স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
-তামান্না তাসনীম*
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ہُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّہُنَّ ‘তারা তোমাদের জন্য আবরণ এবং তোমরা তাদের জন্য আবরণ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)। যদিও পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল (সূরা আন-নিসা : ৩৪), তবুও মানুষ হিসাবে সমান অধিকার সকলের। আর তাই আল্লাহ তা‘আলা উপরিউক্ত আয়াত উল্লেখ করে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে উভয়ের জন্য মর্যাদাবান করেছেন। পোশাক যেমন আমাদের ইজ্জত-সম্মান হেফাযত করে ও আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, ঠা-া ও গরম থেকে রক্ষা করে, স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকাও তেমনি। স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হবে, একজন আরেকজনকে নেকীর কাজে সাহায্য করবে। এভাবেই একে অপরের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে শুধু দুনিয়াতে নয় বরং আখিরাতেও।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল হলেও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর রয়েছে ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু বর্তমান সমাজে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হয়। মনে হয় যেন সংসারে স্ত্রীর কোন মূল্যই নেই, স্বামীর সংসারে মুখ বুজে খেটে যাবার জন্যই তার জন্ম। যখন সমাজে এই চিন্তা প্রবল হয়, তখনই কাঙ্খিত সুখের সংসার ও প্রেমের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর কাছে অত্যন্ত বিকট ও বীভৎস আকার ধারণ করে। এ বীভৎসতা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ গ্রহণই একমাত্র পথ। সুন্দর সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় পরিবারও সমাজ গঠনে ইসলাম নির্ধারণ করেছে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অনেকগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য। যে দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো পালনের মাধ্যমে একজন স্বামী হয়ে উঠবেন প্রকৃত দায়িত্ববান ও কর্তৃত্বশীল। তবেই কুরআনের নির্দেশনার বাস্তবায়ন হবে। নি¤েœ সংক্ষিপ্তভাবে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য ইসলামের আলোকে আলোকপাত করা হল।
১). স্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ ও পারিবারিক কাজে তার পরামর্শ নেয়া
পরিবারের ছোট বড় সকল সিদ্ধান্তে স্ত্রীর মতামত গ্রহণ করা উচিত। তাকে সম্মান দেখান, তাহলে সেও অনেক সম্মান করবে। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের নানা সমস্যা তাঁর স্ত্রীদের কাছে জানাতেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পরামর্শ দিতেন এবং তিনি তাঁদের পরামর্শ গ্রহণও করতেন। যেমন- হুদাইবিয়ার সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাহাবীদেরকে বললেন, قُوْمُوْا فَانْحَرُوْا ثُمَّ احْلِقُوْا ‘তোমরা উঠ, কুরবানী কর এবং মাথা কামিয়ে ফেল’। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার তা বলার পরও কেউ উঠলেন না। তাদের কাউকে উঠতে না দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট এসে লোকদের এ আচরণের কথা বলেন, উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন,
يَا نَبِىَّ اللهِ أَتُحِبُّ ذَلِكَ اخْرُجْ ثُمَّ لَا تُكَلِّمْ أَحَدًا مِنْهُمْ كَلِمَةً حَتَّى تَنْحَرَ بُدْنَكَ وَتَدْعُوَ حَالِقَكَ فَيَحْلِقَكَ
‘হে আল্লাহর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সঙ্গে কোন কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন’। সে অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে নিজের পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়ালেন। তা দেখে ছাহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। অবস্থা এমন হল যে, ভীড়ের কারণে একে অপরের উপর পড়তে লাগলেন।[১] সুবহা-নাল্লাহ, কী সুন্দর পরামর্শ এবং পরামর্শের কত সুন্দর ফলাফল।
২). স্ত্রীর ও বাড়ীর কাজে সহযোগিতা করা
আপনি বাইরের কাজ করে এসে দেখলেন আপনার স্ত্রীর রান্না বা অন্যান্য কাজে বিলম্ব হচ্ছে, এতে আপনি ভ্রুকুটি না করে তার কাজে সহযোগিতা করুন, দেখবেন আপনাকে সে কত ভালোবাসে। সংসারে কতটা সুখ ও শান্তি বিরাজ করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের ঘরের কাজে সহযোগিতা করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন। আসওয়াদ ইবনু ইয়াযীদ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে কী কাজ করতেন? তিনি বলেন, كَانَ يَكُوْنُ فِيْ مِهْنَةِ أَهْلِهِ تَعْنِيْ خِدْمَةَ أَهْلِهِ ‘ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন’। আর ছালাতের সময় হলে ছালাতের জন্য চলে যেতেন।[২] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আরো বলেন, كَانَ بَشَرًا مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِيْ ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন একজন মানুষ। পোশাকের মধ্যে তিনি উকুন তালাশ করতেন, ছাগল দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন’।[৩] অন্য হাদীছে এসেছে, ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন, জুতা মেরামত করতেন। এছাড়া সাধারণ মানুষের মত বাড়ির অন্যান্য কাজেও শরীক হতেন’।[৪]
এমনকি বাড়ির বাইরে বাহনে আরোহণের ক্ষেত্রেও স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন। একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বাহনে আরোহণ করতে চাইলেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
فَرَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَوِّيْ لَهَا وَرَاءَهُ بِعَبَاءَةٍ ثُمَّ يَجْلِسُ عِنْدَ بَعِيْرِهِ فَيَضَعُ رُكْبَتَهُ فَتَضَعُ صَفِيَّةُ رِجْلَهَا عَلَى رُكْبَتِهِ حَتَّى تَرْكَبَ
‘আমি দেখতে পেলাম যে, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পেছনে চাদর দিয়ে ছাফিয়্যাহকে পর্দা করছেন। উঠা-নামার প্রয়োজন হলে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উটের কাছে হাঁটু বাড়িয়ে বসতেন, আর ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর উপর পা রেখে উটে আরোহণ করতেন’।[৫] স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে এরকম সর্বোচ্চ বিনয়-ন¤্রতা, অনুগ্রহের আদলে গড়ে উঠা উত্তম বৈবাহিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!
৩). স্ত্রীর উপর অযথা রাগ না করা, তারা রেগে গেলে ধৈর্যধারণ করা
অনেকেই আছে যারা অযথা স্ত্রীদের উপর রেগে যায়। ফলে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। বরং অনেক সময় স্ত্রীরা রেগে যায়, এমনকি উচ্চৈঃস্বরে কথাও বলে। এমতাবস্থায় স্বামীর উচিত তাতে ধৈর্যধারণ করা এবং ধৈর্যের সাথে তা মোকাবেলা করা। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীরা রাগ করতেন, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন। কিন্তু তিনি তা ধৈর্যের সাথে সহ্য ও মোকাবেলা করতেন।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, আমি জানি কখন তুমি আমার প্রতি খুশি থাক এবং কখন রাগান্বিত হও। আমি বললাম, কী করে আপনি তা বুঝতে সক্ষম হন? তিনি বললেন, তুমি প্রসন্ন থাকলে বল, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রবের কসম! কিন্তু তুমি আমার প্রতি নারাজ থাকলে বল, ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর রবের কসম!’ আমি শুনে বললাম, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি ঠিকই বলেছেন। সে ক্ষেত্রে শুধু আপনার নাম উচ্চারণ করা থেকেই বিরত থাকি’।[৬]
একদিন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কণ্ঠস্বর উঁচু হল। এমতাবস্থায় আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে ধরে বললেন, হে উম্মে রুম্মানের কন্যা! তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছ? নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের দু’জনের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাগান্বিত অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়ার পর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে খুশী করার জন্য (কৌতুকের ছলে) বললেন, দেখলে তো, আমি কিভাবে তোমার ও ঐ লোকটার মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাম।[৭]
৪). স্ত্রীর সাথে বদান্যতা, সুন্দর আচরণ, তার অনুভূতিকে মূল্যায়ন করা এবং বিপদে সমবেদনা প্রকাশ করা
বর্তমানে দেখা যায় যে, অনেকেই স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ করে না। তার অনুভূতিকে মূল্যায়ন করে না এবং বিপদে সমবেদনাও দেয় না। অথচ ইসলামের বিধান হল সকল অবস্থায় তার পাশে থাকা। পরিবারে সুখ-শান্তির জন্য এগুলো অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের সাথে সুন্দর আচরণকারী ছিলেন, তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলতেন, মাঝে মাঝে হাসি ঠাট্টা করতেন, তাদের সাথে ভালোবাসা ও বদান্যতার সাথে আচরণ করতেন। তিনি স্ত্রীদের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করতেন এবং বিপদে সমবেদনা পেশ করতেন। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) কখনো সন্তুষ্টচিত্তে এবং কখনো রাগান্বিত থাকতেন তা তিনি বুঝতে পারতেন।[৮]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কানে পৌঁছে যে, হাফছাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাকে ইহুদীর মেয়ে বলে ঠাট্টা করেছেন। তাই তিনি কাঁদছিলেন। তাঁর ক্রন্দনরত অবস্থায় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি বললেন, তোমাকে কিসে কাঁদাচ্ছে? তিনি বললেন, হাফছাহ আমাকে ইহুদীর মেয়ে বলে তিরস্কার করেছেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
وَإِنَّكِ لَابْنَةُ نَبِيٍّ وَإِنَّ عَمَّكِ لَنَبِيٌّ وَإِنَّكِ لَتَحْتَ نَبِيٍّ فَفِيْمَ تَفْخَرُ عَلَيْكِ؟ ثُمَّ قَالَ اتَّقِى اللهَ يَا حَفْصَةُ
‘অবশ্যই তুমি একজন নবীর কন্যা, তোমার চাচা অবশ্যই একজন নবী এবং তুমি একজন নবীর সহধর্মিণী। অতএব কিভাবে হাফছাহ তোমার উপরে অহংকার করতে পারে? তারপর তিনি বললেন, হে হাফছাহ! আল্লাহকে ভয় কর’।[৯]
স্ত্রীর প্রতি সমবেদনার প্রতি স্বামীদের দৃষ্টি দেয়া অপরিহার্য। বিশেষ করে অসুস্থাবস্থায়। যেমন স্ত্রীদের ঋতু, নিফাস, সন্তান প্রসবকালীন বা অন্যান্য বিপদাপদের সময়। কেননা স্ত্রী এ সময়ে স্বামীর কাছ সমবেদনার দাবী রাখে। হজ্জের সফরে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ঋতুবতী হওয়ার কারণে কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকটে গমন করে সান্ত¦না দিয়ে বললেন,
مَا لَكِ أَنُفِسْتِ؟ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ إِنَّ هَذَا أَمْرٌ كَتَبَهُ اللهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ فَاقْضِيْ مَا يَقْضِي الحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لَا تَطُوْفِيْ بِالْبَيْتِ
‘(হে আয়েশা!) কী হল তোমার? তোমার কী হায়েয এসেছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এ তো আল্লাহ তা‘আলাই আদম-কন্যাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ ছাড়া হজ্জের বাকী সব কাজ করে যাও’।[১০]
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীকে অসুস্থ দেখলে ঝাড়ফুঁক করে দিতেন এবং মাথায় সহানুভূতির পরশ বুলিয়ে দিতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোন কোন স্ত্রীকে সূরা নাস এবং সূরা ফালাক্ব পড়ে ডান হাত দ্বারা বুলিয়ে দিতেন এবং পড়তেন, اَللّٰهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبِ البَاسَ اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِيْ لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا ‘হে আল্লাহ! মানুষের প্রতিপালক, কষ্ট দূর করুন এবং শিফা দান করুন, আপনিই শিফা দানকারী, আপনার শিফা ছাড়া অন্য কোন শিফা নেই। এমন শিফা দিন, যা কোন রোগ অবশিষ্ট থাকে না’।[১১]
চিন্তা করুন! একজন স্ত্রীর বিপদ বা অসুস্থাবস্থায় স্বামীর সহানুভূতির পরশ কতটা স্ত্রীর মনে সাহসের সঞ্চার করে এবং কষ্ট দূর করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
সুধী পাঠক! বহু হতভাগা স্বামী আছে যারা এ বিষয়গুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। তারা মনে করে তাদের স্ত্রীরা সব সময় সুস্থ থাকবে, কখনো অসুস্থ হবে না। যখন স্ত্রী অসুস্থ হয়, তখন তাকে তার পিতার বাড়িতে রেখে আসে অথবা কোন হাসপাতালে একা ছেড়ে আসে। কেননা এই অবস্থায় স্বামী তার সাথে উঠাবসা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। স্ত্রীদের অনুভূতি, রাগ-সন্তুষ্টিকে পাত্তাই দেয় না। অথচ মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও কখনো তাঁকে স্ত্রীদের অনুভূতিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করত না। অথচ আজকের দিনের স্বামীদের কী অবস্থা? তারা তাদের স্ত্রীদের অনুভূতিকে মূল্যায়নই করতে চায় না। স্ত্রী সন্তুষ্ট আছে না-কি অসন্তুষ্ট, সে চিন্তিত আছে না-কি সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে? এ বিষয়গুলোকে তারা পাত্তাই দিতে চায় না।
৫). প্রেম ও রোমান্টিকতা
আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে সবসময় ভালোবাসার কথা বলবেন, তাকে রোমান্টিকতা দিয়ে ভরপুর করে রাখবেন। আপনার স্ত্রী হয়ত ঘুরতে পসন্দ করেন, তাঁকে মাঝে মাঝে দূরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান, হারিয়ে যান কোন অজানা প্রান্তে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদেরকে অনেক সফরে নিয়ে যেতেন, যা রোমান্টিকতায় পূর্ণ থাকত। হাদীছে এসেছে,
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘একবার আমি রাসূূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে এক অভিযানে বের হলাম, তখন আমি অল্প বয়সী ছিলাম, শরীর তেমন মোটা ছিল না। তিনি তাঁর সাথীদেরকে বললেন, তোমরা আগে চল। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা দেই, প্রতিযোগিতায় আমি এগিয়ে গেলাম। এরপরে আমার শরীরে মেদ বেড়ে গেল, একটু মোটা হলাম। একদা এক সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার সাথীদেরকে বললেন, তোমরা আগে চল। অতঃপর আমাকে বললেন, এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা দেই, প্রতিযোগিতায় তিনি এবার এগিয়ে গেলেন। তিনি হেসে হেসে বললেন, هَذِهِ بِتِلْكَ السَّبْقَةِ ‘এটা তোমার পূর্বের প্রতিযোগিতার উত্তর’।[১২]
তিনি তাঁদের সাথে ভালোবাসা আদান-প্রদান করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنْتُ أَشْرَبُ وَأَنَا حَائِضٌ ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَضَعُ فَاهُ عَلَىْ مَوْضِعِ فِىَّ فَيَشْرَبُ وَأَتَعَرَّقُ الْعَرْقَ وَأَنَا حَائِضٌ ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَضَعُ فَاهُ عَلَىْ مَوْضِعِ فِىَّ
‘আমি ঋতু অবস্থায় পানি পান করতাম, অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দিতাম। তিনি আমার মুখ লাগানো স্থানে মুখ রেখে পানি পান করতেন। আমি ঋতু অবস্থায় হাড়ের গোশত খেতাম। অতঃপর তা আমি তাকে দিতাম। তিনি আমার মুখ লাগানো স্থানে মুখ লাগিয়ে খেতেন’।[১৩]
স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকাও ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে ভালোবেসে ‘হুমায়রা’ বলে ডাকতেন।[১৪] এছাড়াও তিনি স্ত্রীদের সঙ্গে এক সাওয়ারীতে আরোহণ করতেন এবং তাঁদের সাথে কথা বলতে বলতে পথ চলতেন।[১৫] রাতে স্ত্রীরা জেগে থাকলে তাঁদের সাথে গল্প করতেন এবং কথাবার্তা বলতেন।[১৬] অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ছাড়াও স্ত্রীদের চুম্বন করতেন ও তাদের শরীরের সাথে শরীর মিলাতেন।[১৭] বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় তাদেরকে চুম্বন করতেন।[১৮] কখনো তিনি স্ত্রীর উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতেন।[১৯] তিনি স্ত্রীদের সাথে একই পাত্র থেকে গোসল করতেন।[২০] যা তাঁর ভালোবাসা, প্রেম ও রোমান্টিকতার পরিচয় বহন করে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
* বি. এ অনার্স (দ্বিতীয় বর্ষ) ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৩১-২৭৩২, ‘শর্তাবলী’ অধ্যায়, ‘অনুচ্ছেদ-৫৪।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৬, ৫৩৬৩, ৬০৩৯, ‘ভরণ-পোষণ’ অধ্যায়, ‘অনুচ্ছেদ-৬৯।
[৩]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৪১; শামায়েলে তিরমিযী, হা/৩৪৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৪৯৯৬, সনদ ছহীহ।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৯০৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৬৭৭; ছহীহুল জামে‘, হা/৪৯৩৭, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৬৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৯।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৯৪, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৯০১।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৯।
[৯]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৪।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১২১১।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৪৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৯১।
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/২৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৩২০; মিশকাত, হা/৩২৫১, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩১।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩০০; মিশকাত, হা/৫৪৭।
[১৪]. নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/৮৯০২; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২৭৭।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২১১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৪৫।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৬৭।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯২৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১০৬।
[১৮]. তিরমিযী, হা/৮৬; আবূ দাউদ, হা/১৭৮; নাসাঈ, হা/১৭০; ইবনু মাজাহ, হা/৫০২, সনদ ছহীহ।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫০।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/৩২১; নাসাঈ, হা/২৩৯।