সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন
-খত্বীব : শাইখ ড. হুসাইন আলে শায়খ
-অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*
[১৬ মুহাররম ১৪৪২ হি. মোতাবেক ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববাহর বঙ্গানুবাদ]
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর মুহতারাম শায়খ হাদীছ উল্লেখ করে বলেন,
হে মুসলিমগণ! মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তুমি যেখানেই থাক না কেন আল্লাহকে ভয় করবে। কোন কারণে মন্দ কাজ হয়ে গেলে পর পরই ভাল কাজ করবে। কেননা ভাল কাজ পাপকে মিটিয়ে দেয়। আর সদাচরণের মাধ্যমে মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকবে।[১]
উপরিউক্ত হাদীছটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপদেশমূলক হাদীছ যাতে ইসলামের সৌন্দর্য ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুলনীতি বর্ণিত হয়েছে। ইবনু হাজার আল-হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত হাদীছটি শরী‘আতের প্রায় সকল বিধি-বিধানের সমন্বয়কারী। কেউ কেউ এটাকে ‘উম্মুস সুন্নাহ’ বা সুন্নাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ হাদীছের আমল বান্দাকে ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য ও বিজয় এনে দেয়।
প্রথম মূলনীতি
যাবতীয় নির্দেশ পালন ও আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং প্রকাশ্য ও গোপনে সব ধরনের অন্যায় ও পাপ পরিহার করার মাধ্যমে আল্লাহর ভয় ও তাক্বওয়া অবলম্বন নিশ্চিত করা। এটা এমন একটি উপদেশ, যা বান্দাকে সে যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহর সীমা রক্ষা করে চলতে, যাবতীয় পাপকার্য ও হারাম পরিত্যাগে বাধ্য করে রাখে এবং সকল বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ রেখে সরল পথের উপর অবিচল রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اتَّقُوا اللّٰہَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِہٖ وَ الۡاَرۡحَامَ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا ‘তোমরা সেই আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামের অসীলায় তোমরা একে অপরকে তাগাদা কর এবং আত্মীয়তাকেও ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহই তোমাদের তত্ত্বাবধানকারী’ (সূরা আন-নিসা : ১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا تُرۡجَعُوۡنَ فِیۡہِ اِلَی اللّٰہِ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ ‘আর তোমরা সেদিনের ভয় কর যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তারপর প্রত্যেকে যা অর্জন করেছে তা পুরোপুরি প্রদান করা হবে, আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮১)।
ইবনু আব্বাস ও সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, কুরআনের সবশেষে নাযিলকৃত এ আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে উক্ত নাছীহা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اِحْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ ‘তুমি আল্লাহর বিধানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ কর, তাহলে আল্লাহও তোমাকে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন’।[২]
উক্ত মূলনীতির উপর আমলের ফলে মহা সাফল্য ও সম্মানজনক প্রতিদান লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা ছায়া দিবেন নিজের ছায়ায়, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে সেই ব্যক্তি, যাকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী নারী তার দিকে আহ্বান করে, আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি’।[৩]
দ্বিতীয় মূলনীতি
কোন গুনাহের কাজ করে ফেললে পরপরই ভাল ও পুণ্যের কাজ করা। প্রত্যেক যা কিছু দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা যায় তাকেই পুণ্য বা নেকী বলা হয়। এক্ষেত্রে গুনাহ মোচনকারী সবচেয়ে বড় নেকীর কাজ হল ‘সত্যনিষ্ঠ তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা’। আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘যদি কখনো তুমি মন্দ কাজ করে ফেল তার পরপরই তুমি কোন ভাল কাজ কর, তবেই তা মিটে যাবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ পাঠ করা কি ভাল কাজ নয়? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, এটা সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ নেকীর কাজ’।[৪] সৎ আমলের মাধ্যমে পূর্বের গুনাহগুলো মিটে যায়। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّہَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ اِنَّ الۡحَسَنٰتِ یُذۡہِبۡنَ السَّیِّاٰتِ ‘এবং ছালাত প্রতিষ্ঠা করুন দিবসের দু’প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে; নিঃসন্দেহে সৎকার্যাবলী মুছে ফেলে মন্দ কার্যসমূহকে’ (সূরা হূদ : ১১৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,اِنۡ تَجۡتَنِبُوۡا کَبَآئِرَ مَا تُنۡہَوۡنَ عَنۡہُ نُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ نُدۡخِلۡکُمۡ مُّدۡخَلًا کَرِیۡمًا ‘তোমরা যদি সেই মহা পাপসমূহ হতে বিরত হও যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তাহলেই আমরা তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব এবং তোমাদেরকে সম্মান-প্রদ গন্তব্যস্থানে প্রবিষ্ট করাব’ (সূরা আন-নিসা : ৩১)। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুমু‘আহ হতে অপর জুমু‘আহ এবং এক রামাযান হতে অপর রামাযানের মধ্যবর্তী সময়ের কাফ্ফারা স্বরূপ, যখন সে কাবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে’।[৫]
তৃতীয় মূলনীতি
মানুষের সাথে উত্তম আচরণ, ভাল কাজ ও সদ্ব্যবহারের সাথে চলাফেরা করা। এক্ষেত্রে সকলের সাথে সদাচরণ করা, হাসিমুখে কথা বলা, তাদের উপকার করা উচিত এবং তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও দুর্ব্যবহার করা হতে বিরত থাকা। এই মূলনীতির সারকথা হচ্ছে, তুমি যে রকম ভাল কথা, কাজ ও উত্তম আচরণ নিজের জন্য আশা কর, ঠিক তেমনটাই অন্যের জন্যও পসন্দ কর। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের প্রশংসা করে বলেছেন, وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ ‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা আল-ক্বলাম : ৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী মুমিন বান্দা তারাই, যারা সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’।[৬] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিন ব্যক্তি তার ভাল চরিত্রের মাধ্যমে দিনের ছওম পালনকারী ও রাতের ইবাদতকারীর সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে’।[৭]
অতএব হে মুসলিম ভাই! আপনি জীবনে উত্তম চরিত্র ও কোমল আচরণের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করুন। কেননা এটা আল্লাহর নিকটে গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল, বরং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাকে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশকারী অন্যতম আমল হিসাবে গণ্য করেছেন। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বললেন, ‘পুণ্য হল উত্তম চরিত্র, আর পাপ হল তাই, যা তোমার অন্তরে সংশয় তৈরি করে এবং লোকে তা জানুক তা তুমি অপসন্দ কর! [৮] নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করা হয়, সবচেয়ে বেশি কোন্ আমলটি বান্দাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। জবাবে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র’।[৯] আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন, আপনারা এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়ন করুন এবং এগুলোর উপর আমল করে অবিচল থাকুন। তবেই ইহকাল ও পরকালের সফলতা ও মুক্তি পেয়ে ধন্য হবেন।
ছানী খুত্ববাহ
দ্বিতীয় খুত্ববাহতে সম্মানিত খত্বীব আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ছালাত ও সালামের পরে বলেছেন,
হে মুসলিমগণ! আমি নিজেকেসহ আপনাদেরকে আল্লাহভীতির অছিয়ত করছি। অতঃপর পাপ মোচনকারী অন্যতম নেকীর কাজ হল ‘বিভিন্ন উপায়ে মানুষের প্রতি ইহসান করা’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَحۡسِنُوۡا اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ‘আর তোমরা ইহসান কর; নিশ্চয় আল্লাহ মুহসিনদের ভালবাসেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৫)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অমুক মহিলা অধিক ছালাত আদায় করা, ছিয়াম রাখা এবং দান-ছাদাক্বাহ করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে সে মুখের দ্বারা তার প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। লোকটি আবার বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অমুক মহিলা যার সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে কম ছিয়াম পালন করে, দান-ছাদাক্বাও কম করে এবং ছালাতও কম আদায় করে; তার দানের পরিমাণ হল পনীরের টুকরা বিশেষ। কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয় না। তখন তিনি বললেন, সে জান্নাতী।[১০]
পরিশেষে খত্বীব ছাহেব আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ ও ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।
*পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৯২; তিরমিযী, হা/১৯৮৭; দারেমী, হা/২৭৯১; মিশকাত, হা/৫০৮৩, সনদ হাসান।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬৯; তিরমিযী, হা/২৫১৬; মুসতাদরাক হাকেম, হা/৬৩০৩; মিশকাত, হা/৫৩০২, সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩১; তিরমিযী, হা/২৩৯১; মিশকাত, হা/৭০১।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৫২৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৭৩; সনদ হাসান।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৩; মিশকাত, হা/৫৬৪।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৮২; তিরমিযী, হা/১১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩৯৬; মুসতাদরাক হাকেম, হা/১; সনদ হাসান ছহীহ।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪০০; মুসতাদরাক হাকেম, হা/১৯৯; মিশকাত, হা/৫০৮২, সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৬৬৮; মিশকাত, হা/৫০৭৩।
[৯]. তিরমিযী, হা/২০০৪; ; মুসতাদরাক হাকেম, হা/৭৯১৯; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৭৭।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৯২৬; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৯০৯৯; সনদ ছহীহ; মিশকাত, হা/৪৯৯২।
প্রসঙ্গসমূহ »:
খুত্ববাতুল হারামাইন