শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার
-মূল : শায়খ ড. ছালেহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান
-অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ*
(৫ম কিস্তি)
প্রশ্ন : কিভাবে বুঝব যে, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ভালোবাসি?
উত্তর : এটা তুমি জানতে পারবে তোমার ইচ্ছা ও আগ্রহের মাধ্যমে। যদি তুমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে ভালোবাস, তাহলে বুঝবে এটাই তোমার জন্য সবচেয়ে বড় লক্ষণ যে, তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ভালোবাস। কেননা হাদীছে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا يَزَالُ عَبْدِيْ يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ ‘আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিব’।[১]
------
প্রশ্ন : পবিত্রতা অর্জন করে মোজা পরিধান করি অতঃপর ওযূ ভেঙে যায়। পরবর্তীতে পুনরায় নতুন করে ওযূ করি কিন্তু ছালাতের পূর্বেই মোজা খুলে ফেলি এখন আমার ওযূ কি ভেঙ্গে যাবে?
উত্তর : যখন মোজা খুলবে তখন তোমার ওযূ ভেঙ্গে যাবে। কেননা পা প্রকাশিত হয়েছে। আর যখন পা প্রকাশিত হবে তখন তা ধৌত করা আবশ্যক। সুতরাং যখন তুমি মোজা খুলবে তখন মাসাহ বাতিল বলে গণ্য হবে। কাজেই তোমার উচিত হল ওযূ করা এবং পা ধৌত করা।
প্রশ্ন : একটি ইসলামী ব্যাংক থেকে আমাকে চাকুরির প্রস্তাব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী দয়া করে জানাবেন?
উত্তর : আমি এই ব্যাংক সম্পর্কে যথার্থ জানি না। কেবল ইসলামী ব্যাংক বলে নামকরণ করাই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে করণীয় হল এই ব্যাংকের লেনদেন ব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা রাখা। যদি তার লেনদেন ব্যবস্থা বৈধ হয় তাহলে সেখানে চাকুরি করাতে কোন সমস্যা নেই। পক্ষান্তরে যদি শুধু নামে ইসলামী কিন্তু এর লেনদেন ব্যবস্থা পুরোটাই ইসলাম বহির্ভূত তাহলে এর সাথে সম্পর্ক রাখা বৈধ হবে না।
প্রশ্ন : আমি একজন নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য আমার ছবি উঠানো আবশ্যক। সুতরাং এক্ষেত্রে আমার জন্য ছবি তোলা কি বৈধ হবে?
উত্তর : স্ত্রীলোক হোক কিংবা কোন ছাত্রী উভয়ের জন্য একই বিধান যে, তাদের ছবি তোলা বৈধ নয়। কেননা তাদের ছবি পুরুষদের ছবির চেয়ে বেশি ফেতনা সৃষ্টি করে এবং তাদের ছবি নিয়ে ছেলেরা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ও বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করে যেটা বৈধ নয়। তবে যদি এই ছবির জন্য তার জ্ঞানার্জন করা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হল- সে সেখানে জ্ঞানার্জন করা থেকে বিরত থাকবে। কেননা তার জন্য সেখানে জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক নয়। যদি সে দ্বীনি বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করে থাকে, তাহলে এটাই তার জন্য যথেষ্ট। কেননা ছবি হারাম। এবং এটি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর মেয়েদের ছবি তোলা তো আরো নিষিদ্ধ। কেননা তাতে ফেতনার আশংকা অনেক বেশি এবং এমন কিছু বিষয় জানা যার মাধ্যমে তোমার দ্বীন স্থির থাকবে এসব বিষয়ে অতিরিক্ত জ্ঞানার্জন আবশ্যক নয়। বরং এটি নফল কিংবা ফাযায়েলে আমলের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এই কারণে সে যেন কোন হারাম কাজ সম্পাদন না করে।
প্রশ্ন : আমার স্ত্রী একজন প্রসূতি মহিলা এমন সময় রামাযান মাস উপস্থিত এবং সে কুরআন তেলাওয়াত করতে ইচ্ছুক। সুতরাং তার জন্য কি প্রসূতি অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করা বৈধ হবে?
উত্তর : কোন ঋতুবতী এবং প্রসূতি মহিলা অথবা কোন অপবিত্র ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করা থেকে বিরত থাকবে। যতক্ষণ না সে পবিত্রতা অর্জন করে এবং বড় নাপাকি ধুয়ে ফেলে।
প্রশ্ন : হায়েয অবস্থায় যৌনসঙ্গমের কাফ্ফারা কী এবং তা সঊদী আরবের মুদ্রানুযায়ী কত রিয়ালের সমান হবে?
উত্তর : হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যদি কেউ হায়েয অবস্থায় যৌনসঙ্গম করে, তাহলে তার সুবিধা মত কাফ্ফারা হিসাবে এক দীনার অথবা অর্ধ দিনার ছাদাক্বাহ করবে। আর এক দীনার হলে স্বর্ণের এক মিসকাল (প্রায় ৪.২৫ গ্রাম) সমপরিমাণ। তুমি মুদ্রাব্যবসায়ীদেরকে জিজ্ঞেস করবে, এক মিসকাল স্বর্ণ সমান কত দীনার হয় এবং দিরহাম অনুযায়ী তার মূল্য কত? যদি তারা বলে, তার মূল্য এত এত তাহলে তুমি সে অনুযায়ী এক মিসকাল বা তার অর্ধেক মূল্য ছাদাক্বাহ কর।
প্রশ্ন : আমরা নতুন এক ফ্লাটে থাকি। আমাদের ফ্লাট থেকে মসজিদের দূরত্ব পায়ে হেঁটে মাত্র ১৯ মিনিট। আর ফ্লাটের মালিক উক্ত ভবনের নিচতলায় আমাদের জন্য ছালাত আদায়ের একটা স্থান নির্ধারণ করেছেন। এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? আমি কি তাদের সাথে ছালাত আদায় করব, না-কি মসজিদে যাওয়াই উত্তম হবে?
উত্তর : যদি ভবনের মালিক সেখানকার কোন একটি জায়গা মসজিদের জন্য দান করেন এবং তাতে মসজিদ নির্মাণ করেন, তাহলে তোমরা সেখানে ছালাত আদায় কর। পক্ষান্তরে যদি সেটা মসজিদ না হয়ে অস্থায়ী মুছাল্লা (ছালাতের স্থান) হয়, তাহলে আল্লাহর জিম্মা বা দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করাই শ্রেয়। আর যদি মসজিদ দূরে হয় এবং কষ্টের কারণে সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করা আবশ্যক নয়।
প্রশ্ন : تكبيرات الإنتقال বা রুকূ এবং সিজদা করার সময় যে তাকবীরগুলো বলতে হয় এগুলো কি রুকূ এবং সিজদায় যাওয়ার সময়ই বলতে হবে, না- একটু আগে অথবা পরে বললেও হবে?
উত্তর : تكبيرات الإنتقال অর্থাৎ রুকূ এবং সেজদার তাকবীরগুলো দুই রুকনে (কিয়াম এবং রুকূ)-তে যাওয়ার সময় বলবে। রুকনে যাওয়ার পর তাকবীর দেয়া অর্থাৎ (ক্বিয়াম থেকে রুকূতে গিয়ে তাকবীর বা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা অথবা রুকূ থেকে সিজদায় গেয়ে তাকবীর বলা) এটা বিশুদ্ধ নয়। বরং এক রুকন থেকে অন্য রুকনে স্থানান্তরিত হওয়ার সময়ই তাকবীর বা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা উচিত।
প্রশ্ন : ১৩ অথবা ১৪ বছর বয়সে উপনীত হয়েছে এমন বালকের ইমামতি করার বিধান কী?
উত্তর : বিশুদ্ধ মতানুযায়ী তার ইমামতিতে কোন বাধা নেই। আর নাবালকের ইমামতিও বিশুদ্ধ যদি সে উপস্থিত মুছল্লীদের চেয়ে অধিকতর শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াতে যোগ্য হয়। কেননা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর যুগে আমর ইবনে ছালামা তার স্বীয় সম্প্রদায়ের ইমামতি করতেন অথচ তিনি তখনও ছোট, যুবক বয়সে পদার্পণ করেননি। কারণ তিনি আল্লাহর কিতাব তাদের চেয়ে বেশি শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে পারতেন (আবূ দাউদ, হা/৫৮৫, সনদ ছহীহ)।
প্রশ্ন : দয়াকরে আপনি কি যুবক-যুবতীদেরকে রামাযান মাসে তাদের মূল্যবান সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে নছীহামূলক কিছু কথা বলবেন?
উত্তর : যুবক হোক অথবা বৃদ্ধ প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত রামাযান মাসে তার মূল্যবান সময়কে আনুগত্য অর্থাৎ সৎ কাজে ব্যয় করা। অনর্থক কথাবার্তা এবং বিভিন্ন ধরনের প্রমোদ-বিনোদন কিংবা অশ্লীল নাটক ও সিরিয়ালসহ সব ধরনের হাসি-তামাশায় সময় অতিবাহিত না করা। কেননা এগুলো সবসময়ই ক্ষতিকর আর রামাযান মাসে তো আরো বেশি। কাজেই তাদের উচিত সবসময়ই যথার্থভাবে সময়কে মূল্যায়ন করা বিশেষ করে রামাযান মাসে। কেননা এর মাধ্যমে তারা ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে উপকার সাধনে সক্ষম হবে। সুতরাং তারা যেন অজ্ঞতাবশত এবং উপহাসের ছলনায় অথবা অশ্লীল নাটক ও সংলাপে মত্ত হয়ে এই মূল্যবান সময়কে নষ্ট না করে।
প্রশ্ন : ইমাম শেষ বৈঠকে থাকা অবস্থায় যদি কোন মুছল্লী মসজিদে প্রবেশ করে, তাহলে সে জামা‘আতে অংশগ্রহণ করবে, না পৃথক একটি জামা‘আতের জন্য অন্যান্য মুছল্লীদের অপেক্ষায় থাকবে?
উত্তর : যদি সে বুঝতে পারে অন্যান্য মুছল্লী জামা‘আতে অংশগ্রহণ করবে তাহলে সে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে নতুবা জামা‘আতে অংশগ্রহণ করেই ছালাত আদায় করবে।
প্রশ্ন : কবরস্থান অতিক্রমকালে মৃতদের সালাম দিতে চাইলে মুখে সালাম দিব, না- হাত দিয়ে ইশারা করব?
উত্তর : হাতে ইশারা করবে না, কেবল মুখেই বলবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ لَلَاحِقُوْنَ أَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ ‘হে মুমিন এবং মুসলিম কবরবাসী! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয় আল্লাহ যদি চায় আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হব। আমরা আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট অনুগ্রহপ্রার্থী’।[২]
প্রশ্ন : আমি জেদ্দা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে কাজ করি। যোহরের ছালাত আদায় করে কাজে বের হই তবে আমার কিছু সাথী আছে যারা যোহর এবং আছরের ছালাত জমা এবং কসর করে। সুতরাং এক্ষেত্রে সঠিক বিধান কী?
উত্তর : যে শহরে অবস্থান কর সেখানে থাকা অবস্থায় যদি আযান হয়ে যায়, তাহলে পূর্ণ ছালাতই আদায় করবে। কেননা এ অবস্থায় তোমার পূর্ণ ছালাত আদায় করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে যদি তুমি শহর থেকে বের হও আর তখনও আযান দেয়া না হয়, তাহলে তুমি এই সময়টাকে সফর হিসাবে গণ্য করবে। আর এই সময়ে তোমার জন্য কসর করা বৈধ হবে।
প্রশ্ন : বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে সক্ষম এমন অনারবী ইমামের পিছনে কি ছালাত আদায় করা বৈধ হবে?
উত্তর : যদি সে বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াতে সক্ষম হয়, তাহলে তার পিছনে ছালাত আদায় করা বৈধ। তবে যদি সে সুন্দরভাবে আরবী বলতে সক্ষম হয় তাহলে আরো বেশি ভালো। কেননা কখনো কখনো ইমাম এবং মুছল্লীদের মাঝে কথা বলার প্রয়োজন হয়। যদি সে অনারবী হয় তাহলে তাদের কথাবার্তা এবং বিভিন্ন ধরনের মাসআলা মাসাইল বুঝা তার জন্য দুঃসাধ্য হবে।
প্রশ্ন : ওয়াজিব ইবাদতের উপর কি পিতা-মাতার আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়া যাবে? এবং পিতা-মাতা যদি সন্তানকে নফল ইবাদতে বাধা প্রদান করে। যেমন নফল ছিয়াম ইত্যাদি তাহলে করণীয় কী?
উত্তর : আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ফরয ইবাদতের উপর পিতা-মাতার আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। যদি পিতা-মাতা বলে, ছালাত আদায় কর না, রামাযানের ফরয সিয়াম পালন কর না, তাহলে এজাতীয় বিষয়ে তাদের আনুগত্য করা বৈধ হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শিরক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা অনুসরণ কর না’ (সূরা লুক্বমান : ১৫)।
সুতরাং তারা যদি তোমাকে শিরক করার জন্য কিংবা ফরয কোন ইবাদত পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়, তাহলে এগুলো বিষয়ে তাদের আনুগত্য করা তোমার জন্য বৈধ নয়। পক্ষান্তরে পিতা-মাতা যদি সন্তানের কল্যাণার্থে নফল ছিয়াম পালনে বাধা দেয় তাহলে সন্তানের কর্তব্য হল সার্বিক কল্যাণ এবং প্রতিদানের বিনিময়ে হলেও সাধ্যানুযায়ী পিতা-মাতার আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়া।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* অধ্যয়নরত : ছানাবিয়াহ ১ম বর্ষ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০৫; মিশকাত, হা/২২৬৬।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০২, ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৫।