শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার (৪র্থ কিস্তি)
-শায়খ ড. ছালেহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান
-অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ*
(৪র্থ কিস্তি)
প্রশ্নমালা
প্রশ্ন : এমন কিছু ব্যক্তি আছে যাদের জন্য পূর্ণ মনোযোগী হয়ে আলেমদের কাছে থেকে ইলম অর্জন করা কষ্টসাধ্য হয়। সুতরাং তাদের জন্য কি মিডিয়া কর্তৃক প্রচারিত অডিও পাঠ শ্রবণ করার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করা সমীচীন হবে?
উত্তর : আবশ্যক হল আলেমদের থেকে প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি জ্ঞান অর্জন করা। পক্ষান্তরে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে অডিও শ্রবণের উপর যথাযথভাবে নির্ভর করা যায় না। বস্তুত তার মাধ্যমে কেবল সীমিত উপকার গ্রহণ করা যেতে পারে। কেননা শিক্ষকের কাছে উপস্থিত হয়ে সরাসরি জ্ঞানার্জন করার মাধ্যমে যতটা উপকৃত হওয়া যায় তার চেয়ে এই মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনে ততটা উপকার সাধন সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : আমি কুরআন মুখস্থ করতে শুরু করেছি এবং কিছু অংশ মুখস্থও করেছি। অতঃপর জ্ঞান অন্বেষণের কাজে অগ্রসর হয়েছি। আর (مِنْهَاجُ السَّالِكِيْنَ) গ্রন্থটি পুরোপুরি শেষ করেছি। হাদীছের গ্রন্থগুলোও বিশিষ্ট আলেমদের কাছে পড়তে শুরু করেছি। সুতরাং আপনি কি মনে করেন, আমার এই পদ্ধতিতে জ্ঞানার্জন করা কি ঠিক আছে, নাকি কুরআন পুরোপুরি মুখস্থ করার পরই অন্যান্য জ্ঞানার্জন করা আরম্ভ করব?
উত্তর : কুরআন পুরোপুরি মুখস্থ করা আবশ্যক নয়। বরং মাছহাফ থেকে সুন্দর করে তেলাওয়াতের যোগ্যতা অর্জন করা যরূরী। বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। হোক সেটা মুখস্থ করার মাধ্যমে অথবা মাছহাফ থেকে সুন্দর করে তেলাওয়াত করার যোগ্যতা অর্জন করার মাধ্যমে। অতঃপর পূর্ণ মনোযোগে জ্ঞানার্জন করা তোমার সামর্থ্য এবং সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যদি তুমি প্রত্যেক দিন কিংবা প্রত্যেক সপ্তাহে সামান্য পরিমাণ সময়ও জ্ঞান অন্বেষণে বরাদ্দ কর এবং ঐ সময় পড়ালেখা অব্যাহত রাখ, তাহলেই তুমি কল্যাণ অর্জনে সক্ষম হবে।
প্রশ্ন : শিক্ষার কি নির্ধারিত কোন সময় আছে, নাকি একজন ব্যক্তি সারা জীবনই জ্ঞানার্জনে অব্যাহত থাকবে?
উত্তর : জ্ঞান অন্বেষণের নির্ধারিত কোন সময় নেই। একজন ব্যক্তি সারাজীবনই জ্ঞানার্জনে অতিবাহিত করবে। আর জ্ঞানার্জনে কখনও পরিতৃপ্ত হওয়া যায় না এবং শিক্ষার কোন সমাপ্তিও নেই। যখন কোন ব্যক্তি এই জ্ঞান সরবরাহ করবে তখন তার কল্যাণ অর্জন ও সৎকর্ম আরো বৃদ্ধি পাবে। কাজেই কোন ব্যক্তি যেন জ্ঞানার্জনে ক্ষান্ত না হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَ فَوۡقَ کُلِّ ذِیۡ عِلۡمٍ عَلِیۡمٌ ‘আর প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপর আছে সর্বজ্ঞানী’ (সুরা ইউসুফ : ৭৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَقُلۡ رَّبِّ زِدۡنِیۡ عِلۡمًا ‘হে আমার রব! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করুন’ (সুরা ত্ব-হা : ১১৪)।
সুতরাং জ্ঞান সরবরাহ করা অপরিহার্য। কাজেই একজন ব্যক্তির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে যেন জ্ঞান অন্বেষণে অব্যাহত থাকতে ক্ষান্ত না হয়। এক্ষেত্রে তার উচিত হল ভালোভাবে জ্ঞানার্জন চালিয়ে যাওয়া। যদি কেউ ছোটতে জ্ঞানার্জন শুরু করে তাহলে সে তো ঐ ছাত্রের চেয়ে উত্তম বলে বিবেচিত হবে যে বড় হয়ে জ্ঞান অন্বেষণ করে। যদিও যে কোন বয়সেই জ্ঞানার্জনে কল্যাণ নিহিত। কিন্তু যুবক বয়সে দ্রুত ইলম হাসিল করা উৎকৃষ্টতর। এ কারণে আলেমগণ বলেন, العلم في الصغر كالنقش في الحجر ‘শৈশবে জ্ঞান আহরণ করা পাথরে খোদায় করার ন্যায়’। কেননা তরুণদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধদের স্মৃতি শক্তির চেয়ে আলাদা হয়। তাদের মেধা অনেক স্বচ্ছ ও সুদৃঢ় হয়। অধিকন্তু বৃদ্ধ বয়সের চেয়ে যুবক বয়সে অনেক বেশি জ্ঞান অন্বেষণ করা যায়।
প্রশ্ন : আপনি বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন যে, একজন শিক্ষার্থীর আবশ্যক হল জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সে প্রত্যেক বিদ্যার সংক্ষিপ্ত কিছু গ্রন্থ পাঠ করার মধ্য দিয়ে পড়ালেখা শুরু করবে। দয়া করে আপনি কি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় বিদ্যার প্রয়োজনীয় কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করবেন যেগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা আমাদের পড়ালেখা শুরু করতে পারি?
উত্তর : একজন শিক্ষক তোমাকে যে গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করার ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেয় সেগুলো অধ্যয়ন করার মাধ্যমে তার থেকে জ্ঞানার্জন শুরু কর। যদি তোমার পড়ালেখা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক হয় তাহলে সেখানকার নির্ধারিত সিলেবাস অনুযায়ী প্রত্যেকটি গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে এবং ধীরে ধীরে সেগুলো শেষ করার মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হবে।
পক্ষান্তরে যদি তুমি এমন কোন মসজিদ চয়ন কর যেখানে কোর্সের ব্যবস্থা চালু আছে তাহলে সেখানকার কোন শায়খের শরণাপন্ন হয়ে তার কাছে জ্ঞান অন্বেষণ কর এবং তিনি যে গ্রন্থগুলো তোমার জন্য চয়ন করে সেগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে তোমার পাঠ শুরু কর।
প্রশ্ন : আমি একজন প্রাথমিক ছাত্র, আমার মন চায় যে, আমি কোন জ্ঞানী ব্যক্তির দারসে উপস্থিত হই। কিন্তু যখন দারস থেকে বের হই তখন লক্ষ্য করি যে, দারসে যা কিছু বলা হল তার সবগুলো ধারণ করতে আমি সক্ষম না। সুতরাং এ বিষয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়ে আমাকে সাহায্য করবেন?
উত্তর : আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং যতটুকু দারস গ্রহণ করা তোমার জন্য সহজ হয় ততটুকুই গ্রহণ কর। যদিও তা অল্প হয় তারপরও তাতে বরকত নিহিত। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে অনেক টেপ রেকর্ডার আছে যাতে বিভিন্ন দারস এবং বক্তব্য রেকর্ড করে সংরক্ষণ করা যায়। তোমার উচিত সেগুলোর শরণাপন্ন হওয়া। দারসে বলা হয়েছে এমন কোন বিষয় যদি তুমি ভুলে যাও তাহলে রেকর্ড থেকে পুনরায় শ্রবণ করে তা মুখস্থ রাখতে সক্ষম হবে।
প্রশ্ন : একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলেছে, একটি আছার বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, تعال بنا نغتب في الله ‘এসো আমরা আল্লাহর জন্য গীবত করি’। এটা কি কোন হাদীছ না আছার?
উত্তর : গীবত করা হারাম। মহান আল্লাহ বলেন,وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ‘তোমরা একে অপরের গীবত কর না’ (সূরা আল-হুজ্বরাত : ১২)। গীবত একটা বড় ধরনের পাপ। সুতরাং কিভাবে আল্লাহর জন্য গীবত করা বৈধ হতে পারে অথচ এটা একটি মারাত্মক পাপের অন্তর্ভুক্ত। এই ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধ। তার উচিত আল্লাহর কাছে তওবা করা। (تعال بنا نغتب في الله ‘এসো আমরা আল্লাহর জন্য গীবত করি’) এই বাক্যটি পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের বিরোধী। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡہِ مَیۡتًا فَکَرِہۡتُمُوۡہُ ‘তোমরা একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? বস্তÍত তোমরা একে ঘৃণ্য মনে কর’ (সূরা আল-হুজরাত : ১২)।
এখানে আল্লাহর জন্য গীবত করার কথা বলা হয়নি। কেননা মহান আল্লাহ স্বয়ং গীবতকে অপসন্দ করেন এবং এ থেকে মানুষকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি এই বাক্যটি দ্বারা হাদীছের বর্ণনাকারী তথা রাবীদের বিষয়ে গীবত করা (জারাহ করা) উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এ বিষয়ে আলোচনা করা বৈধ হবে। আর গীবত (জারাহ) করা কেবল হাদীছ বর্ণনাকারী তথা রাবীদের ক্ষেত্রেই খাছ।
প্রশ্ন : বিতরের ছালাত আদায় করার সময় তাশাহহুদ এর মাঝখানে যদি কেউ ফজরের আযান শুনতে পায় তাহলে সে কি বিতরের ছালাত ছেড়ে দেবে, নাকি পূর্ণ ছালাত আদায় করবে?
উত্তর : যদি কেউ ফজরের সময় হওয়ার পূর্বে বিতরের সালাত শুরু করে এবং ছালাতের মধ্যে আযান শ্রবণ করে, তাহলে তার উচিত হল ছালাত ছেড়ে না দিয়ে পূর্ণ ছালাতই আদায় করা। তবে পরবর্তীতে সে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ফজরের আযান দেয়ার পূর্বেই বিতরের ছালাত সম্পন্ন করবে।
প্রশ্ন : রামাযান মাসে রাতে কতক্ষণ সময় পর্যন্ত সাহারী করব। মুয়াজ্জিনের আযান শ্রবণ করা মাত্রই কি খাবার থেকে বিরত থাকব, নাকি আযান শেষ হওয়া অবধি সাহারী করব?
উত্তর : মুয়াজ্জিন ফজরের আযান দিলেই খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। কেননা মুয়াজ্জিনের আযানই বলে দেয় যে, ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে যদি মুয়াজ্জিন মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য কিংবা সাহারীর সময় হয়েছে এই সংবাদ দেয়ার জন্য আযান দেয়, তাহলে তখন থেকে ফজরের আযান হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তি খাবার গ্রহণ করবে। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّ بِلَالًا يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يُنَادِىَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُوْمٍ ثُمَّ قَالَ وَكَانَ رَجُلًا أَعْمَى لَا يُنَادِىْ حَتَّى يُقَالَ لَهُ أَصْبَحْتَ أَصْبَحْتَ
‘বেলাল রাত থাকতে আযান দেয়। অতএব তোমরা পানাহার করতে থাকবে, যতক্ষণ ইবনু উম্মে মাকতূম আযান না দেয়’। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘ইবনু উম্মে মাকতূম একজন অন্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আযান দিতেন না, যতক্ষণ না তাকে বলা হত যে, ভোর হয়ে গেছে, ভোর হয়ে গেছে’।[১]
প্রশ্ন : আছরের ছালাত না পরেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। মাগরিবের ছালাতের কিছুক্ষণ পূর্বে জাগ্রত হয়ে আছরের ছালাত আদায় করা শুরু করি এই সময়ে মাগরিবের আযান দেয়। সুতরাং আমার এই ছালাত আদায় হবে, না কাযা বলে গণ্য হবে?
উত্তর : যদি সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরে ছালাত আদায় করা হয়, তাহলে সেটা কাযা বলে গণ্য হবে। কেননা আছরের ছালাতের ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেছে। তবে আবশ্যক হল মাগরিবের পূর্বেই দ্রুত আছরের ছালাতের কাযা আদায় করা।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* অধ্যয়নরত : ছানাবিয়াহ, ১ম বর্ষ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৯২; মিশকাত, হা/৬৮০।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিষ্টাচার