রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ন

তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ

-খত্বীব : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ‘আউওয়াদ আল-জুহানী (হাফি.)
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*


[গত ২০ জুমাদিউল উলা, ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, আমি আপনাদেরকে ও নিজেকে আল্লাহভীরুতার এবং ইবাদত একমাত্র তাঁর জন্য সুনির্দিষ্ট করার এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অছীয়ত করছি। তাঁর ইবাদত করুন, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবেন না। আপনারা দ্বীন ইসলামকে আঁকড়ে ধরুন এবং তার উপর অটলতা অবলম্বন করুন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুত্তাক্বীদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে সম্মানিত ও শক্তিশালী করবেন এবং প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। আর যালিমদেরকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত করবেন।

হে আল্লাহর বান্দারা! যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করে, পরকালে সুখ-শান্তি চাই, তাদের এই পথে অবিচল থাকার জন্য দু’টো বিষয়ে নিজেকে আবদ্ধ রাখবেন। ১. নিজের অন্তরকে কোন কিছু হাসিল করার ক্ষেত্রে আবদ্ধ করা। ২. কোন কিছু থেকে বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে আবদ্ধ রাখা। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে যাতে করে মন না যায় এবং নিজের জবানকে অপকারী কথা থেকে ধরে রাখতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণের উপর নিজেকে আবদ্ধ রাখতে হবে। যার মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি হতে পারে।

এরকমই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সমস্ত গুনাহ ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে এবং ওয়াজিব-ফরয, সুন্নাত, মুস্তাহাব কাজের উপর নিজেকে ধরে রাখতে হবে যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না হয়। এভাবে যদি আপনি নিজের জীবনটাকে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে কয়েদখানা রয়েছে, সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন এবং এমন প্রশস্ত জগতে নিয়ে যেতে পারবেন, যে জগৎ হচ্ছে জান্নাত। আর এই দু’টো ক্ষেত্রে যদি নিজেকে ধরে রাখতে না পারেন ও নিজের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করেন, তাহলে এমন এক বন্দীশালা অপেক্ষা করছে, যার নাম জাহান্নাম।

হে মুসলিমগণ! বান্দার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমত হচ্ছে যে, তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্যবিহীন ছেড়ে দেননি। বরং তাদের জন্য নূর নাযিল করেছেন। যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ হেদায়াতপ্রাপ্ত হতে পারে । এবং তাদেরকে শক্তি সামর্থ্য ও হাতিয়ার দিয়েছেন যা দিয়ে মোকাবিলা করতে পারে। এজন্য রাসূলগণকে যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন সুসংবাদ দেয়ার ও সতর্ক করার জন্য। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে আকড়ে ধরার, তাঁর কাছে সাহায্য কামনা করার এবং তাক্বওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যার মাধ্যমে আপনি প্রতিটি অনিষ্টকে প্রতিহত করতে পারেন।

তাক্বওয়া হচ্ছে এমন একটি অনুভূতি, যেটি মুমিনের অন্তরে তৈরি হয়ে থাকে; যার ফলাফল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর প্রকাশ পায়। যার সুপ্রভাব পড়বে গোটা শরীরে উপর। এ তাক্বওয়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে যে অশেষ নে‘মত রয়েছে তা হাসিলের জন্য উৎসাহিত করবে এবং আমল করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করবে, আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে ভয় পাবে। সুতরাং আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণমূলক কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে।

তাক্বওয়া হচ্ছে অকাট্য ঈমানের নাম এবং মানুষের মনের শক্তি। সত্যিকার অর্থে তার যদি সেই শক্তি থাকে, তাহলে কখনো গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা ওয়াজীব-ফরয করা হয়েছে, তাতে কখনো অলসতা করতে পারে না। সত্যিই যদি মুমিন ব্যক্তির অন্তরে তাক্বওয়া থাকে, তাহলে সে সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত ও অবিচল থাকবে এবং সঠিক পথের অনুসরণ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী নে‘মত পূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত সৃষ্টিজগতকে তাক্বওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে মুমিনদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, وَ لَقَدۡ وَصَّیۡنَا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ اِیَّاکُمۡ اَنِ اتَّقُوا اللّٰہَ ‘আমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে (কিতাব প্রাপ্তদেরকে) নির্দেশ প্রদান করেছিলাম যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’ (সূরা আন-নিসা : ১৩১)।

ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, কুরআনে কারীমে যতগুলো আয়াত রয়েছে এই আয়াতটি সবগুলো আয়াতের উপর চাকির মত। কারণ সমস্ত আয়াত এর উপরই ঘুরপাক খায়। অর্থাৎ যেকোন কল্যাণ ইহকালে বা পরকালে, নগদ বা আগামী দিনে হোক যদি কেউ হাসিল করতে চাই, চাই সেটা বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ হোক না কেন তা হলে তাকে অবশ্যই তাক্বওয়া অর্জন করতে হবে। কেননা তাক্বওয়াই সার্বিক কল্যাণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং সার্বিক কল্যাণের ওছীলা হতে পারে। এমন কোন অনিষ্ট নেই যা ইহকালের বা পরকালের, প্রকাশ্যে অথবা গোপনে হোক তা যদি তাক্বওয়ার ভিত্তিতে না হয় তাহলে শেষে সে অনিষ্টের সম্মুখীন হতে পারে। আর যদি তাক্বওয়া থাকে তাহলে সমস্ত অনিষ্ট থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে, সুরক্ষিত দূর্গে ছহীহ-সালামতে জীবন-যাপন করতে পারবে এবং সব রকমের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে।

তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহ ভীতি সহকারে ও পাওয়ার আশা নিয়ে তাঁর ইবাদত করা, আদেশ পালন করা এবং নিষেধ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে তাক্বওয়ার কথা ২৫০ বার উল্লেখ করেছেন। এমনকি তিনি এক আয়াতে দুইবার তিনবার করেও তাক্বওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ  وَ لۡتَنۡظُرۡ  نَفۡسٌ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٍ ۚ وَ اتَّقُوا  اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  خَبِیۡرٌۢ   بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, আগামীকালের (ক্বিয়ামতের) জন্য সে কী পাঠিয়েছে। আর আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত’ (সূরা আল-হাশর : ১৮)। মহান আল্লাহ বলেন,

لَیۡسَ عَلَی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ جُنَاحٌ فِیۡمَا طَعِمُوۡۤا اِذَا مَا اتَّقَوۡا وَّ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ثُمَّ اتَّقَوۡا وَّ اٰمَنُوۡا ثُمَّ اتَّقَوۡا وَّ اَحۡسَنُوۡا ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

‘যারা ঈমান আনে ও ভাল কাজ করে, এরূপ লোকদের উপর তাতে কোন গুনাহ নেই যা তারা পানাহার করেছে, যখন তারা আল্লাহর ভয় করে এবং ঈমান আনে ও ভাল কাজ করে, পুনঃ আল্লাহকে ভয় করতে থাকে এবং ঈমান আনে, পুনঃ আল্লাহকে ভয় করতে থাকে ও ভাল কাজ করতে থাকে; বস্তুত আল্লাহ এরূপ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন’ (সূরা আল-মায়িদা : ৯৩)।

তাক্বওয়া হচ্ছে রাসূলগণের উত্তম আদর্শ, যার উপর তাঁরা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা নিজ উম্মতকে এই তাক্বওয়ার অছীয়ত করেছেন। যেমন, নূহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, 

کَذَّبَتۡ  قَوۡمُ  نُوۡحِۣ الۡمُرۡسَلِیۡنَ  .  اِذۡ قَالَ لَہُمۡ اَخُوۡہُمۡ نُوۡحٌ اَلَا تَتَّقُوۡنَ  

‘নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায় রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না?’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ১০৫-১০৮)।

হূদ (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, 

کَذَّبَتۡ  عَادُۨ    الۡمُرۡسَلِیۡنَ  .  اِذۡ  قَالَ لَہُمۡ  اَخُوۡہُمۡ ہُوۡدٌ  اَلَا تَتَّقُوۡنَ 

‘আদ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন তাদের ভাই হূদ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না?’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ১২৩-১২৬)।

ছালিহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

کَذَّبَتۡ ثَمُوۡدُ  الۡمُرۡسَلِیۡنَ .  اِذۡ قَالَ لَہُمۡ اَخُوۡہُمۡ صٰلِحٌ  اَلَا تَتَّقُوۡنَ 

‘ছামূদ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন তাদের ভাই ছালিহ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না?’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ১৪১-১৪৪)।

লূত্ব (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 کَذَّبَتۡ قَوۡمُ  لُوۡطِۣ الۡمُرۡسَلِیۡنَ .  اِذۡ قَالَ لَہُمۡ اَخُوۡہُمۡ لُوۡطٌ اَلَا تَتَّقُوۡنَ 

‘লূত্ব সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন তাদের ভাই লূত্ব (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না?’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ১৪১-১৪৪)।

শু‘আইব (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

کَذَّبَ اَصۡحٰبُ  لۡـَٔـیۡکَۃِ  الۡمُرۡسَلِیۡنَ . اِذۡ   قَالَ لَہُمۡ شُعَیۡبٌ  اَلَا  تَتَّقُوۡنَ 

‘আয়কাবাসীরা (মাদইয়ানের অধিবাসী) রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন শু‘আইব (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না?’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ১৭৬-১৭৯)।

যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখি যে, শরী‘আতের যে বিধি-বিধানগুলো এসেছে তাতে তাক্বওয়ার বিষয়টি আমরা সর্বপ্রথম সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাব এবং তাক্বওয়া দিয়েই মানুষকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাক্বওয়ার ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে যে, এই শরী‘আতের বিধি-বিধানগুলো পালন করতে পারলে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। এরমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সূদ। মহান আল্লাহ সূদকে হারাম করে বলেন,یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَذَرُوۡا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তবে সূদের মধ্যে যা বকেয়া রয়েছে তা বর্জন কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৮)।

তাক্বওয়া হচ্ছে প্রতিটি নোংরামি এবং পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বেড়ি। এর মাধ্যমে মানুষ প্রতিটি পাপ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয়স্থল। মহান আল্লাহ বলেন,اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا  اِذَا مَسَّہُمۡ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیۡطٰنِ تَذَکَّرُوۡا فَاِذَا ہُمۡ مُّبۡصِرُوۡنَ ‘যারা মুত্তাক্বী, শয়তান যখন তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়ে খারাপ কাজে নিমগ্ন করে, সাথে সাথে তারা আত্মসচেতন হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের (জ্ঞান) চক্ষু খুলে যায়’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২০১)।

দুনিয়ায় কোন ব্যক্তি যদি তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে, তাহলে তা আকাশ এবং যমীনের বরকতকে টেনে নিয়ে আসে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ لَوۡ اَنَّ  اَہۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا  وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡہِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ  کَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰہُمۡ بِمَا  کَانُوۡا  یَکۡسِبُوۡنَ

‘জনপদের অধিবাসীগণ যদি ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বার খুলে দিতাম; কিন্তু তারা নবী-রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, ফলে তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৯৬)।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন ভয়ংকর দিবস পরকালে সৃষ্টিজগতকে একত্রিত করবেন, সেখানে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে অথবা জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এমন এক মহা দিবস, মহা সংকটের দিবস যেই দিন শিশুরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে এবং প্রতিটি মানুষ নিজের ভাই, মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন থেকে পলায়ন করবে। সেইদিন মুত্তাক্বীদেরকে স্বসম্মানে নিয়ে যাওয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ سِیۡقَ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا رَبَّہُمۡ  اِلَی الۡجَنَّۃِ زُمَرًا ؕحَتّٰۤی  اِذَا جَآءُوۡہَا وَ فُتِحَتۡ اَبۡوَابُہَا وَ قَالَ لَہُمۡ خَزَنَتُہَا سَلٰمٌ عَلَیۡکُمۡ طِبۡتُمۡ فَادۡخُلُوۡہَا خٰلِدِیۡنَ

‘যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে ও এর দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের দারোয়ানরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখী হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য’ (সূরা আয-যুমার : ৭৩)।

তাক্বওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবনে শেষ সময়ে বেশি বেশি তাক্বওয়ার উপদেশ দিতেন এবং নেতৃত্বস্থানীয়দের কথা শুনতে বলতেন এবং তাদের আনুগত্য করতে বলতেন। যেমন ইরবায ইবনু সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) একদা বললেন,

أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَّكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وأَبُوْ دَاوُدَ وَالترْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهَ إِلَّا أَنَّهُمَا لَمْ يَذْكُرَا الصَّلَاةَ

‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির এবং আমীরের আদেশ শুনতে ও মানতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলামও হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্তর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টিসমূহ হতে দূরে থাকবে। কেননা দ্বীনের ব্যাপারে নতুন সৃষ্টি হল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই হল ভ্রষ্টতা।[১]

ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, ‘এই দু’টো বাক্যে (তাক্বওয়া এবং শোনা ও মানা) ইহকাল বা পরকালের সার্বিক সৌভাগ্য ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাক্বওয়া হল পরকালের সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম। আর শাসকদের বৈধ কাজ শোনা ও মানার মধ্যে রয়েছে ইহকালের কল্যাণ। এর মাধ্যমে মানুষ সুখে শান্তিতে জীবন-যাপন করবে। এর মাধ্যমে দ্বীনকে প্রকাশ্যে পালন, নিরাপদ চলাফেরা, ইবাদত বন্দেগী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ করতে পারবে’।[২]

সুতরাং হে মুসলিমগণ! আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন যে, তাক্বওয়া হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পোশাক যার মাধ্যমে একজন মুসলিম সুসজ্জিত হতে পারে এবং সবচেয়ে উত্তম সম্বল যে সম্বল গ্রহণ করে পরকালে সুখী হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ‘তাক্বওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২৬)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ‘তোমরা পাথেয় সঞ্চয় করে নাও; বস্তুত নিশ্চিত উৎকৃষ্টতম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৭)।

ইমাম বাকাল মুজানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন ‘ফিতনাতুন ইবনিল আশ‘আছ’ বিরাজ করছিল তখন ইমাম তালক ইবনু হাবিব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন, ‘তোমরা এই ফিতনা থেকে তাক্বওয়ার মাধ্যমে বেঁচে থাক। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তাক্বওয়া আবার কী? তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে নেকীর আশায় তাঁর পক্ষ থেকে নূরের আলোকে তাঁর আনুগত্যমূলক আমল করা এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ে তাঁর পক্ষ থেকে নূরের আলোকে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ পরিত্যাগ করা’।[৩]

ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বওয়া আমল ছাড়া হতে পারে না। আর আমল হয় না ইলম হাসিল এবং ইত্তেবাহ ছাড়া। আর সেটা ইখলাছ ছাড়া কোন উপকার হবে না। একথা বলা মোটেও উচিত হবে না যে, অমুক ব্যক্তি গুনাহ পরিত্যাগ করেছে ফিক্বার আলোকে। বরং গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে গুনাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে আল্লাহ ভয়ে; জনপ্রিয়তার জন্য নয়। সুতরাং সর্বদা এই গুণ যদি কেউ হাসিল করতে পারে, তাহলে সে সফল হতে পারবে’।[৪]

জনৈক ব্যক্তি ইমাম মায়মূন ইবনু মেহরানকে বলেন, হে আবূ আইয়ূব! মানুষেরা ততদিন পর্যন্ত কল্যাণে জীবন-যাপন করবে, যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ আপনাকে রেখেছেন। তখন তিনি বললেন, তোমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দাও। ততদিন পর্যন্ত মানবজাতি কল্যাণে থাকবে যতদিন পর্যন্ত তারা তাদের রবকে ভয় করবে।[৫]  

হে আল্লাহর বান্দারা! নিজের জীবনের, পরিবারের, ধনসম্পদের, ছেলে-মেয়েদের, আচার-আচরণে, চলাফেরাতে, আপনার অধীনে যারা রয়েছে, মুসলিমদের জনকল্যাণমূলক কাজে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাক্বওয়া অনুযায়ী আমল করুন। তাহলে সফলতা লাভ করতে পারবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰہِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا  ہُمۡ  یَحۡزَنُوۡنَ . الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا  وَ کَانُوۡا  یَتَّقُوۡنَ . لَہُمُ الۡبُشۡرٰی فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ لَا  تَبۡدِیۡلَ  لِکَلِمٰتِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ  ہُوَ  الۡفَوۡزُ  الۡعَظِیۡمُ

‘মনে রেখো যে, আল্লাহর অলীদের না কোন ভয় আছে, আর না তারা বিষণ্ণ হবে। তারা (অলীরা) হচ্ছে সেই লোক যারা ঈমান এনেছে এবং (আল্লাহকে) ভয় করেছে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে পার্থিব জীবনে এবং পরকালেও; আল্লাহর কথায় কোন পরিবর্তন হয় না; এটা হচ্ছে বিরাট সফলতা’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪)।

দ্বিতীয় খুত্ববাহ

মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর সম্মানিত খত্বীব বলেছেন,

আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে তাক্বওয়া এবং দ্বীন ইসলামকে আঁকড়ে ধরার উপদেশ দিচ্ছি। দ্বীন ইসলামের বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করুন এবং এর মাধ্যমে হেদায়াত হাসিল করুন। ইসলামের যেসব কল্যাণমূলক ভালোকাজ রয়েছে সেগুলো দিয়ে নিজেকে সুসজ্জিত করুন। দ্বীন ইসলামের নিষিদ্ধ সীমানা অতিক্রম করবেন না। কারণ উম্মত ততক্ষণ পর্যন্ত সফলতা লাভ করতে পারবে না, সম্মানিত হতে পারবে না, উম্মতের জন্য সাহায্য নেমে আসবে না, আল্লাহর পক্ষ থেকে শক্তি-সামর্থ্য পাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বীন ও ইসলামকে আঁকড়ে না ধরবে। আর ক্বিয়ামতের দিনে মুক্তি পাবে না, জান্নাত লাভে ধন্য হতে পারবে না, যদি তাক্বওয়া না থাকে। তাক্বওয়া ছাড়া ইহকাল-পরকালের কোন কল্যাণই লাভ করতে পারবে না। তাক্বওয়া হচ্ছে মুমিনের ইহজগতে হাতিয়ার এবং পরকালে রবের সাথে সাক্ষাতের সর্বোত্তম সম্বল। তাক্বওয়ার মাধ্যমেই দুনিয়া এবং আখিরাতে সমস্ত বালা-মুছীবত থেকে নাজাত হাসিল হতে পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই বাঁচাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ করবে, আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।

অতঃপর খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি উপর দরূদ পাঠ করেন। ছাহাবীদের মর্যাদা বর্ণনা করেন এবং মুসলিম উম্মার জন্য দু‘আ করার মাধ্যমে খুত্ববা শেষ করেন।


* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬।  
[২]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামিঊল ঊলূমি ওয়াল হাকামি ফী শারহি খমসীনা হাদীছান মিন জাওয়ামিঈল কালাম (দারুস সালাম, ১৪২৪ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৬৭।  
[৩]. আবূ নাঈম আল-আছবাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘আরাবী, ১৩৯৪ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৪।  
[৪]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দির রহমান, মাওসূ‘আতু মাওয়াক্বিফুস সালাফ ফিল ‘আক্বীদাতি ওয়াল মানহাজ ওয়াত তারবিয়াতি (কায়রো : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০৫।  
[৫]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৮।  





প্রসঙ্গসমূহ »: খুত্ববাতুল হারামাইন
মানব জীবনে সফলতার উপায় - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
কোমল ও নম্র আচরণ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সদাচরণ-ই হচ্ছে দ্বীন - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ছহীহ আক্বীদার গুরুত্ব - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
যালিমের পতন ও মযলুমের বিজয় অবধারিত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলী - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
শয়তানের চক্রান্ত এবং তার প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আরাফাহর খুৎবাহ - অনুবাদ : ড. মুহাম্মাদ মানজুরে এলাহী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ