রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৬:০৯ পূর্বাহ্ন

 ইসলামী শরী‘আহর সৌন্দর্য

- খত্বীব : শায়খ ওসামা বিন আব্দুল্লাহ আল-খাইয়াত্ব (হাফিযাহুল্লাহ)
- অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*



[৮ যিলক্বদ ১৪৪২ হি. ১৮ জুন, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ, ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন,
হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে ভয় করুন এবং তাঁর সামনে দণ্ডায়মান হতে হবে কথাকে সর্বদা স্মরণ করুন। এমন এক দিবসে, যেদিন কারো কোন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কাজে আসবে না। তবে যে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে পারবে সুস্থ অন্তর নিয়ে এবং সকল রকমের পাপাচার থেকে মুক্ত অন্তর নিয়ে, সেই কেবল প্রত্যাবর্তন দিবসের জন্য উত্তম পাথেয় গ্রহণ করুন। যাতে করে পার্থিবজগৎ আপনাকে প্রতারিত করতে না পারে এবং আল্লাহ সম্পর্কে মহা প্রতারক শয়তান যেন ধোঁকায় না ফেলে রাখে।

হে আল্লাহর বান্দারা! যারা জ্ঞানী এবং নিষ্ঠাবান, তাদের সঠিক আদর্শ হচ্ছে যে, মানব জাতির উপর মহান আল্লাহর যে অসংখ্য নে‘মত রয়েছে তারা সব সময় তা স্মরণ করবে এবং তা স্মরণে উৎসাহিত করবে। আল্লাহ তা‘আলা নিষ্ঠাবান ও জ্ঞানী বান্দাদেরকে সম্মানিত করেছেন, ঈমানের জ্যোতি দিয়ে তাদের অন্তরকে জীবিত করেছেন, তাদের অন্তরকে ইয়াক্বীনের মাধ্যমে শীতল করেছেন এবং সেই সত্যের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যা রাসূলগণ যুগে যুগে নিয়ে এসেছেন। তাদেরকে হেদায়াতের জ্যোতিসমূহ ঢেকে রেখেছে। সুতরাং তারা সব সময় পথভ্রষ্টদের সকল রকমের ভ্রষ্টতাকে দেখতে পায় এবং তাদের অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে ওয়াকিফাল থাকে, যে সমস্ত অজ্ঞতা, গোমরাহী এবং পথভ্রষ্টতায় তারা নিমজ্জিত। এমন গোমরাহী, যা থেকে মুক্তির কোন পথ নেই, সেই অন্ধকার থেকে নিস্তারের কোন সুযোগ-সুবিধা নেই এবং তার কু-পরিণাম থেকে মুক্তির কোন রাস্তাও নেই। মহান আল্লাহ বলেন,

اَوَ مَنۡ کَانَ مَیۡتًا فَاَحۡیَیۡنٰہُ وَ جَعَلۡنَا لَہٗ نُوۡرًا یَّمۡشِیۡ بِہٖ فِی النَّاسِ کَمَنۡ مَّثَلُہٗ فِی الظُّلُمٰتِ لَیۡسَ بِخَارِجٍ مِّنۡہَا ؕ کَذٰلِکَ زُیِّنَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ

‘যে ব্যক্তি মৃত ছিল, যাকে আমরা পরে জীবিত করেছি এবং যাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলোক দিয়েছি, সে ব্যক্তি কি ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেখান থেকে আর বের হবার নয়? এভাবেই কাফেরদের জন্য তাদের কাজগুলোকে শোভন করে দেয়া হয়েছে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১২২)।

আল্লাহর নিষ্ঠাবান এবং জ্ঞানী বান্দারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডাকে সাড়া দেয়া, তাঁর শরী‘আতের অনুসরণ করা এবং সকল পথভ্রষ্টদের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে সতর্ক-সাবধান থাকা আবশ্যক। আর সেটি যারা নিষ্ঠাবান ও জ্ঞানী, তাদের ভাগ্যেই জুটে এবং তাদের জন্য তা ফরয। যেমন আল্লাহ তা‘আলা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন,ثُمَّ جَعَلۡنٰکَ عَلٰی شَرِیۡعَۃٍ  مِّنَ الۡاَمۡرِ فَاتَّبِعۡہَا وَ لَا تَتَّبِعۡ  اَہۡوَآءَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ‘তারপর আমরা আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ বিধানের উপর; কাজেই আপনি তার অনুসরণ করুন। আর যারা জানে না তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না’ (সূরা আল-জাছিয়াহ : ১৮)।

এটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, এই দ্বীন পূর্ণাঙ্গ, বড়ই মর্যাদাপূর্ণ এবং একনিষ্ঠ। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এবং তাঁর নিখুঁত, নির্ভেজাল অনুসারীদেরকে এই ইসলামী শরী‘আহর উপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। আল্লাহ আমাদের সর্বদা সে দলে শামিল করে রাখুন এবং তার ওপর অটল থাকার তাওফীক্ব দান করুন। যেমন ইমাম ইবনু কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) এ বিষয়ে বলছেন, ‘দ্বীন ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান, মানুষের ভাষা এই পূর্ণতা প্রকাশ করতে পারে না। জ্ঞানীরা এ পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের চেয়ে ভাল ও সুন্দর জীবনব্যবস্থা প্রস্তাব করতে পারে না; যদিও সবচাইতে বেশি জ্ঞানী ব্যক্তিরা এ মর্মে একত্রিত হয়। পূর্ণ জ্ঞানীর জন্যই এটাই যথেষ্ট যে, দ্বীন ইসলামের সৌন্দর্য অনুধাবন করবে এবং তার মহত্বের সাক্ষ্য প্রদান করবে। আর সে নিশ্চিত বিশ্বাস করবে যে, ইসলামী শরী‘আহর চেয়ে কোন পূর্ণ এবং সুন্দর বিধান দেখেনি।

এই শরী‘আতই হচ্ছে তার সাক্ষ্য, যার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে অকাট্য দলীল। যদিও এর ওপর রাসূলগণ কোন দলীল না নিয়ে আসে। ইসলামী শরী‘আহ যে আল্লাহর পক্ষ থেকে, এ ব্যাপারে শরী‘আহ নিজের দলীল নিজে পেশ করার জন্য যথেষ্ট। পূর্ণ জ্ঞান, পূর্ণ প্রজ্ঞা, ব্যাপক রহমত, সদ্ব্যবহার এবং সদাচারণ প্রতিটিই তার সাক্ষী। এতে রয়েছে জীবনের আরও বহুমুখী দিক। যেমন জ্ঞান, দৃশ্য-অদৃশ্য, মৌলিক বিষয় এবং উত্তম পরিণামের দিক-নির্দেশনা ইত্যাদি। ইসলামী শরী‘আহ বান্দাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অন্যতম নে‘মত যা তিনি বান্দাদেরকে প্রদান করেছেন। এর চেয়ে বড় নে‘মত কাউকে দেয়া হয়নি। তিনি এই দ্বীনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, দ্বীনের অনুসারী হওয়ার তাওফীক্ব দিয়েছেন এবং তাদের জন্য দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। এ কারণে তিনি তার বান্দাদের জন্য এটাকে পথনির্দেশক করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এ মহান নে‘মতের কথা স্মরণ করে দিয়ে বলেন,

لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ  اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ

‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে জ্ঞাত করেছেন এবং তাদের উপর তাঁর মহান নে‘মত স্মরণ করে দিয়েছেন। তাদেরকে শুকরিয়া আদায়ের জন্য আহ্বান করছেন, যাতে তারা শুকরিয়া আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম’ (সূরা আল-মায়েদা : ৩)।[১]

একটু চিন্তা করে দেখুন! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পূর্ণাঙ্গ  দ্বীনের গুণ কিভাবে বর্ণনা করছেন? এটি এমন এক নে‘মত, যা তিনি পরিপূর্ণ করেছেন। এটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, দ্বীন ইসলামে কোন রকমের ঘাটতি, দোষ-ত্রুটি এবং গোলযোগ নেই। ইসলামের কোন বিধান কোন দিক থেকে প্রজ্ঞা ও হেকমতের পরিপন্থী নয়। বরং ইসলাম হচ্ছে তার সৌন্দর্য মহত্ত্বের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ। দ্বীনকে পরিপূর্ণ নে‘মত বলে আখ্যায়িত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই দ্বীন যেহেতু পরিপূর্ণ, সুতরাং তা স্থায়ী হবে এবং সর্বদা থাকবে যা কখনও আল্লাহর যমীন থেকে মুছে যাবে না। যদি কেউ এ দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা ছিনিয়ে নেবেন না এবং এ নে‘মতকে কেড়ে নেবেন না। তিনি ইহজগতে এবং পরজগতে সর্বদা এই নে‘মতকে পরিপূর্ণ রাখবেন। দুনিয়াতে যারা দ্বীনের সুরক্ষা করবে, তাদের কাছে তা স্থায়ী থাকবে। অনুরূপ মৃত্যুর পরেও সর্বদা এই দ্বীন কাজে আসবে।

হে আল্লাহর বান্দারা! এই দ্বীনের চেয়ে মূল্যবান কোন বস্তু আর আছে কি? মানুষের রব, যিনি প্রজ্ঞাবান, সর্বজ্ঞ, সবকিছু জানেন, সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, তিনিই মানবজাতির জন্য এ দ্বীন মনোনীত করেছেন এবং তাঁর নিকট পৌঁছার জন্য রাস্তা বাতলিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভ এবং সুউচ্চ জান্নাতে পৌঁছার জন্য উত্তম ব্যবস্থা হিসাবে এই দ্বীন দান করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দ্বীনকে এই উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যম বানিয়েছেন। এই দ্বীনের মাধ্যমেই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মত শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে এবং তিনি এই উম্মতকে শক্তিশালী করেছেন। উবাহ ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

بَشِّرْ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِالسَّنَاءِ وَالرِّفْعَةِ وَالدِّيْنِ وَالنَّصْرِ وَالتَّمْكِيْنِ فِى الْأَرْضِ فَمَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ عَمَلَ الْآخِرَةِ لِلدُّنْيَا لَمْ يَكُنْ لَهُ فِى الْآخِرَةِ نَصِيْبٌ

‘এ উম্মতকে তাদের প্রশংসার, পৃথিবীতে শক্তিশালী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, দ্বীনের ক্ষেত্রে সুউচ্চতার এবং সাহায্যের সুসংবাদ দিয়ে দাও। কেউ যদি দুনিয়ার স্বার্থে আখেরাতের আমল করে, তাহলে পরকালে তার কোন অংশ নেই’।[২]  

হে আল্লাহর বান্দারা! যারা জ্ঞানী মানুষ, তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের মাধ্যমে বান্দাদেরকে যে দিকে আহ্বান করেছেন, তার দিকে ছুটে আসবে এবং দৌড় দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারা রবের ডাকে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডাকে সাড়া দিবে। কারণ এটি এমন একটি ডাক ও আহ্বান, যে আহ্বানে সাড়া দিলে মানবজাতির অন্তর সঞ্জিবিত হয়।  মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰہِ وَ لِلرَّسُوۡلِ  اِذَا دَعَاکُمۡ  لِمَا یُحۡیِیۡکُمۡ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ یَحُوۡلُ بَیۡنَ الۡمَرۡءِ وَ قَلۡبِہٖ  وَ اَنَّہٗۤ   اِلَیۡہِ  تُحۡشَرُوۡنَ

‘হে ঈমানদারগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে, তখন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দেবে এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয় তাঁরই দিকে তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে’ (সূরা আল-আনফাল : ২৪)।

ছানী খুত্ববাহ

হাম্দ ও ছানার পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন,

হে আল্লাহর বান্দারা! মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে ইসলামী শরী‘আকে পরিপূর্ণ করা হয়েছে। এই শরী‘আর সৌন্দর্য হল মিল্লাতে হানিফিয়্যাহ তথা একনিষ্ঠ দ্বীন। এই শরী‘আতের সৌন্দর্যের অসংখ্য দিক রয়েছে, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শরী‘আতের মাধ্যমে যেমন আত্মার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন, তেমনি মানবজীবনের জান, মাল ও ধন-সম্পদ, মানুষের মস্তিষ্ক, বিবেক, ইয্যত-আবরু, মর্যাদা ও সম্মান ইত্যাদির সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি শরী‘আত বহির্ভূত হত্যা হারাম করেছেন। যেনা ব্যভিচারের মাধ্যমে যে কারো ইয্যত-আবরু নষ্ট করা হারাম করেছেন। তিনি নিষেধ করেছেন এমন কিছু গ্রহণ করা ও সেবন করা, যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটায়। অর্থাৎ এমন কিছু মাদক ও নেশাদ্রব যা মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে এবং যাতে মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে থাকে না। তিনি অন্যের ধন-সম্পদ বাতিলপন্থায় অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা হারাম করেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্টিচিত্তে কেউ তা না খাওয়াবে বা না দিবে। অপরের কোন ধন-সম্পদ অন্যের জন্য হালাল নয়। সূদ, ঘুষ, বেইমানী, আত্মসাৎ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বা অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রহণ ও ভক্ষণ করাকে হারাম করেছেন।

এগুলো সংক্ষেপে ইসলামের সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেগুলোকে ফিক্বহের ভাষায় ‘আয-যরূুরিয়াতুল খামছ’  পাঁচটি এমন মৌলিক বিষয়, যে বিষয়গুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা ইসলাম দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন, মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য, মস্তিষ্ক-বিবেক, ধন-সম্পদ, ইজ্জত-আবরুর ইত্যাদির হেফাযত করার জন্য প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বহুমুখী বিধি-বিধান দিয়েছেন।

ইসলাম সমস্ত মানুষ তথা মুসলিম-অমুসলিম, আরব-অনারব, সাদা-কাল, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সবার মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এ শিক্ষা দিয়েছে। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন আল্লাহভীরুতাকে। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ  مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ  اَکۡرَمَکُمۡ  عِنۡدَ اللّٰہِ  اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ

‘হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাক্বওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।

আল্লাহ তা‘আলা শরী‘আর মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের অধিকারের সুরক্ষা দিয়েছেন এবং প্রত্যেক মানুষের দায়-দায়িত্ব সুস্পষ্ট করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের বিপরীত এমন কোন বিধান পৃথিবীতে নেই, যে বিধান মানুষের অধিকারের সুরক্ষা দিতে পারে এবং দুর্বলতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। ইসলাম মানুষের মর্যাদাকে উন্নীত করেছে এবং মানুষকে সম্মান দান করেছে।

এ কারণে সত্যিকারের মুমিন-মুসলিম এ বিষয়ে কোন সন্দেহ রাখবে না যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাযিলকৃত শরী‘আত, বিধান, দ্বীন এবং তাঁর যে রাস্তা তথা ছিরাতে মুস্তাক্বীম হচ্ছে মুক্তির মাধ্যম ও পথ। ইহকাল-পরকালে সৌভাগ্যের মাধ্যম। পক্ষান্তরে যারা তাঁর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, এড়িয়ে যাবে, বিরুদ্ধাচরণ করবে, ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিমুখ হবে, তাঁর নাযিলকৃত বিধান ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে দিক-নির্দেশনা এবং সৌভাগ্য খুঁজবে, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ  اَعۡمٰی   - قَالَ رَبِّ  لِمَ حَشَرۡتَنِیۡۤ  اَعۡمٰی وَ قَدۡ کُنۡتُ  بَصِیۡرًا  - قَالَ  کَذٰلِکَ اَتَتۡکَ اٰیٰتُنَا فَنَسِیۡتَہَا ۚ  وَکَذٰلِکَ  الۡیَوۡمَ  تُنۡسٰی

‘যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমরা তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান! তিনি বলবেন, এই রূপই আমাদের নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল; কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে’ (সূরা ত্বো-হা : ১২৪-১২৬)।

যে আল্লাহ তা‘আলার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবনটা হবে অশান্তির, সংকুচিত এবং সংকীর্ণ জীবন। এটি শুধু ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা এবং পার্থিব ও ভোগের সামগ্রীর ক্ষেত্রে নয়। বরং পূর্ণাঙ্গ জীবন জুড়েই। ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) এই মর্মে বলেছেন, ‘দুনিয়াতে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, বসবাস, খাদ্য ও ভোগের সামগ্রীর আধিক্য থাকা সত্ত্বেও কোন নিশ্চিন্ততা ও অন্তরে প্রশান্তি নেই। বরং এসব থাকা সত্ত্বেও তার অন্তর অশান্তিতে, বিব্রত এবং সংশয় নিমজ্জিত রয়েছে। সুতরাং সে হাবুডুবু খাচ্ছে সব সময় এই সংশয় আর অশান্তিতে। এটাই হচ্ছে সংকুচিত জীবন’।[৩]  

পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। অতঃপর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও নিরপত্তার জন্য দু‘আ প্রার্থনার মাধ্যমে জুমু‘আর খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।


*সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১] .মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আস-সাহীম, ইসলাম উছূলুহু ওয়া মাবাদুয়ু (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), পৃ. ২০৫।
[২] .মুসনাদে আহমাদ, হা/২১২৫৮; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৭৮৬২, সনদ ছহীহ।
[৩] .ইবনু কাছীর, তাফসীর ইবনু কাছীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩২৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: জুম‘আ ও ঈদ
জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নবুওয়তের আলামতসমূহ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
উদাসীনতার কুফল এবং এর প্রতিকার - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ক্রোধ সংবরণ করার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ছহীহ আক্বীদার গুরুত্ব - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ