বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ অপরাহ্ন

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

-তামান্না তাসনীম*


(শেষ কিস্তি)

৯). স্ত্রীকে সদুপদেশ দেয়া এবং তার সাথে সদ্ব্যবহার করা

আপনার পরিবারের কে কী রকম তা আপনি আপনার স্ত্রীকে আগেই জানিয়ে দিন। তাকে সবার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দিলে সে অনুযায়ী তাদের সাথে মিলেমিশে চলতে সহজ হবে। মাঝে মধ্যে আপনি তাকে বিভিন্ন সদুপদেশ দেন, তাকে আপনার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বুঝান। এতে সে আপনাকে আরো বেশী ভালোবাসবে। তার সাথে সদ্ব্যবহার করুন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

اِسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهُ كَسْرَتَهُ وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ

‘তোমরা নারীদের সাথে ভাল ও উত্তম আচরণ কর। কারণ তাদেরকে পাঁজরের হাড় হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বাঁকা হাড় হল উপরের হাড়। অতএব তুমি যদি তাকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি ছেড়ে দাও, তাহলে সবসময় বাকাই থাকবে। সুতরাং তোমরা নারীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর’।[১]

স্ত্রীকে সদুপদেশ দেয়ার মাধ্যমে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া, যাতে তারা মুমিন নারীদের আদর্শ হতে পারে। এটাও স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষ করে ফরয বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা (সূরা মারইয়াম : ৫৫; সূরা ত্বা-হা : ১৩২; সূরা আন-নূর : ৩১)। স্বামী হিসাবে স্ত্রীদের কর্মকা- সম্পর্কে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْهُمْ ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে দায়িত্ববান এবং সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[২]

আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হল জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগেই স্ত্রীদেরকে সদুপদেশ দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদেরকে ইবাদতের তা‘লীম দিতেন এবং নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন।[৩] নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে স্ত্রীদেরকে ক্বিয়াম ও ইবাদত-বন্দেগীর জন্য জাগিয়ে দিতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে ফেলতেন। তিনি রাত্রি জেগে নিজে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন।[৪] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে ছালাত আদায় করতেন। বিতর আদায় করার সময় হলে স্ত্রীদের বলতেন, উঠ বিতর আদায় কর।[৫]

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার সর্বোত্তম উদাহরণ

আপনি যদি আপনার স্ত্রীর জন্য এ হাদীছে বর্ণিত আবূ যার‘আ হতে পারেন, আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেভাবে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে ভালোবাসতেন সেভাবে ভালোবাসতে পারেন তবে আপনিই হবেন আপনার স্ত্রীর উত্তম স্বামী ও ভালোবাসার পাত্র।

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ১১ জন মহিলা এক স্থানে একত্রিত বসল এবং সকলে মিলে এ কথার উপর একমত হল যে, তারা নিজেদের স্বামীর ব্যাপারে কোন কিছুই গোপন রাখবে না।

প্রথম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী হচ্ছে অত্যন্ত হালকা-পাতলা দুর্বল উঠের গোশতের মত, যেন কোন পর্বতের চূড়ায় রাখা হয়েছে এবং সেখানে উঠা সহজ কাজ নয় এবং গোশতের মধ্যে এত চর্বিও নেই, যে কারণে সেখানে উঠার জন্য কেউ কষ্ট স্বীকার করবে’। দ্বিতীয়জন বলল, ‘আমি আমার স্বামী সম্পর্কে কিছু বলব না, কারণ আমি ভয় করছি যে, তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেষ করা যাবে না। কেননা যদি আমি তার সম্পর্কে বলতে যাই, তাহলে আমাকে তার সকল দুর্বলতা এবং মন্দ দিকগুলো সম্পর্কেও বলতে হবে’।

তৃতীয় মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তি। আমি যদি তার বর্ণনা দেই (আর সে যদি তা শোনে), তাহলে সে আমাকে ত্বালাক্ব দিবে। আর যদি আমি কিছু না বলি, তাহলে সে আমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখবে। অর্থাৎ ত্বালাক্বও দেবে না, স্ত্রীর মত ব্যবহারও করবে না’। চতুর্থ মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী হচ্ছে তিহামার রাতের মত মাঝামাঝি- অতি গরমও না, অতি ঠা-াও না, আর আমি তাকে ভয়ও করি না, আবার তার প্রতি অসন্তুষ্টও নই’। পঞ্চম মহিলা বলল, ‘যখন আমার স্বামী ঘরে ঢুকে তখন চিতা বাঘের মত থাকে। যখন বাইরে যায়, তখন সিংহের মত তার স্বভাব থাকে এবং ঘরের কোন কাজের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলে না’।

৬ষ্ঠ মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী যখন খেতে বসে, তখন সব খেয়ে ফেলে। যখন পান করে, তখন সব শেষ করে। যখন নিদ্রা যায়, তখন একাই চাদর বা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। এমনকি (একটিবারের জন্য) হাত বের করেও আমার খবর নেয় না’। সপ্তম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী হচ্ছে পথভ্রষ্ট অথবা দুর্বল মানসিকতা সম্পন্ন এবং চরম বোকা, সব রকমের দোষ তার আছে। সে তোমার মাথায় বা শরীরে অথবা উভয় স্থানে আঘাত করতে পারে’। অষ্টম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামীর স্পর্শ হচ্ছে খরগোশের মত এবং তার দেহের সুগন্ধি হচ্ছে যারনাব (এক প্রকার বনফুল)-এর মত’।

নবম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী হচ্ছে অতি উচ্চ অট্টালিকার মত এবং তার তরবারি ঝুলিয়ে রাখার জন্য সে চামড়ার লম্বা ফালি পরিধান করে (অর্থাৎ সে দানশীল ও সাহসী)। তার ছাইভষ্ম প্রচুর পরিমাণের (অর্থাৎ প্রচুর মেহমান আছে এবং মেহমাহদারীও হয়) এবং মানুষের জন্য তার গৃহ অবারিত। এলাকার জনগণ তার সঙ্গে সহজেই পরামর্শ করতে পারে’। দশম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামীর নাম হল মালিক। মালিকের কী প্রশংসা আমি করব। যা প্রশংসা করব সে তার চেয়েও ঊর্ধ্বে। তার অনেক মঙ্গলময় উট আছে, তার অধিকাংশ উটকেই ঘরে রাখা হয় (অর্থাৎ মেহমানদের যব্হ করে খাওয়ানোর জন্য) এবং অল্প সংখ্যক মাঠে চরার জন্য রাখা হয়। বাঁশির শব্দ শুনলেই উটগুলো বুঝতে পারে যে, তাদেরকে মেহমানদের জন্য যব্হ করা হবে’।

একাদশতম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী আবূ যার‘আ। তার কথা আমি কী বলব। সে আমাকে এত অধিক গহনা দিয়েছে যে, আমার কান ভারী হয়ে গেছে, আমার বাজুতে মেদ জমেছে এবং আমি এত সন্তুষ্ট হয়েছি যে, আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। সে আমাকে এনেছে অত্যন্ত গরীব পরিবার থেকে, যে পরিবার ছিল মাত্র কয়েকটি বকরীর মালিক। সে আমাকে অত্যন্ত ধনী পরিবারে নিয়ে আসে, যেখানে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, উটের হাওদার আওয়াজ এবং শস্য মাড়াইয়ের খসখসানি শব্দ শোনা যায়। সে আমাকে ধন-সম্পদের মধ্যে রেখেছে। আমি যা কিছু বলতাম, সে বিদ্রƒপ করত না এবং আমি নিদ্রা যেতাম এবং সকালে দেরী করে উঠতাম। যখন আমি পান করতাম, অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে পান করতাম। আর আবূ যার‘আর আম্মার কথা কী বলব! তার পাত্র ছিল সর্বদা পরিপূর্ণ এবং তার ঘর ছিল প্রশস্ত। আবূ যার‘আর পুত্রের কথা কী বলব! সেও খুব ভাল ছিল। তার শয্যা এত সংকীর্ণ ছিল যে, মনে হত যেন কোষবদ্ধ তরবারি অর্থাৎ সে অত্যন্ত হালকা-পাতলা দেহের অধিকারী। তার খাদ্য হচ্ছে ছাগলের একখানা পা। আর আবূ যার‘আর কন্যা সম্পর্কে বলতে হয় যে, সে কতই না ভাল। সে বাবা-মায়ের সস্পূর্ণ বাধ্য সন্তান। সে অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী, যে কারণে সতীনরা তাকে হিংসা করে। আবূ যার‘আর ক্রীতদাসীরাও অনেক গুণী। সে আমাদের গোপন কথা কখনো প্রকাশ করত না, সে আমাদের সম্পদকে কমাত না এবং আমাদের বাসস্থানকে আবর্জনা দিয়ে ভরে রাখত না’। সে মহিলা আরও বলল, ‘একদিন দুধ দোহন করার সময় আবূ যার‘আ বাইরে বেরিয়ে এমন একজন মহিলাকে দেখতে পেল, যার দু’টি পুত্র সন্তান রয়েছে। ওরা মায়ের স্তন নিয়ে চিতা বাঘের মত খেলছিল (দুধ পান করছিল)। সে ঐ মহিলাকে দেখে আকৃষ্ট হল এবং আমাকে ত্বালাক্ব দিয়ে তাকে বিয়ে করল। এরপর আমি এক সম্মানিত ব্যক্তিকে বিয়ে করলাম। সে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ত এবং হাতে বর্শা রাখত। সে আমাকে অনেক সম্পদ দিয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকারের গৃহপালিত জন্তু থেকে এক এক জোড়া আমাকে দিয়েছে এবং বলেছে, হে উম্মু যার‘আ! তুমি এ সম্পদ থেকে খাও, পরিধান কর এবং উপহার দাও। মহিলা আরও বলল, সে আমাকে যা কিছু দিয়েছে, তা আবূ যার‘আর একটি ক্ষুদ্র পাত্রও পূর্ণ করতে পারবে না (অর্থাৎ আবূ যার‘আর সম্পদের তুলনায় তা খুবই সামান্য ছিল)’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, كُنْتُ لَكِ كَأَبِىْ زَرْعٍ لِأُمِّ زَرْعٍ ‘আবূ যার‘আ তার স্ত্রী উম্মু যার‘আর জন্য যেমন আমিও তোমরা প্রতি তেমন (তবে আমি কখনো তোমাকে ত্বালাক্ব দিব না)’।[৬]

স্বামীর জন্য কতিপয় উপদেশ

স্ত্রীদের সাথে সদাচরণ করা এবং তাদের অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা পুরুষের উপর আবশ্যক। অবশ্য এই অধিকার প্রদানের পরও নারীদের থেকে কোন কোন সময় বক্রতা লক্ষ্য করা যায়। কোন অবস্থাতেই তাদেরকে পুরাপুরিভাবে বশে আনা সম্ভব নয়। এজন্য পুরুষকে ধৈর্যশীল হতে হবে। তাদেরকে সর্বদা সদুপদেশ প্রদান করতে হবে।[৭]  নারীদের মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে বক্রতা থাকলেই যে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এমন নয়; বরং তার মধ্যে অনেক ভাল গুণও আছে। কোন বিষয় হয়তো আপনি অপসন্দ করছেন কিন্তু তাতেই রয়েছে আপনার জন্য প্রভূত কল্যাণ, যা আপনি জানেনই না। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَ عَاشِرُوۡہُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ فَاِنۡ کَرِہۡتُمُوۡہُنَّ فَعَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَہُوۡا شَیۡئًا وَّ یَجۡعَلَ اللّٰہُ فِیۡہِ خَیۡرًا کَثِیۡرًا 

‘আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর; কিন্তু যদি পাপ অনুভব কর তবে তোমরা যে বিষয়ে দোষি মনে কর আল্লাহ সেটাকে প্রচুর কল্যাণকর করতে পারেন’ (সূরা আন-নিসা : ১৯)।

অতএব স্ত্রীর নিকট থেকে কোন বিরোধিতা বা অপসন্দনীয় বিষয় প্রকাশ পেলে দ্রুত তাকে উপদেশ দিবে এবং নছীহত করবে। আল্লাহর কথা স্মরণ করাবে, তাঁর শাস্তির ভয় দেখাবে। তার আবধ্যতা ও গোঁড়ামির পরিণতি যে ভয়াবহ সে সম্পর্কে সতর্ক করবে। কিন্তু এরপরও যদি স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতা, হঠকারিতা ও অসৎ চরিত্র লক্ষ্য করা যায়, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও সীমারেখা রয়েছে যা লঙ্ঘন করা থেকে সাবধান থাকতে হবে। কুরআনুল কারীম এবং সুন্নাতে নববীতে এর একটি সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অনুসন্ধান কর না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান’ (সূরা আন-নিসা : ৩৪)। এ আয়াতে অবাধ্য স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য যে নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :

প্রথম পদক্ষেপ : উপদেশ দেয়া। তাকে ভদ্র ও নম্রভাবে বুঝাতে হবে, বিরোধিতা ও হঠকারিতার পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে হবে। স্বামী যে সত্য সত্যই স্ত্রীর কল্যাণকামী এ বিষয়টি যেন তার কাছে প্রকাশ পায় এমন ভাষা ব্যবহার করতে হবে। রাগতঃ ভাষায় কর্কষ কন্ঠের কথা কখনো উপদেশ হতে পারে না। স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য কখনই কঠিন ও শক্ত ভাষা ব্যবহার করে উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করবেন না। কেননা অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে প্রতিহত করা যায় না।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ : বিছানায় পরিত্যাগ করা। একই বিছানায় তার থেকে আলাদাভাবে শয়ন করা। এমন কথা নয় যে, তাকে ঘরের বাইরে রাখা বা অন্য ঘরে রাখা বা পিতা-মাতার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া। কেননা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার হল নিজ স্ত্রীকে নিজ বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে সুযোগ দিবে না।[৮]

বিছানায় আলাদা করে রাখার অর্থ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তার সাথে তার বিছানাতেই ঘুমাবে কিন্তু তার সাথে সহবাস করবে না, তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে শয়ন করবে এবং তার সাথে স্বাভাবিক কথা ছাড়া আর কিছু বলবে না’।[৯] ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) এই পদক্ষেপের উপকারিতা সম্পর্কে বলেন, ‘স্বামীর প্রতি যদি স্ত্রীর ভালোবাসা থাকে, তাহলে এ অবস্থা তার কাছে খুবই অসহনীয় ও কষ্টকর হবে, ফলে সে সংশোধন হবে। কিন্তু ভালোবাসায় ত্রুটি থাকলে বা মনে ঘৃণা থাকলে নিজ অবাধ্যতার উপর সে অটল থাকবে এবং সংশোধনের পথে অগ্রসর হবে না’।[১০] সংশোধনের এই দ্বিতীয় নীতি ফলপ্রসু না হলে তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর তা হচ্ছে,

তৃতীয় পদক্ষেপ : প্রহার করা। এটি আল্লাহ তা‘আলা (সূরা আন-নিসা : ৩৪) এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশ।[১১] প্রহার করার মূল উদ্দেশ্য হল আদব শিক্ষা।[১২] তবে তা যেন কঠিন ও কষ্টদায়ক না হয়[১৩], দাসীকে প্রহার করার ন্যায় না হয়[১৪] এবং তার মুখে যেন প্রহার করা না হয়।[১৫]

দুঃখজনক বিষয় হল-বর্তমানে দেখা যায় যে, স্বামীরা উপরিউক্ত শারঈ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে স্ত্রীদের উপর সামান্য কারণে যেভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করে; যার ফলাফল অত্যন্ত দুঃখজনক। আপসোস! এসকল স্বামীদের জন্য।

পরিশেষে বলব, একজন আদর্শ স্বামী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে পারিবারিক জীবনে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শই আপনার আদর্শ হতে হবে। আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত স্ত্রীকে ভালোবাসলেই আপনার স্ত্রী নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এবং আপনাকে ভাল মানুষ মনে করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِيْ ‘তোমাদের মধ্যে যে নিজের পরিবারের কাছে ভাল, সেই ভাল। আর আমি হচ্ছি আমার পরিবারের কাছে ভাল’।[১৬] আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুমিনা নারীদের স্বামীকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত একজন আদর্শ স্বামী হিসাবে কবুল করুন- আমীন!!



* বি. এ অনার্স (দ্বিতীয় বর্ষ) ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৩১, ৫১৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৬৮।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৫, ১১২৬।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১২; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪৪।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৪৮; নাসাঈ, হা/৪৬৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪২৪২; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩৫৩।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৩১, ৫১৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৬৮।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২০০২৭; আবূ দাঊদ, হা/২১৪২; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৫০।
[৯]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৪; সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[১০]. তাফসীরে কুরতুবী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৭১; সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮।
[১২]. তাফসীরে কুরতুবী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৭১; সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২০৪, ৪৯৪২।
[১৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২০০২৭; আবূ দাঊদ, হা/২১৪২; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৫০।
[১৬]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৫; দারেমী, হা/২২৬০।




প্রসঙ্গসমূহ »: নারী সমাজ
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (২য় কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম

ফেসবুক পেজ