রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন

 শয়তানের চক্রান্ত এবং তার প্রতিকার

-খত্বীব : শায়খ ড. বান্দার বিন আব্দুল আযীয বালীলাহ (হাফি.)
-অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী*



[২৪ জুমা. উলা. ১৪৪২ হি. ৮ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখের ‘বায়তুল হারাম, মক্কা আল-মুকাররমা’-এর জুমু‘আর খুত্ববার বঙ্গানুবাদ]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছালাত ও সালামের পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুসলিমগণ! আল্লাহকে ভয় করুন এবং সেই মহা দিবসের জন্য আমল করুন, যেদিনের তাপমাত্রা এবং রোদ্রের প্রখরতা প্রচ- হবে। সেদিন বড় ভয়াবহ দিবস হবে, সমস্ত গোপনীয় বিষয়কে উন্মোচিত করা হবে এবং সব লুক্কায়িত বস্তু প্রকাশিত হবে। সেদিন মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হবে। একদল জান্নাতে যাবে আরেক দল জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সেদিন ঐ ভয়াবহ পরিণাম থেকে মুক্তি দিতে কারো জন্য কোন শক্তি এবং সাহায্যকারী থাকবে না।

ইবলীস শয়তান ও তার চক্রান্ত

হে মুসলিমগণ! আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে তাঁর খলীফা সৃষ্টির বিষয়টি ফেরেশতাদেরকে বললে তারা সেটাকে অপসন্দ করেছিল এবং আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু যখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন যে, আমি এটা করব। তখনই তারা দ্রুত রবের নির্দেশে আত্মসমর্পন করলেন এবং এটা মেনে নিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা যা করবেন তার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। অতঃপর তিনি আদম (আলাইহিস সালাম) (আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করে ফেরেশতাদের সিজদা করার নির্দেশ দিলেন। ফেরেশতাগণ সিজদা করলেন। কিন্তু ফেরেশতাদের মধ্যে অবস্থান করা ইবলীসের অন্তরে হিংসা এবং চরম অহংকারের বহিঃপ্রকাশ হল। সে মাটির সৃষ্টি আদম (আলাইহিস সালাম)-কে সিজদা করতে অস্বীকার করল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ  اسۡجُدُوۡا  لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ قَالَ ءَاَسۡجُدُ لِمَنۡ  خَلَقۡتَ طِیۡنًا ‘স্মরণ কর, যখন আমরা ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমের প্রতি সিজদাবনত হও; তখন ইবলীস ছাড়া সবাই সিজদাবনত হল; সে বলল, আমি কি তাঁকে সিজদা করব যাকে আপনি কাদা মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন?’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৬১)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,قَالَ مَا مَنَعَکَ  اَلَّا  تَسۡجُدَ   اِذۡ   اَمَرۡتُکَ  قَالَ  اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡہُ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَہٗ مِنۡ  طِیۡنٍ ‘তিনি (আল্লাহ) তাকে (ইবলীসকে) জিজ্ঞেস করলেন, আমি যখন তোমাকে আদমকে সিজদা করতে আদেশ করলাম, তখন কোন্ বস্তু তোমাকে সিজদা করা হতে নিবৃত্ত করল? সে উত্তরে বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি হতে’ (সূরা আল-‘আরাফ : ১২)।

আল্লাহ ও মানুষের দুশমন ইবলীস তখন থেকেই আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হল, আদম সন্তানের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা শুরু করল এবং অব্যাহতভাবে এই শত্রুতা পোষণের ঘোষণা করল। গোমরাহী ও ফেৎনা সৃষ্টির পতাকা উত্তোলন করল এবং নিজে অঙ্গীকারবদ্ধ  হল যে, সে সবসময় মানব জাতির বিরুদ্ধে ওঁৎ পেতে থাকবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত থাকবে। মহান আল্লাহ ইবলীস সম্পর্কে বলেন,

قَالَ فَبِمَاۤ  اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاَقۡعُدَنَّ  لَہُمۡ صِرَاطَکَ  الۡمُسۡتَقِیۡمَ  - ثُمَّ لَاٰتِیَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ  وَ عَنۡ اَیۡمَانِہِمۡ وَ عَنۡ شَمَآئِلِہِمۡ وَ لَا تَجِدُ اَکۡثَرَہُمۡ شٰکِرِیۡنَ

‘(ইবলীস) বলল, আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন এ কারণে আমিও শপথ করে বলছি, আমি (বনী আদমকে) তাদের (বিভ্রান্ত করার) জন্য সরল পথের (মাথায়) অবশ্যই ওঁৎ পেতে বসে থাকব’। অতঃপর আমি (পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে) তাদের সম্মুখ দিয়ে, পিছন দিয়ে, ডান দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে তাদের কাছে আসব, আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞরূপে পাবেন না’ (সূরা আল-‘আরাফ : ১৬-১৭)।

চক্রান্ত নং-১ : ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানকে আঘাত করা

হে আল্লাহর বান্দারা! ইবলীস মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবসময় শত্রুতা করে এবং করতেই থাকবে। শয়তান মানুষকে কষ্ট দেয়ার ও বিভ্রান্ত করার কোন সুযোগ ছেড়ে দেয় না। সে বিভিন্ন রূপ ধারণের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে এবং মানবজাতির ক্ষতি সাধন করে। মানুষের ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই সে তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে এবং কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে। সন্তান যখন মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে আগমন করে, তখনই ইবলীস নবজাতক সন্তানের দুই পার্শ্বদেশে তার আঙ্গুল দিয়ে আঘাত করে। ফলে শিশু চিৎকার করে ও কাঁদতে থাকে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

مَا مِنْ بَنِىْ آدَمَ مَوْلُوْدٌ إِلَّا يَمَسُّهُ الشَّيْطَانُ حِيْنَ يُوْلَدُ فَيَسْتَهِلُّ صَارِخًا مِنْ مَسِّ الشَّيْطَانِ غَيْرَ مَرْيَمَ وَابْنِهَا

‘আদম সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই যার জন্মলগ্নে শয়তান তাকে স্পর্শ করেনি। অতঃপর সে শয়তানের স্পর্শে চিৎকার দেয় তবে মারইয়াম (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর পুত্র ব্যতীত’। অতঃপর আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহ আনহু)  বলতেন, যদি তোমরা ইচ্ছা কর (এটা জানতে) তাহলে পড়, وَ اِنِّیۡۤ  اُعِیۡذُہَا بِکَ وَ ذُرِّیَّتَہَا مِنَ الشَّیۡطٰنِ  الرَّجِیۡمِ ‘আমি তাঁকে ও তাঁর সন্তানদেরকে বিতাড়িত শয়তান হতে আপনার আশ্রয়ে সমর্পণ করলাম’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩৬)।[১]

চক্রান্ত নং-২ : কুমন্ত্রণা

মানবজাতির বিরুদ্ধে শয়তানের দ্বিতীয় গোপন চক্রান্ত হল- ভয়ঙ্কর কুমন্ত্রণা, যা মানুষের অন্তরে সে জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থায় দিয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّمَا  النَّجۡوٰی مِنَ الشَّیۡطٰنِ  لِیَحۡزُنَ الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا وَ لَیۡسَ بِضَآرِّہِمۡ شَیۡئًا اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ؕ وَ عَلَی اللّٰہِ  فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ

‘কানাঘুষা তো শয়তানেদের কাজ, যা মুমিনদেরকে দুঃখ দেয়ার জন্য করা হয়; তবে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত শয়তান তাদের সামান্যতম ক্ষতি করতে পারবে না। মুমিনদের কর্তব্য আল্লাহর উপর নির্ভর করা’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ১০)। আবূ ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

اَلرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ مِنَ اللهِ وَالْحُلُمُ مِنَ الشَّيْطَانِ فَإِذَا حَلَمَ أَحَدُكُمْ حُلُمًا يَخَافُهُ فَلْيَبْصُقْ عَنْ يَسَارِهِ وَلْيَتَعَوَّذْ بِاللهِ مِنْ شَرِّهَا فَإِنَّهَا لَا تَضُرُّهُ

‘নেক স্বপ্ন বা সত্য স্বপ্ন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কাজেই তোমাদের কেউ যখন ভয়ানক মন্দ স্বপ্ন দেখে তখন সে যেন তার বাম দিকে থুথু ফেলে আর শয়তানের ক্ষতি হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায়। তাহলে এমন স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[২]

চক্রান্ত নং-৩ : ছালাতের মধ্যে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়া এবং তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা

আদম সন্তানের বিরুদ্ধে ইবলীস শয়তানের আরেকটি চক্রান্ত হচ্ছে ছালাতে। একজন মুসলিম যখন ছালাত আরম্ভ করে, তখন শয়তান তাকে ষড়যন্ত্র ও সীমাহীন কষ্ট দেয়া শুরু করে। শয়তান ভালো করে জানে যে, প্রকৃত মুমিন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে থাকে। এই ছালাতই তার সততার একমাত্র মাধ্যম এবং মুক্তির উপায়। একজন মানুষের সর্বোত্তম কাজ হচ্ছে আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়া। কারণ আল্লাহ তা‘আলার সামনে সীমাহীন বিনয়ী হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হল সিজদা। যা শয়তান অস্বীকার করায় সে বিতাড়িত হয়েছে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য লাঞ্ছনা ও আক্ষেপ বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। তাই আদম সন্তান যখন আল্লাহকে সিজদা করে, তখন শয়তান অত্যন্ত কষ্ট পায় এবং আক্ষেপ করে। অনুতপ্ত হতে থাকে যে, সিজদা না করার কারণে আমার পরিণাম এত খারাপ। আর এরা সিজদা করে আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জন করে এবং ইহকাল-পরকালে সুখি থাকে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِذَا قَرَأَ ابْنُ آدَمَ السَّجْدَةَ فَسَجَدَ اعْتَزَلَ الشَّيْطَانُ يَبْكِيْ يَقُوْلُ يَا وَيْلَتِيْ أُمِرَ ابْنُ آدَمَ بِالسُّجُوْدِ فَسَجَدَ فَلَهُ الْجَنَّةُ وَأُمِرْتُ بِالسُّجُوْدِ فَأَبَيْتُ فَلِي النَّارُ 

‘আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পড়ে এবং সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে একদিকে চলে যায় এবং বলে, হায় আমার দুর্ভাগ্য! আদম সন্তানকে সিজদার আদেশ করা হলে সে সিজদা করে। ফলে তার জন্য জান্নাত। আর আমাকে সিজদার আদেশ করা হলে আমি তা অস্বীকার করেছি, ফলে আমার জন্য জাহান্নাম’।[৩]

শয়তান ছালাতের ক্ষেত্রে এক আশ্চর্যজনক কাজ করে। সে মানুষ এবং তার ছালাতের মাঝে বিভিন্নভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে। ছালাতকে ভারী করার চেষ্টা করে। ব্যস্ততা, খেলাধুলা এবং বিভিন্ন পাপে জড়িয়ে দিয়ে ছালাত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। যেমন আল্লাহ বলেন,

اِنَّمَا یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ  یُّوۡقِعَ  بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃَ  وَ الۡبَغۡضَآءَ  فِی الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ وَ یَصُدَّکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ عَنِ الصَّلٰوۃِ ۚ فَہَلۡ اَنۡتُمۡ مُّنۡتَہُوۡنَ.

‘শয়তান তো এটাই চায় যে, মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর স্মরণ হতে ও ছালাত হতে তোমাদেরকে বিরত রাখে। সুতরাং এখনও কি তোমরা বিরত হবে না?’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৯১)।

চক্রান্ত নং-৪ : ছালাতে বিলম্ব করানো

শয়তানের ষড়যন্ত্র হচ্ছে, মুমিন বান্দা যখন ছালাতের জন্য তাড়াহুড়া করে তখন শয়তান তার সংকল্পে বাধাগ্রস্ত করে এবং বিলম্ব করে ছালাতে যাওয়া ও অলসতা দেখানোর কাজটাকে সাজিয়ে পেশ করে। ছালাতের সময় পার করে দেয়া ও বিলম্ব করার জিনিসটাকে সুসজ্জিদ করে এবং বিভিন্নভাবে প্রতারিত করে। এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজী। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلَاثَ عُقَدٍ يَضْرِبُ عَلَى كُلِّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيْلٌ فَارْقُدْ فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللهَ اِنْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ تَوَضَّأَ اِنْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ صَلَّى اِنْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيْطًا طَيِّبَ النَّفْسِ وَإِلَّا أَصْبَحَ خَبِيْثَ النَّفْسِ كَسْلَانًا

‘যখন তোমাদের কেউ ঘুমায়, তখন শয়তান তার মাথার পিছন দিকে তিনটি গিরা দেয় এবং প্রত্যেক গিরার উপর প্রহার করে আর বলে, এখনও অনেক রাত্রি আছে, সুতরাং তুমি ঘুমাও। যদি সে জাগে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে একটি গিরা খুলে যায়। অতঃপর যদি সে ওযূ করে, তাহলে আরো একটি গিরা খুলে যায়। এরপর যদি সে ছালাত আদায় করে, তবে অপর গিরাটিও খুলে যায়, এভাবে সে সকালে উঠে প্রফুল্ল মন ও পবিত্র অন্তরে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষিত অন্তর ও অলস মনে’।[৪]

চক্রান্ত নং-৫ : ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ নষ্ট করা

শয়তানের আরো একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে, মুমিন বান্দা ইবাদতে যেন খুশূ‘-খুযূ‘ আনতে না পারে ও বিনয়ী হতে না পারে সে জন্য শয়তান যড়যন্ত্র করে। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য ওয়াসওয়াসা দিতে থাকে এবং ছালাতে ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত করে। যাতে করে মুছল্লী এমন পেরেশান হয়ে যায় যে, তার সমস্ত ছালাতের খুশূ‘ নষ্ট হয়ে যাবে। ছালাতে শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকই থাকে। কিন্তু মনকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে যায় তা জানা খুবই কঠিন। অথচ খুশূ‘-খুযূ‘ তথা একাগ্রতা ও মনোযোগ ছালাতের রূহ, আত্মা, মগজ এবং সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু।

একদা ওছমান ইবনু আবিল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহ আনহু) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! শয়তান আমার ও আমার ছালাত এবং ক্বিরাআতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যা তাতে তালগোল পাকিয়ে দেয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ذَاكَ شَيْطَانٌ يُقَالُ لَهُ خِنْزَبٌ فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللهِ مِنْهُ وَاتْفِلْ عَلَى يَسَارِكَ ثَلاَثًا ‘ওটা শয়তান। তাকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে, তখন তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইবে ও বামদিকে তিনবার থুতু ফেলবে’। রাবী বলেন, অতঃপর আমি এরূপ করলে আল্লাহ আমার থেকে তা দূর করে দেন।[৫]

চক্রান্ত নং-৬ : আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ লাগানো

হে মুসলিমগণ! শয়তান যে ষড়যন্ত্রে সর্বদা লিপ্ত, তা হচ্ছে- মুমিন-মুমিন, আপনজন-প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং মুসলিম ভাই-বোনদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ লাগিয়ে ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে দেয়া। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে। কারণ যদি মুমিনদের পরস্পর সম্প্রীতি ও ভালোবাসা থাকে, তাহলে তাতে আল্লাহ সন্তুষ্টি হন এবং মানুষ শান্তিতে জীবন-যাপন করতে পারে। দাম্পত্য জীবন সুখী হয়, এতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকেন এবং তাতে মানুষ ইহকাল-পরকালে শান্তি পায়। কিন্তু শয়তান মানবজাতি কল্যাণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করুক এটা চায় না।

জাবের (রাযিয়াল্লাহ আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ইবলীস পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফেৎনা সৃষ্টির জন্য চারিদিকে তার সেনাদলসমূহ প্রেরণ করে। এদের মধ্যে তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে সর্বাধিক বড় ফেৎনা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ এসে বলে, ‘আমি এরূপ এরূপ কাজ করেছি’। তখন সে বলে, তুমি কিছুই করনি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

ثُمَّ يَجِىءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُوْلُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اِمْرَأَتِهِ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيُدْنِيْهِ مِنْهُ وَيَقُوْلُ نِعْمَ أَنْتَ

‘অতঃপর একজন এসে বলে, আমি লোকটিকে ছাড়িনি, যতক্ষণ না আমি তার ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পেরেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অতঃপর শয়তান তাকে কাছে টেনে নেয় এবং বলে, তুমি কতই না সুন্দর!’ রাবী আ‘মাশ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি মনে করি জাবের (রাযিয়াল্লাহ আনহু) একথাও বলেছিলেন যে, ‘অতঃপর ইবলীস তার সাথে আলিঙ্গন করে’।[৬]

চক্রান্ত নং-৭ : মুসলিমদের মাঝে আপসে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেয়া

মুসলিম-মুমিনদের মধ্যে আপসে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেয়া শয়তানের সাত নম্বর ষড়যন্ত্র¿। সে যখন মুসলিমদেরকে শিরক, কবর-মাযার ও মূর্তি পূজা, নাস্তিক ও বড় মুনাফেক্ব বানাতে পারে না, তারপরও সে নিরাশ হয় না। বরং মানবজাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য লেগেই থাকে। যখন তাওহীদ ও সুন্নাহপন্থী মানুষদের শিরক ও বিদ‘আতে লিপ্ত করতে পারে না, তখন তাদের মধ্যে আপসে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। বর্তমানে যেমন ছহীহ আক্বীদার ভাই-বোন ও পরিবারের মধ্যে কলহ বিবাদ, দ্বীনি ভাই-বোনদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষী মনোভাব এবং সামান্য কথা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি অন্যতম। জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহ আনহুমা) বলেন, আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ أَنْ يَّعْبُدَهُ الْمُصَلُّوْنَ فِىْ جَزِيْرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِى التَّحْرِيْشِ بَيْنَهُمْ ‘শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে যে, আরব উপদ্বীপের মুছল্লীরা তাকে পূজা করবে। কিন্তু তাদের পরস্পরের মাঝে বিচ্ছেদ-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির ব্যাপারে নিরাশ হয়নি’।[৭]

আলহামদুলিল্লাহ! সঊদী আরবে মূর্তি, দরগা এবং দূর্গা পূজা নেই। শিরকের কোন আড্ডাখানাও নেই। ওখানে প্রকাশ্যে বিদ‘আত করতে কেউ সাহস পাবে না। শয়তান যখন এসব ক্ষেত্রে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে না, তখন যারা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী তাদেরকে আপসে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দেয়।

চক্রান্ত নং-৮ : মন্দকে সুন্দর করে এবং সুন্দরকে মন্দ করে পেশ করা

শয়তান মন্দকে সুন্দর করে এবং সুন্দরকে মন্দ করে পেশ করে থাকে। এটি অত্যন্ত বিষ্ময়কর ও আশ্চর্যজনক ষড়যন্ত্র। শয়তান মানবজাতির উদ্দেশ্যে আত্মগোপন করে আসে এবং গুনাহগুলোকে চমৎকারভাবে সাজিয়ে পেশ করে। যার কারণে চোখের সামনে গুনাহগুলো ভালো লাগে। যেমন, স্ত্রীকে দেখতে ভালো লাগে না কিন্তু বেগানা মহিলাদেরকে দেখতে ভালো লাগে। স্বামীকে বা স্ত্রীকে ভালো লাগে না, তার সাথে ঝগড়া বিবাদ করে। অন্যদিকে সে (স্বামী অথবা স্ত্রী) পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত থাকে। স্ত্রী, স্বামীর সাথে বা স্বামী, স্ত্রীর সাথে দু, চার, পাঁচ মিনিট কথা বলতে চায় না এবং তাকে সময়ও দিতে চায় না। ঘরে লম্বা ঘুম দেয় অথবা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বেগানা মহিলা বা পুরুষের সাথে কথা বলতে সুযোগ পেলে আর কোন দিশা থাকে না। এটা আজকাল ইন্টারনেট ও ফেৎনার যুগে শয়তানের বড় ও ভয়ঙ্কর একটি চক্রান্ত।

নেকীর কাজ করতে বললে শয়তান সেখানে এমনভাবে পেশ করে যে, মানুষ আগ্রহী হয় না। যেন নেকীর কাজ করতে কষ্ট লাগছে, ভারী লাগছে এবং তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাধা দেয়া হচ্ছে। আজকাল পশ্চিমা সভ্যতায় স্বাধীনতা-স্বাধীনতা-স্বাধীনতা বলে চিৎকার করা হচ্ছে। অথচ যদি ভালো কথা বলেন তাহলে আমার স্বাধীনতায় বাধা দিচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা প্রভৃতি শয়তানের পাতানো চক্রান্ত। এইভাবে শয়তান মানবজাতিকে প্রতারিত করে থাকে এবং পাপে লিপ্ত করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,

تَاللّٰہِ  لَقَدۡ  اَرۡسَلۡنَاۤ  اِلٰۤی اُمَمٍ مِّنۡ قَبۡلِکَ فَزَیَّنَ لَہُمُ الشَّیۡطٰنُ اَعۡمَالَہُمۡ فَہُوَ وَلِیُّہُمُ الۡیَوۡمَ  وَ لَہُمۡ  عَذَابٌ  اَلِیۡمٌ

‘শপথ আল্লাহর! আমরা আপনার পূর্বেও বহু জাতির নিকট (রাসূল) প্রেরণ করেছি; কিন্তু শয়তান ঐ সব জাতির কার্যকলাপ তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল; সুতরাং সে আজ তাদের অভিভাবক এবং তাদেরই জন্য পীড়াদায়ক শান্তি’ (সূরা আন-নাহল : ৬৩)। শয়তানের ষড়যন্ত্র বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

لَعَنَہُ اللّٰہُ  وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنۡ عِبَادِکَ نَصِیۡبًا مَّفۡرُوۡضًا  - وَّ لَاُضِلَّنَّہُمۡ وَ لَاُمَنِّیَنَّہُمۡ وَ لَاٰمُرَنَّہُمۡ فَلَیُبَتِّکُنَّ اٰذَانَ الۡاَنۡعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّہُمۡ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلۡقَ اللّٰہِ وَ مَنۡ یَّتَّخِذِ الشَّیۡطٰنَ وَلِیًّا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ فَقَدۡ خَسِرَ  خُسۡرَانًا مُّبِیۡنًا    - یَعِدُہُمۡ وَ یُمَنِّیۡہِمۡ وَ مَا یَعِدُہُمُ الشَّیۡطٰنُ  اِلَّا  غُرُوۡرًا

‘আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং সে বলেছিল যে, আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের হতে এক নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করব এবং নিশ্চয় আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, মিথ্যা আশ্বাস দিব এবং তাদেরকে আদেশ করব, যেন তারা পশুর কর্ণ ছেদন করে এবং তাদেরকে আদেশ করব, যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে। যে আল্লাহকে পরিত্যাগ করে, নিশ্চয় সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন ও আশ্বাস দান করেন এবং শয়তান প্রতারণা ব্যতীত তাদেরকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে না’ (সূরা আন-নিসা : ১১৮-১২০)।

চক্রান্ত নং-৯ : উলঙ্গ বা বস্ত্রহীন করা

শয়তানের আরেকটি জঘন্য ষড়যন্ত্র হল- আদম সন্তানকে বস্ত্রহীন করা। বর্তমানে এক শ্রেণীর অসৎ এবং অজ্ঞ লোকেরা বস্ত্রহীন, উলঙ্গ এবং অর্ধ উলঙ্গ হয়ে চলাফেরাকে সভ্যতা মনে করছে। তাহলে তো সবচেয়ে বড় সভ্য হচ্ছে হিং¯্র পশু, যে কখনে শরীরে বস্ত্র রাখে না। শয়তান আদম সন্তানকে বস্ত্রহীন ও উলঙ্গ করতে চায় এবং লজ্জাস্থান খুলে দিতে চায়। এর মাধ্যমে তাদের মাঝে বিপর্যয় আনতে চায়। তাদের যে কামনা-বাসনা ও যৌন চাহিদা রয়েছে, তাতে আগুন লাগিয়ে দিতে চায় এবং ঈমানের জ্যোতি কেড়ে নিতে চায়। যা শয়তানের প্রাচীন ষড়যন্ত্র। কেননা সে এই ষড়যন্ত্র সর্বপ্রথম আদম (আলাইহিস সালাম) এবং হাওয়া (আলাইহিস সালাম) -এর বিরূদ্ধে করেছিল। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰبَنِیۡۤ  اٰدَمَ  قَدۡ  اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ  لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَ رِیۡشًا ؕ وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ  لَعَلَّہُمۡ  یَذَّکَّرُوۡنَ  - یٰبَنِیۡۤ  اٰدَمَ  لَا یَفۡتِنَنَّکُمُ الشَّیۡطٰنُ کَمَاۤ اَخۡرَجَ  اَبَوَیۡکُمۡ  مِّنَ الۡجَنَّۃِ یَنۡزِعُ عَنۡہُمَا لِبَاسَہُمَا لِیُرِیَہُمَا سَوۡاٰتِہِمَا ؕ اِنَّہٗ یَرٰىکُمۡ ہُوَ وَ قَبِیۡلُہٗ مِنۡ حَیۡثُ لَا تَرَوۡنَہُمۡ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا الشَّیٰطِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ  لِلَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

‘হে আদম সন্তানগণ! আমরা তোমাদেরকে লজ্জাস্থান আবৃত করার ও বেশভূষার জন্য তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদের উপকরণ অবতীর্ণ করেছি (বেশভূষার তুলনায়) আল্লাহভীতি পরিচ্ছদই সর্বোত্তম পরিচ্ছদ এটা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম নিদর্শন, সম্ভবত মানুষ এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করবে। হে আদম সন্তানগণ! শয়তান যেন তোমাদেরকে সেরূপ ফেৎনায় জড়িয়ে ফেলতে না পারে যেরূপ তোমাদের পিতা-মাতাকে (ফেৎনায় ফেলে) জান্নাত হতে বহিস্কৃত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাবার জন্য বিবস্ত্র করেছিল, সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখতে পায় যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না, নিঃসন্দেহে শয়তানকে আমরা বেঈমান লোকদের বন্ধু ও অভিভাবক বানিয়ে দিয়েছি’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২৬-২৭)।

অতএব হে মুমিনগণ! কুরআনে আল্লাহর যে উপদেশগুলো রয়েছে সেগুলো মনোযোগী হয়ে শ্রবণ করুন এবং তা বাস্তবায়ন করুন। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنَّ  وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّکُمُ الۡحَیٰوۃُ  الدُّنۡیَا ٝ وَ لَا یَغُرَّنَّکُمۡ  بِاللّٰہِ   الۡغَرُوۡرُ   -اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ  لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ  اَصۡحٰبِ  السَّعِیۡرِ

‘হে মানুষ! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সে (শয়তান) যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে প্রবঞ্চিত না করে। নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলকে আহ্বান করে শুধু এই জন্য যে, তারা যেন জাহান্নামী হয়’ (সূরা আল-ফাতির : ৫-৬)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহর ইলম দিয়ে উপকৃত করেন।

ছানী খুত্ববাহ

হাম্দ ও ছানার পরে সম্মানিত খত্বীব বলেছেন, হে মুমিনগণ! জেনে রাখুন, শয়তান যদিও মানবজাতির বিপর্যয় সৃষ্টিকারী তবুও শয়তানের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু তার সৃষ্টিতে অনেক তত্ত্ব ও আশ্চর্যজনক রহস্য রয়েছে। তাকে সৃষ্টি করার রহস্য বহুমুখী। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) কয়েকটি রহস্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-

রহস্য-১ : আল্লাহ তা‘আলার গোলামী প্রকাশ পাওয়া। যদি ইবলীসকে সৃষ্টি করা না হত, তাহলে বান্দার জন্য আল্লাহর গোলামী ও ঊবূদিয়্যাতের বাস্তবায়ন হাসিল হত না। যেমন ভালো কাজের উপদেশ দেয়া আর অন্যায় কাজে বাধা দেয়া। শয়তানই যদি না থাকত, তাহলে কোন মানুষ মন্দ কাজ করত না। আর মন্দ কাজ থেকে বাধা দেয়ার ও ভালো কাজের উপদেশ দেয়ার প্রয়োজনই হত না।

রহস্য-২ : তওবার বাস্তবায়ন। শয়তান যদি না থাকত, তাহলে পাপও হত না; তওবারও প্রয়োজন হত না। শয়তানই যদি না থাকত তাহলে তওবা ও ইস্তেগফারের ইবাদত থেকে মানবজাতি বঞ্চিত থাকত।

রহস্য-৩ : আল্লাহ তা‘আলার শত্রুর বিরোধিতা করা। ইবলীস হল আল্লাহ এবং তাঁর বান্দার শত্রু। এই শত্রুর বিরোধিতা করার মাধ্যমে আল্লাহর গোলামী প্রকাশ করা। সুতরাং তিনি চান যে, তাঁর বান্দা দুশমনকে রাগান্বিত ও লাঞ্চিত করুক। তাঁর দুশমনের যেটা খারাপ লাগে সেই রকম কিছু করুক। এটি এমন একটি সূক্ষ্ম গোলামী যেটি জ্ঞানী মানুষ ছাড়া অন্য কারো অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

রহস্য-৪ : শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় কামনা করা। যদি শয়তান না থাকত তাহলে মানুষ তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করত না বা করার প্রয়োজনই হত না। এছাড়া এটি একটি আল্লাহর বড় ইবাদতও।

রহস্য-৫ : মানুষ যেন শুধু আশায় প্রতারিত হয়ে এবং আকাক্সক্ষা নিয়ে বসে না থাকে। বরং বান্দা আল্লাহর নাফরমানীকে অত্যন্ত ভয় পাবে এবং শয়তান থেকে সাবধান থাকবে। তারা চিন্তা করবে যে, ইবলীস আদমকে সিজদা না করে আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ করে নাফরমানী করেছিল। আমরাও যদি সেরকমই নাফরমানী করি, তাহলে আমরাও শয়তানের কাতারে দাঁড়িয়ে যাব।

রহস্য-৬ : আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির প্রকৃতিতে ভালো এবং মন্দ দু’টি ক্ষমতা নিহিত রেখেছেন। মানুষের যেমন ভালো কথা ও কাজের ক্ষমতা রয়েছে, তেমনি মন্দ কথা ও কাজের ক্ষমতাও রয়েছে। শয়তানকে সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃতিতে যে খারাপ শক্তি রয়েছে, তা তার খারাপ কাজের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে।

উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হল যে, শয়তান মানবজাতির এত অনিষ্টকারী হওয়া সত্ত্বেও শয়তানকে সৃষ্টি করার রহস্য কী?

প্রতিকার

১). শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করা। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিবেন।

২). আল্লাহ তা‘আলার উপর সত্যিকার আশা ও ভরসা রাখা। মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّہٗ  لَیۡسَ لَہٗ  سُلۡطٰنٌ عَلَی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا  وَ عَلٰی  رَبِّہِمۡ  یَتَوَکَّلُوۡنَ

‘তার (শয়তানের) কোন আধিপত্য নেই তাদের উপর, যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে’ (সূরা আন-নাহল : ৯৯)।

৩). সর্বদা শরী‘আতসম্মত যিকির-আযকারে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। সেই যিকির যেকোন সময়, কাজ ও ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে অথবা অনির্দিষ্ট যিকির-আযকার হতে পারে। যেমন, ছালাতের সাথে সম্পৃক্ত যিকির হল- ফরয ছলাতের পরে; বিভিন্ন কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত যিকির হল- ঘুমের পূর্বে, মাঝে ও পরে। বাড়িতে প্রবেশের ও বের হবার সময়, কোন স্থানে অবতরণের সময় ইত্যাদি। বান্দা যতবেশী যিকির-আযকার করবে, ততবেশী শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। আর সেক্ষেত্রে শয়তান দুর্বল হবে এবং তার ষড়যন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়বে। শয়তান যখনই আদম সন্তানকে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে, তখনই যিকির-আযকার করলে তা দূরীভূত হয়, আত্মগোপন করে, লাঞ্চিত ও পদদলিত হয়ে যায়।

৪). কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে সর্বদা সতর্ক-সাবধান থাকা। কখনও মনের খারাপ চাহিদা পূরণ করবেন না। মনের যে খারাপ কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, তার অনুসরণ করবেন না। সতর্ক-সাবধান থাকবেন। শয়তান মনের চাহিদাগুলোকে সাজিয়ে পেশ করে। যখন একজন মানুষ সাবধান হবে, তখন মনের সেই অসৎ বা অবৈধ চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে শয়তানের অনিষ্ট এবং ষড়যন্ত্র থেকে নিরাপদ থাকবেন। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি এর বিপরীত করবে সে ব্যক্তি শয়তানের জালে ফেসে যাবে। আর যদি ভুলভ্রান্তি হয় কিংবা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ ও অন্যায় কাজ করেই ফেলে, তবে এক্ষেত্রে করণীয় হল- দ্রুত তার যে কুপ্রভাব রয়েছে সেটা ইস্তেগফার, তাওবা এবং বেশী বেশী নেকীর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে তা মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। এর মাধ্যমে শয়তান কষ্ট পাবে, লাঞ্চিত হবে এবং তারা অনিষ্ট দূরীভূত হবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীন, দুনিয়া, শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থ-সম্পদ, রুজি-রোজগার এবং শয়তানের যাবতীয় অনিষ্ট ও ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন এবং মুসলিমদের হেফাযত করেন-আমীন!!

পরিশেষে খত্বীব ছাহেব আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর দরূদ পাঠ করেন। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের জন্য কল্যাণের ও নিরাপত্তার দু‘আ চাওয়ার মাধ্যমে খুত্ববাহ সমাপ্ত করেন।


* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৪৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৬৬; মিশকাত, হা/৬৯।       
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৯২; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৬১; মিশকাত, হা/৪৬১২।               
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১; ইবনু মাজাহ, হা/১০৫২; মিশকাত, হা/৮৯৫।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭৬; মিশকাত, হা/১২১৯।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৩; মুসতাদরাক হাকেম, হা/৭৫১৪; মিশকাত, হা/৭৭। 
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১৩, ‘জান্নাত, জাহান্নাম ও ক্বিয়ামতের বিবরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭; মিশকাত, হা/৭১।        
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১২; মিশকাত, হা/৭২।                    




প্রসঙ্গসমূহ »: পাপ আত্মশুদ্ধি
দ্বীনি ইলম অর্জনের গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
দ্বীন রক্ষায় আলেমদের অবদান - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের ফযীলত - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
নেক কাজে অটলতা - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
ক্রোধ সংবরণ করার গুরুত্ব - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ডাক্তারের গুরুত্ব ও মর্যাদা - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
কোমল ও নম্র আচরণ - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
সর্বত্রই আল্লাহকে ভয় করুন - অনুবাদ : হারূনুর রশীদ ত্রিশালী আল-মাদানী
আরাফাহর খুৎবাহ - অনুবাদ : ড. মুহাম্মাদ মানজুরে এলাহী
ইসলামী শরী‘আহর সৌন্দর্য - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
যৌন হয়রানির ভয়াবহতা ও প্রতিকার - অনুবাদ : শায়খ মতিউর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ