বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৪ অপরাহ্ন

আতিথেয়তা

-রাফিউল ইসলাম*


ভূমিকা

ইসলাম আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত ও শ্রেষ্ঠ দ্বীন। এটি পুরো পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত এমন এক মহা সংবিধান যাতে রয়েছে শান্তির মহান বার্তা ও সভ্যতার পূর্ণ দিক-নির্দেশনা। সভ্যতার বুলি আওড়ানো প্রতিটি জাতি ও ধর্ম আজ অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য, যে সবচেয়ে সভ্য ও শান্তিপূর্ণ দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। যার প্রতিটি নির্দেশনাতে রয়েছে মানবতার সর্বোচ্চ কল্যাণ, শিষ্টাচারপূর্ণ বাণী এবং একে অপরের সাথে সুন্দর অমায়িক আচরণের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আতিথেয়তা তথা অতিথি সেবা বা মেহমানদারী। অতিথির প্রতি সঠিক এবং সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের রীতিনীতি শুধু ইসলামেই নিহিত। এটা ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। আতিথেয়তার ক্ষেত্রে রয়েছে করণীয় ও বর্জনীয় কিছু দিক। যিনি অতিথি তিনি হলেন মেহমান এবং যিনি অতিথিকে আপ্যায়ন করাবেন তিনি হলেন মেজবান। বর্তমানে আমরা মেহমানদের মেহমানদারী করতে চাই না।  মেহমানকে আমরা ভয় পাই, ঝামেলা মনে করি। অথচ একজন সত্যিকার মুসলিমের নিকট মেহমানদারী করা খুব প্রিয় এবং সম্মানজনক কাজ। মেহমানদারী করার বিষয়টি একজন মুসলিমের ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। এটা একজন মুমিনের তার ঈমানের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। মেহমানের  মেহমানদারী করা এবং তাদের সম্মান করা নবী-রাসূল এবং সালাফদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

নবীগণের মেহমানদারী

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর মেহমানদারী

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি মেহমানদারির প্রচলন করেছিলেন। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,كَانَ أَوَّلَ مَنْ ضَيَّفَ الضَّيْفَ إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلَامُ ‘সর্বপ্রথম মেহমানদারির প্রচলন করেন ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)’।[১] ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) স্বীয় মেহমানের মেহমানদারিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ঘটনা বর্ণনা করার সময় তার মেহমানদারির বিষয়টি প্রশংসনীয়ভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ہَلۡ  اَتٰىکَ حَدِیۡثُ ضَیۡفِ  اِبۡرٰہِیۡمَ الۡمُکۡرَمِیۡنَ  -  اِذۡ  دَخَلُوۡا عَلَیۡہِ  فَقَالُوۡا سَلٰمًا ؕ قَالَ سَلٰمٌ ۚ قَوۡمٌ  مُّنۡکَرُوۡنَ  -  فَرَاغَ   اِلٰۤی  اَہۡلِہٖ   فَجَآءَ  بِعِجۡلٍ  سَمِیۡنٍ - فَقَرَّبَہٗۤ  اِلَیۡہِمۡ  قَالَ  اَلَا  تَاۡکُلُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনার নিকট ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সম্মানিত মেহমানদের কাহিনী এসেছে কি? যখন তারা তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, (আপনার প্রতি) সালাম। উত্তরে তিনি বললেন, (আপনাদেরকেও) সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর স্ত্রীর নিকট গেলেন এবং একটি মোটা গরুর বাছুর নিয়ে আসলেন ও তাদের সামনে রাখলেন এবং বললেন, আপনারা খাচ্ছেন না কেন? (সূরা আয-যারিয়াত : ২৪-২৭)।

লূত (আলাইহিস সালাম)-এর মেহমানদারী

লূত (আলাইহিস সালাম) তাঁর মেহমানদের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে তাঁর কওমের ষড়যন্ত্র থেকে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলেন,

فَاتَّقُوا اللّٰہَ وَ لَا تُخۡزُوۡنِ فِیۡ ضَیۡفِیۡ ؕ اَلَـیۡسَ مِنۡکُمۡ  رَجُلٌ  رَّشِیۡدٌ

‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমাকে আমার মেহমানদের সামনে অপমানিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি ভালো লোক কেউই নেই?’ (সূরা হূদ : ৭৮)।

মেহমানের সম্মান রক্ষা করাও মেহমানদারির অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারেও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে মেজবানের দ্বারা মেহমানরা কোন প্রকার অপমান-অপদস্থ ও লাঞ্ছনার স্বীকার না হয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেহমানদারী

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সর্বাধিক দয়ালু[২], দানশীল[৩] ও আতিথেয়তায় প্রসিদ্ধ। তিনি কোন কিছুই তাঁর নিজের জন্য ধরে রাখতেন না, যা কিছু তাঁর নিকট আসত তার সবই তিনি সাথে সাথে দান করে দিতেন এবং সাথীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,كَانَ النَّبِيُّ ﷺ لَا يَدَّخِرُ شَيْئًا لِغَدٍ ‘আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কোন কিছুই আগামী দিনের জন্য জমা করে রাখতেন না’।[৪]

আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর আতিথেয়তা সম্পর্কে তাঁর (ﷺ)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর উক্তিই যথেষ্ট। অহী লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অস্থিরতায় তিনি সান্ত¦না দেন এবং বলেন, كَلاَّ وَاللهِ مَا يُخْزِيْكَ اللهُ أَبَدًا ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আপনাকে কখনই অপমান-অপদস্থ করবেন না’। তার কারণ হিসাবে তিনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কয়েকটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করেন। তার মধ্যে অন্যতম গুণ হল, وَتَقْرِى الضَّيْفَ ‘আপনি অতিথির সেবা করেন’।[৫]

মেহমানদারির সম্পর্ক ঈমানের সাথে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দয়া ও অনুগ্রহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল  মেহমানদারী করা। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে’।[৬]

আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর একটি পাত্র ছিল, যা চারজন লোক উঠাতেন। আর তাকে ‘গাররা’ বলা হত। অতঃপর যখন চাশতের সময় হল এবং ছাহাবীগণ চাশতের ছালাত আদায় করলেন, তখন উক্ত পাত্রটি আনা হল এবং তন্মধ্যে ছারীদ প্রস্তুত করা হয় এবং ছাহাবীগণ সমবেতভাবে তার চতুষ্পার্শ্বে খেতে বসেন। অতঃপর যখন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পা গুটিয়ে বসলেন। এক বেদুঈন বলল, এটা কোন্ ধরনের বসা? নবী করীম (ﷺ) বললেন, إِنَّ اللهَ جَعَلَنِيْ عَبْدًا كَرِيْمًا وَلَمْ يَجْعَلْنِيْ جَبَّارًا عَنِيْدًا ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে বিনয়ী বান্দা বানিয়েছেন। তিনি আমাকে অহংকারী নাফরমান বানাননি’। অতঃপর তিনি বললেন, كُلُوْا مِنْ جَوَانِبِهَا وَدَعُوْا ذِرْوَتَهَا يُبَارَكْ فِيْهَا ‘তোমরা প্রত্যেকে তার পার্শ্ব হতে খাও এবং তার মধ্যস্থল ছেড়ে দাও। কেননা সেখানে বরকত রয়েছে’।[৭]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। আমি ক্ষুধার তাড়নায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আর কখনও পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি (ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে) নবী (ﷺ) ও ছাহাবীগণের রাস্তায় বসে থাকলাম। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যাচ্ছিলেন। আমি কুরআনের একটা আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। কিছু করলেন না। অতঃপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যাচ্ছিলেন। আমি কুরআনের একটা আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। কিছু করলেন না। অতঃপর আবুল কাসিম (ﷺ) যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন। আমার প্রাণের ও আমার চেহারার অবস্থা কী তিনি তা আঁচ করতে পারলেন। অতঃপর বললেন, হে আবূ হির! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি উপস্থিত। তিনি (ﷺ) বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চল। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং আমাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালায় কিছু দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোত্থেকে এসেছে? তাঁরা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ বা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছেন। তিনি বললেন, হে আবূ হির! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি হাযির। তুমি ছুফফাবাসীদের কাছে যাও এবং তাদেরকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। এ আদেশ শুনে আমি নিরাশ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম যে, এ সামান্য দুধ দ্বারা ছুফফাবাসীদের কী হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হত। এটা পান করে আমার শরীরে শক্তি আসত।

যখন তাঁরা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে আদেশ দিলেন, আমিই যেন তা তাঁদেরকে দেই। আর আমার আশা রইল না যে, এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ না মেনে কোন উপায় নেই। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে ডেকে আনলাম। তাঁরা এসে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তাঁরা এসে ঘরে আসন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, হে আবূ হির! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি উপস্থিত। তিনি (ﷺ) বললেন, তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদেরকে দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি তা তৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনি তা তৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমনকি আমি এভাবে দিতে দিতে শেষতক নবী (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছলাম। তাঁরা সবাই তৃপ্ত হলেন। তারপর নবী (ﷺ) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, হে আবূ হির! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি উপস্থিত। তিনি (ﷺ) বললেন, এখন তো আমি আছি আর তুমি আছ। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি ঠিক বলেছেন। তিনি (ﷺ) বললেন, এখন তুমি বস এবং পান কর। তখন আমি বসে পান করলাম। তিনি (ﷺ) বললেন, তুমি আরও পান কর। আমি আরও পান করলাম। তিনি (ﷺ) আমাকে পান করার নির্দেশ দিতেই থাকলেন। এমন কি আমি বললাম যে, আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম! আমার পেটে আর জায়গা পাচ্ছি না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন ও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পেয়ালার বাকি দুধগুলো পান করলেন।[৮]  

ছাহাবীগণের মেহমানদারী

আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর ছাহাবীরা মেহমানদারীতে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তারা শুধু মেহমানদারীই করেননি, একজন ভাই অপর ভাইয়ের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করতে  কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেননি। হাদীছে এসেছে,

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে এলো। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তাঁর স্ত্রীদের নিকট লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, তাঁদের নিকট পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, কে আছ যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন এক আনছারী ছাহাবী (আবূ ত্বালহা) বললেন, আমি। এ বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেহমানকে সম্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনছারী বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত কর এবং বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সে বাতি জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াল এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত করল। বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে, তাঁরাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি (ﷺ) বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কা- দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশী হয়েছেন এবং এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। (মহান আল্লাহ বলেন)وَ یُؤۡثِرُوۡنَ  عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ  فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡمُفۡلِحُوۡنَ ‘তাঁরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের উপর অন্যদেরকে অগ্রগণ্য করে থাকে। আর যাদেরকে অন্তরের কৃপণতা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলতাপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-হাশর : ৯)।[৯]

মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে রাত্রিতে মেহমান হলাম। তিনি লোকটিকে বকরীর পাঁজরের গোশত তৈরি করতে বললেন, তা ভুনা হল। অতঃপর তিনি ছুরি নিয়ে ঐ স্থান হতে গোশত কেটে আমাকে দিতে লাগলেন।[১০]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, কোন একটি দিনে বা রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বের হয়েই আবূ বকর ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, কোন্ জিনিসে তোমাদের উভয়কে এই মুহূর্তে ঘর হতে বের হয়ে আসতে বাধ্য করেছে? তাঁরা উভয়ে বললেন, ক্ষুধা। তখন তিনি বললেন, সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! যে জিনিস তোমাদের দু’জনকে বের করেছে আমাকেও সেই জিনিস বাইরে বের করেছে। অতঃপর তিনি বললেন, উঠ। তারা সবাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে চললেন এবং জনৈক আনছারীর বাড়ীতে আসলেন। তখন তিনি তার ঘরে ছিলেন না। অতঃপর যখন আনছারীর স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখতে পেলেন, তখন তিনি তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, অমুক তথা তার স্বামী কোথায়? সে বলল, তিনি আমাদের জন্য মিঠা পানি আনবার জন্য গেছেন। এমতাবস্থায় আনছারী এসে উপস্থিত হয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখলেন এবং বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। আজকের দিন আমার মত সম্মানিত মেহমানের সৌভাগ্য লাভকারী আর কেউই নেই। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন এবং একটি ডাল সঙ্গে নিয়ে আসলেন, যাতে পাকা, শুকনা ও কাঁচা খেজুর ছিল। অতঃপর তিনি বললেন, এগুলো হতে আহার করেন এবং তখন তিনি একটি ছুরি নিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাকে বললেন, সাবধান! দুধওয়ালা বকরী যব্হ করবে না। অতঃপর আনছারী লোকটি একটি বকরী যব্হ করলেন। অতঃপর তাঁরা সবাই বকরীর গোশত এবং খেজুরের ছড়া হতে খেতে লাগলেন এবং পানি পান করলেন। তারপর যখন তাঁরা পরিতৃপ্ত হলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বকর ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে বললেন,

وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَتُسْأَلُنَّ عَنْ هَذَا النَّعِيْمِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُيُوْتِكُمُ الْجُوْعُ ثُمَّ لَمْ تَرْجِعُوْا حَتَّى أَصَابَكُمْ هَذَا النَّعِيْمُ

‘সে মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! ক্বিয়ামতের দিন এ নে‘মতের ব্যাপারে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ী থেকে বের করেছিল। অতঃপর ঘরে ফিরে যাওয়ার পূর্বেই তোমরা এ সমস্ত নে‘মত লাভ করলে’।[১১]

ছাহাবীগণ মেহমানদারির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

كَانَ أَهْلُ الصُّفَّةِ إِذَا أَمْسَوُا انْطَلَقَ الرَّجُلُ بِالرَّجُلِ وَالرَّجُلُ بِالرَّجُلَيْنِ وَالرَّجُلُ بِالْخَمْسَةِ فَأَمَّا سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ فَإِنَّهُ كَانَ يَنْطَلِقُ بِثَمَانِيْنَ كُلَّ لَيْلَةٍ

‘যখন রাত হত, ছুফ্ফাবাসীদের মেহমানদারী করার উদ্দেশ্যে ছাহাবীগণ বাড়ি নিয়ে যেতেন। কেউ দু’জন কেউ তিনজন আবার কেউ পাঁচজন করে নিয়ে যেতেন। আর সা‘আদ ইবনু উবাদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রতি রাতে আশিজন লোককে মেহমানদারির উদ্দেশ্যে বাড়ি নিয়ে যেতেন’।[১২]

আতিথেয়তার ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয়

আতিথেয়তার ক্ষেত্রে মেহমান ও মেজবানের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় কাজ রয়েছে। যা পালন করা ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্গত। নি¤েœ শিষ্টাচারগুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হল।

১. কারো বাড়িতে মেহমান হলে খাওয়ার সময়কে বেছে নিবে না। কারণ, এতে মানুষের কষ্ট হয়। তারা তো তার জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখে দেয়নি, তবে যদি আগে থেকেই জানা থাকে তবে তাতে কোন অসুবিধা নেই। সুতরাং এমনভাবে মেহমান হবে, যাতে তারা তার জন্য রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে। আবার খাবার খেয়ে অযথা কথা-বার্তায় মশগুল হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَدۡخُلُوۡا بُیُوۡتَ النَّبِیِّ  اِلَّاۤ اَنۡ یُّؤۡذَنَ لَکُمۡ  اِلٰی طَعَامٍ غَیۡرَ نٰظِرِیۡنَ  اِنٰىہُ ۙ وَ لٰکِنۡ  اِذَا دُعِیۡتُمۡ فَادۡخُلُوۡا فَاِذَا طَعِمۡتُمۡ فَانۡتَشِرُوۡا وَ لَا مُسۡتَاۡنِسِیۡنَ لِحَدِیۡثٍ

‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা আহার প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে (ভোজনের জন্য) নবী গৃহ প্রবেশ করো না। তবে তোমাদেরকে আহ্বান করা হলে তোমরা প্রবেশ করো এবং আহার শেষে তোমরা চলে যাও; তোমরা কথা-বার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৩)।

২. কারো বাড়িতে মেহমান হলে, তাদের অবস্থার প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখবে। ৩. নির্দিষ্ট কোন খাদ্যের চাহিদা প্রকাশ করবে না। তারা যা ব্যবস্থা করবে, তাই খাবে। ৪. খাওয়ার জন্য কোন খাবার সামনে পেশ করলে, তাকে তুচ্ছ মনে করবে না।

৫. সীমিত খাবার গ্রহণ করবে অধিক পরিমাণে নয়।  রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, طَعَامُ الاِثْنَيْنِ كَافِى الثَّلَاثَةِ وَطَعَامُ الثَّلَاثَةِ كَافِى الْأَرْبَعَةِ ‘দু’জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট’।[১৩] তাছাড়া মুমিন অল্প আহার করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَأْكُلُ فِيْ مِعًى وَاحِدٍ وَالْكَافِرُ يَأْكُلُ فِيْ سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ ‘মুমিন খায় এক পাকস্থলীতে আর কাফের খায় সাত পাকস্থলীতে’।[১৪]

৬. খুব বিনয় ও নম্র-ভদ্র হয়ে থাকবে। বাড়ীর লোকের অসুবিধা হয় এমন কোন কাজ করবে না এবং তাকে বিপাকে ফেলবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ধরনের কর্ম থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি (ﷺ) বলেন,

لَا يَحِلُّ لِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَنْ يُقِيْمَ عِنْدَ أَخِيْهِ حَتَّى يُؤْثِمَهُ. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَكَيْفَ يُؤْثِمُهُ قَالَ يُقِيْمُ عِنْدَهُ وَلَا شَىْءَ لَهُ يَقْرِيْهِ بِهِ

‘কোন মুসলিম ভাইয়ের জন্য এটা হালাল নয় যে, সে তার অপর ভাইয়ের নিকট অবস্থান করবে এবং তাকে বিপাকে ফেলবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাকে কীভাবে বিপাকে ফেলবে? তিনি (ﷺ) বললেন, তার নিকট অবস্থান করতে থাকবে অথচ তার ঘরে তাকে মেহমানদারী করার মত কিছুই নেই’।[১৫]

৭. যদি কোন খারাপ কর্ম বা কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়, সম্ভব হলে তা বিনয়ের সাথে সংশোধন করবে।

৮. খাওয়ার পর মেজবানের জন্য দু‘আ করবে। আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মেজবানের (যে মেহমানকে খাদ্য খাওয়ায় তার) জন্য দু‘আ করে বলেছিলেন,

اَللّٰهُمَّ  بَارِكْ لَهُمْ فِيْمَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ

উচ্চারণ : ‘আল্ল-হুম্মা বারিক লাহুম ফীমা রযাক্বতাহুম ওয়াগফির লাহুম ওয়ারহামহুম’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে যা দান করেছেন তাতে বরকত দান করুন এবং তাদেরকে ক্ষমা করুন ও দয়া করুন’।[১৬]

মিক্বদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (মেজবানের জন্য) নিজ মাথা আকাশের দিকে তুলে বলেছিলেন,

اَللّٰهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِىْ وَاسْقِ مَنْ سَقَانِىْ

উচ্চারণ : ‘আল্ল-হুম্মা আত্ব‘ইম মান আত্ব‘আমানী ওয়াসক্বি মান সাক্বানী ’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! যে লোক আমার খাবারের ব্যবস্থা করে আপনি তার খাদ্যের ব্যবস্থা করুন। আর যে আমাকে পান করায় আপনি তাকে পান করান’।[১৭] উক্ত দু‘আ পাঠ করলে খাদ্যে বরকত হয়।[১৮]

৯. কারো বাড়িতে প্রতিদিন মেহমান হবে না। অনেকদিন পরপর মেহমান হবে, তাতে মহব্বত বাড়বে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, زُرْ غِبًّا تَزْدَدْ حُبًّا ‘কিছু দিন পর পর সাক্ষাৎ বা ভ্রমণ কর, মহব্বত বাড়বে’ ।[১৯]

১০. কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করবে না। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,مَا عَابَ النَّبِيُّ ﷺ طَعَامًا قَطُّ إِنِ اشْتَهَاهُ أَكَلَهُ وَإِنْ كَرِهَهُ تَرَكَهُ ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনও কোন খাদ্যের দোষ প্রকাশ করেননি। যদি খেতে মনে চাইত, তাহলে খেতেন এবং অপসন্দ হলে পরিত্যাগ করতেন’।[২০]

১১. মেহমানের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার অতিথির সম্মান করে’।[২১]

১২. মেহমানের ব্যাপারে অনীহা না করা। ১৩. যখন মেহমান উপস্থিত হয়, তখন তার সামনে সাধ্যানুযায়ী খাবার পেশ করা।

১৪. বাড়িতে প্রবেশ করার পূর্বে সালাম দেয়া এবং খানা শুরুর পূর্বে বিসমিল্লাহ বলা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন কোন ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ করে এবং প্রবেশকালে ও খাওয়ার সময় আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান বলে, এই ঘরে তোমাদের জন্য রাত্রি যাপনের সুযোগ নেই এবং খাদ্যও পাওয়া যাবে না। আর যখন কেউ ঘরে প্রবেশ করে এবং প্রবেশের সময় আল্লাহর নাম না নেয়, তখন শয়তান বলে, তোমরা রাত্রি যাপনের স্থান পেয়েছ। আর যখন সে খাওয়ার সময়ও আল্লাহর নাম না নেয়, তখন সে বলে, তোমরা রাত্রি যাপন ও খাওয়া উভয়টির সুযোগ লাভ করেছ।[২২]

১৫. মেহমানের সাথে উত্তমভাবে কথা বলা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,اَلْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ  ‘কারও সাথে উত্তম কথা বলা ছাদাক্বাহ’।[২৩] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন,تَبَسُّمُكَ فِيْ وَجْهِ أَخِيْكَ صَدَقَةٌ ‘তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার হাসিমুখ করা ছাদাক্বাহ।[২৪]

আতিথেয়তার সময়সীমা

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অতিথি আপ্যায়নের জন্য তিনদিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তবে এর অতিরিক্ত সময়ও যদি অতিথি বাড়িতে অবস্থান করে তাহলেও তার সাথে কোন রূপ অসৌজন্যমূলক আচরণ করা যাবে না। কেননা তিনদিনের অতিরিক্ত যা করা হবে তা ছাদাক্বাহ। আবূ শুরাইহ আলকা‘বী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ جَائِزَتُهُ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ وَالضِّيَافَةُ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ فَمَا بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ وَلَا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَّثْوِيَ عِنْدَهُ حَتَّى يُحَرِّجَهُ

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার অতিথির সম্মান করে। অতিথির জন্য এক দিন ও এক রাত উত্তম খানাপিনার ব্যবস্থা করা বিধিসম্মত। আর আতিথেয়তা হল তিনদিন। এর পর যা করবে, সেটা ছাদাক্বাহ। আর মেজবানের বাড়িতে মেহমানের এত সময় থাকা বৈধ নয়, যাতে মেজবানের কষ্ট হয়’।[২৫]

আতিথেয়তার ফযীলত

উত্তম মেহমানদারী ও আপ্যায়নের ফযীলত অত্যধিক। এতে মহান আল্লাহ খুশি ও আনন্দিত হোন। ছাহাবীদের আতিথেয়তায় মহান আল্লাহ বলেন, وَ یُؤۡثِرُوۡنَ  عَلٰۤی  اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ  فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡمُفۡلِحُوۡنَ  ‘তাঁরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের উপর অন্যদেরকে অগ্রগণ্য করে থাকে। আর যাদেরকে অন্তরের কৃপণতা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলতাপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-হাশর : ৯)।[২৬]

আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন্ কাজ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلَامَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ ‘তুমি লোকদের খাদ্য খাওয়াবে এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দিবে’।[২৭]

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আতিথেয়তা মুসলিমদের অনুপম আদর্শ। আধুনিক যুগেও এসব সুন্নাহই আভিজাত্যের নিদর্শন। এসব সুন্নাহ থেকে মুসলিমরা নিত্য দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আসুন, মেহমানের সমাদর করি। তাদের খাতির-যত্ন ও আদর-আপ্যায়নে সুন্নাতের অনুসরণ করি। ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিই পৃথিবীময়। আল্লাহ আমাদেরকে আতিথেয়তার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!

* ৩য় বর্ষ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[১]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৯১৭০; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৭২৫।
[২]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৯৮৫।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৬৯।
[৪]. তিরমিযী, হা/২৩৬২; মিশকাত, হা/৫৮২৫; ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬৩৫৬, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩, ৪৯৫৭, ৪৯৫৩, ৩৩৯২।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১৮, ৬১৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৭; মিশকাত, হা/৪২৪৩।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৭৭৩; মিশকাত, হা/৪২৫১, সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৫২।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৯৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৪। ।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/১৮৮; মিশকাত, হা/৪২৩৬।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩৮; মিশকাত, হা/৪২৪৬।
[১২]. ইবনু আবিদ দুনিয়া, ক্বিরাউয যইফ, তাহক্বীক্ব : আব্দুল্লাহ ইবনু হামাদ আল-মানছূর (রিয়াদ : মাকতাবাতু আযওয়াইস সালাফ, ১৪১৮ হি.), হা/২০, পৃ. ২৯।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৯২; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৮।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৯৭।
[১৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৪২; তিরমিযী, হা/৩৫৭৬, ‘দা‘ওয়াত’ অধ্যায়,  ‘মেহমানের দু‘আ করা’ অনুচ্ছেদ; আবূ দাঊদ, হা/৩৭২৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৭১১; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫২৯৭; মিশকাত, হা/২৪২৭।
[১৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৬০।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৬০।
[১৯]. ত্বাবারাণী, আল-মুজামুল কাবীর, হা/৩৪৫৫; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৫৪৭৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬২০; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৫৮৮১।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৬৪; মিশকাত, হা/৪১৭২।
[২১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮; মিশকাত, হা/৪২৪৪।
[২২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০১৮; মিশকাত, হা/৪১৬১।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৯।
[২৪]. তিরমিযী, হা/১৯৫৬; মিশকাত, হা/১৯১১, সনদ ছহীহ।
[২৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮; মিশকাত, হা/৪২৪৪।
[২৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৯৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৫৪। ।
[২৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১২, ২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯। 




প্রসঙ্গসমূহ »: যুবসমাজ
মসজিদে করণীয় ও বর্জনীয় কাজসমূহ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ ফাহিমুল ইসলাম
আতিথেয়তা - রাফিউল ইসলাম
যুবকদের অবসর সময় কাটানোর উপায় - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
পাশ্চাত্য বিশ্বে ইসলামফোবিয়া : সমস্যা ও সমাধান - মাযহারুল ইসলাম
যেমন ছিল সালাফদের রামাযান - মাযহারুল ইসলাম
সমকামিতা ও ট্রান্স জেন্ডার: সাম্রাজ্যবাদীদের নীল নকশা - মাযহারুল ইসলাম
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ
কোথায় আজ বিশ্ব মানবতা? - সাখাওয়াত হোসাইন
সনদেই দ্বীন - মাযহারুল ইসলাম
এ্যাপস যামানা - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
অপসংস্কৃতির কবলে মুসলিম সমাজ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
শিক্ষার্থীর শিষ্টাচার - অনুবাদ : জাহিদ বিন মাসঊদ

ফেসবুক পেজ