কোমল ও নম্র আচরণ
-খত্বীব : শায়খ সালাহ বিন মুহাম্মাদ আল বুদাইর (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী*
[গত ১৮ জুমাঃ আখেরা ১৪৪৩ হি. মোতাবেক ২১ জানুয়ারী, ২০২২ তারিখের ‘মসজিদে নববী, মদীনাতুল মুনাওয়ারা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! হৃদয়ের উৎকর্ষতাই উত্তম চরিত্র। আর কোমল আচরণ ও নম্রতা চারিত্রিক গুণাবলীর সৌন্দর্য এবং অলংকার। কোমল আচরণই বিচক্ষণতার মূল, নিরাপত্তার দূর্গ, জ্ঞানী ও গুণীর বৈশিষ্ট্য এবং সাফল্যের ডানা। কোমল আচরণেই রয়েছে সফলতা, আর নম্রতা ও ধৈর্যেই নেতৃত্ব...। কাজেই কোমল আচরণে ধৈর্যধারণ করুন, সফলতা পাবেন। যদি কোন প্রয়োজনে হাজার জন সজ্জিত হয়ে বের হয় .. তা পূরণ করতে পারে সেই ব্যক্তি যে কোমল আচরণ করে। মুক্বীম ব্যক্তির জন্য সদাচরণ করা তো স্বাভাবিক বিষয় .. তবে সে সফরে বের হলে সদাচরণ করা আরো যরূরী। কথা বললে মেপে বলুন। কেননা .. বচনেই বিজ্ঞতা বা ত্রুটি প্রকাশ পায়। আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ فَقَدْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ فَقَدْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الْخَيْرِ
‘যাকে নম্রতার মত গুণ দান করা হয়েছে, তাকে কল্যাণ দান করা হয়েছে। আর যাকে নম্রতার গুণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।[১] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِى الْأَمْرِ كُلِّهِ ‘আল্লাহ কোমল; তিনি যাবতীয় কাজে কোমলতা বা নম্রতা পসন্দ করেন’।[২] আর ছহীহ মুসলিমে এসেছে, إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لَا يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ ‘আল্লাহ কোমল; তিনি কোমলতা পসন্দ করেন এবং তিনি কোমল আচরণের কারণে এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার কারণে দান করেন না ও অন্য কোন কিছুর কারণেও দান করেন না’।[৩] ছহীহ মুসলিমে আরো এসেছে, إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُوْنُ فِىْ شَىْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلَّا شَانَهُ ‘কোন কিছুর মধ্যে নম্রতা থাকলে তা সেটাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর কোন কিছু থেকে তা অপসারণ করা হলে তা সেটাকে কলুষিত করে’।[৪]
কোমল আচরণ হল : পার্শ্ব নম্র রাখা, কাজে নমনীয়তা, ভাল অবদান, সৌজন্যতা ও সুহৃদয়তা প্রকাশ করা, সহাবস্থানকে প্রাধান্য দেয়া, উত্তম পন্থায় মোকাবেলা করা, রূঢ়তা ও তাড়াহুড়া পরিত্যাগ করা, কঠোরতা ও জবরদস্তি থেকে দূরে থাকা, কথা ও কাজে রূঢ়তা, অহমিকা ও কর্কশ ভাষা বর্জন করা, মধ্যমপন্থার সীমাতিক্রম না করা এবং যে কোন বিষয়কে উত্তম ও সহজ পন্থায় গ্রহণ করা।
কিছু কিছু মানুষ এমন যে, তার মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে না, হস্তদ্বয় নরম হয় না, তার দুর্দশার শেষ নেই। সে অহমিকার সাথে ঘাড় বাঁকা রাখে ও দয়া প্রদর্শন করা থেকে দূরে থাকে; সে কঠোর, কর্কশ, ত্বরাপ্রবণ, অজ্ঞ, প্রতারিত; সে নানা অবস্থা ও বিষয়কে সুন্দরভাবে মুল্যায়ন করতে পারে না। যে ব্যক্তি বক্র ও প্রতিকূল বিষয়ে কোমল হয় না, সে এর আপদের সম্মুখীন হয়। আর যে ব্যক্তি তার রাগের বশবর্তী হয়, সে তার শিক্ষা ও নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে। আর যে ব্যক্তি কোমল আচরণ পরিত্যাগ করে, তাকে তার সঙ্গী ও সহযোগীরা বর্জন করে। হে বৎস! যদি তোমার ক্ষতি না হয় তাহলে ধীরতা অবলম্বন কর .. বুদ্ধিমানের জন্য নম্রতাই শ্রেয় ও নিরাপদ।
আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে উদ্দেশ্য করে মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) চিঠিতে লিখেন, ‘অতঃপর, মঙ্গলজনক বিষয় বুঝতে পারলে তাতে কল্যাণ আরো বৃদ্ধি পায় ও সুপথ বেরিয়ে আসে। বিচক্ষণ সেই ব্যক্তি যে তাড়াহুড়া বাদ দিয়ে সত্যের উপর থাকে। আর হতাশ ও ব্যর্থ সেই যে ধীরতা ও বিলম্বতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাবধানী ও স্থির ব্যক্তিই যথার্থ বা সত্যের কাছাকাছি। আর তাড়াহুড়াকারী ভুলকারী বা প্রায় ভুল করে থাকে। যাকে নমনীয় আচরণ উপকৃত করে না তাকে তার নির্বুদ্ধিতা ক্ষতি করে। আর যাকে অভিজ্ঞতা উপকার দেয় না সে তো মর্যাদা লাভ করতে পারে না। ব্যক্তি কখনো সুচিন্তা ও যথার্থ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না যতক্ষণ না তার অজ্ঞতা ও প্রবৃত্তির উপর তার বুদ্ধিমত্তা প্রাধান্য পায়’।[৫] ওমর ইবনু ‘আব্দিল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
إِنَّ مِنْ أَحَبِّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ الْعَفْوَ عِنْدَ الْقُدْرَةِ، وَتَسْكِيْنَ الْغَضَبِ عِنْدَ الْحِدَّةِ، وَالرِّفْقَ بِعِبَادِ اللهِ
‘আল্লাহর কাছে অন্যতম প্রিয় আমল হল, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেয়া, প্রচ- ক্রোধের সময় নিজের রাগ প্রশমন করা এবং আল্লাহর বান্দাদের সাথে কোমল আচরণ করা’।[৬]
ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা পরম দয়ালু; তিনি দয়ালু বান্দাদেরকে ভালোবাসেন এবং তাঁর দয়ালু বান্দাদের প্রতিই দয়া করেন। তিনি মানুষের দোষ আড়ালকারী; কাজেই যে অন্যের দোষ গোপন রাখে তাকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি মার্জনাকারী; বান্দাদের ত্রুটি মার্জনাকারী ব্যক্তিকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি ক্ষমাশীল; তাদের প্রতি ক্ষমাশীল বান্দাকে তিনি পসন্দ করেন। তিনি কোমল আচরণকারী; বান্দাদের প্রতি আমায়িক আচরণকারীকে তিনি ভালোবাসেন এবং অসভ্য, কর্কশ, কঠোর ও রুক্ষ্ম স্বভাবের মানুষকে ঘৃণা করেন। তিনি নমনীয়; ন¤ তাকে পসন্দ করেন। তিনি সহিষ্ণু; সহনশীলতা পসন্দ করেন। তিনি সদাচরণকারী; সদাচরণ ও এরূপ ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ; তাই ন্যায়বিচার পছন্দ করেন। তিনি ওজর বা কৈফিয়ত গ্রহণকারী; যারা তাঁর বান্দাদের কৈফিয়ত বা ওজর মেনে নেয় তিনি তাদেরকে পসন্দ করেন। বান্দার মাঝে এ মহৎ গুণগুলোর বিদ্যমান থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে তাকে তিনি প্রতিদান দান করেন; কাজেই যে মার্জনা করে তাকে তিনি মার্জনা করেন, যে ক্ষমা করে তাকে ক্ষমা করেন। যে ছেড়ে দেয় তাকেও তিনি ছেড়ে দেন, আর যে নিজ দাবিতে অনঢ় থাকে তার উপরও তিনি অনমনীয় থাকেন। আর যে তাঁর বান্দাদের প্রতি কোমল আচরণ করে তিনি তার সাথে কোমল আচরণ করেন। যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া করে তিনি তার প্রতি দয়া করেন। যে তাদের প্রতি ইহসান করে তিনি তার প্রতি ইহসান করেন। যে তাদের সাথে উদারতা ও বদান্যতা দেখায় তিনিও তার প্রতি উদার হন। যে তাদের উপকার করে তিনি তার উপকার করেন। যে মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে তিনিও তার দোষ গোপন রাখেন। যে তাদের মার্জনা করে তিনি তাদেরকে মার্জনা করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় তিনিও তার দোষ খোঁজেন এবং যে তাদের সম্মানহানি করে তিনি তার দোষ ফাঁস করে তাকে অপদস্ত করেন। যে তাদেরকে স্বীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে তিনি তাকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করেন। যে ব্যক্তি বিরোধ ও চক্রান্ত করে তিনি তার বিরোধিতা করেন ও তার বিষয়ে কৌশল অবলম্বন করেন। যে ধোঁকা দেয় তিনি তাকে ধোঁকায় ফেলেন; কাজেই আল্লাহর সৃষ্টির সাথে ব্যক্তি যেরকম আচরণ করবে তার সাথে ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ সেরকমই আচরণ করবেন; কেননা আল্লাহ বান্দার সাথে সেরকম আচরণ করেন যেরকম বান্দা তাঁর সৃষ্টির সাথে আচরণ করে’।[৭]
হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তা‘আলা কোন পরিবারের মধ্যে কল্যাণ চাইলে তাদেরকে নম্রতা ও কোমল আচরণের পথ দেখিয়ে দেন। যে পরিবার কোমলতা বঞ্চিত, তারা মূলত যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। সে পরিবার কতই না উত্তম যাকে কোমলতা সুশোভিত করেছে, নম্রতা পরিবেষ্টন করে রেখেছে, দয়া, সততা ও সহানুভূতি সজ্জিত করেছে এবং শান্তি ও প্রশান্তি আবৃত করে রেখেছে। পক্ষান্তরে সে ঘর কতই না দুর্দশাগ্রস্ত, যাকে কোলাহল ও ঝগড়া-বিবাদ প্রকম্পিত রাখে, অনিষ্টতা ও অশান্তি সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শত্রুতা ও বিবাদ ধ্বংস করে।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِذَا أَرَادَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِأَهْلِ بَيْتٍ خَيْرًا أَدْخَلَ عَلَيْهِمُ الرِّفْقَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন পরিবারের মধ্যে কল্যাণ চান তখন তাদের মাঝে নম্রতা ও কোমল আচরণ প্রবেশ করিয়ে দেন’।[৮]
কোন পরিবার নম্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তারা মতবিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হবে, সন্দেহ ও ধারণা পোষণের লক্ষ্যে পরিণত হবে এবং অভিযোগ-অনুযোগ ও দাবি-দাওয়ার উৎসে পরিণত হবে; তারা একে অপরকে দোষারোপ ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকবে। এরা তো কঠোরতা করার সময় মোটেও নমনীয় হয় না .. সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় নূন্যতম সদ্ব্যবহার করে না।
কাজেই হে সুরক্ষিত ঘরের বাসিন্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও দেখা-সাক্ষাৎ করার মাধ্যমে নিঃসঙ্গতা ও ঘৃণার পর্দা তুলে ফেলুন। বিচ্ছিন্নতা বা ফাটল জোড়া লাগিয়ে, দূরাবস্থাকে মেরামত করে ও বিচ্ছিন্নতাকে একীভূত করে পরিচ্ছন্ন দিনে ফিরে আসুন। উদারতা, সহজকরণ, মার্জনা ও ক্ষমার মাধ্যমে অনৈক্য ও বিরোধের আগুনকে নিভিয়ে ফেলুন। যে ব্যক্তি কৈফিয়ত বা ওজর পেশ করে তার কাছ থেকে ওজর গ্রহণ করুন। তাদের মত হবেন না যাদেরকে তুষ্ট বা শান্ত করতে চাইলেও তারা সন্তুষ্ট হয় না।
আমাকে বলা হল, অমুক তো আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে .. আর নওজোয়ানের অপমানিত থাকা দোষনীয়। জবাবে আমি বললাম, সে আমাদের কাছে এসে ওজর পেশ করেছে .. আমাদের কাছে অপরাধের বদলা কৈফিয়তদান।
হে মুসলিমগণ! বিশেষভাবে কোমল আচরণ ও নম্রতা একান্তভাবে কাম্য শিক্ষার্থী, অজ্ঞ ও জানতে ইচ্ছুকদের প্রতি; তাদের প্রতি আন্তরিক হওয়া, তাদের কাছে বিষয়কে স্পষ্ট করা, সত্য তুলে ধরা, ভাবার্থ বর্ণনা করা এবং যা তারা বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারবে না তা ছেড়ে দেয়া, যা তাদের জানা নেই সে বিষয়ে তাদেরকে মার্জনা করা এবং তাদের অজানা বিষয়কে নম্রতা ও কোমলতার সাথে শিক্ষা দেয়া যরূরী। এক্ষেত্রে কোনভাবেই কঠোরতা ও অহমিকা প্রদর্শন না করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنۡہَرۡ ‘আর সওয়ালকারীকে আপনি ধমক দিবেন না’ (সূরা আয-যোহা : ১০)। আলেমগণের একটি মত হল, এখানে সওয়ালকারী বলতে ইল্ম ও দ্বীন শিখতে ইচ্ছুক ব্যক্তি; কাজেই জ্ঞান পিপাসু, জানতে ইচ্ছুক ও পরামর্শ কামনাকারী ব্যক্তিকে ধমক দিবেন না। আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাদীছ চর্চাকারীদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ও তাদের জন্য চাদর বিছিয়ে দিতেন এবং বলতেন, আল্লাহর রাসূলের প্রিয়পাত্রদেরকে স্বাগতম। আবূ হারুন আবদী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে এসেছে, তিনি বলেন, আমরা আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে এলে তিনি বলতেন, তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অছীয়ত অনুযায়ী স্বাগতম।
মু‘আবিয়া ইবনু হাকাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলাম। ইতিমধ্যে কোন একজন হাঁচি দিলে আমি জবাবে বললাম, ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’। এতে সবাই রূঢ় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে লাগল। তা দেখে আমি বললাম, আমার মা আমার বিয়োগ ব্যথায় কাতর হোক- কী ব্যাপার! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? তখন তারা নিজ নিজ উরুতে হাত চাপড়াতে থাকল। আমি যখন দেখলাম যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চায়, তখন আমি চুপ করে রইলাম। পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছালাত শেষ করে আমাকে ডাকলেন। আমার পিতা-মাতা তার জন্য কুরবান হোক। আমি এর আগে বা পরে কখনো অন্য কোন শিক্ষককে তার চেয়ে উত্তম পন্থায় শিক্ষা দিতে দেখিনি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি আমাকে ধমকালেন না, প্রহার করলেন না, বকাঝকাও করলেন না। বরং বললেন, إِنَّ هَذِهِ الصَّلَاةَ لَا يَصْلُحُ فِيْهَا شَىْءٌ مِنْ كَلَامِ النَّاسِ إِنَّمَا هُوَ التَّسْبِيْحُ وَالتَّكْبِيْرُ وَقِرَاءَةُ الْقُرْآنِ ‘ছালাতের মধ্যে কথাবার্তা বলা যথোচিত নয়। বরং ছালাতে তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে’।[৯]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান চরিত্রের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে- যে চরিত্রের পক্ষে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন। না জানা ব্যক্তির সাথে তার কোমল আচরণ, তার উম্মতের প্রতি সদাচরণ ও দয়ার বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। এ হাদীছে অজ্ঞ ব্যক্তির সাথে কোমল আচরণ করা, তাকে সুন্দরভাবে শিক্ষা দেয়া, তার প্রতি সদয় হওয়া ও তার কাছে সঠিক ধারণা পৌঁছে দেয়ার মত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্দর চারিত্রিক গুণাবলীও বর্ণিত হয়েছে’।[১০]
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক বেদুঈন ব্যক্তি মসজিদে পেশাব করে দেয়। তাই লোকজন তাকে ধমক দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
دَعُوْهُ وَهَرِيْقُوْا عَلَى بَوْلِهِ سَجْلًا مِنْ مَاءٍ ، أَوْ ذَنُوْبًا مِنْ مَاءٍ ، فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِيْنَ ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِيْنَ
‘তাকে ছেড়ে দাও এবং তার পেশাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কেননা তোমাদেরকে সহজ নীতি অবলম্বনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, কঠোর নীতি অবলম্বনের জন্য পাঠানো হয়নি’।[১১] তারপর তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ডেকে বললেন, এটা মসজিদ; এখানে পেশাব করা বা ময়লা আবর্জনা ফেলা সমীচীন নয়। এটা আল্লাহর যিকির করা, ছালাত আদায় করা ও কুরআন পাঠ করার স্থান’।[১২] তারপর বেদুঈন লোকটি তার অশিষ্ট আচরণ উপলব্ধি করতে পেরে বলল, অতঃপর নবী (ﷺ) আমার কাছে এলেন। আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য কুরবান হোক। কিন্তু তিনি আমাকে গালি দিলেন না, ধমক দিলেন না ও মারধরও করলেন না।[১৩]
কাজেই গ-মূর্খদের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্দর আচরণ, মহানুভবতা, দয়া ও নমনীয় আচরণের দিকে আপনারা লক্ষ্য করে দেখুন। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ও আপনাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শে আদর্শিত ও তাঁর সুন্নাতের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন-আমীন!!
দ্বিতীয় খুত্ববাহ
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ছালাত ও সালামের পর সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! উপদেশ প্রদানের সময় কোমলতা অবলম্বন করলে তা সাড়া পাওয়া, ফলপ্রসূ হওয়া, উপকৃত হওয়া ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হওয়ার জন্য অধিক উপযোগী হয়। কঠোর আচরণের কারণে কাউকে যা কিছু দেয়া হয়- তার চেয়েও উত্তম বস্তু কোমল আচরণের কারণে প্রদান করা হয়। হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি আবূ আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, সৎ কাজের আদেশের সময় কঠোরতা পরিহার করে সৌজন্যতা ও কোমল আচরণের প্রতি মানুষ মুখাপেক্ষী। তবে সে ব্যক্তি ব্যতীত যে প্রকাশ্যে ফাসেক্বী কাজ করে বেড়ায়। এ ক্ষেত্রে আপনার উপর আবশ্যক হল তাকে নিষেধ করা ও জানানো’। তবে সেটা যেন অবশ্যই উপদেশের ক্ষেত্রে কোমল আচরণ, কথায় নম্রতা ও সুন্দর ভাষা ব্যবহারের নীতিমালার আওতায় হয়।
জনসম্মুখে উপদেশ দেয়া তিরস্কার ও নিন্দা করার শামিল। বস্তুত নিন্দায় রয়েছে বিতাড়ণ ও হারানোর সম্ভাবনা। ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সালাফগণ যখন কাউকে নছীহত করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তাকে গোপনে বা একান্তে নছীহত করতেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কোন ভাইকে একান্তে নিজেদের মধ্যে হিতোপদেশ দেয়, বস্তুত সেটাই নছীহত। আর যে ব্যক্তি মানুষের সামনে কাউকে উপদেশ দেয়, মূলত সে যেন তাকে তিরস্কার করল’।
ফুযাইল ইবনু ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الْمُؤْمِنُ يَسْتُرُ وَيَنْصَحُ، وَالْفَاجِرُ يَهْتِكُ وَيُعَيِّرُ ‘মুমিন ব্যক্তি দোষ-ত্রুটি গোপন রেখে নছীহত করে। আর লম্পট ব্যক্তি ফাঁস করে বেড়ায় ও অপদস্ত করে’।[১৪]
আব্দুল আযীয ইবনু আবূ রাওয়াদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কারো কাছে তার ভাইয়ের কোন কিছু দৃষ্টিগোচর হলে, তাকে নম্র ও ভদ্রভাবে উপদেশ দিতেন। ফলে তারা আদেশ নিষেধ করেও সওয়াব অর্জন করতেন’।
হে মুসলিমগণ! আপনারা আপনাদের পিতা-মাতা, বয়োবৃদ্ধ ও মুরুব্বী এবং বয়সে প্রবীণদের সাথে কোমল ও নম্র আচরণ করুন। তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন ও সম্মান করুন। দুর্বল, রোগী ও প্রতিবন্ধীদের সাথে সদয় আচরণ করুন। তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন ও কাছে রাখুন। গরীব, মিসকীন ও অসহায়দের সাথে নমনীয় আচরণ করুন ও তাদের প্রতি সদয় হোন ও তাদেরকে সাহায্য করুন। নারী ও শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করুন, তাদের উপর সুহৃদ হোন এবং তাদের হক্ব আদায় করুন। শ্রমিক-কর্মচারী, চাকর ও গৃহকর্মী যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের অধীনস্ত করেছেন- তাদের প্রতি আমায়িক ও উদার আচরণ করুন; তাদেরকে সাধ্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দিবেন না, তাদের হক্ব থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং তাদেরকে কটু কথা শুনাবেন না।
চতুষ্পদ প্রাণী ও নির্বাক জীব-জন্তুর সাথে নরম আচরণ করুন। শরী‘আত প্রণেতা তো উটের মালিককে নির্দেশ দিয়েছেন যেন উর্বর জমি, ঘাস ও তৃণলতাবিশিষ্ট এলাকার উপর দিয়ে সফর করার সময় উটের উপর সদয় হয়ে তাকে সেগুলো থেকে আহার করে পরিতৃপ্ত হয়ে সতেজ হতে দেয়। এ সময় তাড়াহুড়া করতেও তিনি নিষেধ করেছেন যেন তা শক্তিহীনতা ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় না ভুগে। তাকে তিনি আদেশ করেছেন যে, যদি সে অনুর্বর, খরাপ্রবণ এলাকা দিয়ে সফর করে তাহলে যেন দ্রুত চলে যায়; যাতে উক্ত পশুটি দুর্বল হওয়ার আগেই তার চলার সক্ষমতা থাকাবস্থায় সে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِذَا سَافَرْتُمْ فِى الْخِصْبِ فَأَعْطُوا الْإِبِلَ حَظَّهَا مِنَ الْأَرْضِ وَإِذَا سَافَرْتُمْ فِى السَّنَةِ فَبَادِرُوْا بِهَا نِقَيَهَا ‘যখন তোমরা উর্বর ভূমি দিয়ে পথ অতিক্রম কর, তখন উটকে ভূমি থেকে তার অংশ দাও। আর যখন দুর্ভিক্ষগ্রস্ত বা অনুর্বর জমি দিয়ে পথ অতিক্রম কর, তখন তাড়াতাড়ি তা অতিক্রম করে যাও’।[১৫] আপনারা সকল কাজে অমায়িকভাব দেখান; কেননা কোমল আচরণই ভয় ও বিপদের সময়ের একমাত্র আশ্রয়স্থল।
পরিশেষে খত্বীব মহোদয় আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।
* পি-এইচ.ডি গবেষক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব এবং বাংলা আলোচক ও জুমু‘আর খুৎবার লাইভ অনুবাদক, মসজিদে নববী।
তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/২০১৩, সনদ ছহীহ।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৯২৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৩।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৩।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৪।
[৫]. আবুল ক্বাসিম হিবাতুল্লাহ ইবনু রাযী আল-লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, ৮ম খণ্ড (সঊদী আরব : দারুত ত্বায়্যিবা, ১৪২৩ হি.), পৃ. ১৫৩৩, হা/২৭৮৯।
[৬]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৭৯৬৮।
[৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ ছায়্যিব মিনাল কালামিত ত্বায়্যিব (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৯৯৯ খৃ.), পৃ. ৩৫।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪৭১, সনদ ছহীহ।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩৭।
[১০]. ইমাম নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ১৩৯২ হি.), পৃ. ২০।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/২২০।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৫।
[১৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৫৪০।
[১৪]. যাইনুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ আল-হাম্বলী, জামিঊল ‘ঊলূম ওয়া হাকাম ফী শারহি খমসীনা হাদীছান মিন জাওয়ামি‘ঊল কালাম, ১ম খণ্ড (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২২ হি.), পৃ. ২২৫।
[১৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯২৬।
প্রসঙ্গসমূহ »:
খুত্ববাতুল হারামাইন