বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
অপসংস্কৃতির কবলে মুসলিম সমাজ
-আব্দুল্লাহ আল-মামুন*

সংস্কৃতি হল সভ্যতা, যা রুচিগত ব্যাপারও বটে। তাতে খাওয়া-দাওয়া, নিয়ম-নীতি, আচার-আনুষ্ঠান, স্বভাব-চরিত্র এবং আনন্দ-ফুর্তি লাভের উপকরণ, আনন্দ-উৎসব, শিল্পচর্চা, পারস্পরিক আলাপ-ব্যবহার ও আচরণবিধি শামিল রয়েছে। সংস্কৃতির আসল অর্থ হল আত্মপরিচয়। Aggressions ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ হল বিনা উত্তেজনায় আক্রমণ করা। কারো পসন্দের উপর আমার পসন্দকে কৌশলগতভাবে এমনরূপে চাপিয়ে দেয়া, যাতে সে পর্যায়ক্রমে তাতে প্রভাবিত হয় এবং এক সময় আমার পসন্দকে গ্রহণ কর। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যে কোন জাতি বা সমাজের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে, সেই জাতি বা সমাজকে পিষ্ট করে মারে, ধ্বংসের শেষ স্থানে পাঠিয়ে দেয়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে একটি দেশ বা জনগণের নিজস্ব ইতিহাস, মুল্যবোধ ও বিশ্বাসের ধরন উলট পালট করে দেয়া হয় ও তার আত্মপরিচয়কে অস্পষ্ট করে তোলা হয়। পরিণতিতে ঐ দেশ বা জনগণের স্থির বিশ্বাস ও মূল্যবোধে ফাটল ধরে এবং সেই সমস্ত জনগণ এক দীর্ঘ হীনমন্যতার কবলে জড়িয়ে পড়ে।

অপসংস্কৃতি হল সংস্কৃতির বিকৃত রূপ। সংস্কৃতির কাজ জীবনকে বিকশিত করা, স্বীয় সত্তাকে প্রেমময় করে তোলা ইত্যাদি। আর অপসংস্কৃতি মানুষের জীবনে আনে বিকৃতি, অন্তরে আনে কলুষতা, চেতনাকে করে বিনষ্ট আর মুল্যবোধে আনে ভাঙ্গন। যেসব আচার-আচরণ বা সংস্কৃতি নিজের আত্মার অবনতি আনে তাই-ই অপসংস্কৃতি। এক কথায় সংস্কৃতি হল জীবন চর্চা আর অপসংস্কৃতি হল জীবন নাশ, যা সাময়িকভাবে মুগ্ধকর, মোহনীয় অথচ স্থায়ী কোন উপকার বয়ে আনে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে আগে তার সংস্কৃতিকে বিনাশ করে দাও। তাই কোন জাতিকে ধ্বংসস্তূপের কঠিন পরাধীনতায় পতিত করতে হলে কোন বাহিনীর প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন হবে একদল হীনমন্যতাসম্পন্ন অপসংস্কৃতির চর্চাকারীর। যারা কিনা সমাজের আনাচে-কানাচে জোঁকের মত চুপটি মেরে বসে আছে। রাজনৈতিক পরাজয় হতে হতো দেশ উদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু সাংস্কৃতিক পরাজয় ঘটলে অর্থাৎ অপসংস্কৃতির কালো ছায়া স্পর্শ করলে তা থেকে স্বাধীনতা অর্জন প্রায় অসম্ভব।

বর্তমানে আমাদের সমাজে যেভাবে সংস্কৃতির নগ্ন চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে খুব বেশি দিন লাগবে না এ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হতে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কোন রোগীর যেমন বাঁচার আশা খুব কম। তেমনি অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে কোন জাতি আক্রান্ত হলে সে জাতির অপমৃত্যু হতে বেশি দিন সময় লাগে না। অপসংস্কৃতি হচ্ছে ঠিক ক্যান্সার রোগের মত মরণব্যাধি, যার স্বাভাবিক পরিণতি খুব ভয়াবহ। কোন মুসলিম এই অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হলে সর্বপ্রথম তার ঈমানের উপর আঘাত আসে। আর ঠিক তখনি তারা সত্যিকারের মানুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে আমরা আজ পাপাচার, কামাচার, ব্যভিচার, অত্যাচার, বর্বরতা, হঠকারিতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আর উচ্ছৃঙ্খলতার মত ভয়াবহ কান্ডে জর্জরিত। অপসংস্কৃতির কবলে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঐতিহ্যে এগিয়ে যাওয়া অনেক দেশ ধ্বংসের মুখে দণ্ডায়মান। কিছু কিছু জায়গায় অপসংস্কৃতির ধরন এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে, তা পশুত্বকেও হার মানায়।

দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে অনেক দেশ বিভিন্নভাবে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতিতে যতসব বস্তাপচা অপসংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তার গৌরবময় মুসলিম সংস্কৃতির নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে নামমাত্র একটি জাতিতে দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন রকম পাঁয়তারা করে সংস্কৃতির নামে আমাদের সমাজের গৌরবের প্রতীক, জাতির ঐক্যের দিশারী যুবসমাজকে অপসংস্কৃতি নামক আফিম খাইয়ে অথর্ব বানিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। যাতে চলমান বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবার মত কেউ বর্তমান না থাকে। অতঃপর এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে পশ্চিমা ফ্রি মিক্সিং ফ্রি সেক্স বাসা বাঁধছে আমাদের মত বড়সড় ইসলামী দেশের সাধারণ মানুষের মনে, যা রীতিমত আঁতকে উঠার মত।

পশ্চিমাদের কবলে আসক্ত মানুষজনের কল্যাণে এসব বিধ্বংসী সংস্কৃতি নামক অপসংস্কৃতি বন্যার পানির মত আমাদের সমাজে ঢুকে পড়ছে। কারণ নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অহংবোধ লুপ্ত হলে পরগাছা সংস্কৃতি স্বাভাবিকভাবে মনোজগৎকে গ্রাস করে ফেলে। এটা সত্য যে, সংস্কৃতি কোন অচল বিষয় নয়, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে অবাধে আদান-প্রদান চলতে থাকে। তবে সংস্কৃতি কোন শ্রোতের শেওলা নয় কিংবা সর্বজনীন বিষয় নয়, যে তাকে উৎপাটন করা সম্ভব। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে নব্য অপসংস্কৃতিগুলো ছাকনার মাধ্যমে ছেকে ফেলে তার প্রতিকার করা অসম্ভব নয়।

মুসলিম সমাজে সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় প্রবেশদ্বার হল মিডিয়া। আর তার বড় উৎস হল ভারতীয় মিডিয়া। দীর্ঘদিন ধরে ভারত বিশেষ করে কলকাতাইয়া সংস্কৃতি এখানে ইনজেক্ট করেছে এবং মুসলিম সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকে ছিন্নমূল গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করতে অনেকটাই সক্ষমও হয়েছে। অপসংস্কৃতির বিভীষিকায় আমাদের ডানা আজ ভেঙ্গে রাস্তায় নুইয়ে পড়েছে। বিভিন্নপ্রকার কৌশলগত অপসংস্কৃতি আজ আমাদের সমাজের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় পৌঁছে গেছে।

আমরা ভক্তি ভরে স্মরণ করি রবিন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, সূর্যসেন, বিদ্যাসাগর, প্রীতিলতা এমনকি শেক্সপিয়ার কেরি ছাহেবদের। অন্যদিকে আমাদের জাতীয় অগ্রনায়ক যেমন- গোলাম মোস্তফা, সিরাজদ্দৌলা, নওয়াব সলিমুল্লাহ প্রমুখ স্মরণীয় মানুষদেরকে অন্ধকারের অতল তলে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চলছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মীর মোশাররফ বা শাহেদ আলীর মত প্রসিদ্ধ কথাশিল্পী কিংবা ফজলুল হক, নাজিমুদ্দীন, সোহরাওয়ার্দী, আকরম খাঁ-দের মত রাজনীতিবিদ এদেশে কখনো ছিলেন কি-না তা নিয়ে গবেষণায় নামতে হবে।

অপসংস্কৃতির কবলে গোটা জাতি আজ অবসন্ন। তাদের প্রাণশক্তি আজ নিস্তেজ করে দেয়া হয়েছে। দেশের বুদ্ধিজীবি নামক মানুষেরা এর বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিরোধতো দূরে থাকুক, তাদের এ বিষয়ে সচেতনতা আছে বলেও সন্দেহ জাগে। অপসংস্কৃতিগুলোকে সমাজে বসিয়ে দিয়ে তারা দেশ বাঁচানোর রাজনৈতিক সমাধান খুঁজছেন। ম্যাস মিডিয়ার সবকটি মাধ্যম আজ অরক্ষিত। এই মাধ্যমগুলোর একটি তালিকা হল- ১. রেডিও ২. টেলিভিশন ৩. চলচ্চিত্র ৪. নাটক ৫. বিজ্ঞাপন ৬. সঙ্গীত ৭. নাট্য বিদ্যালয় ৮. আর্ট স্কুল ৯. ফ্যাশন শো ১০. মেলা ১১. শিক্ষাঙ্গন ১২. খেলাধুলা ১৩. সংবাদপত্র ১৪. স্মরণোৎসব ১৫. ম্যাগাজিন ইত্যাদি আরও অনেক। এই বহুমুখী মাধ্যমগুলো থেকে নিত্য নতুন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে আর আমাদের সকল প্রকার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

সংস্কৃতি হল জাতির আত্মা। সেই আত্মাকে রক্ষা করার কোন পাহারাদার খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা এই আগত ক্ষতির দিকটা সম্পর্কে সচেতন করার লোকও বোধ হয় খুঁজে পাওয়া ভার। আত্মাকে অরক্ষিত রেখে যেমন শরীর বাঁচবে না, তেমনি সংস্কৃতিকে কলুষিত করে অপসংস্কৃতির ছবলে পড়ে কোন সমাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে আমরা বাধ্য। সিনেমায় দেখা যায় যে, একটা সুদর্শন ছেলে একটা অর্ধোলঙ্গ সুন্দরী মেয়ের সাথে ঢলাঢলি করছে। আর সেটা চোখ জুড়ানোর খোরাক হিসাবে মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে এক সাথে বসে উপভোগ করছে। অথচ একটু লজ্জাও করে না। বরং খুব দারুণ আনন্দে উপভোগ করছি। আর বিদেশী সিনেমার নায়ক-নায়িকারা তো ক্যামেরার সামনে হাজির হয় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়েই। এসব দেখে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কোনভাবেই সুস্থ থাকতে পারে না।

অন্যদিকে ভেঙ্গে পড়ছে পরিবার ব্যবস্থা। অধিকাংশ পরিবারে আজ শান্তির লেশমাত্র নেই উল্টো অশান্তির দাবানলে দাউ দাউ করে পুড়ছে। বর্তমানে আবার যোগ হয়েছে সমাজের জনপ্রিয় সব ভারতীয় সিরিয়াল, যা সমাজের মানুষের প্রাণ নাশের শামিল। মুসলিম সমাজের সন্তান হয়েও ঢেই ঢেই করে গেয়ে যাচ্ছি ‘আমি নই হিন্দু, নই বৌদ্ধ মুসলমান, আমি বাঙ্গালী’। আর মোবাইল ফোন বা এমপি ফোরে রাখছি ‘আশিক বানায়া’ বা ‘খিচ মেরি ফটো’।

ফেব্রুয়ারী, মার্চ আর ডিসেম্বরের নির্দিষ্ট তিনদিন মাথায় পতাকা বেঁধে গলা ফাটিয়ে নিজেকে প্রমাণ করি আমি যোদ্ধা। আর ঠিক একটু পরে বিএসএফ এর হাতে প্রাণ হারাতে বসা আমার স্ব-জাতীয় ভাইটির রক্ষার বেলায় আমি বনে গেলাম তাদেরই একজন পোষা শয়তান। তখন প্রতিবাদ জানানোর মত দেশপ্রেমিক খুঁজে পাওয়া ভার। শাহরুখ, সালমান খানের ছবি সংবলিত টি-শার্টই যৌবনের প্রাণশক্তি নয়। আমরা এই যৌবনের মাঝে বৃদ্ধের কংকাল দেখতে পায়। গাই গরুর শিং ভাঙ্গলেই যেমন বাছুর হতে পারে না, তেমনি এসব উগ্র ঢঙ্গে তথাকথিত যোদ্ধা সাজে সেজেও যোদ্ধা হওয়া যায় না। ইদানিং আমাদের সমাজের অলি গলিতে এই সব রিজেক্ট প্রোডাক্ট ছেয়ে গেছে। ফলে হ্রাস পাচ্ছে জাতীয় চেতনা শক্তি ও ঈমানী জাযবা।

ম্যাগাজিনের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির সয়লাব প্রবহমান। প্রতিটি ম্যাগাজিন বা প্রচারণায় নারীর উপস্থিতি বিদ্যমান। তৈরি হচ্ছে পর্ণোগ্রাফি। আর এসব বিষে ভরা সংস্কৃতির কবলে পড়ে মুসলিম সমাজের যুবারাও তৈরি করছে পর্ণো ভিডিও, যা দ্বারা তারা লাভবানও হচ্ছে। এই-ই হল তাদের জয়জয়কার প্রচারণার ফসল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঐসব তৈরিকৃত ভিডিওগুলো দেশের সিংহভাগ কোমলমতী যুবক-যুবতীরাই ভিউ করে থাকে। ফলে নিজেদের অজান্তেই কালো মেঘের ঘনঘটায় আছন্ন হয়ে পড়ছে আমাদের যুব সমাজ। সিনেমা বা নাটকের সবচেয়ে খরাপ চরিত্রটি দেয়া হচ্ছে টুপি দাড়িওয়ালা লোকদের। ইসলামপন্থীদের ঘৃণা করায় যেন এদের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটা সময় পোশাক পরিচ্ছেদে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু অপসংস্কৃতির অঢেল প্রভাবে তা আজ বিলুপ্ত প্রায়। বিদেশী সংস্কৃতি আর টেলিভিশনের ছায়াতলে আমাদের ঐতিহ্য ধারণকারী পোশাকগুলো আজ হারিয়ে গেছে। সন্তানরা আর পিতা-মাতা বা মুরব্বীদের অনুসরণ করে না। তারা অনুসরণ করে তাদের প্রিয় নায়ক-নায়িকা কিংবা খেলোয়ারদের হোক না তা স্বল্পবাসন। এই স্বল্পবাসনই তাদের আরামদায়ক করে তোলে। আধুনিকতার ছায়া নাকি এইগুলোর মাঝেই। জিন্স, টি শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি, লুঙ্গি, বোরকা, পাঞ্জাবী-পাজামা এখন আর তেমন প্রিয় নয়। অনুসরণীয় হিরো হিরোইনরাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। পরিবর্তন এনেছে তাদের চুলের ছাটেও। এতে করে তাদের সৃজনশীল মানসিকতা নষ্ট হচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে তারা পরনির্ভর।

৩১ শে ডিসেম্বর প্রতিটি সৌর বর্ষের শেষ দিন। এই দিন দিবাগত রাতকে ইংরেজিতে বলে ‘থার্টি ফাস্ট নাইট’। বেশ কয়েক বছর যাবত এই রাতকে নতুন রূপে পালন করছে আমাদের সমাজ। উক্ত রাতটিকে বলা যায় একটি ভয়ংকর রাত। এ রাতটি আনন্দ-ফুর্তির নামে একদম জঘন্য রাতে পরিণত হয়েছে। সমাজের দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবকরা এই রাতের প্রধান উপকরণ। বাপের কষ্টার্জিত টাকাগুলোকে পটিয়ে এনে ফষ্টি নষ্টি করে উড়িয়ে দেয়া হয় এই রাতে। সদর্পে চলে নাচ গান। সম্প্রতি কয়েকটি বছরে এই রাতকে কেন্দ্র করে নানা প্রকার শ্লীলতাহানি ও আপত্তিকর ঘটনা ঘটলে সরকার তার প্রতিকার করার জন্য এগুলোকে নিষিদ্ধ করছে না, বরং যাতে আনন্দ-ফুর্তি ঠিক থাকে কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে না যায়, সেজন্য পুলিশ প্রটেকশন দিচ্ছে। এ যেন রসগোল্লা আলগা রেখে মাছি তাড়াতে কামান দাগা। অথচ ইসলামী সংস্কৃতিতে বর্ষ বিদায়, বর্ষ বরণের কোন স্থান নেই। প্রতি রাতেই আমরা মৃত্যুবরণ করি। প্রতি সকালেই আমরা নতুন জীবন পেয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করি। কিন্তু সমাজ চলছে ঠিক তার উল্টো দিকে।

আমাদের সমাজে যেসব অপসংস্কৃতি ছেয়ে বসেছে তার মধ্যে আরেকটি অন্যতম হল- ভালবাসা দিবস। আসলে কথাটা এই ভাবে বলা উচিত ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’। এদিন প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের ফাঁকির দ্বারা অর্জিত টাকা দিয়ে একগুচ্ছ গোলাপ কিনে পায়ের হাঁটু গেড়ে প্রিয়তমাকে উপহার দেয়। এইদিন রক্তমাখা লাল গেঞ্জি পরে রাস্তায় বের হয় তারা। অথচ আদৌও কি আমরা খুঁজে দেখেছি এগুলো কাদের সংস্কৃতি? এটা হল- রোমক সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু মুসলিম সমাজ তা হুবহু নকল করে অত্যন্ত সাবলীলভাবে তা প্রতি বছর পালন করে আসছে। আরো রয়েছে সুন্দরী প্রতিযোগিতা। এখানে নারীদেরকে একটি পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এসব কালো সংস্কৃতির আধারে আমাদের মুসলিম সমাজ আজ কলুষিত। পরিত্রাণের উপায় কোথায়??

মুসলিম সমাজের মানুষেরা আক্বীকা করে তাদের ছেলে-মেয়েদের নাম রাখছে ডেভিড আর টুইট। অথচ ঐ ডেভিডদের পিতা-মাতা কিন্তু অগাধ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অনেক সংস্কৃতিমনা। আব্দুর রহীম, আব্দুল করীম, আব্দুল্লাহর মত সুন্দর সুন্দর নামগুলো এসব অত্যাধুনিক পরিবারে বেমানান। আর এভাবেই চলছে আধুনিক ধারায় নামকরণ প্রতিযোগিতা। যেমন- ডেভিড, ক্রেডিট, ডন, প্রিন্স, ডলার, লকেট, চায়না, বিউটি, লাভলী ইত্যাদি।

সমাজ শুধু এখানেই থেমে থাকলো না। কাউকে ডাকার ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণের মোড়কে ঢাকতে তারা আজ ব্যস্ত। অনেক পরিবারের শিশুদের ‘আব্বা’ ডাকতে না শিখিয়ে শেখানো হচ্ছে ‘পাপ্পি’ ডাকতে। যার অর্থ সন্তান তার বাবাকে ডাকছে ‘কুকুরের বাচ্চা’ বলে। অত্যন্ত গর্ব ভরে আনন্দের সাথে শিশুদের ডাকতে শেখানো হচ্ছে ‘ডেডি, মাম্মি, আঙ্কেল, আন্টি’ ইত্যাদি। অপসংস্কৃতির চর্চাকারীদের ‘ডেডী’, ‘মাম্মি’ আর মুসলিম সমাজের ‘আব্বা’, ‘আম্মা’ কখনই এক হতে পারে না। কেননা যারা হাতি দেখেছে তাদের হাতির কথা মনে পড়লেই সামনে ভেসে উঠবে বড় বড় কান ওয়ালা আর লম্বা সুড় ও লেজ বিশিষ্ট বিশাল আকৃতির একটি জন্তু। ঠিক তেমনি ‘মাম্মি’ ‘আন্টি’ শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে একদল অর্ধ উলঙ্গ বেপর্দা নারী। আর অন্যদিকে ‘আব্বা’ ‘আম্মা’ উচ্চারণ করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে ঘোমটা পরা সুশীলা মমতাময়ী শ্রদ্ধাভাজনী একদল নারীর ছবি। এসব ‘ডেডি’ ‘মাম্মি’ ডাকা ছেলে-মেয়েরা কি বড় হয়ে কোনভাবেই তাদের পিতা-মাতাকে ‘আব্বা’ ‘আম্মা’ ডাকতে শিখবে?

আধুনিকীকরণের প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য স্বীকারেও আমাদের সমাজ অপসংস্কৃতিতে পতিত। তাইতো হর্ষ-বিষাদে আমাদের মন বলে উঠে না ‘ইয়া আল্লাহ’। উল্টো আমাদের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারিত হয় ‘ও মাই গড’। আত্মীয় স্বজনদের সাথে কুশল বিনিময়ের ধারাও আমরা পাল্টে দিয়েছি। আর এজন্যই সালাম দেয়ার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি Hi…Hello ইত্যাদি। সুন্দর কর্মের জন্য কাউকে ধন্যবাদ জানাতে Thank you এর মর্যাদা এখন অনেক বেশি। নববর্ষে গলা ফাটিয়ে চেচিয়ে বলছি Happy new year। আর শিশুর জন্মদিনে প্রতিটি ঘরে কেক কেটে করতালি দিয়ে বলছি Happy birthday to you। আর এগুলোর কথা যদি বর্তমান সমাজকে জিজ্ঞেস করা যায় যে, এগুলো কাদের কালচার? এর উত্তরে তারা বলে- তুমিতো সেকেলেই রয়ে গেছ!

সুধী পাঠক! প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় আর অপসংস্কৃতির কবলে আমাদের মুসলিম সমাজে আরও কত ধরনের বস্তাপচা সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটবে তা আমাদের মত সেকেলে মানুষদের অতি অল্প বিদ্যা বুদ্ধিতে ধর্তব্য নয়। সেদিন হয়তো আমাদের মুসলিম সমাজ হতে বিদায় নিবে মা, বাবা, চাচা, খালা, আপারা সবাই। অত্যন্ত সদর্পে নিজস্ব সংস্কৃতিতে জেঁকে বসবে মাম্মি আঙ্কেল আন্টির দল। হয়তো সেদিন আমাদের কৃতি সন্তান পাপ্পী, ডায়না, মেরি কুরীদের ‘বাবা মা’ শব্দের অর্থ খুঁজতে অভিধানের দারস্ত হতে হবে। একটা সভ্য জাতির সভ্যতার নিদর্শন বহন করে, সেই জাতির সংস্কৃতি। তবে কি এগুলোই আমাদের সভ্যতার নিদর্শন?

সংস্কৃতি মানুষের জীবনের প্রতিদিনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। আমরা যেসব বিষয় উল্লেখ করেছি এগুলো মোটেও আমাদের মুসলিম সংস্কৃতি হতে পারে না। অনেকেই মনে করে, মুসলিমদের নিজস্ব কোন সংস্কৃতি নেই। অথচ আমাদের সংস্কৃতি প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গার দু‘আ দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় ঘুম পাড়ানোর দু‘আ দিয়েই। আমরা মুসলিম। আমরা সর্বদায় আখিরাত ও তাক্বদীরে বিশ্বাস করি। আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই, রাসূলের অনুমোদন নেই, আখিরাতের কোন কাজে আসবে না সে কাজকে আমরা অহেতুক মনে করি।

পরিশেষে বলতে চাই, এসব বর্ববরতাপূর্ণ অপসংস্কৃতি আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। তাই আসুন! আমরা মুসলিম সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিবান হই। আসল সংস্কৃতির আলোকচ্ছটায় জীবনকে আলোকিত করি। আধুনিক নব্য সংস্কৃতিকে পায়ের নীচে পদদলিত করে ইসলামী সংস্কৃতিকে মেলে ধরি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে বর্তমান অপসংস্কৃতি নামক এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে রক্ষা করুন এবং ইসলামী সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!

 *অধ্যায়নরত, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।




প্রসঙ্গসমূহ »: যুবসমাজ শিশু-কিশোর পাপ
যুবকদের অবসর সময় কাটানোর উপায় - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ
ডিপ্রেশন : একটি মানসিক পঙ্গুত্ব - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
সমকামিতা ও ট্রান্স জেন্ডার: সাম্রাজ্যবাদীদের নীল নকশা - মাযহারুল ইসলাম
সনদেই দ্বীন - মাযহারুল ইসলাম
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ
মসজিদে করণীয় ও বর্জনীয় কাজসমূহ - মুহাম্মাদ ফাহিমুল ইসলাম
যেমন ছিল সালাফদের রামাযান - মাযহারুল ইসলাম
কোথায় আজ বিশ্ব মানবতা? - সাখাওয়াত হোসাইন
মসজিদে করণীয় ও বর্জনীয় কাজসমূহ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ ফাহিমুল ইসলাম
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ

ফেসবুক পেজ