শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা

-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*


(২য় কিস্তি)

২. লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করা ওয়াজিব

নারীদের উপর সর্বদা তাদের লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করা আবশ্যক। এটা শারঈ পর্দার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ ‘(ঈমানদার নারীগণ যেন) তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, عن الفواحش ‘(তোমাদের লজ্জাস্থানকে) অশ্লীলতা থেকে (সংরক্ষণ কর)’। ক্বাতাদা ও সুফিয়ান বলেন, عما لا يحل لهن ‘যা তাদের জন্য হালাল নয়, (সেখান থেকে লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করা)’। মুক্বাতিল বলেন, عن الزنى ‘যেনা বা ব্যভিচার থেকে (সংরক্ষণ করা)’। আবুল ‘আলিয়া বলেন, ‘আল-কুরআনে যতস্থানে লজ্জাস্থানের সংরক্ষণের কথা আলোচনা করা হয়েছে, সবগুলো স্থানে অর্থ হবে যেনা বা ব্যভিচার থেকে সংরক্ষণ করা। কিন্তু এ আয়াত وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ ‘লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ’ ব্যতীত। কেননা এখানে এর অর্থ ‘তাদেরকে যেন কেউ না দেখে’।[১] অর্থাৎ তিনি শারঈ পর্দাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ধর্ষণ, স্পর্শ ও কুদৃষ্টি থেকে লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করা’।[২] হাদীছে এসেছে,

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ اضْمَنُوْا لِيْ سِتًّا مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوْا إِذَا حَدَّثْتُمْ وَأَوْفُوْا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوْا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ وَغَضُّوْا أَبْصَارَكُمْ وَكُفُّوْا أَيْدِيَكُمْ

ওবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের পক্ষ হতে আমাকে ছয়টি বিষয়ের হেফাযতের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের যামিন হব। ১. যখন তোমরা কথা বলবে, তখন সত্য কথা বলবে। ২. যখন ওয়াদা করবে, তখন তা পূর্ণ করবে। ৩. যখন তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়, তখন তা আদায় করবে। ৪. তোমরা নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে। ৫. তোমাদের স্বীখয় দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে এবং ৬. স্বীয় হাতকে অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখবে’।[৩]

৩. মহিলাদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখা ওয়াজিব, তবে যা এমনিতেই প্রকাশ হয় তাতে কোন সমস্যা নেই

মহিলাদের শারঈ পর্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ হয় এমন বিষয় সর্বদা ঢেকে রাখা। এটা তাদের উপর ওয়াজিব। তবে এমনিতেই যা প্রকাশ হয় তাতে কোন সমস্যা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا یُبۡدِیۡنَ  زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا ‘ তারা যেন তার মধ্যে যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের অলংকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। উক্ত আয়াতের الزينة ‘সৌন্দর্য’ শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

ما يتزينّ به من الحلية وغيرها وفي النهي عن إبداء الزينة نهي عن إبداء مواضعها من أبدانهنّ بالأولى

‘ব্যবহৃত গহনা ও অন্যান্য বস্তুর মাধ্যমে যা সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়, এরূপ সৌন্দর্য প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ এবং মহিলাদের শরীরের কোন স্থানও প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ’।[৪] ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) চেহারা, হাতের কব্জি, হাতের আংটি, কানের দুল, বালা, পায়ের মল, কণ্ঠহার ইত্যাদির কথা বলেছেন। আর এ কথাগুলো তিনি ইবনু ওমর, ‘আত্বা, ইকরমা, সাঈদ ইবনু জুবাইর, আবুশ শা‘ছা, যাহহাক, ইবরাহীম নাখঈ, ইসহাক্ব আস-সাবীঈ, আবুল আহওয়াছ (রাহিমাহুল্লাহ) এবং আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন।[৫]

আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মহিলাদের সুন্দর পোশাক, গহনা এবং গোটা শরীর হল তাদের সৌন্দর্য। তবে সুন্দর পোশাক যদি প্রকাশিত হয় তাতে কোন সমস্যা নেই’।[৬] আবূ বকর আল-জাযাইরী (রাহিমাহুল্লাহ) নারীদের সৌন্দর্যের স্থানগুলো বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সৌন্দর্যের স্থানগুলো হল- দু’পায়ের নলায় পরিহিত গহনা, দু’হাতের কব্জি ও কনুই যেখানে বলা পরিধান করা হয়, আংটিসমূহ, মেহেদী, মাথা ও মাথার চুল, দু’কানের দুল, দু’চোখের ভ্রু, কাজল লাগানো দু’চোখের পাতা, ঘাড়, বুক এবং কণ্ঠহার’।[৭]

অতএব যখন আংটি প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, তখন তার প্রথম স্তর আংটির স্থান আঙ্গুলসমূহ প্রকাশ করাও নিষিদ্ধ। আর যখন কণ্ঠহার ও বালা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, তখন কণ্ঠহার ও বালার স্থানসমূহ প্রকাশ করাও নিষিদ্ধ। আর তাহল- ঘাড় ও কব্জি। অতঃপর যদি কাজলের কালো রং এবং মেহেদী প্রদর্শন করা হারাম হয়, তখন কাজলের কালো রং এবং মেহেদী লাগানোর স্থানও প্রদর্শন করা হারাম। আর তাহল- চেহারা ও দুই কব্জি। আর যখন পায়ের গহনা প্রকাশ করা হারাম, তখন তা পরিধানের স্থান প্রকাশ করাও হারাম। আর তাহল- পায়ের গোছা।[৮] উল্লেখ্য, মেহেদী লাগানো অর্থ দ্বারা এটাও হতে পারে যে, উভয় চোখের ভ্রু ও উভয় ঠোটের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা এবং উভয় চিবুকে বা গালে জাফরান কিংবা অন্য হালাল কিছুর প্রলেপ দেয়া।[৯]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,   اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا ‘যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত’ (সূরা আন-নূর : ৩১) আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আবূ বকর আল-জাযাইরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সাধারণত প্রকাশ পাওয়া স্থানগুলো হল- কোন কিছু দেয়া ও গ্রহণ করার জন্য দু’হাতের কব্জি, যদিও হাতে আংটি ও মেহেদী লাগানো থাকে। অথবা কোন কিছু দেখার জন্য দু’চক্ষু, যদিও চোখে কাজল বা সুরমা লাগানো থাকে। অনুরূপভাবে মাথার উপরের ওড়না এবং গোটা শরীর ঢাকার এক প্রকার জামা প্রকাশ করা ক্ষমার যোগ্য, যদি গোপন কোন স্থান প্রকাশ না পায়’।[১০]

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলার বাণী وَ لَا یُبۡدِیۡنَ  زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا ‘তারা যেন তার মধ্যে যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের অলংকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে’ (সূরা আন-নূর : ৩১) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কব্জি ও চেহারার কোন অংশ’।[১১] ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, اَلزِّيْنَةُ الظَّاهِرَةُ الْوَجْهُ وَالْكَفَّانِ ‘সৌন্দর্য প্রকাশের স্থান হল- চেহারা ও কব্জিদ্বয়’।[১২] বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) ও উক্ত কথা বলেছেন।[১৩] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِيْ بَكْرٍ শ قَالَتْ كُنَّا نُغَطِّيَ وُجُوْهَنَا مِنَ الرِّجَالِ وَكُنَّا نَتَمَشَّطُ قَبْلَ ذَلِكَ فِي الْإِحْرَامِ

আসমা বিনতে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমরা পুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম এবং ইহরামের পূর্বে চিরুনী করতাম।[১৪]

ক্বাযী আবূ বকর ইবনুল ‘আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৫৪৩ হি.) বলেন, ‘নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখম-ল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্জের সময় এর ব্যতিক্রম। কেননা এই সময় তার ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষকে নিজেদের থেকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে’।[১৫]

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ইফক্বের দীর্ঘ হাদীছের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন যে,

وَكَانَ صَفْوَانُ بْنُ المُعَطَّلِ السُّلَمِيُّ ثُمَّ الذَّكْوَانِيُّ مِنْ وَرَاءِ الجَيْشِ فَأَصْبَحَ عِنْدَ مَنْزِلِيْ فَرَأَى سَوَادَ إِنْسَانٍ نَائِمٍ فَعَرَفَنِيْ حِيْنَ رَآنِيْ وَكَانَ رَآنِيْ قَبْلَ الحِجَابِ فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِيْنَ عَرَفَنِيْ فَخَمَّرْتُ وَجْهِي بِجِلْبَابِيْ وَوَاللهِ مَا تَكَلَّمْنَا بِكَلِمَةٍ وَلَا سَمِعْتُ مِنْهُ كَلِمَةً غَيْرَ اسْتِرْجَاعِهِ

‘আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম, এক সময় আমি নিন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। ছাফওয়ান বিন মু‘আত্ত্বাল সুলামী ছিলেন কাফেলার পিছনে আগমনকারী। সে যখন সকালে আমার অবস্থান স্থলে এল, তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। তার ইন্না-লিল্লাহ পাঠ করার দরুন আমার ঘুম ভাঙ্গল; তখন আমি আমার চাদর দ্বারা আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। আল্লাহর কসম আমরা কোন কথা বলিনি, আর তার ইন্না-লিল্লাহ বলা ছাড়া কোন কথা আমি শুনিনি।[১৬]

উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হল যে, সাধারণ প্রকাশ পাওয়া স্থানগুলোর ব্যাপারে কিছু বক্তব্য থাকলেও আসমা বিনতে আবূ কবর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ও আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এর হাদীছদ্বয় থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহিলাদের চেহারা ঢেকে রাখতে হবে। সুতরাং আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলামের সোনালী সময়ের মর্যাদাবান মহিলাগণ সৌন্দর্য প্রকাশ না করার ব্যাপারে যদি এতটাই সতর্ক থাকেন, তাহলে বর্তমান ফিতনার যুগে মুসলিম মহিলাগণ কিভাবে তাদের শারঈ পর্দা অক্ষুণœ রাখবেন সে ব্যাপারে এখনই তাদেরকে সতর্ক হওয়া উচিত।

মহিলা ছাহাবীগণ নেকাব ও হাত মোজা পরিধান করতেন

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَلَا تَنْتَقِبِ الْمَرْأَةُ المُحْرِمَةُ وَلَا تَلْبَسِ القُفَّازَيْنِ ‘আর ইহরাম পরিহিতা নারী যেন নিক্বাব ও হাত মোজা পরিধান না করে’।[১৭] এই হাদীছ প্রমাণ করে যে, মহিলা ছাহাবীদের পর্দার সাধারণ আমল ছিল নিক্বাব ও হাত মোজা পরিধান করা। তাই ইহরামের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা খুলে রাখতে বলেছিলেন।

চার মাযহাবের ঐকমত্যে নারীর চেহারা ঢেকে রাখা ফরয

হানাফী মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম মূলনীতি ও দলীলের আলোকে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, পরপুরুষের সামনে তা খোলা রাখা বৈধ নয়। ইমাম আবূ বকর আল-জাছ্ছাছ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

فِيْ هَذِهِ الْآيَةِ دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ الْمَرْأَةَ الشَّابَّةَ مَأمُوْرَةٌ بِسَتْرِ وَجْهًا عَنْ الْأَجْنَبِيِّينَ وَإِظْهَارِ السِّتْرِ وَالْعَفَافِ عِنْدَ الْخُرُوْجِ لِئَلَّا يَطْمَعَ أَهْلُ الرِّيَبِ فِيْهِنَّ

‘পর্দার আয়াত দ্বারা সাবালিকা নারীকে বেগানা পুরুষ থেকে চেহারা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং বাহিরে বের হওয়ার সময় সংযত হতে বলা হয়েছে। যাতে বিবেকহীন লোকেরা লোলুপ দৃষ্টি দিতে না পারে’।[১৮]

‘রদ্দুল মুহতার’ গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন,

(فَإِنْ خَافَ الشَّهْوَةَ) أَوْ شَكَّ (امْتَنَعَ نَظَرُهُ إلَى وَجْهِهَا) فَحِلُّ النَّظَرِ مُقَيَّدٌ بِعَدَمِ الشَّهْوَةِ وَإِلَّا فَحَرَامٌ وَهَذَا فِيْ زَمَانِهِمْ وَأَمَّا فِيْ زَمَانِنَا فَمَنَعَ مِنْ الشَّابَّةِ قُهُسْتَانِيٌّ وَغَيْرُهُ

‘যদি পুরুষ কামনার আশঙ্কা করে বা সন্দিহান হয়, তাহলে নারীর চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করা নিষেধ। সুতরাং দৃষ্টির বৈধতা, কামনা জাগ্রত না হওয়ার সাথে শর্তযুক্ত ছিল, অন্যথা তা হারামই; এটা তাদের যুগের মতামত। তবে আমাদের যুগে, কুহুস্তানী সহ অন্যান্যরা নাজায়েয বলেছেন’।[১৯]

যদিও অনেকে ইমাম আবূ হানীফার দোহাই দিয়ে বলেন যে, তার মতে চেহারা খোলা রাখা বৈধ। এটা তাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক। ফিতনার আশঙ্কা না থাকার শর্তে কিছু দলীলের ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) সেই সোনালী যুগে চেহারা খোলা রাখার মতামত দিয়েছিলেন বটে। কিন্তুু চূড়ান্ত ফিতনার যুগে সেই শর্ত বিলিন হয়ে, ইমাম আবূ হানীফার মূলনীতির আলোকেই তা অবৈধ হয়ে যায়।

মালেকী মাযহাবের ক্ষেত্রেও একই কথা অর্থাৎ শর্ত সাপেক্ষে রুখসাত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নাজায়েয বলা হয়।وَاَلَّذِيْ أَوْقَعَهُمْ فِيْ تَنْوِيْعِهِ أَنَّهُمْ رَأَوْا السِّتْرَ وَالْحِجَابَ ‘এখন নারীর চেহারা ঢেকে রাখাই তারা ফরয গণ্য করেন’।[২০]

ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) এবং তাদের মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম চেহারাকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং খোলা রাখাকে নাজায়েয বলেছেন। ফিতনার আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক।[২১]

সুধী পাঠক! চার মাযহাবের বাইরে আহলেহাদীছ তথা সালাফীসহ অপরাপর বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামও নারীর চেহারা খোলা রাখাকে নাজায়েয বলেছেন। মুষ্টিমেয় কিছু আলিম ব্যতিক্রম বলেছেন। মোটকথা চার মাযহাব এবং জমহূর আলিমের বর্তমান সম্মিলিত অবস্থান হল- নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তা পরপুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়। বর্তমান ফিতনার যুগে এর বাইরে কিছু বলার সুযোগ নেই। যেমনটি বলা হয়েছে ‘আদিল্লাতিল হিযাব’ নামক গ্রন্থে,

نَسْتَطِيْعُ أَنْ نُخَلِّصَ مِّمَّا تَقَدَّمَ بِأَنَّ عُلَمَاءَ الْمَذَاهِبِ الْأَرْبَعَةِ يَكَادُوْنَ يَتَّفِقُوْنَ عَلَى تَغْطِيَةِ المْرَأَةِ جَمِيْعِ بَدَنِهَا عَنِ الْاَجَانِبِ سَوَاءٌ مِنْهُمْ مَنْ يَّرَى أَنَّ الْوَجْهَ وَ الْكَفّيْنِ عَوْرَةٌ وَمَنْ يَّرَى أَنَّهُمَا غَيْرُ عَوْرَةٌ. لَكِنَّهُ يُوْجِبُ تَغْطِيَتُهُمَا فِىْ هَذَا الزَّمَانِ لِفَسَادِ أَكْثَرِ النَّاسِ

‘এ বিষয়ে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি যে, চার মাযহাবের ঐকমত্যে, পরপুরুষ থেকে পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখা ফরয। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চেহারা ও উভয় কব্জি পর্দার অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেন আবার অনেকে তা করেন না। কিন্তু বর্তমানে ফিতনার যুগে হাত ও চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব’।[২২]

এক্ষণে আশা করি পাঠকবৃন্দের নিকট নারীর চেহারা ঢেকে রাখার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে ফালিল্লাহিল হামদ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের পরিপূর্ণ শারঈ পর্দা মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!!

ভিন্নমত পোষণকারীদের উপস্থাপিত দলীল ও তার জবাব

ভিন্নমত পোষণকারী কিছু বিদ্বান, যারা নারীর মুখ খোলা রাখাকে জায়েয বলেন। তাদের দলীলের উপযুক্ততা বিশ্লেষণ করে সমাজের সামনে পেশ করা সমীচীন মনে করছি।

প্রথম দলীল

তারা দলীল হিসাবে নিম্নের আয়াত পেশ করে থাকেন। আল্লাত তা‘আলা বলেন, وَ لَا یُبۡدِیۡنَ  زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا ‘তারা যেন তাদের সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তবে যা প্রকাশিত হয়ে যায় তা ভিন্ন’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। এ আয়াতে বর্ণিত اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا এর ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তা হচ্ছে নারীর মুখমণ্ডল ও হাত’। সুতরাং বুঝা গেল নারীদের চেহারা খোলা রাখা যাবে।

জবাব

প্রথমতঃ আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর তাফসীর অনুযায়ীই এর সঠিক ব্যখ্যা হচ্ছে, পর্দা করার কাপড় ও এর বাহ্যিক সৌন্দর্যতা; চেহারা বা হাত নয়।[২৩]

দ্বিতীয়তঃ اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا এর ব্যাখ্যা মুখমণ্ডল ও হাত বর্ণনা করাকে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর দিকে সম্মন্ধ করা সঠিক নয়। কেননা তৎসংশ্লিষ্ট বর্ণনা ঐ সকল পুরুষের জন্য প্রজোয্য, যারা মহিলার জন্য মাহরাম। তাদের সামনে হাত, মুখ, চোখের সুরমা ইত্যাদি বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ হওয়াতে কোন দোষ নেই। যেমনটি ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

عن ابن عباس قوله (وَ لَا یُبۡدِیۡنَ  زِیۡنَتَہُنَّ  اِلَّا مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا) قال والزينة الظاهرة الوجه وكحل العين وخضاب الكفّ والخاتم فهذه تظهر في بيتها لمن دخل من الناس عليها

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, উল্লেখিত আয়াতে প্রকাশিত যিনাত বা সৌন্দর্য বলতে চেহারা, চোখের সুরমা, হাতের রং, আংটি ইত্যাদি যেগুলো মহিলারা তাদের নিকট আগমনকারী (মাহরাম) পুরুষের নিকট প্রকাশ করে থাকে’।[২৪]

তৃতীয়তঃ সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি নারীদের চেহারা আবৃত রাখার কথা বলেছেন।[২৫] এমনকি ইহরাম অবস্থায় যখন মহিলাদের চেহারায় নেকাব দেয়া নিষিদ্ধ, তখনও তিনি ভিন্ন কাপড় চেহারার উপর ফেলে মহিলাদেরকে পর্দা করতে বলেছেন। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, মহিলারা তখন চেহারার উপর জিলবাব বা বড় ওড়না ঝুলিয়ে দিবে, পেঁচিয়ে বাঁধবে না।[২৬]

সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা কিছুতেই কোন পরপুরুষের সামনে নারীর চেহারা ও হাত খোলা রাখার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। বরং এ আয়াত দ্বারা নারীদের যীনাত বা সাজ-সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশের দ্বারা তাদের চেহারা ও হাতের সৌন্দর্য পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করার নিষিদ্ধতাই প্রমাণিত হয়।

দ্বিতীয় দলীল

তারা দলীল হিসাবে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ উপস্থাপন করে থাকেন,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِىْ بَكْرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا دَخَلَتْ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ رِقَاقٌ فَأَعْرَضَ عَنْهَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَقَالَ يَا أَسْمَاءُ إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيْضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَا وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, একদা আসমা বিনতু আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘হে আসমা! মেয়েরা যখন সাবালিকা হয়, তখন এই দু’টি অঙ্গ ছাড়া অন্য কোন অঙ্গ প্রকাশ করা তার জন্য সংগত নয়, এ বলে তিনি তাঁর চেহারা ও দুই হাতের কব্জির দিকে ইশারা করেন’।[২৭] এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, নারীদের চেহারা ও হাত বাদে সমস্ত অঙ্গ ঢাকতে হবে। সুতরাং বুঝা যায় যে, নারীদের চেহারা ও হাত পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়।

জবাব

প্রথমতঃ মুহাদ্দিছগণের মতে এ হাদীছ পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের। কেননা এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসমাকে মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্কা হওয়ার কথা উল্লেখ করে নছিহত করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, আসমা তখন সদ্য প্রাপ্ত বয়স্কা হয়েছিলেন। অথচ পর্দার বিধান সম্বলিত সর্বপ্রথম আয়াত সূরা আল-আহযাবের ৫৩নং আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন (৫ম হিজরীতে) আসমার বয়স ছিল ৩২ বছর।[২৮]

দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য হাদীছ থেকে জানা যায় যে, পর্দার বিধান নাযিলের পর আসমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) পর্দার জন্য চেহারা ঢাকার ব্যাপারে এমন সতর্কতা অবলম্বন করতেন যে, হজ্জের ইহরাম অবস্থায় যখন চেহারা জড়িয়ে নেকাব পরা নিষিদ্ধ এবং চেহারা নেকাবমুক্ত রাখা ওয়াজিব, তখনও তিনি পর্দার বিধান রক্ষার্থে ভিন্ন কাপড় ঝুলিয়ে চেহারা ঢাকতেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আসমা বিনতে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আমরা পুরুষদের সামনে মুখম-ল আবৃত করে রাখতাম’।[২৯] এতদ্ব্যতীত আসমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সাথে অন্য মহিলারাও চেহারা ঢেকে পর্দা করতেন। এ সম্পর্কে ফাতেমা বিনতে মুনযির (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘আমরা আসমা বিনতে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম’।[৩০]

তৃতীয়তঃ বর্ণনাকারিণী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নিজেও কখনও মহিলাদের চেহারা খোলা রাখার পক্ষে যাননি। বরং পর্দার বিধান নাযিলের পর তিনি পরপুরুষ থেকে নিজেকে এমনভাবে আড়াল করেন যে, কোন বেগানা পুরুষ কখনো তার চেহারা দেখেনি।[৩১]

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, চেহারা খোলা রাখার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশকৃত উক্ত হাদীছটি পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরের হুকুমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং তা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা। এ হাদীছকে পর্দার বিধানের পূর্ব সময়ের কথা উল্লেখ করে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হিজাবের আয়াত নাযিলের পূর্বে মহিলারা জিলবাব বা বড় ওড়না ছাড়া বের হতেন। তখন পুরুষেরা তাদের চেহারা ও হাত অবলোকন করতেন। আর সে সময় মহিলাদের জন্য চেহারা ও হাত খোলা রাখা জায়েয ছিল। অতএব যখন হিজাবের আয়াত নাযিল হয় তখন মহিলাগণ পুরুষের থেকে লুকিয়ে যান এবং তাদের চেহারা ও হাতসহ সমস্ত শরীর জিলবাব বা বড় ওড়না দ্বারা ঢেকে ফেলেন।[৩২]

চতুর্থতঃ এ হাদীছটি সনদের দিক দিয়ে যঈফ বা দুর্বল। তাই তা চেহারার পর্দা নির্দেশ সম্বলিত ছহীহ হাদীছসমূহের বিপক্ষে দলীল হতে পারে না। মুহাক্কিক্বগণের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এ হাদীছটিতে তিন ধরনের দুর্বলতা বিদ্যমান। যেমন,

(ক) হাদীছটি খালিদ ইবনু দুরাইক আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ তিনি এ হাদীছ আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে সরাসরি শুনেননি। এ হিসাবে হাদীছটি ‘মুনক্বাতি’ বা সনদ বিচ্ছিন্ন। আর মূলনীতি হল- মুনক্বাতি হাদীছ যঈফ, যা দলীলের উপযুক্ত নয়।

(খ) হাদীছের সনদে সাঈদ ইবনু বাশীর নামে একজন রাবী রয়েছে। যিনি যঈফ ও অগ্রহণযোগ্য রাবী।

(গ) হাদীছটি দুরাইক থেকে ক্বাতাদার সূত্রে عَنْ শব্দের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। আর ক্বাতাদার তাদলীসের (শায়খের নাম উল্লেখ না করা) দোষ ছিল। কিন্তু উছূল হল- কোন তাদলীসকারীর عَنْ শব্দ দ্বারা বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য হয় না। যতক্ষণ না সে সরাসরি শোনার কথা বলে। সুতরাং এ হাদীছ দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।[৩৩]

তৃতীয় দলীল

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘বিদায় হজ্জের সময় তার ভাই ফযল ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাওয়ারীর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন। সেই সময় ‘খাছ‘আম’ গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করতে লাগল। তখন ফযল সেই মহিলার দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাটিও ফযলের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফযলের চেহারাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেন।[৩৪] এতে প্রতীয়মান হয় যে, মহিলার মুখ খোলা ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে চেহারা ঢাকতে নির্দেশ দেননি। অতএব প্রমাণিত হয় যে, মহিলাদের জন্য চেহারা খোলা রাখা জায়েয।

জবাব

উক্ত হাদীছে মহিলার মুখমণ্ডল খোলা ছিল এ কথা কোথাও বলা হয়নি। আর ফযল ইবনু আব্বাসের তার দিকে তাকানোতে তার চেহারা খোলা থাকা প্রমাণিত হয় না। কেননা কোন মহিলা পর্দার সাথেও কারো কাছে কিছু প্রশ্ন করলে সেই প্রশ্নত্তোরের প্রতি কৌতুহলবশতঃ অন্য কারো দৃষ্টিপাত করা অসম্ভব কিছু নয়। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফযলের চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তাক্বওয়া শিক্ষা দেয়ার জন্য। সুতরাং এ হাদীছটি দ্বারা মহিলার চেহারা খোলা রাখাকে জায়েয বলার কোন সুযোগ নেই।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা।

তথ্যসূত্র :
[১]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৪৫।
[২]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির ইবনু আব্দুর রহমান আস-সা‘আদী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৫৬৬।
[৩]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৪৮০২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮০৯; মিশকাত, হা/৪৮৭০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৪৭০।
[৪]. মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আশ-শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৪।
[৫]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৬।
[৬]. তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৫৬৬।
[৭]. জাবির ইবনু মূসা ইবনু আব্দুল কাদির ইবনু জাবির আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসারুত তাফাসীর লিকালামিল ‘আলিয়্যিল কাবীর (মদীনা, সঊদী আরব : মাকতাবাতুল ঊলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৫।
[৮]. আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ হাম্মাদ, রিসালাতু ইলাল মারআতিল মুসলিমাহ ফিত তারহীবি মিনাত তাবাররুজি ওয়াত তারগীবি ফিল হিজাব, পৃ. ১৪।
[৯]. জারুল্লাহ আবুল কাসিম যামাখশারী, আল-কাশশাফ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘আরাবী, ১৪০৭ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
[১০]. আইসারুত তাফাসীর লিকালামিল ‘আলিয়্যিল কাবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৬।
[১১]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/১৭২৮১; ইরওয়াউল গালীল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২০০, সনদ ছহীহ।
[১২]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/১৭২৯০; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৩০৩৩; সনদ ছহীহ, আলবানী, রদ্দুল মুফহাম, পৃ. ১২৯।
[১৩]. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী, জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), ১৯তম খণ্ড, পৃ. ১৫৮।
[১৪]. মুস্তাদরাক ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/১৬৬৮; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/২৬৯০; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, হা/১০২৩, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১২; আলবানী, জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ, হা/৫।
[১৫]. ইবনুল আরাবী আল-মালিকী, ‘আরিযাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী (বৈরূত : দারু কুতুল আল-‘ইলমিয়্যাহ, তাবি), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৬।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৪১৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৭০।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৩৮।
[১৮]. আহমাদ ইবনু আলী আবূ বকর আর-রাযী আল-জাছ্ছাছ, আহকামুল কুরআন (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ১৪০৫ হি.), ৫ম খ-, পৃ. ২৪৫।
[১৯]. রদ্দুল মুহতার (ফতোয়ায়ে শামী), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৬; আল-বাহরুর রায়েক্ব, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২১৮।
[২০]. ক্বাযী আবূ বকর ইবনুল ‘আরাবী আল-মালেকী, আহকামুল কুরআন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬০৩।
[২১]. শিহাবুদ্দীন রমলী (মৃ. ১০০৪ হি.), নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ (বৈরূত : দারুল ফিকর, তা.বি), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৮৭; ইবনু কুদামা (মৃ. ৬২০ হি.), আল-মুগনী (মাকতাবাতুল কায়রো, তাবি), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০২।
[২২]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী (মৃ. ১২৫০ হি.), নায়লুল আওত্বার (মিশর : দারুল হাদীছ, তাবি), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৩৭।
[২৩]. জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ১৫৬।
[২৪]. জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[২৫]. জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ২০তম খণ্ড, পৃ. ৩২৪।
[২৬]. সুল্লামুল আমানী, পৃ. ১৭৪।
[২৭]. আবূ দাঊদ, হা/৪১০৪, সনদ ছহীহ।
[২৮]. আবূ নু‘আইম, মা‘রিফাতুছ ছাহাবা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩২৫।
[২৯]. মুস্তাদরাক ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/১৬৬৮; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/২৬৯০; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, হা/১০২৩, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১২; আলবানী, জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ, হা/৫।
[৩০]. মুওয়াত্তা মালেক, হা/১১৭৬; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, হা/১০২৩, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১২।
[৩১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৭০।
[৩২]. ইবনুল ক্বাত্তান (মৃ. ৬২৮ হি.), ইহকামিন নাযর ফী আহকামিন নাযর (দামেস্ক : দারুল ক্বলম, তাবি), পৃ. ১৬৭-১৬৮।
[৩৩]. ছালাহুদ্দীন আব্দুল্লাহ আদ-দিমাশক্বী (মৃ. ৭৬১ হি.), জামিঊত তাহসীল ফী আহকামিল মারাসীল (বৈরূত : দারু ‘আলামিল কুতুব, তাবি), পৃ. ২৫৪; মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪৯৬।
[৩৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৫৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: পর্দা-হিজাব নারীমঞ্চ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (২য় কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন

ফেসবুক পেজ