যেমন ছিল সালাফদের রামাযান
-মাযহারুল ইসলাম*
ভূমিকা
রামাযান মাস কল্যাণের মাস। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত যাবতীয় কল্যাণের সমাহার নিয়ে বছর ঘুরে আমাদের সামনে রামাযান উপস্থিত হয়। রহমত, বরকত আর মাগফিরাতের সামষ্টিক রূপ রামাযান। সত্যিকার অর্থে ঐ ব্যক্তি ব্যর্থ, বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত যে এই মহান মাস পেল অথচ ছিয়াম রাখতে পারল না। এই সুবর্ণ বর্ণাঢ্য আয়োজনে যেখানে ইসলামের বিভিন্ন ইবাদত একাকার হয়। যেই ইবাদতের একেকটি মহা মূল্যবান, ফলাফল কাঙ্ক্ষিত জান্নাত। ছিয়াম এমন একটি ইবাদত যেই ইবাদতের ছওয়াব আনলিমিটেড ও পুরস্কারও মহান রবের হাত থেকে পাওয়া যায়। সুবহানআল্লাহ। কতই না সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তির জীবন, যে এমন প্রভূত কল্যাণের মালিক হতে পারে। তাই তো আমরা দেখি ছাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের পূর্বসূরী সালাফে ছালিহীন রামাযানের ছিয়ামকে পাওয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই দু‘আ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। ব্যবসা বাণিজ্য, দারস-তাদরীস, দায়বদ্ধতা ও সফর ছাড়াও সকল কিছু থেকে মুক্ত থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতেন। মূলত বক্ষমাণ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হল- উৎসাহ, উদ্দীপনা সৃষ্টি করা এবং তাঁদের রামাযানের ছিয়াম সাধনা, পরিশ্রম, লৌকিকতাহীন ইবাদত করে ছিয়ামের যথার্থ হক আদায় করে উভয় জীবনে সফলতার পথে চলা। তাই আমরাও তাঁদের মত আলোকজ্জ্বল অনুপ্রেরণার জীবন গড়তে তাঁদের ইবাদতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জান্নাত কামনা করতে চাই।
যেভাবে সালাফগণ রামাযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন
সালাফগণ রামাযান আসার পূর্বে নানা রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। রামাযানকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন, রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের পাবন্দি হওয়ার জন্য তারা সদা উদগ্রীব ছিলেন। রামাযানের এই ইবাদতের মৌসুমকে উপলক্ষে তাঁদের চেহারায় আনন্দের ছাপ ভাসত। সদা হাস্যোজ্জ্বল, পরিস্ফুটিত চেহারা জ্বলজ্বল করত। তাঁদের রামাযানের প্রস্তুতি হত দু‘আ করার মাধ্যমে। কেননা রামাযান মাসে যাবতীয় কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করা হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। যে মাস কুরআনের মাস। সে কারণে তাঁরা আনন্দে আবেগাপ্লুত হত। আনন্দ, খুশির বহিঃপ্রকাশ করত। তাঁরা রামাযানের আগমনে যাবতীয় দায়বদ্ধতা, কর্মব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকার প্রস্তুতি নিত। উদ্দেশ্য যেন রামাযান মাসের ইবাদত হাতছাড়া না হয়। যথাযথভাবে প্রত্যেক সময়কে মূল্যায়ন করতে তাঁরা বিভিন্ন পথ ও পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন,
- >> কতিপয় সালাফ থেকে বর্ণিত যে, ‘তাঁরা আল্লাহর কাছে ৬ মাস দু‘আ করতেন এই মর্মে যে, যেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের রামাযানে পৌঁছান (তথা তাঁরা ছিয়াম রাখতে পারেন)। অতঃপর রামাযান পরবর্তী ৫ মাস তাঁরা দু‘আ করতেন আল্লাহর কাছে যেন তাদের ছিয়াম আল্লাহ কবুল করেন। অতঃপর তাঁরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করতেন যেন আল্লাহ তাদের রামাযানে উপনীত করে দ্বীন ও শারীরিক কল্যাণের উপর এবং তাঁরা আল্লাহকে ডাকতেন যেন তিনি তাঁদেরকে তাঁর আনুগত্যের উপর সাহায্য করেন। তাঁরা দু‘আ করতেন যেন আল্লাহ তা‘আলা আমলসমূহ কবুল করেন’।[১]
- >> রামাযানের ছিয়ামের সাথে অন্যান্য ইবাদত পালনে কোনরকম ঘাটতির সম্ভাবনা এড়াতে সালাফগণ শা‘বান মাসে বেশি করে ছিয়াম রাখার অনুশীলন করতেন।
- >> রামাযান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। এজন্য বলা হয় রামাযান কুরআনের মাস। কুরআন তেলাওয়াত, উপলব্ধি, অনুধাবন এবং তাঁর বাস্তব চিত্র জীবনে ধারণ করার সুবর্ণ সুযোগ হল রামাযান মাস। এজন্য লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সালাফগণ শা‘বান মাসেই কুরআন তেলাওয়াতের পরিবেশ তৈরি করতেন। ছাহাবী আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘মুসলিমদের কাছে যখন শা‘বান মাস উপনীত হয়, তখন তাঁরা কুরআনের মাছহাফের উপর উপুড় হয়ে পড়ত’।[২]
- >> সালামাহ ইবনে কুহাইল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘শা‘বান মাসকে তেলাওয়াতকারীদের মাস বলা হত। ক্বারীদের মাস’। শা‘বান মাস শুরু হলে আমর ইবনে কায়েস (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর দোকান বন্ধ রাখতেন এবং কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন। আবূ বকর আল-বালখী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘রজব মাস হল- বীজ বপনের মাস। শা‘বান মাস হল- ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রামাযান মাস হল- ফসল তোলার মাস’। তিনি আরও বলেছেন, ‘রজব মাসের উদাহরণ হল- বাতাসের ন্যায়, শা‘বান মাসের উদাহরণ হল- মেঘের ন্যায়, রামাযান মাসের উদাহরণ হল- বৃষ্টির ন্যায়। তাই যে ব্যক্তি রজব মাসে বীজ বপন করল না, শা‘বান মাসে সেচ প্রদান করল না, সে কিভাবে রামাযান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?’[৩]
- >> ঈমাম মালেক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) যখন রমাযান মাস প্রবেশ করত তখন তিনি হাদীছের দারস থেকে সরে যেতেন। অতঃপর তেলাওয়াতের জন্য শুধু কুরআন গ্রহণ করতেন।[৪]
- >> সুফিয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন রমাযান মাস আগমন করত তখন তিনি যাবতীয় ইবাদত পরিত্যাগ করে শুধু কুরআন গ্রহণ করতেন।[৫]
যেমন ছিল সালাফদের রামাযানের দিনানিপাত
রামাযানের ছিয়াম মানেই হল আত্মসংযম, যাবতীয় অন্যায়, অশালীন, মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা। গীবত, তোহমত, সূদ, ঘুষ, মিথ্যাচার ছাড়াও সকল প্রকারের পাপ থেকে বিরত থাকার নামই ছিয়াম তথা ছিয়াম। যেহেতু ছিয়াম মানুষকে বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ সকল প্রকারের পাপের পথকে নিষেধ করে তাই একজন ছিয়ামপালনকারীর জীবন হয় পরিমার্জিত, সুসজ্জিত ও সুগঠিত। পাপের কোন প্রকার গন্ধ তাঁর শরীরে পাওয়া যাবে না বলেই ছিয়াম নিয়ে আসে বড় আত্মসংযমী শিক্ষা। সুধী পাঠক! লক্ষ্য করুন সালাফগণ রামাযানের ছিয়াম থাকা অবস্থায় কিভাবে দিনাতিপাত করতেন। তাদের চিত্র আর আমাদের জীবনযাত্রার চলমান চিত্রকে তুলনা করুন। দেখুন আমাদের কত করুণ অবস্থা!
সালাফগণ রামাযান মাসে খেতেন হিসাব করে। কম খেতেন, কম ঘুমাতেন, কম কথা বলতেন, ঘোরাফেরা খুব কমই করতেন। সব সময় ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সকল ধরনের পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁরা ইবাদত বিমুখ চিন্তা-চেতনায় মশগুল থাকা থেকে যথাযথ বিরত থাকতেন। তাঁরা পরস্পর সৎ কাজের প্রতিযোগিতা করতেন। প্রত্যেক সময়ের মূল্যায়ন করতেন। ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সময় নষ্ট মৃত্যুর চেয়েও বেশি কঠিন। কেননা সময় নষ্ট আল্লাহ ও পরকাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে আর মৃত্যু তোমাকে দুনিয়া ও তোমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে’।[৬]
ছিয়াম শুধুই ভুখা থেকে দিনযাপনের নাম নয়। বরং ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত এক ব্যাপক পরিবর্তনের কর্মসূচির নাম। ছিয়াম যেমন ছিয়াম পালনকারীর ছিয়ামকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়ে থাকে যা আল্লাহর আবশ্যকীয় হক। ঠিক তেমনি ছিয়াম আরো শিক্ষা দেয় ছিয়াম থাকা অবস্থায় কিভাবে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, জিহ্বাকে হেফাযত করা যায়। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘যখন তুমি ছিয়াম রাখবে তখন তুমি তোমার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির ছিয়াম রাখো। তোমার জিহ্বাকে যাবতীয় মিথ্যাচার ও হারাম থেকে বিরত থাকার ছিয়াম রাখো এবং প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। তোমার উপর আবশ্যক হল ছিয়াম থাকা অবস্থায় নম্র, বিনয়ী ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা। খবরদার! ছিয়ামের দিন আর অন্য দিনসমূহকে একই মনে করিও না’।[৭]
সালাফগণ রামাযানে ছিয়াম থাকা অবস্থায় গীবত, মিথ্যাচার, মূর্খতামূলক আচরণ থেকে বিরত থাকতেন, যাতে করে ছিয়ামের উপর প্রভাব না পড়ে। ইবনুল মুনকাদির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তি যখন গীবত করে তখন সে ছিয়ামকে ছিদ্র করে। আর যখন ইস্তিগফার করে তখন তা জোড়াতালি লাগে।[৮] তাঁরা ছিয়াম থাকা অবস্থায় ছালাত, ছিয়ামের পাশাপাশি দান-ছাদাক্বাহ, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ও মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।
ছিয়ামকে ‘ঢালস্বরূপ’ বলা হয় কেন?
যুদ্ধের মাঠে যেমন বিরোধী দল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় প্রতিপক্ষকে হেনস্থা ও পরাজয় করার জন্য, ঠিক এমন সংকটময় যুদ্ধ ময়দানে প্রতিপক্ষের তরবারী, তীর ও অস্ত্রশস্ত্র থেকে নিজেকে সুরক্ষা ও হেফাজত রাখার জন্য সেনাবাহিনীরা যে বস্তু ব্যবহার করে তাঁকে ঢাল বলে। ছিয়ামকে ‘ঢাল’ বলা হয়েছে এজন্য যে, ‘ঢাল যেমন ব্যক্তিকে যুদ্ধের ময়দানে আঘাত ও তীরসহ যাবতীয় অস্ত্র থেকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি ছিয়াম বান্দাকে তার দুনিয়ার জীবনে যাবতীয় পাপাচার ও অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করে। মনে রাখবেন! যদি ছিয়াম দুনিয়ার জীবনে যাবতীয় পাপাচার ও অবাধ্যতা থেকে বাঁচার জন্য ‘ঢালস্বরূপ’ হয়, তাহলে সেই ছিয়াম তার জন্য পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ‘ঢাল’ হিসাবে কাজ করবে। পক্ষান্তরে যদি দুনিয়ার জীবনে ছিয়াম যাবতীয় পাপাচার অবাধ্যতা থেকে বাঁচার জন্য ‘ঢাল’ হিসাব কাজ না করে, তাহলে পরকালেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ঢাল হিসাবে কাজ করবে না। এজন্য ছিয়ামকে ঢালের সাথে তুলনা করা হয়েছে।[৯]
সালাফদের ক্বিয়ামুল লাইল
সালাফগণ ক্বিয়ামুল লাইল নিয়মিত পালন করতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেমন,
১. ইবনু মুনকাদির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তিনটি জিনিস ছাড়া দুনিয়ার কোন স্থায়ী স্বাদ নেই। যথা : ১- ক্বিয়ামুল লাইল (তারাবীহ/তাহাজ্জুদ), ২- মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং ৩- জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়’।
২. আবূ সুলাইমান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘খেল-তামাশায় মত্ত প্রেমিকদের চেয়ে ইবাদতগুজার ব্যক্তির রাত জেগে ইবাদতে মশগুল থাকাতে রয়েছে অনেক স্বাদ ও মিষ্টতা। যদি রাত না থাকত, তাহলে দুনিয়াতে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আমার কোন ইচ্ছাই থাকত না’।
৩. জনৈক সালাফ বলেন, ‘যদি রাজা-বাদশাহরা জানত যে, আমরা রাতে কী নে‘মত পাই, তাহলে তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র দ্বারা লড়াই করত’।
৪. আলী ইবনু বকর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘চল্লিশ বছর সূর্য উদিত ছাড়া আমাকে অন্য কিছু চিন্তাগ্রস্ত করেনি’।
৫. ফুযাইল ইবনু ই‘আয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যখন সূর্য অস্ত যায় তখন আমি আনন্দিত হই এজন্য যে, রাত্রি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে আমার রবের সান্নিধ্যে একাকীত্বের জন্য। আর যখন সূর্য উদিত হয় মানুষের সামনে তখন আমি চিন্তাগ্রস্ত হই’।[১০]
সালাফদের ঈদ উদযাপন
ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু সালাফদের ঈদের আনন্দ ছিল ভিন্ন স্বাধের ও ভিন্ন রকমের। যেমন,
১. ইবনু রজব হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য নয়, যে নতুন পোশাক পরিধান করে; বরং ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য, যে তার আনুগত্য বৃদ্ধি করে। ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য নয় যে নতুন পোশাকের সাজসজ্জা ও গাড়ি বহর প্রদর্শন করে; বরং ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য, যার পাপকে মোচন করা হয়েছে’।[১১]
২. একদিন এক ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের দিন আমীরুল মুমিনীন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে প্রবেশ করে তাঁর কাছে একটি শুকনো রুটি দেখতে পান। লোকটি শুকনো রুটি দেখে বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আজকে ঈদের দিন অথচ শক্ত শুকনো রুটি! আলী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে বলেন, ‘আজকে ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য যার ছিয়াম, ক্বিয়াম কবুল করা হয়েছে। ঈদ ঐ ব্যক্তির জন্য যার পাপ ক্ষমা করা হয়েছে এবং আমলকে কবুল করা হয়েছে। আজকে আমাদের জন্য ঈদ, আগামীকালও আমাদের জন্য ঈদ। প্রত্যেক এমন দিন যে দিনে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয় না সেই দিন আমাদের ঈদ’।[১২]
৩. সুফিয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কতিপয় সাথী বলেন, ‘আমি ঈদের দিন তাঁর সাথে বের হয়েছিলাম। অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমরা এই দিন সর্বপ্রথম শুরু করব চোখ নিম্নগামী করার মাধ্যমে’।[১৩]
৪. কতিপয় সালাফদের মুখে হতাশা, দুশ্চিন্তার ছাপ প্রকাশ পায় ঈদের দিনে। ঈদের দিন আনন্দ ও খুশির বদলে এমন মলিন চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করা হল: আজকের দিন হল খুশির ও আনন্দের। অতঃপর তিনি প্রতিত্তোরে বলেন, তোমরা সত্য বলেছ। কিন্তু আমি এমন একজন বান্দা যে, আমার রব আমাকে আদেশ করেছে তাঁর জন্য এমন আমল করার অথচ আমি জানি না যে, সে আমল আমি করতে পেরেছি কিনা!’[১৪]
৫. হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘প্রত্যেক এমন দিন যে দিনে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয় না সেটাই হল ঈদ’।[১৫]
রামাযান ও রামাযান পরবর্তী সালাফদের কুরআন খতম
- >> ইমাম ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কোন কোন সালাফ রামাযানের ক্বিয়ামুল লাইলে তিন রাত্রে কুরআন খতম করতেন। ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) প্রত্যেক সাত রাত্রে কুরআন খতম করতেন। আবূ রাজা আত্তারিদি (রাহিমাহুল্লাহ) প্রত্যেক দশ রাত্রে কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ রামাযানের ছালাত ও ছালাত ছাড়া কুরআন খতম করতেন। আসওয়াদ (রাহিমাহুল্লাহ) রামাযানের প্রত্যেক দুই রাতে খতম করতেন। বিশেষ করে ইমাম নাখয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) রামাযানের শেষ দশকে কুরআন খতম করতেন। আর মাসের অন্যান্য সময়ে তিন রাতে খতম করতেন।[১৬]
- >> ইমাম যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) রামাযান মাস উপস্থিত হলে বলতেন, নিশ্চয় এ মাস কুরআন তেলাওয়াত ও খাবার খাওয়ানোর মাস।[১৭]
- >> হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুকসিম ইবনু সাঈদ বলেছেন, রামাযান মাসে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট রাতের প্রথম ভাগে তার সাথীবৃন্দ জমায়েত হত। তিনি তাদরেকে নিয়ে ছালাত আদায় করতেন। প্রতি রাক‘আতে বিশ আয়াত তেলাওয়াত করতেন। এভাবেই তিনি কুরআন খতম করতেন। আর সাহারীর সময় অর্ধেক থেকে এক তৃতীয়াংশ পাঠ করতেন। আর প্রতি রাতে ইফতারের সময় তার খতম সম্পন্ন হত।[১৮]
- >> আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) রামাযানের প্রথম অংশে মুছহাফ নিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। অতঃপর সূর্য উদয় হওয়ার পর তিনি ঘুমাতেন।[১৯]
- >> ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) সালাফদের কুরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে বলেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হওয়া এবং বেশি বেশি তেলাওয়াত করা আবশ্যক। সালাফগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী খতম করতেন। এটা তাঁদের নিয়মিত অভ্যাস ছিল’।[২০]
- >> সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ দু’মাসে একবার কুরআন খতম দিতেন। আর কেউ কেউ এক মাসে একবার কুরআন খতম দিতেন। কেউ কেউ ১০ দিনে একবার কুরআন খতম দিতেন। কেউ কেউ ৮ দিনে একবার কুরআন খতম দিতেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ৭ দিনে একবার কুরআন খতম দিতেন। কেউ কেউ ৬ দিনে দিতেন। কেউ পাঁচ দিনে, কেউ চার দিনে। কেউ তিন দিনে, কেউ দুই দিনে আবার কেউ দিনে রাতে একবার কুরআন খতম দিতেন। কেউ কেউ দিনে একবার রাতে একবার কুরআন খতম দিতেন। কেউ দিনে তিন বার আবার কেউ দিনে চারবার রাতে চারবার মোট আটবার কুরআন খতম দিতেন।[২১] যারা দিনে ও রাতে একবার কুরআন খতম দিতেন তারা হল- উছমান ইবন আফ্ফান, তামীম দারী, সাঈদ বিন জুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহুম), মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ), শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ)। আর যারা তিনবার খতম দিতেন তারা হলেন সুলাইম বিন ঈতর (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আবু বকর বিন আবু দাঊদ। তাদের মধ্যে যারা রাতেই চারবার খতম দিতেন তিনি হলেন আবূ ওমর আল-কিন্দি। আর যারা দিনে রাতে মোট আটবার কুরআন খতম দিতেন তিনি হলেন উছমান আল-মাগরীবী।[২২]
সুধী পাঠক! যদিও তিন দিন ও তিন রাতের কম সময়ে কুরআন খতম করতে নিষেধ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَا يَفْقَهُ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِىْ أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ ‘যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করল সে তার মর্ম বুঝবে না’।[২৩] তবে এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম করাকে কেবল সর্বদা পাঠ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ সময় যেমন রামাযান মাস ইত্যাদি, সময়ে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব’।[২৪]
শায়খ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুমিন-মুমিনার জন্য শরী‘আতসম্মত হল- ফায়দা অর্জন, ইলম হাসিল, অন্তরের একাগ্রতা এবং কালামুল্লাহ থেকে উপকার লাভের আশা করা। তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদাব্বুর তথা চিন্তা-ভাবনা, তা‘আক্কুল তথা বুঝতে পারা এবং বেশি বেশি আমল করা; শুধু খতমের আশায় তেলাওয়াত না করা। উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কালামুল্লাহ থেকে উপকার এবং অন্তরের একাগ্রতা ও বিন¤্রতা অর্জন করা, কুরআন অনুযায়ী আমল করা এবং যা তেলাওয়াত করা হয় তা অনুধাবনের মাধ্যমে অন্তর নরম করা। আর যদি কেউ কুরআন স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করে এবং তিনদিনে খতম করে অথবা পাঁচদিনে বা সাতদিনে তাহলে কোন অসুবিধা নেই। তবে উত্তম হল, তিনদিনের কম সময়ে খতম না করা। তাই প্রত্যেক দিন দশপারা তেলাওয়াত করা, যাতে করে তাদাব্বুর বা চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা যায়, যাতে তা‘আক্কুল তথা পুরোপুরি বুঝতে পারা যায় ও তাড়াতাড়ি না হয়। আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে তাওফীক দান করুন’।[২৫]
রামাযানের শেষে সালাফদের অবস্থা
রামাযানের শেষে সালাফদের চেহারা বিষন্ন ও বিবর্ণ হয়ে হত। ভারাক্রান্ত মনে তাঁরা রামাযানের প্রাপ্তি নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন যেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই দীর্ঘ সাধনা কবুল করেন। যেমন,
১. বাশার আল-হাফী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, এমন গোত্র আছে যারা রামাযানে ইবাদতগুজার ও আমলের ক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম করে। অতঃপর রামাযান শেষ হলে তা পরিত্যাগ করে। তিনি একথা শুনে বলেন, ঐ ক্বওম কতই না নিকৃষ্ট যারা রামাযান ছাড়া আল্লাহকে চিনে না।[২৬]
২. খলীফা ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) ঈদুল ফিতরের দিন বের হলেন অতঃপর তিনি খুতবায় বলেন, হে মানুষ সকল! নিশ্চয় তোমরা আল্লাহর জন্য ৩০ দিন ছিয়াম রেখেছ, ৩০ দিন ক্বিয়াম করেছ। আর আজকে তোমরা বের হয়েছ আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করার জন্য যে, যেন আল্লাহ তোমাদের থেকে রামাযানের ছিয়াম ও ক্বিয়াম কবুল করেন’।[২৭]
৩. ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যাকে রামাযান মাসে ক্ষমা করা হয়নি তাকে রামাযান ছাড়া অন্য কোন মাসে ক্ষমা করা হবে না’।[২৮]
উপসংহার
পরিশেষে বলতে চাই যে, সালাফরা আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। তাঁদের অনুপ্রেরণা আমাদের চলার পথকে শাণিত করে। তাদের ইবাদতগুজার, পরহেযগারিতা ও দুনিয়াবিমুখ জীবন আমাদেরকে আবার নতুন করে ভাবতে শেখায় যে, ইবাদত কিভাবে করতে হয়? যার ফলাফল উভয় জাহানের প্রভূত কল্যাণের মালিক হওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সালাফে ছালেহীনের পথকে যথাযথভাবে অনুসরণ করা এবং রামাযানকে তাঁদের মত করে গ্রহণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
* অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদিস শেষ বর্ষ, মাদরসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।
তথ্যসূত্র :
[১]. লা ত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ১৪৮।
[২]. প্রাগুক্ত।
[৩]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯২৭৪৮।
[৪]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ৩১৮।
[৫]. দ্র. : লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী।
[৬]. দ্র. : ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, আল ফাওয়ায়েদ।
[৭]. মুছান্নাফু ইবনি আবী শায়বাহ, হা/৮৮৫২।
[৮]. দ্র. : জামিঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম লিইবনে রজব হাম্বলী।
[৯]. দ্র. : জামিঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম লিইবনে রজব হাম্বলী।
[১০]. দ্র. : ড. মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম সুলাইমান, ক্বিয়ামুল লাইল।
[১১]. লা ত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ২২৭।
[১২]. মাওকেয়ুল মিম্বার থেকে গৃহীত, খুতবার বিষয়: ঈদুল আযহা আল-মুবারক।
[১৩]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, আত্ব-তাবছীরাহ, পৃ. ১০৬।
[১৪]. লা ত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ২০৯।
[১৫]. লা ত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ২৭৮।
[১৬]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ৩১৮।
[১৭]. প্রাগুক্ত।
[১৮]. হাদিউস সারী ইবনু হাজার আসক্বালানী, পৃ. ৪৮১।
[১৯]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ৩১৮।
[২০]. আত-তিবইয়ান ফী আদাবিল হামালাতিল ক্রুআন, পৃ. ৪৬।
[২১]. প্রাগুক্ত।
[২২]. প্রাগুক্ত।
[২৩]. আবূ দাঊদ, হা/১৩৯৪; তিরমিযী, হা/২৯৪৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৪৭; মিশকাত, হা/২২০১, সনদ ছহীহ।
[২৪]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ৩১৮।
[২৫]. শারহু সামাহাতিশ শায়খ আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনু বায আলা কিতাবি ওয়াযাইফু রামাযান আবদির রহমান বিন মুহাম্মাদ বিন কাসিম, পৃ. ১৪০।
[২৬]. মিফতাহুল আফকার লিলত্বায়াহুব লিদারিল ফেরার, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৩।
[২৭]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ২০৯।
[২৮]. লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ লিইবনি রজব হাম্বালী, পৃ. ২১১।