কুরআনুল কারীম যাকে ‘আল-বাকিয়াতুছ ছালিহাত’ বলা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ  رَبِّکَ  ثَوَابًا  وَّ  خَیۡرٌ  اَمَلًا

‘অবশিষ্ট থাকে এমন সৎকর্ম যা আপনার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশাপ্রাপ্তির ব্যাপারে উৎকৃষ্টতর’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৪৬)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও ইরশাদ করেছেন,

وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ رَبِّکَ ثَوَابًا وَّ  خَیۡرٌ  مَّرَدًّا

‘স্থায়ী সৎকর্ম আপনার প্রতিপালকের পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও শ্রেষ্ঠ’ (সূরা মারইয়াম : ৭৬)।

নেক কাজে অটলতা এবং নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া মানবজীবনে কল্যাণের লক্ষণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে যে তাওফীক্ব ও তার পরিচয় এবং তিনি যে ঐ ব্যক্তিকে ও তার নেক আমলকে কবুল করেছেন, তার প্রমাণ হল- ঐ ব্যক্তির নিয়মিত আমল সম্পাদন করে যাওয়া। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,

وَ لَوۡ اَنَّہُمۡ فَعَلُوۡا مَا یُوۡعَظُوۡنَ بِہٖ لَکَانَ خَیۡرًا لَّہُمۡ  وَ اَشَدَّ  تَثۡبِیۡتًا- وَّ اِذًا لَّاٰتَیۡنٰہُمۡ مِّنۡ لَّدُنَّـاۤ اَجۡرًا عَظِیۡمًا- وَّ لَہَدَیۡنٰہُمۡ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا

‘যদি তারা তাদেরকে যা উপদেশ দেয়া হয়েছে তা সম্পাদন করত, তাহলে তা তাদের জন্য অতি উত্তম হত এবং দ্বীনের উপর অটলতার ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় হত, আর এইরকম হলে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে অবশ্যই মহা পুরস্কার দান করতাম এবং অবশ্যই আমরা তাদেরকে সরলপথ প্রদর্শন করতাম’ (সূরা আন-নিসা : ৬৬-৬৮)।

হে আল্লাহর বান্দারা! হেদায়াতের পথ এমন একটি পথ, যা কোন সময়ের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। রাব্বুল আলামীনের ইবাদত-বন্দেগী কোন একটি স্থান বা কালের সাথে সীমিত নয়। প্রখ্যাত তাবেঈ, ইমাম হাসান আল-বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, إنَّ اللهَ لَمْ يَجْعَلْ لِعَمَلِ الْمُؤْمِنِيْنَ أَجَلًا دُوْنَ الْمَوْتِ ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনের আমলের সময়সীমা মৃত্যুর আগে রাখেননি’। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে এমন কোন সময়সীমা নেই, যেখানে মানুষের বা মুমিনের আমল শেষ হয়ে যায়। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন,

وَ اعۡبُدۡ رَبَّکَ حَتّٰی یَاۡتِیَکَ الۡیَقِیۡنُ

‘আর আপনার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত আপনি আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করুন’ (সূরা আল-হিজর : ৯৯)। [১]

নেকীর ময়দান অত্যন্ত প্রশস্ত ময়দান। বিভিন্ন নেক আমল যেমন ছালাত, ছিয়াম, ওমরাহ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দান-ছাদাক্বাহ, যাকাত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফরয হিসাবে যতগুলো ইবাদত বন্দেগী শরী‘আতে প্রণয়ন করেছেন এবং তার পাশাপাশি প্রত্যেকটি নেকীর ক্ষেত্রে নফল হিসাবে সাব্যস্ত শারঈ ইবাদতসমূহ। যাতে করে বান্দা বেশি বেশি নেকী ও ছাওয়াব অর্জন করতে পারে এবং তার পরিণাম হয় অতি উত্তম।

হাদীছে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে আমার কোন বন্ধুকে শত্রু ভাবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমি আমার বান্দার উপর যা ফরয করেছি শুধু তা দ্বারা কেউ নৈকট্য লাভ করতে পারবে না; বরং আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে সর্বদা আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে। অবশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শুনে, আমি তার চোখ হযে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে ধরে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে এবং যখন সে আমার নিকট কিছু চায় আমি তাকে তা দেই। যদি সে আমার আশ্রয় চায়, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেয়। আর আমি যা করতে চাই তা করতে দ্বিধা করি না। তবে মুমিনের রূহ কবয করতে ইতস্তত করি। সে মরণকে অপসন্দ করে, আর আমি তাকে অসন্তুষ্ট করতে (বেঁচে থাকা) অপসন্দ করি। যদিও মৃত্যু তার জন্য আবশ্যক।[২]

নেক আমল নিয়মিত করে যাওয়া এবং তার উপর অটলতা যরূরী। আল্লাহ তা‘আলা যতটুকু ফরয করেছেন সেটা পালন করা আবশ্যক, করতেই হবে। কিন্তু নফলের ক্ষেত্রে নেক আমলগুলো নিয়মিত করে যাওয়া যদিও তা অল্প-স্বল্প হোক বা তার পরিমাণ কম হোক না কেন। এই অল্প আমলই এমন অনেক বেশি পরিমাণ নেক আমলের চেয়ে ভালো, যা অল্প সময়ের জন্য করা হয় কিংবা ছেড়ে দেয়া হয়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ سُئِلَ النَّبِىُّ ﷺ أَىُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হল- ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কোন্ আমল অধিক প্রিয়’? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘যে আমল স্থায়ী হয়ে থাকে যদিও পরিমাণে কম হোক না কেন’।[৩] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَلْقَمَةَ قَالَ سَأَلْتُ أُمَّ الْمُؤْمِنِيْنَ عَائِشَةَ قُلْتُ يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِيْنَ كَيْفَ كَانَ عَمَلُ النَّبِىِّ ﷺ هَلْ كَانَ يَخُصُّ شَيْئًا مِنَ الْأَيَّامِ قَالَتْ لَا  كَانَ عَمَلُهُ دِيْمَةً وَأَيُّكُمْ يَسْتَطِيْعُ مَا كَانَ النَّبِىُّ ﷺ يَسْتَطِيْعُ

প্রখ্যাত তাবেঈ আলক্বামা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমল কেমন ছিল? তিনি কি কোন ইবাদতের জন্য কোন দিন নির্দিষ্ট করতেন? তিনি বললেন, না। তাঁর আমল ছিল সার্বক্ষণিক ও নিয়মিত। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা করতে পারতেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তা করতে পারবে’?[৪]

উক্ত হাদীছে স্পষ্ট হয় যে, আলক্বামা (রাহিমাহুল্লাহ) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিয়মিত বা দৈনন্দিন আমল কেমন ছিল, তা জানতে চেয়েছেন। অর্থাৎ বিশেষ কোন দিনকে বিশেষ আমলের জন্য তিনি খাছ করে নিতেন কিনা, যে দিনগুলোতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ইবাদত-বন্দেগী করবেন আর সারা দিন-রাত করবেন এমনটা করতেন কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছিলেন, তিনি এমনটা করতেন না যে, বিশেষ বিশেষ দিনে ও রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে যাচ্ছেন আর মাঝে মধ্যে তেমনটা করছেন না। তার যে আমল হত সেটা স্থায়ী হত। আর তিনি সেগুলো কঠোর পরিশ্রমের সাথে পালন করতেন।

হাফেয ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, أن الأولى في العبادة القصد والملازمة لا المبالغة المفضية إلى الترك ‘ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা এবং সেটাকে আঁকড়ে ধরে নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া উত্তম। এক্ষেত্রে এমন সীমালঙ্ঘন বা বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয় যে, তা পরিত্যাগ করে ফেললেন’।[৫] অর্থাৎ এমন কঠোর পরিশ্রম করে ইবাদত-বন্দেগী করা, যার ফলে বিরক্তি চলে আসে কিংবা একঘেঁয়েমি চলে আসে, এমনটা যেন না নয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে সকল রকম নেক আমল নিয়মিতভাবে করার তাওফীক্ব দান করেন এবং সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করেন। এছাড়া আল্লাহ আমাদেরকে যখন মৃত্যু দান করবেন, তখন আমাদের উপর যেন সন্তুষ্ট থাকেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে যেন বারাকাহ দান করেন এবং নবী কারীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ দিয়ে আমাদেরকে যেন ইহকাল ও পরকালে লাভবান করেন।            

দ্বিতীয় খুতবাহ

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে খত্বীব মহোদয় বলেন,

হে মুমিনগণ! হে হাজী ছাহেবগণ! আপনারা হজ্জ থেকে বিভিন্ন মহত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে ফিরে এসেছেন। এই পবিত্র হজ্জ আল্লাহ তা‘আলা ফরয করেছেন। নিঃসন্দেহে হজ্জের মধ্যে বায়তুল্লায় হজ্জের ময়দানে যে তাওহীদ ফুটে ওঠে তার বাস্তব শিক্ষা পেয়েছেন। সুতরাং হজ্জ থেকে ফিরে যাওয়ার পরে এবং হজ্জের অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত-বন্দেগী করবেন না। আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহ্বান করবেন না, অন্যকে ডাকবেন না। ইয়া গাউছ, ইয়া খাজা, ইয়া আলী, ইয়া হুসাইন প্রভৃতি করবেন না এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘর ছাড়া অন্য স্থানের কোন ঘরের ত্বাওয়াফ করবেন না। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য যবহ করবেন না।

হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন তাহল- নেকীর কাজে ধৈর্যধারণ করা, অটলতা অবলম্বন করা এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। শয়তানের যে জাল পাতানো রয়েছে, সেই জালে ফেঁসে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আপনাদেরকে আরো নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, সবসময় নেক আমল করতে থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোর উপর অটল থাকবেন এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন সেগুলো থেকে দূরে থাকবেন। মহান আল্লাহ তাঁর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, 

فَاسۡتَقِمۡ کَمَاۤ  اُمِرۡتَ

‘হে নবী! আপনাকে যেভাবে আদেশ করা হয়েছে ঐভাবে অটল থাকুন’ (সূরা হূদ : ১১২)।  অর্থাৎ নিজের খেয়াল-খুশিমত নেক আমল করলে চলবে না। এখানে এটাও বলা হয়েছে যে, দ্বীনের উপর অটলতা, ভালো ও নেকীর কাজ-কর্মে অটল থাকা, পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অটলতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে کَمَاۤ  اُمِرۡتَ ‘সেটা পালন করতে হবে যেমন আপনি আদিষ্ট হয়েছেন’। অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অহীতে যেভাবে আদেশ করেছেন এবং যে দ্বীন নাযিল করেছেন, সেই দ্বীনের উপর আপনি অটল থাকুন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ سُفْيَانَ بْنِ عَبْدِ اللهِ الثَّقَفِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قُلْ لِىْ فِى الْإِسْلَامِ قَوْلًا لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ وَفِىْ حَدِيْثِ أَبِىْ أُسَامَةَ  رَضِىَ اللهُ عَنْهُ غَيْرَكَ قَالَ ﷺ قُلْ آمَنْتُ بِاللهِ فَاسْتَقِمْ

সুফিয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ আছ-ছাক্বাফী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলে দিন, যাতে উক্ত বিষয়ে আপনার পরে আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে না হয়’। অন্যত্র আবূ উসামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে এসেছে, ‘আপনি ব্যতীত’। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তুমি বল, আমি আল্লাহ্র উপর ঈমান এনেছি। অতঃপর এর উপর দৃঢ় থাক’।[৬]

ছাহাবী সুফিয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ ছাক্বাফী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে ইসলামের এমন কিছু জানতে চাইলেন, যেটা তিনি শক্ত করে ধরে থাকলে তার জন্য ইহকাল-পরকালে কল্যাণের জন্য যথেষ্ট হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাত্র দু’টি বাক্য ও দু’টি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তুমি একথা বল, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে এসেছি অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একত্বের স্বীকৃতি দান করেছি, মেনে নিয়েছি। তারপরে তুমি এর উপর অটল ও অবিচল থাক। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ ثَوْبَانَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ اِسْتَقِيْمُوْا وَلَنْ تُحْصُوْا

ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা যথাযথভাবে দ্বীনের উপর অবিচল থাকবে। কিন্তু কখনোই তোমরা তা যথাযথভাবে করতে পারবে না।[৭]

উক্ত হাদীছ থেকে স্পষ্ট হয় যে, শরী‘আতের নির্দেশনা হল- তোমরা দ্বীনের উপর দৃঢ়তা অবলম্বন কর। নেকীর কাজে অটল থাক, সোজা চল ও অবিচল থাক। আর তোমরা সবকিছুর সংরক্ষণ করতে পারবে না। যদি মনে কর যে সবকিছু করে ফেলব, তাহলে সেটা সম্ভব নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেছেন, أعظم الكرامة لزوم الاستقامة ‘সবচেয়ে বড় মর্যাদা এবং সম্মান হচ্ছে নেকীর কাজে অটলতাকে ধরে রাখা’।[৮]

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে কামনা করুন তিনি যেন আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, আমাদের নেক আমলগুলো কবুল করেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে হেদায়াতের আশা রাখুন তিনি যেন দ্বীনের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল রাখেন। যেমনটি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, তুমি বল, اَللهم اهْدِنِيْ وَسَدِّدْنِيْ ‘(হে আলী! তুমি বল) হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হেদায়াত করুন এবং সঠিক পথে আমাকে প্রতিষ্ঠিত রাখুন’।[৯]

পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। অতঃপর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য দু‘আ করার মাধ্যমে জুমু‘আর খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।

* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৪১৮।
[২]. ছহীহ বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত, হা/২২৬৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী হা/৬৪৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৩; মিশকাত, হা/১২৪২।
[৪]. ছহীহ বুখারী হা/৬৪৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৩।
[৫]. ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭১ ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৮; মিশকাত, হা/১৫। 
[৭]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৯০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৪৮৯; ইবনু মাজাহ, হা/২৭৭; দারেমী, হা/৬৫৫; মিশকাত, হা/২৯২, সনদ ছহীহ।
[৮]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, আল-মুসতাদরাকু ‘আলা মাজমূঈল ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম (১ম সংস্করণ, ১৪১৮ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৫; মিশকাত, হা/২৪৮৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: খুত্ববাতুল হারামাইন
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
হৃদয়ের আমলসমূহ ও তার সুস্থতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নবুওয়তের আলামতসমূহ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ফিতনার সময় রাসূূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মানহাজ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
শয়তানের চক্রান্ত এবং তার প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশসমূহ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ