রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন
হৃদয়ের আমলসমূহ ও তার সুস্থতা

খত্বীব : শায়খ ড. বান্দার বিন আব্দুল আজীজ বালীলাহ (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*

[২৭ রবিউল আখের ১৪৪২ হি. মোতাবেক ২০ নভেম্বর, ২০২০ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর, তাঁর ছাহাবায়ে কেরামদের উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন,

হে সম্ভ্রান্ত লোকেরা! আল্লাহকে ভয় করুন এবং তাঁর ব্যাপারে লজ্জাশীল হৌন। কারণ লজ্জা সমস্ত কল্যাণকে বয়ে নিয়ে আসে। তাঁর অফুরন্ত নে‘মতসমূহ যা আমাদের উপর অবতরণ হচ্ছে এ জন্য শুকরিয়া আদায় করুন। বিভিন্ন বালা মুছীবতের সময় ধৈর্যধারণ করুন। যখন রাস্তা সংকীর্ণ হয় বা নিরাশ হচ্ছেন, তখন আল্লাহ্র কাছে আশা রেখে এবং আশার রশ্মিকে মযবুত করে ধারণ করুন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, আগামীকালের জন্য সে কি পাঠিয়েছে। আর আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত। আর তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে  ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভুলা করেছেন। তারাই তো পাপাচারী। জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই সফলকাম’ (সূরা আল-হাশর : ১৮-২০)।

হে মুসলিমগণ! মনে রাখবেন, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর একটি প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে, তিনি বলেছেন, إنَّ في الدنيا جنةً من لم يدخلها لا يدخلُ جنة الآخرة ‘দুনিয়ায় এমন জান্নাত রয়েছে, যে ব্যক্তি সেই জান্নাতে প্রবেশ করেনি, সে পরকালের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[১]

যদিও ঈমান ও তাওহীদের বলে জান্নাতে প্রবেশ করে। ঐ ঈমানের বলে জান্নাতে গেলেও সবচেয়ে নি¤œস্তর এবং নি¤œ নে‘মত পাবে। এই পার্থিব জান্নাত, যে জান্নাতের কথা এখানে বলা হল, সেই জান্নাত হচ্ছে ‘জান্নাতুল ‘আমালিল ক্বলবিয়্যাহ’ বা হৃদয়ের আমলসমূহ।

আজকের বিষয়বস্তু এখান থেকে নেয়া হয়েছে তা হচ্ছে ‘অন্তরের ‘আমলসমূহ এবং তার সুস্থতা’। অন্তর বা হৃদয়ের যে নেক ‘আমল বা ভাল কাজকর্মগুলো রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে মানুষের জান্নাত।

তার প্রথমটি হচ্ছে ‘আল-মা‘রেফা বিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ্র সাথে পরিচিত লাভ করা। আল্লাহকে জানা, তাঁর নাম, গুণাবলী, কাজকর্ম, রুবূবিয়্যাত, ইবাদত, আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা। তাঁকে ভালবাসা, তাঁকে পেয়ে মনে আনন্দ বোধ করা, তাঁর সাথে নির্জনে কথা বলে স্বাদ পাওয়া, তৃপ্তি লাভ করা এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভের জন্য সবর্দা সতেষ্ট হওয়া। তাঁর সামনে বিনয়ী হয়ে প্রশান্তি লাভ করা, ভয়-ভীতির সময় তাঁর সামনে কাকুতি-মিনতি পেশ করা, আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তাঁর পথে অবিচল থাকা, শুধু তাঁরই ভালবাসা অন্তরে থাকা, তাঁর ভালবাসা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর ভালবাসা থেকে অন্তরকে মুক্ত করা এবং যে ভালবাসা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ভালবাসায় অন্তরায় হয় বা বাধা দান করে, সে সব ভালবাসা থেকে অন্তরকে মুক্ত করা। তাঁর ভালবাসাকে এবং তিনি যে কথা ও কাজকে ভালবাসেন সেই ভালবাসা, কথা ও কাজকে সমস্ত বস্তুর উপর প্রাধান্য দেয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টিকে সমস্ত রকমের মনের চাহিদার উপর অগ্রাধিকার দেয়া। এসব হচ্ছে অন্তরের কাজকর্ম বা আ‘মালুল কুলূব।

উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ যদি একজন মানুষের মধ্যে থাকে, তাহলে সে এগুলোর মাধ্যমে ঈমানের স্বাদ পাবে। যখন কোন ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ অর্জন করবে, তখন তার অন্তরে ইয়াক্বীন (বিশ্বাস) ও দেহ-প্রত্যয়ের আলো সেখানে আলোকময় হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ তখন হেদায়াত এবং তাওফীক্ব হাছিল করতে পারবে এবং হেদায়াত এবং তাওফীক্বের রাস্তা পাবে।

যদি আপনি আপনার অন্তরে এ সমস্ত ভাল কাজকে একত্রিত করতে চান এবং অন্তরে বসাতে চান, তাহলে আপনার অন্তরকে প্রস্তুত করুন। যাতে করে সে অন্তর নেক, ক্বলবে সালীম এবং সুস্থ অন্তর হয়। কারণ অন্তর যদি সুস্থ, রোগমুক্ত, সৎ এবং নেক না হয়, তাহলে অন্তরের যে আচার-আচরণ, কাজকর্ম রয়েছে সেগুলো সেখানে টিকতে পারে না। অন্তর এমন হতে হবে, যা সমস্ত রকমের বালা-মুছীবত এবং সকল বাধাদানকারী বিষয়গুলো থেকে মুক্ত। সে অন্তর বিদ্বেষ, শত্রুতা, অহংকার, আমিত্ব, যুলম-অত্যাচার থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে এবং সেই অন্তরে কোন রকমের কালিমা থাকবে না। সেই অন্তর হচ্ছে ক্বলবে সালীম অর্থাৎ সুস্থ অন্তর। সেই অন্তর হাছিল করা বা তৈরি করার জন্য যারা পরকালমুখী তারা সর্বদা প্রতিযোগিতা করেছে।

পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ামুখী, দুনিয়াকে কামড়ে ধরে রেখেছে তারা এ থেকে উদাসীন এবং তারা পার্থিব ভোগ বিলাসের সামগ্রীতে রাত-দিনকে লাগিয়ে রেখেছে। মনে রাখবেন যে, দুনিয়ায় এ অন্তরের সততা এবং সুস্থতার চাইতে বড় নে‘মত এবং বড় সুস্বাদু বস্তু আর কিছু হতে পারে না। রব্বুল আলামীনের জ্ঞান অর্জন করা, তাঁর ভালবাসা, তাঁর আদেশ-নিষেধের অনুকূলে কাজকর্ম করা, আমল করা এবং আসল সুখময় জীবনই তো হচ্ছে সুস্থ অন্তরের জীবন।

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন যে, তাঁর অন্তর ছিল ক্বলবে সালীম তথা সুস্থ অন্তর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ  اِنَّ مِنۡ شِیۡعَتِہٖ  لَاِبۡرٰہِیۡمَ - اِذۡ  جَآءَ  رَبَّہٗ  بِقَلۡبٍ  سَلِیۡمٍ.

‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর (নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর) অনুসারীভুক্ত ছিলেন। স্মরণ করুন, যখন সে তার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত হয়েছিল বিশুদ্ধ চিত্তে’ (সূরা আছ-ছাফফাত : ৮৩-৮৪)। আল্লাহ রব্বুল আলামীন সুস্থ অন্তরওয়ালা মানুষ সম্পর্কে বলছেন,

یَوۡمَ لَا  یَنۡفَعُ  مَالٌ  وَّ  لَا  بَنُوۡنَ  -  اِلَّا  مَنۡ  اَتَی اللّٰہَ  بِقَلۡبٍ سَلِیۡمٍ.

‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। সেদিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহ্র নিকট আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে (সূরা আশ-শু‘আরা : ৮৮-৮৯)।

ক্বলবে সালীম অর্থাৎ সুস্থ অন্তর। সুস্থ অন্তর বা রোগমুক্ত অন্তর সেই হৃদয়কে বলা হয়, যা শিরকের ব্যাধি থেকে নিরাপদ। হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, কৃপণতা, অহংকার, দুনিয়ার আসক্তি, নেতৃত্বের মোহ ইত্যাদি রোগ, ব্যাধি থেকে যে অন্তর সুস্থ ও নিরাপদ সেটি হচ্ছে ক্বলবে সালীম বা সুস্থ অন্তর। এমন যেকোন রকমের রোগ ও ব্যাধি থেকে নিরাপদ এবং সুস্থ সে অন্তর, যে রোগ ও ব্যাধি আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সেই অন্তর প্রশস্ত এমন যেকোন সংশয় থেকে, যে সংশয় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিধানের পরিপন্থি এবং এমন কুপ্রবৃত্তি থেকে, সুস্থ যা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নির্দেশের বিরুদ্ধাচারণের দিকে নিয়ে যায় এবং তাঁর সাথে সম্পর্ককে ছিন্ন করে দেয়। এই সুস্থ অন্তর পার্থিব জগতের জান্নাত। আর যারা এই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে, তারাই বারযাখের জান্নাত এবং ক্বিয়ামতের বিচার দিবসের পর যে জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে সেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। এ রকমের সুস্থ অন্তর যারা হাসিল করতে পেরেছে, তারাই এগিয়ে যেতে পেরেছে এবং সম্মানিত হয়েছে। পক্ষান্তরে বহু জাতি নিচে নেমে গেছে, বহু জাতির পদস্খলন ঘটেছে যখন এই সুস্থ অন্তর থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে।

ইমাম সুফিয়ান ইবনু দীনার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গী আবূ বাশীরকে বললাম, আমাদের পূর্বের সালাফদের ভাল আমল সম্পর্কে সংবাদ দিন?। তখন তিনি বললেন, كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ يَسِيْرًا وَيُؤْجَرُوْنَ كَثِيْرًا ‘তারা সামান্য আমল করতেন এবং অধিক প্রতিদান লাভ করতেন’। সুফিয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তখন আমি বললাম, এটা কিভাবে। তখন তিনি বললেন, لِسَلَامَةِ صُدُوْرِهِمْ ‘তাদের অন্তরের সুস্থতার মাধ্যমে’।[২]

অতএব চিন্তা করুন! অন্তরের সুস্থতা কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্তরের সততা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যাতে একজন মানুষ সার্বিক কল্যাণ এবং সমস্ত রকমের ফযীলত-মর্যাদা হাছিল করতে পারে। এটি হচ্ছে যে কোন ইবাদত কবুল হওয়া, সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার রহস্য এবং সফলতার চাবিকাঠি। আর এই সুস্থ অন্তরবিশিষ্ট হওয়াটাই হচ্ছে জান্নাতীদের পরিচয়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ نَزَعۡنَا مَا فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ  مِّنۡ غِلٍّ اِخۡوَانًا عَلٰی  سُرُرٍ  مُّتَقٰبِلِیۡنَ .

‘আমরা তাদের অন্তর হতে হিংসা দূর করব; তারা ভ্রাতৃভাবে পরস্পর খাটে মুখোমুখি আসনে অবস্থান করবে’ (সূরা আল-হিজর : ৪৭)।

হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা ১৫ দিনে পূর্ণিমা রাত্রির চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল ও সুন্দর রূপ ধারণ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা হবে আকাশের উজ্জ্বল তারকার ন্যায় ঝকঝকে। জান্নাতীদের সকলের অন্তর এক ব্যক্তির অন্তরের ন্যায় হবে। তাদের মধ্যে কোন মতবিরোধ থাকবে না এবং হিংসা বিদ্বেষও থাকবে না’।[৩]

মানবজাতির জন্য সবচাইতে বড় ক্ষতিকর হচ্ছে বিরান অন্তর। এরকম অন্তরের উদাহরণ হচ্ছে ধ্বংসস্তুব বাড়ি-ঘরের মত, যে বাড়ি-ঘরে কোন মানুষ বসবাস করে না। মানুষের মিষ্টি ভাষা ও চাকচিক্যময় কর্মকা- কী কাজে আসবে যদি তার অন্তরে বিদ্বেষ, শত্রুতা থাকে এবং অন্তর যদি রোগাক্রান্ত থাকে। মানুষ কি সম্মান হাসিল করতে পারে? মানুষ কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? যদি তার বাহ্যিকটা চাকচিক্যময় হয় আর আভ্যন্তরিন অবস্থাটা বিকৃত হয়। কখনোই সেই ব্যক্তি মর্যাদা হাসিল এবং আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারবে না। হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইলম দুই প্রকার। ১. একটি হচ্ছে অন্তরে জ্ঞান যা উপকারী জ্ঞান। ২. আরেকটি হচ্ছে মুখের জ্ঞান। যা আদম সন্তানের জন্য আল্লাহ তা‘আলা পক্ষ থেকে দলীল।[৪]

হে মুসলিমগণ! সত্যিকার সুস্থ অন্তর হচ্ছে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর অন্তর। যখন তিনি শিরক থেকে, পৌত্তলিকতা থেকে সম্পর্কছেদের ঘোষণা করেছেন। আর এ কারণেই তিনি আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধু ‘খলীল’ হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি বললেন, তোমরা কি সেগুলো সম্বন্ধে ভেবে দেখেছো, যেগুলোর পূজা করছো? তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা? তারা সবাই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ৭৫-৭৮)।

তারপরে সবচাইতে সুস্থ ও রোগমুক্ত হৃদয় হচ্ছে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর। যিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং প্রতিটি মানুষের জন্য যিনি উত্তম আদর্শ। তিনি এমন প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী, যে নিজের জন্য জীবনে কখনো প্রতিশোধ নেননি। তবে আল্লাহর হক্ব নষ্ট করা হয়েছে তখন তিনি দ-বিধি কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং আল্লাহর জন্য তিনি প্রতিশোধ নিয়েছেন। কিন্তু নিজের জন্য, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য তার উপর কেউ যুলম-অত্যাচার করেছে, কখনো সে কারণে তিনি প্রতিশোধ নেননি।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে সবচাইতে সুস্থ অন্তর হচ্ছে এই উম্মতের শায়খাইন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দুই ব্যক্তি আবূ বকর সিদ্দীক এবং ওমর ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর অন্তর। তাদের দু’জনের একটি ঘটনা রয়েছে। যে কোন এক সময় আপষে একটু কথা কাটাকাটি বা মনমালিন্য হয়েছিল। তারপরে প্রত্যেকে নিজেকে তিরস্কার করা শুরু করে। এবং একজন অপরজনের কাছে নিজের ওজর-অজুহাত পেশ করে এবং ভুল স্বীকার করে। দু’জনেই সচেষ্ট হয় আমি ভুল স্বীকার করব, তিনি কেন ভুল স্বীকার করবেন। হাদীছে এসেছে,

আবূ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পরনের কাপড়ের একপাশ এমনভাবে ধরে আসলেন যে তার দু’ হাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমাদের এ সাথী এই মাত্র কারো সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে। তিনি সালাম করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার এবং ওমর ইবনুল খাত্তাবের মাঝে একটি বিষয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমিই প্রথমে কটু কথা বলেছি। অতঃপর আমি লজ্জিত হয়ে তাঁর কাছে মাফ চেয়েছি। কিন্তু তিনি মাফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার নিকট উপস্থিত হয়েছি। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বললেন, ‘হে আবূ বকর! আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন’। অতঃপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবূ বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল, না। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট চলে আসলেন। তাঁকে দেখে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ভীত হয়ে নতজানু হয়ে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি প্রথমে অন্যায় করেছি। এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ যখন আমাকে তোমাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, তুমি মিথ্যা বলছ আর আবূ বকর বলেছে, আপনি সত্য বলছেন। তাঁর জীবন, মাল সবকিছু দিয়ে আমার সহানুভূতি দেখিয়েছে। তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দিবে? এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে আর কখনও কষ্ট দেয়া হয়নি।[৫] তাদের অন্তর এমন ছিল, যে অন্তর এই দুনিয়া থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। যে অন্তরকে, যে অন্তরের পরিচ্ছন্নতাকে দুনিয়ার লোভ-লালসা কোন রকমে ধুলায় ধুসরিত করতে পারেনি।

সুস্থ অন্তর হচ্ছে প্রখ্যাত ছাহাবী সা‘দ ইবনু রাবীআ‘ আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অন্তর। মদিনায় আসার পর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর এবং আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন করে দিয়েছিলেন। তিনি আনছার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি করে দিয়েছিলেন। কেননা মুহাজিরদের বাড়ি এবং খাদ্য-পানি, কোন আশ্রয় স্থল এবং টাকা-পয়সাও ছিল না। তারা নতুন এসেছে। সুতরাং একজন মুহাজির একজন আনছারীর ভাই। অতএব যে যার ভাই, সে তাঁর বিশেষভাবে দেখাশোনা করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবেই তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল সা‘দ ইবনু রাবীআ‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন। আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হিজরত করে আমাদের কাছে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ও সা‘দ ইবনু রাবীআ‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করে দিলেন। সা‘দ ছিলেন অনেক সম্পদশালী। সা‘দ বললেন, সকল আনছারগণ জানেন যে, আমি তাঁদের মধ্যে অধিক সম্পদশালী। আমি শীঘ্রই আমার ও তোমার মাঝে আমার সম্পদ ভাগাভাগি করে দিব দু’ ভাগে। আমার দু’জন স্ত্রী রয়েছে; তোমার যাকে পসন্দ হয় বল, আমি তাকে তালাক্ব দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে তুমি তাকে বিয়ে করে নিবে। আব্দুর রহমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহ আপনার পরিবার পরিজনের মধ্যে বরকত দান করুন। আমাকে বাজার দেখিয়ে দিন। তিনি বাজার হতে মুনাফা করে নিয়ে আসলেন পনীর ও ঘি।[৬] আসলে তাদের অন্তর ছিল প্রশস্ত, ব্যাধিমুক্ত।

সুস্থ অন্তর ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর। তিনি সতীন হওয়ার পরও ইফক্বের ঘটনায় আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর ব্যাপারে সত্যবাদী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সম্পর্কে যায়নাব (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তুমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সম্পর্কে কি জান অথবা (বলেছিলেন) তুমি তাঁর ব্যাপারে কি দেখেছ? তখন তিনি (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আমার চোখ ও কানকে হেফাযত করেছি। আল্লাহর কসম! ‘আমি তাঁর ব্যাপারে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনিই আমার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর তাক্বওয়ার কারণে তাঁকে রক্ষা করেছেন।[৭] আল্লাহু আকবার! তাদের অন্তর কত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল।

সুস্থ অন্তর ছিল সেই আনছারী ছাহাবীর অন্তর, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে আনছারীর জান্নাতী হওয়ার ব্যাপারে ছাহাবীদেরকে সংবাদ দিয়েছিলেন। হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মজলিসে ছিলাম। তিনি বললেন, এখনি জান্নাতী এক লোক তোমাদের নিকট আগমণ করবে। সাধারণ এক আনছারী উপস্থিত হল, যার ওযূর পানি দাঁড়ি দিয়ে টপটপ করে পড়ছিল। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনদিন এ কথা বললেন এবং ঐ আনছারী ছাহাবী তখন উপস্থিত হতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তখন আমি তাঁর অনুসরণ করলাম। আমি তাঁকে বাহানা করে বললাম যে, আমার বাবার সাথে একটু কথার কাটাকাটি হয়েছে। এ কারণে আমি কসম করে ফেলেছি যে, তিনদিন বাড়িতে যাব না। তুমি যদি চাও তাহলে আমি তোমার সাথে অবস্থান করব, যাতে করে আমার বাবার রাগটা কেটে যায় এবং আমাকেও কসমের কাফফারা দিতে না হয়। তখন আনছারী বলল, ঠিক আছে। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন যে, আমি তাঁর সাথে তিনদিন অবস্থান করলাম। কিন্তু আমি তাঁকে রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে দেখিনি। তবে তিনি রাতে যখন বিছানায় যেতেন এবং শুয়ে এদিক-ওদিক হতেন, তখন আল্লাহকে স্মরণ করতেন, তাকবীর পাঠ করতেন এবং ফযরের ছালাতের জন্য উঠতেন। ‘আমর ইবনুল ‘আছ বলেন, আমি তাঁর সাথে তিনদিন অবস্থান করে ভাল ছাড়া কোন (মন্দ, কটু, গীবত ইত্যাদি) কথা শুনিনি। তিনরাত যখন কেটে গেল, আমি তাঁর তিন রাতের আমলকে তুচ্ছ মনে করলাম। আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমার এবং আমার পিতার মাঝে কোন রাগারাগী হয়নি ও কথাও বন্ধ হয়নি। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে (তোমার ব্যাপারে) তিনদিন বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, এখনি জান্নাতী এক লোক তোমাদের নিকট আগমণ করবে। আর এ কারণে আমি তোমার বাড়িতে অবস্থান করার ইচ্ছা করেছি; যাতে আমি দেখতে পারি যে, তুমি কি আমল কর এবং আমি যেন তার অনুসরণ করতে পারি। কিন্তু আমি তো তোমাকে বেশি আমল করতে দেখলাম না। তাহলে কোন আমলের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিল? তখন আনছারী ছাহাবী বলল, তুমি যা দেখেছ, আমি ওরকমই আমল করি। ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম; তখন আনছারী আমাকে ডেকে বলল, তুমি যা দেখেছ, আমি ওরকমই আমল করি। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের ব্যাপারে ধোঁকাবাজি, প্রতারণা রাখি না এবং অন্যের কল্যাণে কোন হিংসাও করি না, যদি আল্লাহ তাকে তা দিয়ে থাকেন। তখন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তাহলে ঐ গুণই (অন্তরের সুস্থতা) তোমাকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছে। যা করতে আমরা অনেকেই সক্ষম না।[৮]

অতঃপর হে আল্লাহ বান্দারা! বহু নর-নারী রয়েছে যারা সততার প্রমাণ পেশ করেছে এবং আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য তারা নিষ্ঠাবান হয়েছে। তাদের অন্তরকে তারা বিদ্বেষ, হিংসা, শত্রুতা, কলহ, আমিত্ব, কৃপণতা ইত্যাদি রোগ থেকে পাক-পবিত্র রেখেছে। সুতরাং তারা জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তাতে অধিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ তাঁরা জীবন্ত। বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁরা জান্নাতী বলে ঘোষিত হয়েছে এবং তাঁরা দুনিয়াতেই আখিরাতের নে‘মত, সুখ-শান্তির নে‘মত হাসিল করেছে। আর এটা কোন আশ্চর্য বিষয় নয়। যাদের অন্তর সুস্থ তাদের জীবনটাই সত্যিকার সুখের জীবন। তাদের অবস্থা সবচাইতে ভাল, শান্তিতে রয়েছে এবং তাঁরা সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা, শোক, রোগ এবং মানসিক টেনশন মুক্ত। কারণ দুনিয়ার কী এল? আর কী গেল? এ নিয়ে তারা কোন পরোয়া করে না। এ তুচ্ছ দুনিয়া আসলেই বা কী? আর চলে গেলেই বা কী? না পেলেই বা কী? কোন অসুবিধা নেই। সুতরাং তাদের জীবনে কোন রকমের তিক্ততা এবং খারাপ আচরণ দেখা যায় না। তারা সবসময় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণের আশা রাখে এবং তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভ করা ও তাঁকে কাছে পাওয়া।

এরাই হচ্ছে বিশ্বজগতের মনোনীত ব্যক্তিত্ব, আদম সন্তানের সবচাইতে বড় ভাল মানুষ এবং খাঁটি মানুষ। আর এদের জীবনটা হচ্ছে সত্যিকার সুখ-শান্তির জীবন। এদের নে‘মত হচ্ছে সত্যিকারের নে‘মত। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে দু‘আ করি যে, আল্লাহ এসব লোকদের সাথে আমাদেরকে মিলিত কর, তাদের পথের পথিক আমাদেরকে বানিয়ে দাও, তাদের দলে আমাদেরকে শামিল করে দাও; যাতে করে আমরা তাদের দলভুক্ত হতে পারি। যাদের সম্পর্কে তুমি আল্লাহ শিখিয়েছ, আর তোমার কথা সত্য। পরবর্তীকালে যারা আসবে মুমিন নর-নারী, তারাও এ দু‘আও বলবে। আল্লাহর কাছে এ যাঞ্ছা করবে যে, আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাদের সেসব ভাই-বোনদের মাফ করে দাও, যারা আমাদের পূর্বে ঈমানের সাথে চলে গেছে এবং মুমিনদের সম্পর্কে আমাদের অন্তরে আল্লাহ কোনরকমের বিদ্বেষ, শত্রুতা রেখে দিও না। নিশ্চয়ই তুমি বড়ই ¯েœহশীল, বড়ই দয়ালু। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে এবং আপনারদের সকলকে কুরআনে কারীম দিয়ে এবং নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ দিয়ে উপকৃত করেন।

ছানী খুত্ববাহ

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলছেন, হে মুসলিমগণ! অন্তরের ব্যাধি রয়েছে, যেমন অন্তরের সুস্থতা আছে। অন্তরের সুস্থতা হতে হবে অন্তরের ব্যাধিগুলো থেকে। অন্তরের ব্যাধি কঠিন ব্যাধি এবং বহুমুখী ব্যাধি। অন্তরের ব্যাধিগুলোকে সুশোভিত করার জন্য এবং সাজ-সজ্জিত করার জন্য মানুষের যে কু-প্রবৃত্তি তা সবসময় লেগে আছে এবং সেটাকে চাকচিক্যময় করে প্রকাশ করে থাকে। আর শয়তান এই বান্দার সাথে সবসময় চক্রান্ত করে থাকে যাতে করে অন্তরের রোগগুলো আরো বৃদ্ধি পায়। যাতে করে বান্দাকে ধ্বংসের নি¤œ থেকে নি¤œ স্থানে পৌঁছিয়ে দিতে পারে এবং তার পরিণামকে খারাপ করতে পারে।

আর এ থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতায় নিজের মনকে বাধ্য করা। মনের যে চাহিদা রয়েছে, খারাপ কামনা-বাসনা রয়েছে তার বিরোধিতার জন্য নিজের মনকে বাধ্য করা এবং মনকে শক্ত করা। আর মন যেদিকে ঝুঁকছে সেদিকে না ঝুঁকানো। কারণ এটি এমন একটি রোগ ও গোপন ব্যাধি, যা ধ্বংসাত্মক। এ ব্যাধি কত লোককে ধ্বংস করেছে এবং কত লোকের জীবননাশ করে ফেলেছে তার হিসাব নেই। ইবলিসের যে ষড়যন্ত্র রয়েছে বান্দা যেন সেটাকে সবসময় প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। শয়তানের যে ছলনা রয়েছে, সেটাকে দূর করতে হবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। মনের চাহিদা, কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, তার বিরুদ্ধে জিহাদ এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগুলোর প্রতিরোধ করতে হবে এবং শয়তানকে নিরাশ করে দিতে হবে। কারণ মানুষ যখন আল্লাহ রব্বুল আলামীন পর্যন্ত পৌঁছা, তাঁর সন্তÍষ্টি অর্জনের জন্য খুব বেশি প্রচেষ্টা করে এবং অন্তরকে পাক-পবিত্র করার জন্য এর মাধ্যমে মানুষের যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রয়েছে সেটা শক্তিশালী হয় এবং মানুষের অন্তরে যে প্রতিভা নিভে আছে সেটা জ্বলে ওঠে।

বান্দা যখন উপলব্ধি করবে যে, তার অন্তরের সুস্থতাতে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে কোন কিছু তখন তার চিকিৎসার চেষ্টা করবে। এই চিকিৎসা হবে একজন শরীরের চিকিৎসকের মতো। শারীরিক রোগের যেমন চিকিৎসা করা হয়। ঠিক তেমনি অন্তরে যেসব ব্যাধি রয়েছে সেগুলোর চিকিৎসার জন্য আপনি সচেষ্ট হবেন। আর এ ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে অন্তরের রোগ এবং সেই রোগের কারণ কী? তা নির্ণয় করতে হবে? শরীরের রোগ নির্ণয় করার জন্য ডাক্তার যেমন রোগের বিভিন্ন লক্ষণ অনুসন্ধান করে, বিভিন্ন পরীক্ষা করে ইত্যাদি।

ঠিক তেমনি আপনিও আপনার অন্তরে ব্যাধিগুলোর লক্ষণ অনুসন্ধান করবেন। অন্তর কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হল, তা উদঘাটন করার চেষ্টা করবেন। একজন চিকিৎসকের মত আপনি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখবেন যে, এসব অন্তরের যে রোগ রয়েছে সেগুলোর পরিণাম তো খুব খারাপ হবে। সুতরাং সেই পরিণাম থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে আপনার অন্তরের সুস্থতার জন্য সচেষ্ট হবে হবে। সুতরাং যার মধ্যে যেই রোগ রয়েছে, সেই রোগকে উদঘাটন করার চেষ্টা করবে। আর তারপরে সেই রোগের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিবে। কোন ব্যক্তি যদি দেখে যে, তার মধ্যে অহংকার কাজ করছে; এই অহংকার মানুষের অন্তরের সুস্থতাকে কেড়ে নেয়। সুতরাং সেটাকে দূর করার চেষ্টা করবে। অহংকার দুর করার জন্য সে নিজে স্মরণ করবে যে, আমি অত্যন্ত দুর্বল  ও তুচ্ছ মানুষ, অহংকার কেন আসবে?  আমার চেয়ে কত বড় বড় এবং কত সুস্থ মানুষ রয়েছে। আমি নিজের উপকার ও অপকার কোনটারই মালিক না, সবকিছুরই মালিক তো আল্লাহ। আমি এই অহংকারে লিপ্ত কেন হলাম? যে অহংকার আমার মধ্যে এসেছে। এই অহংকারে আসার কারণটা তো স্থায়ী নয়। এটা এখন আছে. কিছুক্ষণ পর নাও থাকতে পারে। সুতরাং আমার অহংকার যুক্তিযুক্ত নয়। যদি কোন নে‘মত আমি পেয়ে থাকি, সুখে-শান্তিতে আছি। আমি অনেক এগিয়ে যেতে পেরেছি অন্যদের থেকে, তাহলে তো এটা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং ইহসান। তাতে আমার কোন ক্ষমতা নেই? যে আল্লাহ দান করেছেন, তিনি সেটা যেকোন সময় কেড়ে নিতে পারেন। এটা স্থায়ী করার ক্ষমতা আমি রাখি না। এ কথাগুলো মনে রাখতে হবে। আমি এই নে‘মতটার সূচনা করার ক্ষমতা রাখি না, যা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। ঠিক তেমনই এই নে‘মতটাকে স্থায়ীভাবে রাখারও ক্ষমতা রাখি না। যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে, তখন তার চোখের উপর যে পর্দা আছে, সে পর্দা খুলে যাবে এবং সেই ব্যক্তির সামনে সত্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং সে উপলব্ধি করবে যে, আমি দুর্বল। তখন সে ভাল করে উপলদ্ধি করবে যে, আমার অহংকারের কোন যুক্তি নেই। সুতরাং সেই ব্যক্তি তখন সংশোধন হবে। অন্তরের সুস্থতা তার ফিরে আসবে।

আর অন্তর যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে সে বিরান অন্তর। যে অন্তর কোনদিন শান্তি পেতে পারে না। মানুষের অন্তর বিরান এবং যে অত্যাচারী; যদি তার মধ্যে আল্লাহ্র যিকির না থাকে। মানুষকে চিন্তা করতে হবে যে, পরকালে হিসাব রয়েছে, আখিরাতের যাত্রা অনেক লম্বা, জান্নাতের পথের জন্য তাকে দীর্ঘ সময় সফর করতে হবে? অথচ অন্তর যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে লম্বা সফর কিভাবে পারি দিবে এবং আখিরাতে কিভাবে হিসাব দিবে? তাকে তো আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে হিসাব দিতে হবে। এসব কথা-বার্তা আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অন্তরের সুস্থতা দান করুন-আমীন!!

পরিশেষে খত্বীব আল্লাহ্র প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠ করেন। সকল মুসলিম ও ইসলামের জন্য কল্যাণের এবং নিরাপত্তার দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।

* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

[১]. ইবনু তাইমিয়াহ, আল-মুসতাদরাক ‘আলা মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১ম খ-, পৃ. ১৫৩।
[২]. হান্নাদ ইবনু সাররী আল-কুফী, আয-যুহদ (কুয়েত : দারুল খুলাফায়ে লিল কিতাবিল ইসলামী, ১৪০৬ হি.), ২য় খ-, পৃ. ৬০০; সুলাইমান ইবনু মুহাম্মাদ, শারহুল আরবাইন আন-নবুবিয়্যাহ, ১ম খ-, পৃ. ১০১।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৪৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৩৪।
[৪]. দারেমী, হা/৩৬৪; সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৬১।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৪৯, ৩৭৮১।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৬১, ৪১৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৭০।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৭২০, সনদ ছহীহ।




আল্লাহর অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলী - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীন মানেই হচ্ছে শুভকামনা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কষ্টের পরেই সুখ আছে - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ক্রোধ সংবরণ করার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
যৌন হয়রানির ভয়াবহতা ও প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
তাক্বওয়া ও তার বহিঃপ্রকাশ - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আল-কুরআন নাজাত লাভের মাধ্যম - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
শয়তানের চক্রান্ত এবং তার প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ