শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন

শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা

-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*


(৫ম কিস্তি) 

শারঈ জিলবাবের শর্তাবলী

হে মুসলিম বোন! উপরে আলোচিত জিলবাব সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রত্যেক মুসলিম নারীকে যথাযথভাবে পূরণ করা আবশ্যক। আল্লামা মুহাদ্দিছ ফক্বীহ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘জিলবাবুল মার’য়াতিল মুসলিমাহ’ নামক গ্রন্থে আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জিলবাবের কতিপয় শর্ত সন্নিবেশিত করেছেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল :

প্রথম শর্ত : সমস্ত শরীর ঢেকে নিবে, তবে এমনিতে যা প্রকাশিত হয় তা ব্যতীত।

এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা গত হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় শর্ত : জিলবাব অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত না হওয়া

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ  ‘তারা যেন তাদের স্বামী ব্যতীত কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে ...’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। উক্ত আয়াতের ব্যাপকতা হল- এটি দ্বারা কাপড়ের বাহ্যিকতাকে অন্তর্ভুক্ত করে, যখন তা সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় এবং তার দিকে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর জিলবাব পরিধানের উক্ত নির্দেশ প্রদানের মৌলিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে মহিলার সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখা। সুতরাং স্বয়ং জিলবাবটাই সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে এমনটি সঠিক নয়। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) (১২৭৪-১৩৪৮ হি.) তাঁর ‘আল-কাবাইর’ কিতাবের মধ্যে বলেছেন, ‘যে সকল কর্মকাণ্ডের কারণে মহিলার উপর লা‘নত হয় সেগুলো হল- নেকাবের নিচ হতে সৌন্দর্য, স্বর্ণ, মনি-মুক্তা প্রকাশ করা। আর বাহিরে বের হওয়ার সময় মেশকে আমবার, আতর দ্বারা সুরভিত হওয়া। রং-বেরংয়ের কাপড়, রেশমী বুতাম, প্রশস্ত ও লম্বা হাতা এবং লম্বা কাপড়ের খাটো আলখেল্লা। এই ধরনের প্রদর্শনকারী ব্যক্তির উপর আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সে ঘৃণিত হয়’।[১]

মুসলিম নারীর জানা উচিত যে, জিলবাব সাদা বা কালো হওয়া কোন শর্ত নেই। যেহেতু এ ব্যাপারে দলীল নেই। বরং নবী করীম (ﷺ) মহিলার জন্য রং প্রকাশ করার এবং সুগন্ধি চেপে রাখতে অনুমতি দিয়েছেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ طِيْبُ الرِّجَالِ مَا ظَهَرَ رِيْحُهُ وَخَفِيَ لَوْنُهُ وَطِيْبُ النِّسَاءِ مَا ظَهَرَ لَوْنُهُ وَخَفِيَ رِيْحُهُ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, পুরুষদের সুগন্ধি হল যার গন্ধ বিচ্ছুরিত হয় এবং রং গোপন থাকে। আর মহিলাদের সুগন্ধি হল যার রং উজ্জ্বল হয় এবং গন্ধ বিচ্ছুরিত হয় না।[২]

এছাড়াও উম্মাহাতুল মুমিনীন হতে প্রমাণিত যে, তাঁরা সাদা-কালো ব্যতীত বিভিন্ন রঙ্গের কাপড় পরিধান করতেন। ‘আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে মহিলাদের ত্বাওয়াফের বিবরণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, وَرَأَيْتُ عَلَيْهَا (عَائِشَةَ) دِرْعًا مُوَرَّدًا ‘আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে গোলাপী চাদর পরা অবস্থায় দেখেছি’।[৩] আল্লামা ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৭৩-৮৫২ হি./১৩৭২-১৪৪৯ খ্রি.) বলেন, أي قميصا لونه لون الورد ‘এর অর্থ হল গোলাপী রংয়ের জামা’।[৪] ইবরাহীম নাখয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) (৪৭-৯৬ হি.) বলেন, 

أَنَّهُ كَانَ يَدْخُلُ مَعَ عَلْقَمَةَ وَالْأَسْوَدِ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ ﷺ فَيَرَاهُنَّ فِي اللُّحُفِ الْحُمْرِ

‘তিনি আলক্বমা ও আসওয়াদের সাথে নবী করীম (ﷺ)-এর স্ত্রীদের নিকট যেতেন। তখন তিনি তাদেরকে লাল চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখতেন’।[৫] সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,

أَنَّهُ رَأَى بَعْضَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ ﷺ تَطُوْفُ بِالْبَيْتِ وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ مُعَصْفَرَةٌ

‘তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর কোন এক স্ত্রীকে রঙ্গীন কাপড় পরে ত্বাওয়াফ করতে দেখেছেন’।[৬]

অতএব জিলবাবের সৌন্দর্যতা প্রকাশ করা বৈধ। তবে সেটা যাতে করে অতিরিক্ত না হয়, লোক দেখানো কিংবা অন্যকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে না হয়, সেদিকটা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

তৃতীয় শর্ত : জিলবাবের কাপড় পুরু হতে হবে, পাতলা হওয়া যাবে না

হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلَاتٌ مَائِلَاتٌ رُؤُوْسَهُمْ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَتُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا

‘দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামী। অবশ্য আমি তাদেরকে দেখতে পাব না। তাদের এক শ্রেণী এমন লোক হবে, যাদের হাতের মধ্যে থাকবে গরুর লেজের ন্যায় র্দোরা। যার দ্বারা তারা মানুষদেরকে মারধর করতে থাকবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হবে এমন সব নারী, যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ, অপরকে নিজের দিকে আকৃষ্টকারী এবং নিজেও অপরের দিকে আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুল হবে বুখতি উটের হেলিয়ে পড়া কুঁজের ন্যায়। তারা কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি তারা জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। যদিও তার সুঘ্রাণ অনেক অনেক দূর হতে পাওয়া যাবে’।[৭] উক্ত হাদীছের كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ অংশের ব্যাখ্যায় শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন,

أَنْ تَكْتَسِيَ مَا لَا يَسْتُرُهَا فَهِيَ كَاسِيَةٌ وَهِيَ فِي الْحَقِيْقَةِ عَارِيَةٌ مِثْلُ مَنْ تَكْتَسِي الثَّوْبَ الرَّقِيْقَ الَّذِيْ يَصِفُ بَشَرَتَهَا أَوْ الثَّوْبَ الضَّيِّقَ الَّذِيْ يُبْدِيْ تَقَاطِيْعَ خَلْقِهَا مِثْلَ عَجِيْزَتِهَا وَسَاعِدِهَا وَنَحْوِ ذَلِكَ. وَإِنَّمَا كُسْوَةُ الْمَرْأَةِ مَا يَسْتُرُهَا فَلَا يُبْدِيْ جِسْمَهَا وَلَا حَجْمَ أَعْضَائِهَا لِكَوْنِهِ كَثِيْفًا وَاسِعًا

‘যে এমন পোশাক পরবে যা তাদেরকে আবৃত করবে না। সুতরাং সে পোশাক পরিহিতা হয়েও বাস্তবে বিবস্ত্র হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, এমন পাতলা কাপড় পরিধান করবে যাতে চামড়া অনুমিত হবে। অথবা এমন আঁট-সাঁট সরু কাপড় যদ্দারা তার অঙ্গের অবয়ব প্রকাশ পায়। যেমন, তার নিতম্ব, বাহু ইত্যাদি। আর মহিলার পোশাক তো এমন হওয়া চাই, যা তাকে আবৃত করবে। তার দেহ প্রকাশ পাবে না এবং তা পুরু ও প্রশস্ত হওয়ার কারণে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার-আকৃতিও অনুমিত হবে না’।[৮] শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩৪৭-১৪২১ হি.)ও এই বিষয়ে শায়খুল ইসলামের উক্ত বক্তব্যই নকল করেছেন।[৯]

হিশাম ইবনু উরওয়া (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, মুনযির ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) ইরাক থেকে ফিরে, আসমা বিনতে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট একটি চকমকে শক্ত কাপড় পাঠালেন। অতঃপর তার দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার পর তিনি তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললেন, আফসোস! তোমরা তাকে কাপড়টি ফিরিয়ে দাও। রাবী বলেন, বিষয়টা তার কাছে ভারী মনে হল এবং বলল হে আম্মা! এটা তো পাতলা না। তখন তিনি বললেন, এটা পাতলা না হলেও অনুমিত হবে। এর মধ্যে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, কাপড় পাতলা হোক বা আঁটো-সাঁটো উলামার নিকট তা পরিধান করা জায়েয নেই। আর যেটা দেখা যায় তাা আঁটো-সাঁটোর চেয়ে জঘন্য।[১০]

ইবনু হাজার আল-হায়ছামী (রাহিমাহুল্লাহ) তার কিতাব ‘আল-যাওয়াজির’-এর মধ্যে একটা অধ্যায় এনেছেন এই মর্মে যে, ‘মহিলাদের পাতলা কাপড় পরিধান করা, যাতে চামড়া প্রকাশ পায়। এটা কাবীরা গুনাহ। যার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন’।[১১]

চতুর্থ শর্ত : জিলবাব ঢিলেঢালা হতে হবে এবং এমন সংকীর্ণ হবে না, যাতে শরীরের আংশিকও প্রকাশ পায়

আব্দুল করীম যাইদান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পোশাকের উদ্দেশ্য হচ্ছে আবৃত হওয়া এবং ফেতনা-ফাসাদ প্রতিরোধে মহিলার দেহকে অবাঞ্চিত ব্যক্তি থেকে লুকানো। নিঃসন্দেহে সংকীর্ণ পোশাক এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে না। কেননা তা মহিলার দেহকে প্রকাশ করে এবং তার আকার বা অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গের আকার প্রকাশ করে। সুতরাং তা বাস্তবে শরীর ঢাকতে পারে না এবং অবাঞ্চিত ব্যক্তি থেকে তাকে আড়ালও করতে পারে না। আর ফেতনা, কামনার উদ্ভব এবং বিপর্যয় তৈরিতে প্রতিবন্ধক তা হতেই পারে না। ঐ সকল কারণে শরী‘আহ কর্তৃক মহিলাদের সংকীর্ণ পোশাকের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আর তাতে শর্ত হচ্ছে যে, সেটা হবে ঢিলেঢালা প্রশস্ত যাতে শরীরের কোন অংশ বের না হয়। আর তার আকার পরিমাপ না করা যায় এবং দর্শকদের দৃষ্টিতে প্রকাশ না পায়’।[১২] হাদীছে এসেছে,

عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَسَانِىْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ قُبْطِيَّةً كَثِيْفَةً مِمَّا أَهْدَاهَا لَهُ دِحْيَةُ الْكَلْبِىُّ فَكَسَوْتُهَا امْرَأَتِىْ فَقَالَ مَا لَكَ لَمْ تَلْبَسِ الْقُبْطِيَّةَ قُلْتُ كَسَوْتُهَا امْرَأَتِىْ. فَقَالَ ্রمُرْهَا فَلْتَجْعَلْ تَحْتَهَا غِلَالَةً فَإِنِّىْ أَخَافُ أَنْ تَصِفَ حَجْمَ عِظَامِهَا

উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে একটা পুরু টাইট কাপড় প্রদান করলেন, যা তাকে দেহইয়া কালবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাদিয়া দিয়েছিল। আমি সেটা আমার স্ত্রীকে পরালাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি সেই টাইট কাপড় পরছ না কেন? আমি বললাম, সেটা আমার স্ত্রীকে পরতে দিয়েছি। তখন তিনি বললেন, তাকে নির্দেশ দাও যে, সে যেন ওটার নিচে তার অন্তর্বাস রাখে। আমি আশঙ্কা করছি যে, তার হাড়ের আকার প্রকাশ পেয়ে যাবে।[১৩]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ পেয়ে ছাহাবী উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার স্ত্রীকে ঐ কাপড়ের নিচে অন্তর্বাস পরিধানের আদেশ করেন। আর তা হচ্ছে এমন কাপড়, যা দেহ প্রকাশিত হওয়াকে রোধ করার জন্য কাপড়ের নিচে পরিধান করা হয়। আর এই নির্দেশ ওয়াজিবের ফায়দা দেয় অর্থাৎ এটা মহিলাদের উপর আবশ্যকীয়ভাবে পালনযোগ্য। আব্দুল্লাহ ইবনু আবী সালামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত,

أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ كَسَا النَّاسَ الْقَبَاطِىَّ ثُمَّ قَالَ لَا تَدَّرِعْهَا نِسَاؤُكُمْ. فَقَالَ رَجُلٌ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ قَدْ أَلْبَسْتُهَا امْرَأَتِىْ فَأَقْبَلَتْ فِى الْبَيْتِ وَأَدْبَرَتْ فَلَمْ أَرَهُ يَشِفُّ. فَقَالَ عُمَرُ إِنْ لَمْ يَكُنْ يَشِفُّ فَإِنَّهُ يَصِفُ.

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকদের আঁটো-সাঁটো পোশাক পরিধান করতে দিলেন এবং বললেন, তোমাদের নারীরা যেন এর দ্বারা জামা না বানায়। এক ব্যক্তি বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমিতো ওটা আমার স্ত্রীকে পরিধান করিয়েছি। সে ঘরের মধ্যে আমার সামনে-পিছে যাতায়াত করে। তবে আমিতো তা পাতলা দেখিনি। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, যদি তা পাতলা নাও হয় তবে তা প্রকাশ করে দেয়’।[১৪]

ইবনু রুশদ আল-কুরতুবী আল-মালেকী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৪৫০ হি.) বলেন, ‘ক্ববাতী হচ্ছে সংকীর্ণ কাপড়, যা শরীরের সাথে জড়িয়ে থাকে। আর তা আঁটো-সাঁটো হওয়ার কারণে শরীরের অবয়ব ও তার সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। সুতরাং উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহ তা‘আলার বাণী وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ ‘তারা যেন তাদের স্বামী ব্যতীত কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে ...’ (সূরা আন-নূর : ৩১) আয়াতের অনুসরণ করতে গিয়েই মহিলাদেরকে ঐ পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন’।[১৫]

ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মহিলাদের ক্বাবাতী পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, যদিও তা পাতলা নয় কিন্তু তাতে অবয়ব অনুমিত হয়। কেননা টাইট পোশাক তার নিচের জিনিসকে প্রকাশ করে দেয়। আর তাতে মহিলার কাঁধ, স্তনসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রকাশিত হয়’।[১৬] এ আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, মহিলাদের জন্য ‘ওভার কোট’  পরিধান করা বৈধ নয়। কেননা তা এমন সংকীর্ণ কাপড়, যার দ্বারা আবৃত দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহকে ফুটিয়ে তোলে। এ ছাড়াও তা পুরুষদের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে দেয়। কেননা তা পুরুষদের পোশাক।[১৭]

সতর্কতা

আব্দুল কারীম যাইদান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, মহিলার পোশাকের হাতা সরু হওয়া তার মূল  পোশাক সরু হওয়ার অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ দুটো এক নয়। মহিলার হাতা প্রশস্ত হওয়া নিষিদ্ধ কিন্তু সংকীর্ণ হওয়া নয়। মূল কাপড় তার বিপরীত। কেননা হাতা যখন প্রশস্ত হবে, তখন মহিলা হাত উঁচু করলে তার কনুই বা বগল প্রকাশিত হবে, যদি উহার নিচে ভিন্ন কাপড় না থাকে। আর ইবনুল হজ্জ (রাহিমাহুল্লাহ) হাতা সরু হওয়া এবং মূল কাপড় প্রশস্ত হওয়া এবং সংকীর্ণ না হওয়ার পার্থক্য বিষয়ের প্রতি সতর্ক বার্তা দিয়েছে বলেন, ‘শাসকবৃন্দের উপর ওয়াজিব হল, তাদেরকে নিষেধ করবে এই মর্মে যে, তারা যেন এমন ঢিলা হাতা না বানায়, যা খাটো হয়ে যায়। কেননা এমতাবাস্থায় তারা হাত উপরে তুললে তাদের বগল ও স্তন প্রকাশ পাবে’।[১৮] 

পঞ্চম শর্ত : জিলবাব সুগন্ধিযুক্ত ধুপ মিশ্রিত না হওয়া

ইসলামে মহিলাদের সুগন্ধি মেখে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوْا مِنْ رِيْحِهَا فَهِىَ زَانِيَةٌ ‘যে মহিলা আতর মেখে কোন সম্প্রদায়ের নিকট থেকে অতিবাহিত হয় যাতে তার ঘ্রাণ তারা পায়, তাহলে সে ব্যভিচারিণী’।[১৯]

যয়নাব ছাক্বাফিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, أَيَّتُكُنَّ خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَلَا تَقْرَبَنَّ طِيْبًا ‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয় সে যেন খুশবু ব্যবহার না করে’।[২০]

সুধী পাঠক! মসজিদে গমনেচ্ছুক মহিলার জন্য সুগন্ধি জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হারাম। সুতরাং সুগন্ধি মেখে যদি মসজিদে যাওয়া হারাম হয়, তাহলে বাজারে, রাস্তা-ঘাটে চলাচলকারিণী নারীদের জন্য আরো কঠিনতর হারাম এবং কাবীরা গুনাহ। উল্লেখিত হাদীছদ্বয়ের হুকুমটি ব্যাপক। কেননা সুগন্ধি যেমন শরীরে ব্যবহার করা হয়, তেমনি কাপড়েও ব্যবহার করা হয়। তাইতো ইমাম হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘মহিলার সুগন্ধি মেখে সাজ-সজ্জা করে ঘর থেকে বের হওয়া কাবীরা গুনাহ। যদিও স্বামী তাকে অনুমতি দেয়’।[২১]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ ইবনু উছমান ইবনু শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, আল-কাবাইর (বৈরূত : দারুন নাদওয়াতিল জাদীদাহ, তাবি), পৃ. ১৩৪।
[২]. তিরমিযী, হা/২৭৮৭; নাসাঈ, হা/৫১১৭; মিশকাত, হা/৪৪৪৩, সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬১৮।
[৪]. ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহুল বুখারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৮১।
[৫]. মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/২৫২৩৩; জিলবাবুল মার’য়াতিল মুসলিমাহ, পৃ. ১২১।
[৬]. মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/২৫২৪০; জিলবাবুল মার’য়াতিল মুসলিমাহ, পৃ. ১২৩।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮; মিশকাত, হা/৩৫২৪।
[৮]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ১৪৬।
[৯]. মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১২তম খণ্ড, পৃ. ২২০, ২৭১।
[১০]. জিলবাবুল মার’য়াতিল মুসলিমাহ, পৃ. ১২৭; তারীখে দিমাস্ক, ৬০তম খণ্ড, পৃ. ২৯০।
[১১]. আয-যাওয়াজিরু ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবাইর, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭।
[১২]. আল-মুফাছ্ছাল ফী আহাকামিল মার’য়াতি ওয়াল বায়তিল মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩০।
[১৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৮৩৬, সনদ হাসান।
[১৪]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৩৩৮৯; জিলবাবুল মার’য়াতিল মুসলিমাহ, পৃ. ১২৭-১২৮, সনদ ছহীহ।
[১৫]. আবুল ওয়ালীদ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু রুশদ আল-কুরতুবী, আল-বায়ানু ওয়াত তাহছীল (বৈরূত : দারুল র্গাব আল-ইসলামী, ২য় সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খ্রি.), ১৭তম খণ্ড, পৃ. ৯৫।
[১৬]. আল-মুফাছ্ছাল ফী আহকামিল মার’য়াতি ওয়াল বায়তিল মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২।
[১৭]. আব্দুল্লাহ ইবনু ছালিহ আল-ফাওযান, যীনাতুল মার’আতিল মুসলিমাহ (দারুল মুসলিম প্রকাশনী, তাবি), পৃ. ২৬।
[১৮]. আল-মুফাছ্ছাল ফী আহকামিল মার’য়াতি ওয়াল বায়তিল মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২।
[১৯]. নাসাঈ, হা/৫১২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৭২৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪২৪; দারেমী, হা/২৬৪৬; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৬৮১; মিশকাত, হা/১০৬৫, সনদ হাসান।
[২০]. নাসাঈ, হা/৫১৫১, ৫২৫২; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৯৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৫০১।
[২১]. ইবনু হাজার আল-হায়ছামী, আয-যাওয়াজিরু ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবাইর (দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৭১ ‍




প্রসঙ্গসমূহ »: নারীমঞ্চ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (২য় কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন

ফেসবুক পেজ