বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ন
পরকালের জবাবদিহিতা
- খত্বীব : শায়খ ড. আলী বিন আব্দুর রহমান আল হুযায়ফী
- অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*



[গত ১০ রবি. আউয়াল ১৪৪৬ হি. মোতাবেক ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, যথাপোযুক্ত আকৃতি দান করেছেন এবং সবকিছু দয়া ও জ্ঞান দিয়ে পরিবেষ্টন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল ও ক্ষমাশীল। আমি আমার প্রতিপালকের অগণিত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি- আমাদের জানা ও অজানা তাঁর প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব নে‘মতের জন্য। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। তিনি সর্বদাই উত্তম গুণাবলী ও সুন্দর নামের অধিকারী। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও সর্দার মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাকে বিশ্ববাসীর প্রতি প্রেরণ করেছেন রহমতস্বরূপ এবং সুসংবাদবাহক ও সতর্ককারীরূপে, আর আল্লাহর নির্দেশে তাঁর পথে আহবানকারী ও আলোকিত প্রদীপ হিসাবে। হে আল্লাহ! আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তার পরিবার ও ছাহাবাদের প্রতি অগণিত শান্তি, বরকত ও রহমত বর্ষণ করুন।

অতঃপর, আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন তাঁর সন্তুষ্টিমূলক আমল সম্পাদন এবং তাঁর নিষেধকৃত বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। তাহলে তিনি আপনাদের জন্য তাঁর সন্তুষ্টি অবধারিত করবেন এবং আপনাদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রবেশ করাবেন। তিনি বলেছেন,

اِنَّہٗ  مَنۡ یَّاۡتِ رَبَّہٗ  مُجۡرِمًا فَاِنَّ  لَہٗ جَہَنَّمَ ؕ لَا  یَمُوۡتُ  فِیۡہَا وَ  لَا  یَحۡیٰی . وَ مَنۡ یَّاۡتِہٖ مُؤۡمِنًا قَدۡ عَمِلَ الصّٰلِحٰتِ فَاُولٰٓئِکَ  لَہُمُ  الدَّرَجٰتُ  الۡعُلٰی . جَنّٰتُ عَدۡنٍ  تَجۡرِیۡ مِنۡ  تَحۡتِہَا  الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا  مَنۡ  تَزَکّٰی.

‘যে তার রবের নিকট অপরাধী অবস্থায় আসবে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না। আর যারা তাঁর কাছে সৎকর্ম করে মুমিন অবস্থায় আসবে, তাদের জন্যই রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা। স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটা তাদেরই পুরস্কার যারা পরিশুদ্ধ হয়’ (সূরা ত্ব-হা: ৭৪-৭৬)।

হে মানবসকল! মহান আল্লাহ বলেন,

یٰبَنِیۡۤ  اٰدَمَ  اِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ رُسُلٌ مِّنۡکُمۡ یَقُصُّوۡنَ عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِیۡ ۙ فَمَنِ اتَّقٰی وَ اَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ  

‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেন, যারা আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বিবৃত করবেন, তখন যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ৩৫)।

হে আদম সন্তানেরা! নিশ্চয় আল্লাহ আপনাদেরকে এক মহৎ কাজ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যা আসমান ও যমীন বহন করতে অপারগ হয়েছিল এবং তা পালন করতে ভয় পেয়েছিল এই আশঙ্কায় যে, তারা এর অপব্যবহার করার ফলে শাস্তির সম্মুখীন হবে, অথবা তা পালনে ত্রুটি করার কারণে নিন্দিত হবে এবং এ ত্রুটির কারণে আল্লাহর হিসাব ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। জেনে রাখুন, এই মহৎ দায়িত্বটি হচ্ছে নিষ্ঠার সাথে মহান আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহর শরী‘আত অনুসারে পৃথিবীতে সংশোধন করা এবং যুলুম ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ বলেন, مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِہٖ وَ مَنۡ  اَسَآءَ فَعَلَیۡہَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ ‘যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। আর আপনার রব তার বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন’ (সূরা ফুসসিলাত: ৪৬)।

হে আদম সন্তান! আপনার জীবনের শুরু ও শেষের বিষয়গুলো এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনশীল অবস্থাগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করুন। আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ  کَبَدٍ ‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে’ (সূরা আল-বালাদ: ০৪)। মুফাসসিরগণ বলেছেন, আল্লাহ মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সে দুনিয়া ও আখিরাতের কষ্ট ও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। তারপর ধৈর্যশীল ও পরহেজগারদের জন্য রয়েছে অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধি। আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ ও নিষিদ্ধ কামনা-বাসনার পথে চলে, তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اتَّبَعَ  الَّذِیۡنَ  ظَلَمُوۡا مَاۤ اُتۡرِفُوۡا فِیۡہِ وَ کَانُوۡا مُجۡرِمِیۡنَ ‘আর যারা যুলুম করেছে তারা বিলাসিতার পেছনে পড়ে ছিল, আর তারা ছিল অপরাধী’ (সূরা হুদ: ১১৬)।

হে মানুষ! "حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ" (আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক) এটা এমন একটি বাক্য যা নবী (ﷺ) কঠিন পরিস্থিতি, বিপদ ও সংকটের সময় পাঠ করতেন এবং ছাহাবিদেরকে তা বলার পরামর্শ দিতেন। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি এই বাক্যটি পাঠ করেছিলেন।

আল্লাহু আকবার! মানুষ তার পার্থিব জীবনে ও আখিরাতে কতই না বিশাল ও ভয়াবহ সেইসব ঘটনার সম্মুখীন হবে। আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, (আমি যা দেখি তোমরা তা দেখ না, আমি যা শুনি তোমরা তা শুনো না, আকাশ তো চড়চড় শব্দ করছে, আর সে এই শব্দ করার যোগ্য। সেখানে চার আঙ্গুল জায়গাও এমন নেই যেখানে কোন ফেরেশতা কপাল রেখে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করছে না। আল্লাহর কসম, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তবে অবশ্যই তোমরা কম হাসতে, বেশি কাঁদতে এবং বিছানায় স্ত্রীদের উপভোগ করতে না, বাড়ী-ঘর ছেড়ে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়তে, আর আল্লাহর নিকট কাকুতি-মিনতি করতে থাকতে। আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলে উঠলেন, হায়! আমার মন চায় আমি যদি একটি বৃক্ষ হতাম আর তা কেটে ফেলা হতো।[১]

পার্থিব জীবনের পরে প্রত্যেকেই কবরে সওয়াল-জওয়াবের সম্মুখীন হবে। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, (বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তাকে পিছনে রেখে তার সাথীরা চলে যায় এতটুকু দূরে যে, তখনও সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায়, এমন সময় তার কাছে দু’জন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে দেন। এরপর তারা প্রশ্ন করেন, এই ব্যক্তি মুহাম্মদ (ﷺ) সম্পর্কে তুমি কী বলতে? তখন সে মুমীন হলে বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)। তখন তাকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থানের জায়গাটি দেখে নাও, যার পরিবর্তে আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাতে একটি স্থান নির্ধারিত করেছেন। তখন সে দু’টি স্থান একই সময় দেখতে পাবে। আর কাফির ও মুনাফিক্ব হলে বলবে, আমি তো জানিনা, অন্য লোকেরা যা বলতো আমিও তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, না তুমি নিজে জেনেছ, না তেলাওয়াত করে শিখেছ। এরপর তার দুই কানের মধ্যবর্তী স্থানে লোহার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হবে, এতে সে চিৎকার করে উঠবে, মানুষ ও জ্বীন ব্যতীত তার আশেপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে।[২]  

অতঃপর, আল্লাহ মুমিনদের স্থির রাখবেন এবং মুনাফিক্ব ও কাফিরদের বিপথগামী করবেন; তাদের দুনিয়ার স্বীকৃতি কোনো কাজে আসবে না। তারপর আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে প্রশ্ন করবেন: তোমরা তোমাদের উম্মতের কাছে রিসালত পৌঁছে দিয়েছিলে কি না? এই প্রশ্ন নূহ থেকে শুরু করে শেষ নবী মানব সর্দার মুহাম্মাদ (ﷺ) পর্যন্ত সকল নবীকে করা হবে। আল্লাহ বলেন,

فَکَیۡفَ اِذَا جِئۡنَا مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍۭ بِشَہِیۡدٍ وَّ جِئۡنَا بِکَ عَلٰی ہٰۤؤُلَآءِ شَہِیۡدًا . یَوۡمَئِذٍ یَّوَدُّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ عَصَوُا الرَّسُوۡلَ لَوۡ تُسَوّٰی بِہِمُ الۡاَرۡضُ ؕ وَ لَا یَکۡتُمُوۡنَ اللّٰہَ  حَدِیۡثًا.

‘অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর সাক্ষীরূপে? যারা কুফরী করেছে এবং রাসূলের অবাধ্য হয়েছে তারা সেদিন কামনা করবে, যদি তারা মাটির সাথে মিশে যেত। আর তারা আল্লাহর কাছে কোন কথা গোপন করতে পারবে না’ (সূরা আন-নিসা: ৪১-৪২)। তিনি আরো বলেন,

وَ قِفُوۡہُمۡ   اِنَّہُمۡ  مَّسۡئُوۡلُوۡنَ . مَا  لَکُمۡ  لَا  تَنَاصَرُوۡنَ.

‘আর তাদেরকে থামাও, অবশ্যই তারা জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদের কী হল যে, তোমরা একে অন্যের সাহায্য করছ না?’ (সূরা আছ-ছফফাত: ২৪-২৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,

فَلَنَسۡـَٔلَنَّ الَّذِیۡنَ اُرۡسِلَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَنَسۡـَٔلَنَّ  الۡمُرۡسَلِیۡنَ . فَلَنَقُصَّنَّ عَلَیۡہِمۡ بِعِلۡمٍ  وَّ مَا کُنَّا غَآئِبِیۡنَ.

‘অতঃপর যাদের কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছিল অবশ্যই তাদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করব এবং রাসূলগণকেও অবশ্যই আমি জিজ্ঞাসা করব। অতঃপর অবশ্যই আমি তাদের নিকট জ্ঞানের ভিত্তিতে বর্ণনা করব। আর আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম না’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ০৬-০৭)।      

সবশেষে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন; আবূ বারযা’ আল-আসলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ক্বিয়ামত দিবসে কোন বান্দার পা ততক্ষণ পর্যন্ত নড়বে না যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞেস করা হবে: কোন্ কাজে তার জীবন অতিবাহিত করেছে, ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে, তার ধন-সম্পদ কোথা হতে উপার্জন করেছে এবং তা কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার দেহ কোন কাজের মধ্য দিয়ে জীর্ণ করেছে।[৩]

নিশ্চয় সেদিনের হিসাব হবে অত্যন্ত কঠিন এবং এর নিরীক্ষক অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, আর মহান আল্লাহর কাছে কিছুই গোপন নয়, তিনি অন্তরের খবর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। ক্বিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা তার স্থান থেকে সরবে না এবং জান্নাতে যাওয়ার জন্য জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুলসিরাত অতিক্রম করতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়: তার জীবন সম্পর্কে কিভাবে সে তা নিঃশেষ করেছে; দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। যদি স্বীয় রবের নিকট সে সঠিক উত্তর দিতে পারে এবং তার জীবন মাওলার আনুগত্যে অতিবাহিত করে থাকে, তবে কতই না সৌভাগ্যবান সেই আনুগত্যশীল ব্যক্তিরা! মহান আল্লাহ বলেন,

قَالَ اللّٰہُ ہٰذَا یَوۡمُ یَنۡفَعُ الصّٰدِقِیۡنَ صِدۡقُہُمۡ ؕ لَہُمۡ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ   تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ  خٰلِدِیۡنَ  فِیۡہَاۤ  اَبَدًا ؕ رَضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡہُ ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ.

‘আল্লাহ বলবেন, এ সে দিন যেদিন সত্যবাদিগণ তাদের সত্যের জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা’ (সূরা আল-মায়েদা: ১১৯)।

তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তার সম্পদ সম্পর্কে কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কিভাবে তা ব্যয় করেছে? এটি একটি কঠিন প্রশ্ন এবং সে সম্পর্কে উত্তর দেয়া কষ্টসাধ্য; সম্পদের উৎস, এর বন্টন পদ্ধতি ও ব্যয়ের মাধ্যম সম্পর্কে। হালাল সম্পদের কারণে সৎকর্মশীল ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে প্রবেশ করবে, পক্ষান্তরে হারাম সম্পদের কারণে সে তার জীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং তার মৃত্যুর পরে তার উত্তরাধিকারীগণও এর অমঙ্গলের কারণে দুর্ভাগ্যবান হবে।

খাওলাহ আল-আনসারীয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, কিছু লোক আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত।[৪]

সুতরাং সম্পদের দায়িত্বভার কতইনা কঠিন এবং এর অকল্যাণ ও ক্ষতি কতইনা বিশাল ঐ ব্যক্তির জন্য যে তা কুপ্রবৃত্তির পথে ব্যয় করে এবং হক্বদারদেরকে বঞ্চিত করে!

তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তার ইলম সম্পর্কে, ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? ইলম অনুযায়ী আমল করার অর্থ হল, যার প্রয়োজন তাকে শিক্ষা দেয়া, সে অনুযায়ী ভাল কাজের আদেশ করা ও খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা। কাজেই সে ভাল কাজের আদেশ করবে এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। মূলত সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হল মানুষকে সঠিক পথ দেখানো এবং খারাপ বিষয় থেকে নিষেধ করা।

যে ব্যক্তি তার অতীত জীবনের জবাব তৈরিকরণে ত্রুটি করেছে, কিন্তু সবশেষে নিজেকে সংশোধন করেছে ও তাওবা করেছে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন, তাকে স্বীয় রহমতে আবৃত করবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি এ চারটি বিষয়ের উত্তরের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করবে, আল্লাহ তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবেন এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ یَوۡمَ یُحۡشَرُ اَعۡدَآءُ  اللّٰہِ  اِلَی النَّارِ فَہُمۡ  یُوۡزَعُوۡنَ  .حَتّٰۤی  اِذَا مَا جَآءُوۡہَا شَہِدَ عَلَیۡہِمۡ سَمۡعُہُمۡ وَ اَبۡصَارُہُمۡ وَ جُلُوۡدُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ.

‘আর যেদিন আল্লাহর শত্রুদেরকে জাহান্নামের দিকে সমবেত করা হবে, সেদিন তাদেরকে বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে। পরিশেষে যখন তারা জাহান্নামের সন্নিকটে পৌছবে, তখন তাদের কান, চোখ ও ত্বক তাদের বিরুদ্ধে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে’ (সূরা ফুস্সিলাত: ১৯-২০)।

আর যে ব্যক্তি স্বীয় রবের নিকট উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলবে, আল্লাহ তার কাছ থেকে এ চার বিষয়ে সে যা আমল করেছে তার স্বীকৃতি আদায় করবেন, অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,یُنَبَّؤُا الۡاِنۡسَانُ یَوۡمَئِذٍۭ بِمَا قَدَّمَ وَ اَخَّرَ ‘সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে যা সে আগে পাঠিয়েছে ও যা পিছনে রেখে গেছে’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ: ১৩)। তিনি আরো বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الۡاِنۡسَانُ  اِنَّکَ کَادِحٌ  اِلٰی رَبِّکَ کَدۡحًا  فَمُلٰقِیۡہِ  .فَاَمَّا مَنۡ  اُوۡتِیَ  کِتٰبَہٗ  بِیَمِیۡنِہٖ   . فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا  .  وَّ  یَنۡقَلِبُ  اِلٰۤی  اَہۡلِہٖ مَسۡرُوۡرًا  . وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ  کِتٰبَہٗ  وَرَآءَ ظَہۡرِہٖ  . فَسَوۡفَ یَدۡعُوۡا  ثُبُوۡرًا  . وَّ  یَصۡلٰی سَعِیۡرًا  . اِنَّہٗ  کَانَ  فِیۡۤ   اَہۡلِہٖ مَسۡرُوۡرًا.

‘হে মানুষ! তোমাকে রবের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাত লাভ করবে। অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে। তার হিসাব-নিকাশ সহজেই নেয়া হবে। এবং সে তার স্বজনদের কাছে প্রফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে। আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পিছন দিক থেকে দেয়া হবে, সে অবশ্যই তার ধ্বংস ডাকবে; এবং জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। নিশ্চয় সে তার স্বজনদের মধ্যে আনন্দে ছিল’ (সূরা আল-ইনশিকাক: ৬-১৩)।

দ্বিতীয় খুত্ববা

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা, পরম করুণাময় ও বিচার দিনের মালিক। আমি তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন অংশীদার নেই, তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বিশ্বস্ত বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।

অতঃপর, আপনারা যথাযথভাবে আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন এবং দৃঢ় রজ্জুকে মজবুতভাবে ধারণ করুন; কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করে, সে কল্যাণ লাভে ধন্য হয় এবং অকল্যাণ ও ধ্বংস থেকে মুক্তি পায়। মহান আল্লাহ বলেন,

لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ  اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ.

‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’ (সূরা আলে-ইমরান: ১৬৪)। আল্লাহ তাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন, তাই দুনিয়া ও আখেরাতে একজন মুসলিম যে কল্যাণই অর্জন করে, আল্লাহ তা তার মাধ্যমেই সূচনা করেছেন। কাজেই আল্লাহর হক্বের পরই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হক্ব। মহান আল্লাহ বলেন, اَلنَّبِیُّ  اَوۡلٰی بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ مِنۡ اَنۡفُسِہِمۡ وَ اَزۡوَاجُہٗۤ  اُمَّہٰتُہُمۡ ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মা’ (সূরা আল-আহযাব: ৬)। তিনি আরো বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰہِ وَ لِلرَّسُوۡلِ  اِذَا دَعَاکُمۡ  لِمَا یُحۡیِیۡکُمۡ ‘হে ঈমানদারগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে তখন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও’ (সূরা আল-আনফাল: ২৪)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হক্ব হল, তাঁকে ভালোবাসা, তাঁর ভালোবাসাকে সকল কিছুর উপর অগ্রাধিকার দেয়া, তাঁর আদেশ মান্য করা, তাঁর নিষেধ বর্জন করা, তাঁর দেয়া সংবাদকে সত্যায়ন করা এবং একমাত্র তাঁর দেখানো পদ্ধতিতেই আল্লাহর ইবাদত করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশী প্রিয় হই’।[৫]

অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে রূঢ় আচরণের অন্তর্গত হল, ঈদে মিলাদুন্নবীর বিদ‘আত পালনে উদ্যত হওয়া ও ঐ সকল বিদ‘আত পালন করা যার স্বপক্ষে কোন দলীল নেই এবং নবীর সুন্নাত অনুসরণে অবহেলা করা। মহান আল্লাহ বলেন,  قُلۡ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ  رَّحِیۡمٌ ‘বলুন! তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে-ইমরান: ৩১)। মুহাজীর ও আনছারদের পরে এমন কতক সম্প্রদায় এই দুনিয়া ত্যাগ করে চলে গেছেন যারা ঈদে মিলাদুন্নবীর কথা শ্রবণ করেননি। ফলে তারা সুন্নাতের অনুসরণ, সে অনুযায়ী আমল সম্পাদন ও সকল ধরনের বিদ‘আত পরিত্যাগের মাধ্যমে সফলকাম হয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

وَ اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ  وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ.

‘আর এ পথই আমার সরল পথ কাজেই তোমরা এর অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হও’ (সূরা আল-আন‘আম: ১৫৩)।

পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববা সমাপ্ত করেন।



* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।

[১]. তিরমিযী, হা/২৩১২, সনদ হাসান।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৭০।

[৩]. তিরমিযী, হা/২৪১৬, সনদ হাসান।

[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১১৮।

[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫; ছহীহ  মুসলিম, হা/৪৪।




তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
প্রতারণা করা ও ধোঁকা দেয়া হারাম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কোমল ও নম্র আচরণ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
যৌন হয়রানির ভয়াবহতা ও প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ইসলামী শরী‘আহর সৌন্দর্য - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ফিতনার সময় রাসূূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মানহাজ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশসমূহ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
যালিমের পতন ও মযলুমের বিজয় অবধারিত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আল-কুরআন নাজাত লাভের মাধ্যম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী

ফেসবুক পেজ