বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৮ অপরাহ্ন

শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা

-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*


ভূমিকা

আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হিসাবে ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছেন। আত্মিক পরিশুদ্ধি ইসলামের অন্যতম ভূষণ। কেননা আত্মা পবিত্র না হলে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘মানব দেহের মধ্যে একটা গোশতের টুকরা রয়েছে। যখন সেটা ভালো থাকে সমস্ত দেহ ভালো থাকে। আর যখন সেটা নষ্ট হয়, তখন গোটা দেহ নষ্ট হয়। শুনে রাখ! সেটা হচ্ছে কলব বা হৃদয়’।[১] আর এই হৃদয়কে পবিত্র রাখতে হারাম ভক্ষণ, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি ত্যাগ করা আবশ্যক। ইসলামী শরী‘আত বেগানা নারীর প্রতি হারাম দর্শন থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। এথেকে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম হল- নারীকে যথাযথভাবে তার হিজাব বা পর্দার শারঈ বিধান বাস্তবায়ন করা। নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর শারঈ হিজাব বা পর্দা কেমন হবে সে সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হল : 

পর্দার পরিচয় ও বিধান

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে নারী-পুরুষ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন এবং উভয়ের প্রতি আকর্ষণবোধও সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি এই আকর্ষণ যেন অবৈধ স্থানে বিকশিত না হয় সে জন্য ইসলামী শরী‘আতে পর্দার মত নিরাপত্তার সুব্যবস্থা করেছে। আর পর্দা বলতে নারীর চেহারা-সৌন্দর্যকে বেগানা পুরুষ থেকে চাদর, জিলবাব, বোরকা ইত্যাদির মাধ্যমে আড়াল করে রাখাকে বুঝায়। আর এই নিয়মে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর জন্য পর্দা করা এবং প্রত্যেক পুরুষের জন্য তার ব্যবস্থা করা ফরজ। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ  قُلۡ  لِّاَزۡوَاجِکَ  وَ  بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا  یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের বড় চাদর বা ওড়না তাদের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৯)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,

أَمَرَ اللهُ نِسَاءَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا خَرَجْنَ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ فِيْ حَاجَةٍ أَن يُّغْطِيْنَ وُجُوْهَهُنَّ مِنْ فَوْقِ رُءُوْسِهِنَّ بِالْجَلَابِيْبِ وَيُبْدِيْنَ عَيْنًا وَاحِدَةً

‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে, তখন যেন মাথার উপর থেকে বিশেষ চাদর টেনে স্বীয় মুখমণ্ডল আবৃত করে, আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে’।[২] মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 

سَأَلْتُ عَبِيْدَةَ السَّلْمَانِيَّ عَنْ قَوْلِ اللهِ تَعَالٰى یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ فَغَطَّى وَجْهَهُ وَرَأْسَهُ وَأَبْرَزَ عَيْنَهُ الْيُسْرٰى

‘আমি ‘আবীদাহ আস-সালমানী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি, তার বড় চাদর দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করলেন এবং এক চোখ খোলা রাখলেন’।[৩] অর্থাৎ জিলবাব বা বড় চাদর দ্বারা চেহারা আবৃত করার বাস্তব ব্যাখ্যা দেখালেন।

ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৬৭১ হি.) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন, ‘জিলবাব বা বড় চাদর দ্বারা জামা-কাপড় সহ সমস্ত শরীর ও চেহারা ঢাকতে হবে’।[৪] ইমাম সূয়ুত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, ‘এটি সকল নারীর জন্য পর্দার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত। এর দ্বারা তাদের মাথা ও চেহারা ঢাকা ফরয করা হয়েছে’।[৫]

মুমিন নারীর জন্য বেগানা পুরুষ হতে দৃষ্টি ও আবরু হেফাযতের নির্দেশ সম্বলিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ قُلۡ  لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ  زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِہِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِہِنَّ ۪ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا  لِبُعُوۡلَتِہِنَّ  اَوۡ اٰبَآئِہِنَّ اَوۡ اٰبَآءِ بُعُوۡلَتِہِنَّ اَوۡ اَبۡنَآئِہِنَّ  اَوۡ اَبۡنَآءِ بُعُوۡلَتِہِنَّ اَوۡ اِخۡوَانِہِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ  اِخۡوَانِہِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اَخَوٰتِہِنَّ اَوۡ نِسَآئِہِنَّ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُنَّ اَوِ التّٰبِعِیۡنَ غَیۡرِ اُولِی الۡاِرۡبَۃِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفۡلِ الَّذِیۡنَ لَمۡ  یَظۡہَرُوۡا عَلٰی عَوۡرٰتِ النِّسَآءِ ۪ وَ لَا یَضۡرِبۡنَ بِاَرۡجُلِہِنَّ لِیُعۡلَمَ  مَا یُخۡفِیۡنَ مِنۡ زِیۡنَتِہِنَّ ؕ وَ تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ جَمِیۡعًا اَیُّہَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, ঈমানদার নারীগণ যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। তারা যেন তার মধ্যে যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের অলংকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের ঘাড় ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় (ওড়না বা চাদর) দ্বারা আবৃত্ত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, (পিতামহ-মাতামহ) শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনাহীন পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে না হাঁটে। হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আন-নূর : ৩১)।

সুধী পাঠক! উক্ত আয়াতে নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা চেহারা হল নারীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।[৬] এছাড়া মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পর্দা করা ওয়াজিব। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

يَرْحَمُ اللهُ نِسَاءَ الْمُهَاجِرَاتِ الْأُوَلَ لَمَّا أَنْزَلَ اللهُ (وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِہِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِہِنَّ) شَقَّقْنَ مُرُوْطَهُنَّ فَاخْتَمَرْنَ بِهِ

‘আল্লাহ তা‘আলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন। যখন আল্লাহ তা‘আলা وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِہِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِہِنَّ মর্মে আয়াতটি নাযিল করেন, তখন তারা নিজে চাদর ছিঁড়ে ওড়না হিসাবে ব্যবহার করল’।[৭] উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তারা (চাদর ছিঁড়ে) মুখমণ্ডল আবৃত করেন’।[৮]

উক্ত আয়াতে মুসলিম নারী-পুরুষের ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করা হয়েছে, যা পালন করা তাদের উপর আবশ্যক। বর্ণিত বিষয়গুলো নিম্নরূপ :

১. মহিলাদের উপর চক্ষু অবনমিত করা ওয়াজিব

মহিলাগণ সর্বদা তাদের চক্ষু অবনমিত রাখবে। এটা তাদের উপর তেমনি আবশ্যিক, যেমন পুরুষগণের ক্ষেত্রে তাদের চক্ষু অবনমিত রাখা আবশ্যিক। এ ব্যাপারে ইসলামে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা কখনো মহিলাদের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে না। তবে যদি রাস্তাঘাটে চলাফেরাতে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মহিলাদের প্রতি দৃষ্টি পড়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে চক্ষু অবনমিত করবে। এটা তাদের উপর ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ  اَبۡصَارِہِمۡ ‘(হে নবী!) আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। হাদীছে এসেছে,

عَن جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظْرِ الْفُجَاءَةِ فَأَمَرَنِيْ أَنْ أَصْرِفَ بَصَرِيْ

জারীর ইবনু আব্দুলাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নারীদের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে আমার চোখ ফিরিয়ে নিতে আদেশ করলেন।[৯] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ بُرَيْدَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَلِيٍّ يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإِنَّ لَكَ الْأُوْلَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ

বুরায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, হে আলী! কোন নারীর প্রতি আকস্মিক একবার দৃষ্টিপাতের পর আবার দৃষ্টিপাত কর না। কেননা তোমার জন্য প্রথমবারের অনুমতি আছে এবং দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই।[১০]

সন্দেহজনক না হলে হাব্‌শী বা অনুরূপ লোকদের প্রতি মহিলারা দৃষ্টি দিতে পারবে। অনুরূপভাবে যৌন চাহিদা ব্যতীত যরূরী প্রয়োজনে মহিলারা পুরুষদের দিকে দৃষ্টি দিতে পারবে। যেমন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

رَأَيْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتُرُنِىْ بِرِدَائِهِ وَأَنَا أَنْظُرُ إِلَى الْحَبَشَةِ يَلْعَبُوْنَ فِى الْمَسْجِدِ حَتَّى أَكُوْنَ أَنَا الَّذِىْ أَسْأَمُ فَاقْدُرُوْا قَدْرَ الْجَارِيَةِ الْحَدِيْثَةِ السِّنِّ الْحَرِيْصَةِ عَلَى اللَّهْوِ

‘আমি একদিন হাবশীদের খেলা দেখছিলাম। তারা মসজিদের আঙ্গিনায় খেলা করছিল। আমি ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত খেলা দেখছিলাম। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তোমরা অনুমান কর যে, অল্পবয়স্কা মেয়েরা খেলাধূলা দেখতে কী পরিমাণ আগ্রহী!’[১১] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِيْ سَلَمَةَ عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ قَيْسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ أَبَا عَمْرِو بْنَ حَفْصٍ طَلَّقَهَا الْبَتَّةَ وَهُوَ غَائِبٌ فَأَرْسَلَ إِلَيْهَا وَكِيْلُهُ الشَّعِيْرَ فَسَخِطَتْهُ فَقَالَ وَاللهِ مَا لَكِ عَلَيْنَا مِنْ شَيْءٍ فَجَاءَتْ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرْتَ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ لَيْسَ لَكِ نَفَقَةٌ فَأَمَرَهَا أَنْ تَعْتَدَّ فِيْ بَيْتِ أُمِّ شَرِيْكٍ ثُمَّ قَالَ تِلْكِ امْرَأَةٌ يَغْشَاهَا أَصْحَابِيْ اعْتَدِّيْ عِنْدَ ابْنِ أُمِّ مَكْتُوْمٍ فَإِنَّهُ رَجُلٌ أَعْمَى تَضَعِيْنَ ثِيَابَكِ

আবূ সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফাতেমা বিনতে ক্বায়স (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণনা করেন, আবূ ‘আমর ইবনু হাফছ (ফাতেমার স্বামী) তাকে দূরদেশ হতে শেষ ত্বালাক্ব দিয়ে দিল। অতঃপর আবূ ‘আমরের প্রতিনিধি তার নিকট কিছু যব পাঠিয়ে দিল। এতে ফাতেমা অসন্তুষ্ট হল। প্রতিনিধি বলল, আল্লাহর কসম! আমাদের উপর তোমার বাধ্যতামূলক কোন পাওনা নেই। ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গেল এবং তাঁকে তা বলল। তিনি বললেন, হ্যাঁ তোমার খোরপোষ পাওনা নেই। রাবী বলেন, এ সময় তিনি তাকে উম্মু শরীকের ঘরে গিয়ে ইদ্দত পালন করতে নির্দেশ দিলেন। অতঃপর বললেন, না, উম্মু শরীকের ঘর আমার ছাহাবীদের আনাগোনার স্থল। তুমি ইবনু উম্মু মাকতূম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘরে গিয়ে ইদ্দত পালন কর। সে অন্ধ মানুষ, সেখানে তুমি গায়ের কাপড় ছাড়তে পারবে...।[১২]

আল্লাহ তা‘আলা বাণী- وَ قُلۡ  لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, ঈমানদার নারীগণ যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে’ (সূরা আন-নূর : ৩১)-এর ব্যাখ্যায় আহমাদ মুছত্বফা আল-মারাগী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কোন নারীর জন্য কোন পুরুষ ও নারীগণের গোপনাঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করা বৈধ নয়। আর কামোত্তেজনার সাথে দৃষ্টিপাত করা হারাম। তবে তা ব্যতীত দৃষ্টিপাত করলে হারাম নয়। বরং সর্বদা চক্ষু অবনমিত রাখা অগ্রগণ্য ও অতীব সুন্দর’।[১৩]

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اضْمَنُوْا لِيْ سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوْا إِذَا حَدَّثْتُمْ وَأَوْفُوْا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوْا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ وَغَضُّوْا أَبْصَارَكُمْ وَكُفُّوْا أَيْدِيَكُمْ

ওবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের পক্ষ হতে আমাকে ছয়টি বিষয়ের হেফাযতের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের যামিন হব। ১. যখন তোমরা কথা বলবে, তখন সত্য কথা বলবে। ২. যখন ওয়াদা করবে, তখন তা পূর্ণ করবে। ৩. যখন তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়, তখন তা আদায় করবে। ৪. তোমরা নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে। ৫. তোমাদের স্বীয় দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে এবং ৬. স্বীয় হাতকে অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখবে’।[১৪]

অন্যদিকে রাস্তার হক্ব সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছে চক্ষু অবনমিত রাখার নির্দেশনা এসেছে। যেমন, আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِيَّاكُمْ وَالْجُلُوْسَ عَلَى الطُّرُقَاتِ فَقَالُوْا مَا لَنَا بُدٌّ إِنَّمَا هِىَ مَجَالِسُنَا نَتَحَدَّثُ فِيْهَا قَالَ فَإِذَا أَبَيْتُمْ إِلَّا الْمَجَالِسَ فَأَعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهَا قَالُوْا وَمَا حَقُّ الطَّرِيْقِ قَالَ غَضُّ الْبَصَرِ وَكَفُّ الْأَذَى وَرَدُّ السَّلَامِ وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهْىٌ عَنِ الْمُنْكَرِ

‘তোমরা রাস্তার উপর বসা ছেড়ে দাও। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোন পথ নেই। কেননা এটাই আমাদের উঠাবসার জায়গা এবং আমরা এখানেই কথাবার্তা বলে থাকি। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক্ব আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক্ব কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনমিত রাখা, কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেয়া, সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করা’।[১৫]

উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য শারঈ পর্দা আবশ্যক। আর তার প্রথম পদক্ষেপ হল- সর্বদা চক্ষু অবনমিত রাখা। এটা শারঈ পর্দার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

*সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২।
[২]. আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী, জামিঊল বয়ান ফী তা’বীলিল কুরআন (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), ২০তম খণ্ড, পৃ. ৩২৪।
[৩]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু ওমর ইবনু কাছীর আদ-দিমাশক্বী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৮২।
[৪]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আল-ক্বুরতুবী, আল-জামেঊ লি আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ১৪০৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৭৯।
[৫]. আবূ আব্দুর রহমান মুহাম্মাদ আশরাফ ইবনু আমীর আল-‘আযিমাবদী, ‘আওনুল মা‘বূদ শরহু সুনানি আবী দাঊদ (বৈরূত : দারুল কুতুব, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি.), ১১তম খণ্ড, পৃ. ১০৬।
[৬]. ইবনুল জাওযী, আদিল্লাতুল হিজাব (মিশর : মাকতাবাতুল আযহার, ১ম সংস্করণ, ২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৪৭৪।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭৫৮; আবূ দাঊদ, হা/৪১০২।
[৮]. হাফেয ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৯০।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৫৯; তিরমিযী, হা/২৭৭৬; মিশকাত, হা/৩১০৪।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩০৪১; তিরমিযী, হা/২৭৭৭; আবূ দাঊদ, হা/২১৪৯; দারেমী, হা/২৭০৯; মিশকাত, হা/৩১১০, সনদ হাসান।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৩৬; নাসাঈ, হা/১৫৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৫৮৫।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৮০; আবূ দাঊদ, হা/২২৮৪ নাসাঈ, হা/৩২৪৫; মিশকাত, হা/৩৩২৪।
[১৩]. শায়খ আহমাদ মুছত্বফা আল-মারাগী, তাফসীরুল মারাগী, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৯৯।
[১৪]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৪৮০২; মিশকাত, হা/৪৮৭০, সনদ ছহীহ লিগাইরিহী।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২১২১; আবূ দাঊদ, হা/৪৮১৫; মিশকাত, হা/৪৬৪০।




প্রসঙ্গসমূহ »: নারী সমাজ
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
প্রশ্নোত্তরে মুসলিম নারীদের ইসলাম শিক্ষা (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার

ফেসবুক পেজ