শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ অপরাহ্ন

শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা

-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*


(শেষ কিস্তি) 

৪. ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিষয় বাহ্যিক কোন বিষয় নয়।

পর্দার বিরোধিতহা করতে গিয়ে কেউ কেউ এ কথা বলে থাকেন। এটি একটি গোলকধাঁধাঁ, যার মাধ্যমে প্রবৃত্তির অনুসরণকারীরা তাদের নিন্দনীয় আচরণকে বৈধতা দিতে গিয়ে শরী‘আতের বিধান থেকে দূরে যেতে চায়। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে ও হাদীছ অধ্যয়ন করে সে জানে যে, শরী‘আতের মধ্যে এমন বহু বিষয় রয়েছে যেখানে মানুষকে বাতিনী বিষয় ব্যতীত যাহেরী বা প্রকাশ্য বিষয়ের দিকে ধাপিত করার প্রতি উৎসাহিত করে। সুতরাং মুসলিম নারীর জন্য জানা যরূরী যে, বাহ্যিক আমল ঈমানের প্রকৃতির অন্তর্গত। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُہٗ زَادَتۡہُمۡ  اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ - الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ  یُنۡفِقُوۡنَ- اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا ؕ لَہُمۡ دَرَجٰتٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ وَ مَغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ

‘নিশ্চয় মুমিনরা এইরূপ হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে। যারা ছালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি যা কিছু তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা খরচ করে। এরাই সত্যিকারের ঈমানদার, এদের জন্যই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট উচ্চ মর্যাদা, আরও রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা’ (সূরা আল-আনফাল : ২৩)। অত্র আয়াতে ছালাত ও আল্লাহর পথে ব্যয় করাকে (উভয়টা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ) ঈমান হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে, নবী (ﷺ) বলেন,

اَلْإِيْمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُوْنَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّوْنَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطَّرِيْقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيْمَانِ

‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাখা হলো- আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই একথা বলা এবং সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে, রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জাও ঈমানের অংশ’।[১] সুতরাং ছালাত, ব্যয় করা, কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। শরী‘আত প্রণেতা এগুলোকে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

৫. যুগের সাথে পর্দা বেমানান

এধরনের কথা-বার্তা কোন মুমিন নারীর থেকে প্রকাশ পেতে পারে না। কেননা নারীর পর্দা তার লজ্জাশীলতা ও সতীত্বের পরিপূরক। আর এদু’টি প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক দেশের জন্যই কাম্য।

৬. পর্দা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে নারীকে বাধাগ্রস্ত করে

এ সংশয় দূর করতে আমরা মহিলা ছাহাবীদের বিভিন্ন কাজের অবদান ও বিভিন্ন সক্রিয়তা উপস্থাপন করব। বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসারে তাদের কী ভূমিকা ছিল? মূলত পর্দানশীল নারীরা উক্ত মতবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে। যেহেতু তাদের মধ্যে ছাত্রীরা আছে। সাংস্কৃতিক, লেখিকা, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষিকা, প্রভাষক এবং দ্বীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের  গবেষণা রয়েছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্ত দায়িত্ব পালন করছে। আরো কষ্টসাধ্য কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। সেগুলো হল বাচ্চাদের লালন-পালন, প্রজন্ম তৈরি ইত্যাদি অবদানগুলো তাদের প্রকাশ্য। মুসলিম সমাজে আরো অনেক কাজ তারা করে থাকে, যা তাদের পর্দার ও সতীত্বের ঠিকানা এবং তাদের উত্তম হওয়ার প্রমাণ। এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি, তাহল, প্রিয় বোনেরা! লক্ষ্য করুন, মহাকাশচারীরা তারা কাপড় পরিধান করে এবং তাদের স্যুট সম্পূর্ণ শরীরকে আবৃত করে। তাদের মধ্যে অনেক নারীও থাকে। অথচ এত্দসত্ত্বেও এটা তাদের কঠিন কাজ হতে বাধার সৃষ্টি করে না। সুতরাং শারঈ পর্দা সামাজিক উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে কথাটি সর্বোতভাবে ভুল কথা।

৭. পর্দা একটি কঠোর ব্যবস্থা

নারীরা এই সংশয়ের মধ্যে নিমজ্জিত হয় যে, পর্দা তাদের জন্য অনেক কঠিন একটি ব্যবস্থা। যাতে করে তারা ইচ্ছামত জীবন-যাপন করতে পারে না। কিছু মহিলা যারা সর্বদা অশ্লীল চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কৃতি দ্বারা পরিতৃপ্ত হতে চায়। তাদের উপর লালনকারীর পরিকল্পনা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে তাদের জীবন হয় উচ্ছৃঙ্খল। এজন্য নরম প্রকৃতির মানুষ বিষয়টিকে সঠিক জানার পরেও কঠিন মনে করে থাকে। অথচ এটি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি সহনীয় বিধান। যেখানে প্রচুর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মূলত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার উপর সর্বদা সহজটাই চান কখনো কঠিনটা চান না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَ لَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ‘তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)। তিনি আরো বলেন, وَ مَا جَعَلَ عَلَیۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ مِنۡ حَرَجٍ ‘আর তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭৮)। তিনি আরো বলেন,

مَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیَجۡعَلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ حَرَجٍ وَّ لٰکِنۡ یُّرِیۡدُ لِیُطَہِّرَکُمۡ وَ لِیُتِمَّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ

‘আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা আনয়ন করতে চান না, বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে ও তোমাদের উপর স্বীয় নে‘মত পূর্ণ করতে চান, যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, اَللّٰہُ  لَطِیۡفٌۢ  بِعِبَادِہٖ ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু’ (সূরা আশ-শূরা : ১৭)। আর নবী (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ هَذَا الدِّيْنَ يُسْرٌ ‘নিশ্চয় এই দ্বীন হচ্ছে সহজ’।[২]

৮. বিয়ের আগে পর্দা করব না, পরে পর্দা করব

অনেকেই মনে করে যে, বিয়ের আগে পর্দা করব না। যারা মনে মনে এই ধাঁধাঁয় পড়েছে, তাদেরকে আমরা মহান আল্লাহর নি¤েœর বাণীর দিকে দৃষ্টি আর্কষণ করতে চাই।

وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا  رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ  قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ  اَحَدَکُمُ  الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ  رَبِّ لَوۡ لَاۤ  اَخَّرۡتَنِیۡۤ  اِلٰۤی  اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ  اَکُنۡ  مِّنَ  الصّٰلِحِیۡنَ- وَ لَنۡ  یُّؤَخِّرَ اللّٰہُ  نَفۡسًا  اِذَا جَآءَ اَجَلُہَا ؕ وَ اللّٰہُ  خَبِیۡرٌۢ  بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসলে সে বলবে, হে আামর প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি ছাদাক্বাহ করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম! কিন্তু নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হবে, আল্লাহ কখনও কাউকেও অবকাশ দিবেন না, তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আল-মুনাফিকূন : ১০-১১)।

হে প্রিয় বোন! তোমার কি অবগতি আছে যে, তোমার বিবাহের পূর্বেই তোমার সময়ের ঘণ্টা বেজে যেতে পারে। অতঃপর মৃত্যু এসে যাবে আর তুমি বেপর্দা অবস্থায় থাকবে অথচ তাওবার সুযোগ পাবে না। সুতরাং তোমার রবের নিষেধাজ্ঞাকে মেনে নাও আর লজ্জিত হওয়ার সময় থাকতে লজ্জিত হও। মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّمَا التَّوۡبَۃُ عَلَی اللّٰہِ لِلَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السُّوۡٓءَ بِجَہَالَۃٍ ثُمَّ  یَتُوۡبُوۡنَ مِنۡ قَرِیۡبٍ فَاُولٰٓئِکَ یَتُوۡبُ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ  عَلِیۡمًا  حَکِیۡمًا- وَ لَیۡسَتِ التَّوۡبَۃُ لِلَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السَّیِّاٰتِ ۚ حَتّٰۤی  اِذَا حَضَرَ اَحَدَہُمُ الۡمَوۡتُ قَالَ  اِنِّیۡ تُبۡتُ الۡـٰٔنَ  وَ لَا الَّذِیۡنَ یَمُوۡتُوۡنَ وَ ہُمۡ کُفَّارٌ ؕ اُولٰٓئِکَ اَعۡتَدۡنَا لَہُمۡ عَذَابًا  اَلِیۡمًا

‘তাওবাহ কবুল করার দায়িত্ব যে আল্লাহর উপর তা তো শুধু তাদেরই জন্য যারা অজ্ঞতাবশতঃ পাপ করে থাকে, তৎপর অবিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা করে। সুতরাং আল্লাহ তাদেরকেই ক্ষমা করবেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। আর তাদের জন্য ক্ষমা নেই যারা ঐ পর্যন্ত পাপ করতে থাকে, যখন তাদের কারও নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমি এখন ক্ষমা প্রার্থনা (তাওবা) করছি এবং তাদের জন্যও নয় যারা অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়; তাদেরই জন্য আমি বেদনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা আন-নিসা : ১৭-১৮)। আর নবী (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ الْعَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবাহ প্রাণ ওষ্ঠগত না হওয়া পর্যন্ত কবুল করে থাকেন’।[৩]

৯. যারা বলে গরমে পর্দা করতে দেয় না

মুসলিমদের নিকট এটি কোন যুক্তিই নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ نَارُ جَہَنَّمَ اَشَدُّ حَرًّا ؕ لَوۡ کَانُوۡا یَفۡقَہُوۡنَ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, জাহান্নামের আগুন (এর চেয়ে) অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝতে পারত’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৮১)।

১০. পিতা-মাতা ও স্বামী নিষেধ করে

অনেক মহিলার স্বামী, পিতা কিংবা কোন বন্ধু পর্দা করতে নিষেধ করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এজন্য নারীদেরকে নির্যাতের শিকারও হতে হয়। অথচ রাসূল (ﷺ) বলেন, لاَ طَاعَةَ فِى مَعْصِيَةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ ‘আল্লাহর অবাধ্য হয়ে কোন আনুগত্য করা যাবে না। আনুগত্য কেবল ভালো কাজে হবে’।[৪] সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তোমার স্বামী ও অন্যরা ক্বিয়ামত দিবসে তোমার কোন কাজে আসবে না। বরং তোমার থেকে দায়মুক্তি হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

اِذۡ  تَبَرَّاَ الَّذِیۡنَ اتُّبِعُوۡا مِنَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡا  وَ رَاَوُا  الۡعَذَابَ وَ تَقَطَّعَتۡ بِہِمُ الۡاَسۡبَابُ

‘যখন অনুসরণীয় নেতার অনুসারীদেরকে প্রত্যাখান করবে এবং তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৬)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,

یَوۡمَ  یَفِرُّ  الۡمَرۡءُ مِنۡ  اَخِیۡہِ- وَ اُمِّہٖ  وَ اَبِیۡہِ - وَ صَاحِبَتِہٖ  وَ بَنِیۡہِ

‘সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তাঁর নিজের ভাই হতে এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান হতে’ (সূরা আল-‘আবাছা : ৩৪-৩৬)।

সুতরাং হে বোন! তুমি মনে করত, তোমার মৃত্যু হল তোমার স্বামী তোমাকে দাফন করে তোমার স্থানে পৌঁছে দিল। অতঃপর কয়েকরাত পরেই নতুন বিবাহ করে তোমাকে ভুলে গেল। যেন তুমি ছিলেই না! তাই আল্লাহকে ভয় কর।

১১. যারা বলে যে, পর্দানশীল নারীরা ভালটা প্রকাশ করে বস্তুত তারা নিচু চরিত্রের মহিলা।

অর্থাৎ পর্দা পালনের মাধ্যমে লৌকিকতা প্রদর্শন ছাড়া কিছুই নয়। সবাই জানুক যে, ঐ মহিলা পর্দা করে। ফলে মানুষ তাকে ভাল মনে করবে। অথচ এটা ঠিক নয়। কেননা এটা কিছু পর্দাকারিণী নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে সকলকে এর মধ্যে শামিল করা অন্যায়, অবিচার ও সীমালংঘন হবে। বরং ব্যাপারটা প্রকৃত পর্দানশীল নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন। কেননা যখন তাকে পর্দা সংক্রান্ত আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা পালন করতে আহ্বান করি, তখন সে তা মেনে নেয়। যাতে করে তার আল্লাহর প্রতি আনুগত্যটা পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ হয়।

১২. যারা বলে যে, আমি এখনো পর্দার ব্যাপারে বিশ্বাসী নয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَ مَا کَانَ  لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ  اِذَا قَضَی اللّٰہُ  وَ رَسُوۡلُہٗۤ  اَمۡرًا اَنۡ  یَّکُوۡنَ  لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ  مِنۡ اَمۡرِہِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ  فَقَدۡ  ضَلَّ  ضَلٰلًا  مُّبِیۡنًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের কোন ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)।

হে মুসলিম বোন! এধরনের কিছু সংশয় যা তোমার পর্দা করতে অন্তরায় মনে করে থাক। অথচ আমরা ওর থেকে পরিত্রাণের উপায় উল্লেখ করছি। যা তোমার মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। আর যে নারী ওগুলোর সাথে যুক্ত হবে, তাহলে সে মাকড়সার বাসার সাথে যুক্ত হলো। আর মাকড়সার বাসা হচ্ছে সব থেকে নি¤œ মানের বাসা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اِنَّ  اَوۡہَنَ الۡبُیُوۡتِ لَبَیۡتُ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۘ  لَوۡ  کَانُوۡا  یَعۡلَمُوۡنَ ‘ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি তারা জানত! (সূরা আল-আনকাবূত : ৪১)। আর এরা ভাঙ্গন তীরের কিনারায় অবস্থান করছে। অতি সত্বরই তা ভেঙ্গে জাহান্নামে পতিত হবে।

সতর্কীকরণ

হিজাব সংক্রান্ত প্রতারণার ব্যাপারে মুসলিম রমণীকে সতর্ক করা অপরিহার্য। ইতিহাসের আলোকে আমরা এমন উম্মত সম্পর্কে জানতে পারি যে, যারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, তার আদেশসমূহ অমান্য করেছিল এবং নবী-রাসূলগণের আনুগত্যের ক্ষেত্রে যারা হঠকারিতা করেছিল তারা হল ইহুদি জাতি। আল্লাহ তা‘আলা অনেক জায়গায় তাদের লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতির কথা আলোচনা করেছেন এবং আমাদেরকে তাদের ভ্রান্ত পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করা হতে সতর্ক করেছেন। কেননা তারা আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে প্রতারণা ও বাহানার মাধ্যমে কূট-কৌশলে হারামে লিপ্ত হয়। আল-কুরআন থেকেও জানা যায় যে, মহান আল্লাহর বাণী,

وَ سۡـَٔلۡہُمۡ عَنِ الۡقَرۡیَۃِ  الَّتِیۡ کَانَتۡ حَاضِرَۃَ  الۡبَحۡرِ ۘ اِذۡ یَعۡدُوۡنَ فِی السَّبۡتِ اِذۡ تَاۡتِیۡہِمۡ حِیۡتَانُہُمۡ یَوۡمَ سَبۡتِہِمۡ شُرَّعًا وَّ یَوۡمَ لَا یَسۡبِتُوۡنَ ۙ لَا  تَاۡتِیۡہِمۡ ۚۛ کَذٰلِکَ ۚۛ نَبۡلُوۡہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَفۡسُقُوۡنَ

‘আর তাদেরকে সেই জনপদের অবস্থাও জিজ্ঞেস কর যা সমুদ্রের তীরে অবস্থিত ছিল, (স্মরণ কর সেই ঘটনার কথা) যখন তারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, শনিবারের দিন মাছ পানিতে ভেসে তাদের নিকট আসত; কিন্তু যেদিন তারা শনিবার উদযাপন করত না (অর্থাৎ শনিবার ছাড়া বাকি অন্য দিন) সেদিন ওগুলো তাদের কাছে আসত না, এইভাবে আমরা তাদের নাফরমানীর কারণে তাদেরকে পরীক্ষা করছিলাম’ (সূরা আল-আ’রাফ : ১৬৩)।

ইহুদীদেরকে শনিবারে শিকার করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তখন তারা কৌশল করে শনিবার রাতে জাল পেতে রাখত এবং রবিবার সকালে সংগ্রহ করত। এটাই হচ্ছে তাদের আল্লাহর হুকুম অমান্য করার অপকৌশল, যার কারণে তাদের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঐ সম্প্রদায় তারা আল্লাহর হারাম বিধানকে অপকৌশলের মাধ্যমে লঙ্ঘন করেছিল এবং তারা বাহ্যিক আসবাবপত্র ব্যবহার করেছিল বটে কিন্তু গভীরভাবে বিবেচনা করলে তারা হারাম কাজই করেছিল’।[৫] জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন,

قَاتَلَ اللهُ الْيَهُوْدَ إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْهِمُ الشُّحُوْمَ فَأَجْمَلُوْهُ ثُمَّ بَاعُوْهُ فَأَكَلُوْا ثَمَنَه

‘আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদেরকে ধ্বংস করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর চর্বি হারাম করেছেন অথচ তারা এটা বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে’।[৬]

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উম্মতের অনেক লোকই সেই প্রতারণায় পতিত হয়েছে যে প্রতারণায় ইহুদীরা পতিত হয়েছিল। তারা কিছু কিছু বিধানের ক্ষেত্রে কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। যেমন মদ, সূদ, হিলা বিবাহ ইত্যাদি যেগুলোকে হারাম করা হয়েছে। সুতরাং এদের মধ্যে ঐ সকল মুসলিম নারীও গণ্য হবে, যারা পর্দা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বাহানা খোঁজে। পর্দা ও খোলামেলা চলার মাঝে একটা যুক্তি উপস্থাপন করে। এটা বিপরীতমুখী দু’টি বিষয়ের সমন্বয়, যা অসম্ভব। যে মেয়ে প্রকৃত পর্দা করে সে তার পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে রবের ব্যাপারে বাহানা খুঁজবে না। সুতরাং মুসলিম রমনী সে শারঈ জিলবার পরিধান করবে, যা শান্ত ও নম্র পোশাক হবে এবং নিজের দেহের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। তাকে ঢেকে রাখবে। অসম্মান করবে না এবং উঁচু করবে না। হেয় করবে না বরং তাকে সম্মানিত করবে এবং বিকৃত করবে না। অতঃপর তার রবের নিকটবর্তী হবে দূরে সরে যাবে না। আর মুমিন নারী কখনো ট্রাউজার ও আঁটোসাঁটো কোর্ট পরিধান করে বের হবে না। এবং এমন পাজামাও পড়বে না, যা দ্বারা সতর আবৃত হয় না। এছাড়া মুসলিম নারীরা কখনো ইউরোপীয় স্যুট পড়ে পুরুষের ন্যায় বের হবে না, যা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অভ্যাস। কেননা আধুনিক মহিলারা শুধু তার মাথার উপর এক টুকরা কাপড় রেখে দিয়েই মনে করে যে সে পর্দানশীল মহিলা। অথচ হিজাব একটা ইবাদাত। আর নিয়ম বহির্ভূত কোন কাজ আল্লাহর ইবাদত হিসাবে গণ্য হয় না এবং মানুষের প্রবৃত্তি ও ফ্যাশন অনুযায়ীও হয় না। আর মুমিন নারী কখনো তার মাথার উপর এক টুকরা কাপড় রাখে না, টাখনু খোলা রেখে লোকদের সামনে প্রকাশ করে না। আর এব্যপারে কোন মতবিরোধ নেই যে, মহিলার পায়ের পাতা সতরের অন্তর্ভুক্ত। এজন্যই তো যে নারী তার পায়ের পাতাদ্বয়, গিরাদ্বয় খোলা রেখে ছালাত আদায় করে তার ছালাত হবে না। আর মুমিন নারী কখনো এমন নরম ও পাতলা কাপড়, যা শরীরের সাথে মিশে থাকে সেগুলো পরিধান করে বের হয় না। যাতে করে তার প্রত্যেক পদক্ষেপে ও চলাচলে ফেতনা প্রকাশিত হয়। ঈমানদার নারী মজলিসে কখনো চেচামেচি ও অট্টহাসি দেয় না এবং নির্লজ্জের মত পুরুষের সাথে হাসিঠাট্টা করে না। আর ছেলেরা তার কাঁধ ও বুকে ঠেলাঠেলি করে না। মুুমিন নারী তার শারঈ পোশাককে রঙিন ফ্যাশনে রাঙ্গায় না, যা দ্বারা শয়তানের মেধা বিকশিত হয়। যেমন মেকাপ করা, নকশা করা, ফটোগ্রাফিং, উল্কি আঁকানো ইত্যাদি। সুতরাং হে মুসলিম বোন! তুমি নিজেকে নিজে শয়তান হতে দূরে রাখো যাতে তোমাকে কোন প্রতারণার দিকে নিতে না পারে, তাহলে শয়তান তোমাকে সেই বেপর্দার মধ্যে ফেলে দিবে, যা আল্লাহ তা’আলা তোমার জন্য হারাম করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, لَا تَرْتَكِبُوْا مَا ارْتَكَبَتِ الْيَهُوْدُ فَتَسْتَحِلُّوْا مَحَارِمَ اللهِ بِأَدْنَى الْحِيَلِ ‘তোমরা সে পাপ কর না যে ধরনের পাপ ইহুদীরা করেছে। সামান্য অযুহাতে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে তারা হালাল করেছে’।[৭]

উপসংহার

মুসলিম নারীর উপর আবশ্যক হল, সে তার নিজের ব্যাপারে ও মেয়ের ব্যাপারে ভয় করবে। আল্লাহ তা‘আলা তার উপর যা আবশ্যক করেছেন তার হেফাযত করবে। যদি তা না করে তাহলে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হবে। যেমন নবী (ﷺ) বলেছেন,

سَيَكُوْنُ آخِرُ أُمَّتِيْ نِسَاءً كَاسِيَاتٍ عَارِيَاتٍ عَلَى رُؤُسِهِنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْعَنُوْهُنَّ فَإِنَّهُنَّ مَلْعُوْنَاتٌ

‘আমার উম্মতের শেষ জামানায় কিছু নারী হবে যারা পোশাক পরেও বিবস্ত্র থাকবে। তাদের মাথার উপর কুমতি উটের কুঁজের মত থাকবে। তাদেরকে অভিশাপ দিবে কেননা তারা অভিশপ্ত’।[৮] আল্লাহ আমাদের সকল মুসলিম নারীদের ফেতনা থেকে হেফাযত করুন এবং শারঈ পর্দা যথাযথ নিয়মে পালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

* সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা। ‌

তথ্যসূত্র:
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৫; মিশকাত, হা/৪।
[২]. নাসাঈ, হা/৫০৩৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১১৬১।
[৩]. তিরমিযী, হা/৩৫৩৭; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘, হা/১৯০৩।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৫৭।
[৫]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৩।
[৬]. তিরমিযী, হা/১২৯৭; ইবনু মাজাহ, হা/২১৬৭, সনদ ছহীহ।
[৭]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৩।
[৮]. মুসতাদরাকু আলাছ ছহীহাইন, হা/৮৩৪৬, সনদ ছহীহ।




স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (২য় কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন

ফেসবুক পেজ